ওয়র অন টেরর`র সাইকোলজিকাল পলিসি
মঈনুল ইসলামপ্রকাশিত : মে ১৫, ২০১৯
এফবিআইয়ের বিতর্কিত স্টিং অপারেশনের কথা সকলেরই মনে থাকার কথা, যা তারা ওয়ার অন টেররের জন্য বিশেষভাবে চালু করছিল। তারা জঙ্গি সাইজা আপনারে গোপনে উস্কায়া পরীক্ষা করবে যে, আপনার ভিতরে জঙ্গি হওয়ার পসিবলিটিজ আছে কিনা! বাঙলাদেশের নাফিসের সেই ষড়যন্ত্রমূলক অপারেশনের শিকার হওয়ার ঘটনাও মনে থাকার কথা অনেকের।
বাঙলাদেশেও এখন তাই হইতেছে। ছোট প্লেটে ভাত খাইলে জঙ্গি, বাসায় টিভি না থাকলে জঙ্গি, চুপচাপ ইন্ট্রোভার্ট হইলে জঙ্গি, নামাজের কথা কইলে জঙ্গি! মানে, এইসব করার অর্থ তার ভিতরে ইনহেরেন্টলি জঙ্গিত্বের উপাদান আছে! এইগুলা নাকি ক্রিমিনাল সাইকোলজি।
`সম্প্রীতি বাঙলাদেশ` নামের কোনো এক এনজিও দেখলাম, জঙ্গিবাদের ইন্ডিকেটর বানাইছে। এর আগে এইসব ইন্ডিকেটর পুলিশও বানাইছিল। জঙ্গিবাদের মতো এমন একটা গ্লোবাল কমপ্লেক্স ইস্যুর মোকাবেলায় এই সরল সহজ সুন্দর সাইকোলজিকাল পদ্ধতি দেইখা মজা পাইলাম।
ওয়েল, ক্রিমিনাল সাইকোলজি তো আছেই। কিন্তু জঙ্গিত্বের এইসব লক্ষণ কি বাঙলাদেশের ঘটনা এনালিসিস কইরা বানানো হইছে আদৌ? নাকি সাইকোলজিস্টরা নিজেরাই বানাইছেন? বাঙলাদেশে এই ধরণের বেশিরভাগ খুনেরই কোন বিচার হয় নাই, সাসপেক্ট ধরার পরে কোন রিমান্ড না কইরা ক্রসফায়ারে দেওয়ারও নজির আছে। যাদের ধরা হইছে, তাদের কয়জনের সাইকোলজির উপরে অ্যানালিসিস কইরা এই ইন্ডিকেটর তৈরি করা হইছে—তা আমাদের জানা দরকার। বা আদৌ, এই ইন্ডিকেটরগুলার ভিত্তি আসলে কি, সেইটাও খোলাসা আলাপে আসা দরকার।
সাইকোলজিকাল সাইন্সের কথা কইয়া আপনারে সাইকোলজিক্যালি জঙ্গি বানাইয়া শাস্তি দিবে তারা। মানে, আপনি চেতনায় জঙ্গি! কারুর চেতনায় কী আছে, এরে আপনি আধুনিক আইনে কীভাবে বিচার করবেন? আধুনিক রাষ্ট্র এইখানে আল্লাহ হয়া ওঠে, নিজেরে `আলেমুল গায়েব` দাবি করে। মনের বা মগজের তথ্য নিয়া মানুশেরে অপরাধী বানায়। তাইলে আইন-আদালত নিয়া নতুনভাবে আবার ভাবা লাগে কিনা? সাইন্সরে যে সারাদিন পুজা করেন, এই সাইকোলজি দিয়া অত্যাচার অবিচার জায়েজ করা হইতেছে কিনা?
সাইকোলজির কথা কইয়া নিরপরাধ লোকরে মুহূর্তেই অপরাধী বানানো যায়। সাইন্সের এই সাইকোলজিরই পলিটিকাল নাম `চেতনা`। চেতনার নামে, ফিলোসফিক্যাল মতপার্থক্যের কারণে আপনারে জেলে নিয়া যাওয়া হবে। আপনার মাইন্ড ও ফিলোসফিরে, সাইকোলজিরে নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় এলিটেরা, রাষ্ট্রের জন্যে যাতে অনেক অনেক সাইকোলজিকাল এনিমি তৈরি করা যায়।
তা, সাইকোলজিকাল এনিমি তৈরি হইতেছে। লোকে একে অপররে সন্দেহের চোখে দেখতেছে। এই সাইকোলজিকাল পন্থায়ই, এইরকম সাইকোলজিকাল ইন্ডিকেটর দিয়া, বিগত সময়ে প্রচুর `শিবির` ধরে থানায় দিছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে এই কারণে। ছাত্রলীগের ইন্ডিকেটরগুলার মধ্যে বড় একটা ইন্ডিকেটর ছিল, হুজুর বা মাদ্রাসার ছেলেদের সাথে ছবি থাকা। অনেক বই পড়া বা পাঠচক্র করাও তাদের একটা ইন্ডিকেটর ছিল। এই দুই ইন্ডিকেটরে পইড়া আমারেও একবার হাজতে যাইতে হইছে। বিগত বছরগুলিতে `মুক্তিযুদ্ধের চেতনা` নামক সাইকোলজিকাল ফিল্টারে আটকা পড়ছেন কত যে মানুশ, তার কোন হিশাব নাই।
এই যে `চেতনা`/`সাইকোলজি` দিয়া এনিমি তৈরি করা, এইটাই আধুনিক রাষ্ট্রের সবচাইতে বড় দানবীয় ফিচার। ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি বলতেছেন, মানুশ এখন `মোস্ট হ্যাকেবল এনিমেল`। আধুনিক রাষ্ট্র লোকের গায়ের পোশাক, ফেসবুকের পোস্ট, ফটো বা লাইক (গেস্টরুমে বাঁশেরকেল্লায় লাইকের জন্য কত ছেলের যে নাজেহাল হইতে হইছে! অথচ বাঁশেরকেল্লায় লাইক থাকা আসলে কিচ্ছুই প্রমাণ করে না), তার চুপচাপ থাকা (যা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার), তার ঘরের থালা-বাসনের মাপ (পুলিশ বলছিল, জঙ্গিরা ছোট ছোট থাল-বাসন ইউজ করে), তার ধর্মীয় মতাদর্শ—ইত্যাদি দিয়া তার মগজ হ্যাক করবে, তারে জঙ্গি বানাবে।
ঠিক যেমন বড় বড় চুল থাকলে বেয়াদব/উগ্র, টাইট জামা পরলে `কানকে মাগে`, চোখ লাল আর চেহারা শুকনা থাকলে `গাঁজাখোর`টাইপের স্টেরিওটাইপিং সমাজে চালু, এইসব ইন্ডিকেটরও সেইরকমই অনেকটা। আধুনিক রাষ্ট্র তার `শত্রু`মাত্রেরই বিপক্ষে এইসব `সাইকোলজি` ওরফে `চেতনা` অ্যাপ্লাই করে। যেমন ধরেন, ভারতের খালি মোসলমানে সমস্যা না, তাদের `মাওবাদ`ও বড় সমস্যা; তাই `আরবান মাওবাদী` নাম দিয়া, মাওবাদের একটা নতুন স্টেরিওটাইপ সংজ্ঞা ও লক্ষণ হাজির কইরা, নিরপরাধ লোকদের তুইলা নিয়া যাওয়া হইতেছে। বাঙলাদেশে স্কুল-কলেজে ছেলেদের চুলের ডিজাইন নির্ধারণ কইরা দেওয়া হইতেছে। জঙ্গিবাদের এইসব ইন্ডিকেটরও ঠিক তেমন।
ঘটনা হইল, আমাদের প্রতিবাদ সিলেক্টিভ। বন্ধুমহলের কেউ কেউ এইসব ইন্ডিকেটরে ঈমান আনেন, যার যার `চেতনা` অনুযায়ী। কিন্তু, ফ্যাসিবাদের যুগে আপনার এইসব ঈমান আপনারেও গ্রাস করবে, করতেছে অলরেডি। নওশাবা কেন গ্রেফতার হইছেন? `উস্কানি` ও `গুজব` ছড়ানোয়। শহিদুল আলম? `দেশবিরোধী` স্টেটমেন্ট দেওয়ায়। এই যে `গুজব`, `দেশবিরোধ` বা `জেহাদি বই`—এইসব হইল সাইকোলজিকাল এনিমি তৈরির অস্ত্র। যেগুলার কোন ডেফিনেশন নাই, যা গ্রাস করে সমস্ত মানুশের অধিকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, `জণকণ্ঠ` যে আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের বই `শরহে মিয়াতে আমেল`রেও জঙ্গি বই বইলা রিপোর্ট করছিল, তা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকার কথা।
সমস্যা কী এইসবে? সমস্যা নাই তো আসলে! বড় চুলে সন্ত্রাসীপনা, ছোট কাপড়ে `কানকে মাগে`, সবুজ জার্সিতে `পাকিচেতনা` বা ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবে `জঙ্গিত্ব` আপনি খুঁইজা পাইতেই পারেন। কিন্তু আয়রনি হইলো, এইসব ঘটার যুগেই আবার আপনে সহিষ্ণুতা, ভিন্নমতরে সম্মান, ফিলোসফিক্যাল মতপার্থক্য আর লিবারালিজমের সবক দিতে আসেন মানুশের দুয়ারে। ইন্ডিকেটর দিয়া শিবির/জঙ্গি ধরেন, কিন্তু `আমি শিবির করি না` বইলাও কি বাঁচতে পারছেন—পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ বা সম্প্রতি জেলে খুন হওয়া ডাক্তার পলাশ কুমার? তাদের খুনের ইন্ডিকেটর আগে বাইর করেন। নাইলে এইসব ইন্ডিকেটর দিয়া গণতন্ত্র রক্ষা হইবে না বস।