ওরহান পামুকের গল্প ‘বৃষ্টিতে সমুদ্রচিল’
অনুবাদ: রথো রাফিপ্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২০
ছাদে, বৃষ্টির মাঝে, সমুদ্রচিলটা বসে আছে, যেন কিছুই ঘটেনি। যেন বৃষ্টিই হচ্ছে না আসলে; সমুদ্রচিলটা ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এটুকুই, কোনো নড়চড় নেই, আগেও যেমন ছিল না। নতুবা, এমনও হতে পারে সমুদ্রচিলটা আসলে বড়ো কোনো দার্শনিক, এত বড়ো যে তার পক্ষে এ নিয়ে মনখারাপ করাই অসম্ভব। চিলটা দাঁড়িয়েই আছে ওখানে। ছাদের উপর। বৃষ্টি চলছে। যেন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্রচিলটাই আসলে একটা ভাবনা। আমি জানি, জানি আমি, বৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু তেমন কিছুই নেই যা নিয়ে আমি ভাবতে পারি। কিংবা, হা বৃষ্টিই হচ্ছে। কথা হলো, এর কী কোনো গুরুত্বটুরুত্ব আছে? কিংবা এমনও হতে পারে, এখন আমি বৃষ্টির সঙ্গে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি : এর ফলেও কিছু ঊনিশবিশ হচ্ছে না।
আমি বলতে চাইছি না, এই সমুদ্র চিলগুলো কঠোর স্বভাবের। আমি তাদের দেখছি আমার জানালা থেকে। আমি তাদের লক্ষ্য করি যখন লিখতে চেষ্টা করি আমি, তাদের লক্ষ্য করি যখন আমি পায়চারিতে ঘরের এ মাথা ও মাথা করি; এমনকি সমুদ্রচিলেরাও তাদের জীবনের গ-ির বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারে।
বাচ্চা ছিল একটার। আকস্মিক চিঁ চিঁ করা পরিষ্কার ওলের ছোট্ট দুটো ধূসর বল, একটু ভয়কাতুরে আর একটু বোকাটেও। একবার বামে তো আবার ডানে এভাবে পেরিয়ে যায় একসময়ের লাল টাইলগুলো, ছানাদুটি আর তাদের মায়ের বিষ্ঠার চুনে যা এখন সাদা হয়ে গেছে, তারপর তারা কোথাও থেমে পড়ে, আর বিশ্রাম নেয়। যদিও আপনি একে আসলে বিশ্রাম বলতে পারবেন না; তারা কেবল থেমে গেছে। তারা অস্তিত্বশীল, এর বেশি কিছু নয়। অধিকাংশ মানুষ আর অন্যান্য জীবের মতোই সমুদ্রচিলেরাও তাদের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়ে দেয় কিছু না করেই, কেবল ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। একে এক ধরনের অপেক্ষা বলতে পারেন। পরের বেলার খাদ্য, আর মৃত্যু, আর ঘুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা, এ বিশ্বে। জানি না আমি, তারা কিভাবে মারা যায়।
তার ওপর, ছানাগুলো সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না। বাতাস তাদের পালকগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে, এলোমেলো করছে তাদের পুরো শরীরটাকেই। তারপর তারা আবার থেমে যাচ্ছে; থেমে পড়ছে আবার। তাদের পেছনে শহর ঠিকই নিজের ব্যস্ততায় নিমগ্ন; তাদের নিচে, জাহাজ, গাড়িঘোড়া, গাছপালা, সব সবই ব্যস্ত আর অস্থির।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা চিলটা, যাকে নিয়ে কথা বলছি, মাঝে মাঝে এটা-ওটা কোথাও না কোথাও সে পেয়ে যায়, আর তার শিশুদের কাছে নিয়ে আসে সেগুলো, খেতে দেয় তাদের। তাহলে বলতেই হয়, বেশ টানটান উত্তেজনার বিষয়ও আছে: এক তাল কাজ, পরিশ্রম, আর দুশ্চিন্তা। ম্যাকারনির মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মরা মাছ, খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়া এবং খেয়ে ফেলা— টানো, টানো, চেষ্টা করে দেখো পারো কিনা এটা টেনে নিতে। এ বেলার নাওয়া-খাওয়া শেষে, নীরবতা। ছাদের উপরে বসে থাকে সমুদ্রচিলেরা, আর কিছুই করে না। একসঙ্গেই অপেক্ষা করি আমরা। আর আকাশে সীসবর্ণ মেঘ।
তবে একটা কিছু এখনও দেখার বাইরেই রয়ে গেছে আমার। আমি যখন জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আচমকা নজরে এলো ব্যাপারটা: সমুদ্রচিলের জীবনটা সরল, সাদামাটা কিছু নয়। ওখানে কতগুলো আছে তারা! সমুদ্রচিলেরা মন্দ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহনকারী, প্রত্যেক ছাদের উপরে বসে থাকে, আর নীরবে কিছু একটা ভাবে যার মাথামু-ু কিছুই আমি জানি না। আমি বলতে চাই, বিশ্বাসবিনাশী কূটচিন্তায় মগ্ন থাকে তারা।
আমি কী করে বুঝলাম? একবার খেয়াল করলাম, তারা সবাই মিলে সকালের হলুদ আলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ওই হালকা হলুদ আলোর দিকে। প্রথমে একটা দমকা বাতাস এলো, তারপর একটা হলুদ রঙা বৃষ্টি। হলুদ বৃষ্টি যখন ধীরে ধীরে নামছিল, সব সমুদ্রচিল আমার দিকে তাদের পিঠ ফেরালো এবং তারা যখন একে অপরের দিকে মুখ করে অস্পষ্টভাবে দ্রুত কিছু একটা বললো তখনই ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো, তারা সবাই কিছু একটার অপেক্ষায় রয়েছে। নিচে, শেষ মাথায়, শহরের লোকজন আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর আর গাড়িঘোড়ার জন্য ছোটাছুটি করছিল, উপরে, সমুদ্রচিলগুলো ছিল প্রতীক্ষায়, রাখঢাকহীন, আর নীরব। আমি তখন ভাবলাম, আমি তাদের বুঝতে পেরেছি।
কখনও সমুদ্রচিলগুলো সব একসঙ্গে উড্ডীন হয়, বাতাস ভেদ করে ক্রমেই ঊর্ধ্বে উঠতে থাকে। তারা যখন এমন করে, তাদের পাখসাটের শব্দ বৃষ্টিপাতের মতো মনে হয়।
লেখক পরিচিতি: তুর্কি ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্য সম্পাদক, শিক্ষক এবং ২০০৬ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লেখক ওরহান পামুক। তিনি তুরস্কের প্রধান লেখক। বিশ্বের ষাটটিরও বেশি ভাষায় তার এক কোটি দশ লাখের বেশি বই বিক্রি হয়েছে। ১৯৫২ সালের ৭ জুন ইস্তাম্বুলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।