ওমর আলীর জনপ্রিয় পাঁচটি প্রেমের কবিতা
প্রকাশিত : অক্টোবর ২০, ২০২০
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ওমর আলীর আজ ৮১তম জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনা শহরের দক্ষিণের দুর্গম চরশিবরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার জনপ্রিয় পাঁচটি প্রেমের কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোনও এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ।
সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।
আমি কিন্তু যামুগা
আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতই কও তোতাপাখি, চান, মণি, সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো।
আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানি না কো।
আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও।
তুমি বড় দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও,
অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো।
শোবো না তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে
আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়,
দেখুম ক্যামন তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে,
না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।
এখন পালাও দেখি
এখন পালাও দেখি! বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা!
এ রাত্রিতে, আমার দু’হাত থেকে পারো না পালাতে।
বরং সেটাই মেনে নেওয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা।
আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাকো এ সুন্দর রাতে।
মিছেমিছি কেন তুমি রাগ করে চলে যেতে চাও!
বেশ তো, আমার সাথে আজ রাতে কথা বলবে না।
হয়েছে তোমার রাগ, আলাদা কি হবে বিছানা?
অন্যখানে শুতে যাবে, কিছুতেই হবে না, হবে না!
চামেলী, মালতী আর রজনীগন্ধার সুরভিতে
তোমার বিত্ত্বল দেহ, সে সুরভি সারা ঘরময়,
আর সে সুরভি যেন কেঁপে ওঠে তোমার নাভিতে।
রাত্রিতে তোমাকে ছেড়ে একা থাকা… বড় কষ্ট হয়!
হে অভিমানিনী, আমি অসহায়, বড়ই কাতর,
প্রেয়সী, মিষ্টি হেসে ক্ষমা করো, তুমি নও পর।
বৈশাখে তোমাকে ভালোবাসি
বৈশাখে আবার আমি তোমাকে ভালোবাসি।
স্বপ্নে চলে যাই আমার সুদূর ভেনিসে,
গণ্ডোলায় বসি মুখোমুখি সারারাত,
ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী জ্যোৎস্নায়
ধুয়ে যাচ্ছি তুমি আর আমি।
ফিরে আসি, আবার আমরা ফিরে আসি চট্টগ্রামে,
কর্ণফুলীতে খুলে দিই একটি নতুন সাম্পান,
বৈঠা আমার হাতে আর তুমি দুটো হাত
রেখেছো আমার দুই কাঁধে,
বাতাসে তোমার রাত্রি কালোচুলের বিপুল সুগন্ধ।
যুগল চাঁদের ছবি খুলে যায়
তোমার বুকে।
বৈশাখের চাঁদ মুখ টিপে হাসে আমাদের
দুজনের মাথার উপরে।
তুমি আমার গান, তুমি আমার সুমধুর সুর,
তোমার ভালোবাসার ফিসফিস কথাগুলো
একবার গণ্ডোলায় একবার সাম্পানের পাটাতনে,
পানির সিম্ফনিতে কী যে মিষ্টি বেজে ওঠে,
জার্মানির বেটোফেন এই সুর সৃষ্টি করেছেন।
চাকমা ইটালিয় যুবতীর খিলখিল হাসি।
বৈশাখে তোমাকে আমি ধুয়ে মুছে
সাফ সুতরো করে
আবার নতুন করে ভালোবাসি।
আবার আমাদের ভালোবাসা শুরু করি
নতুন বঙ্গাব্দে,
কালবৈশাখী যাতে আমাদের এই ভালোবাসা
ভেঙে না ফেলে, যাতে উড়িয়ে না-নেয়, উপড়ে না-ফেলে,
আমরা নতুন খুঁটি লাগাই আমাদের ভালোবাসার চারপাশে।
শেষ পর্যন্ত চাঁদ ডুবে যাবে, নক্ষত্র ডুববে আকাশে,
ভালোবাসার সাম্পান গণ্ডোলা ডুববে না।
এই শুভ কামনায় তোমার ঠোঁটের মিষ্টি
আমার দু’ঠোঁটে।
কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে, সাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, রবীন্দ্রনাথ, ওমর আলীর হাতের ওপরে কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
কবিতা মনের মধ্যে এক খণ্ড সীমানা চৌহদ্দির জমির ওপরে
ঝরে যায় বহুক্ষণ ঝরে যায় বৃষ্টি
ওপরে মেঘ বিজলির চমক বজ্রপাত হতে থাকে
বিরহী যক্ষ কৈলাসগিরি থেকে মেঘদূত প্রেরণ করেন প্রিয়ার উদ্দেশে
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শিশির মুক্তা হোমারের মনের ওপর
অন্ধ হোমার গেয়ে যান ইলিয়াড ও ওডিসি
সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে যান প্যারিস প্রিয়ামের পুত্র
ট্রয়ের যুদ্ধ হয় কাঠের ঘোড়া তৈরি হয় হেক্টর মারা যান
অ্যাকিলিস মারা যান
পৃথিবী কোটি কোটি বছর ঘুরতে থাকে নিয়মমতো
এক মুহূর্তের জন্যও থামে না।
মানুষের জন্ম হয় মৃত্যু হয় কবি স্যাফোর জন্ম-মৃত্যু হয়
খলিল জিবরানের জন্ম-মৃত্যু হয়
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, র্যাঁবো, বোদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ,
কালিদাস, ওমর আলীর হাতের ওপর
কবিতা ঝরে... বৃষ্টি ঝরে...