এলিজা খাতুন
এলিজা খাতুনের দুটি কবিতা
প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৪, ২০২১
কৃষ্ণপক্ষের এক রাতে
গভীর শীতরাত
চোখের ’পরে নিদ্রা অনিদ্রার তুমুল ঠোকাঠুকি
নাকি চিন্তার-ইচ্ছার ক্ষণ চারিদিকে নামছে নীরবে!
ঘাটের জলে শ্যাওলা সরানোর মতো করে
মৃত্যুর উদ্বেগকে আলতো ঠেলে
স্মৃতির উঠোনে ঘুরেফিরে আসে কতিপয় দৃশ্যকল্প
আকাশের নক্ষত্ররা যেমন নিঃশব্দে ঘোরে
ঐ তো সম্মুখেই ছিল—
ভূঁই থেকে সদ্য তুলে আনা পোক্ত সর্ষে ছড়ার স্তূপ
ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকতো বরেন্দ্র থেকে—
সোনালি খড়ের গাদা পিঠে করে আসা গরুর গাড়ি
ক্ষেতের ঢেলায় গোঁজা কিষাণের হাসি থেঁতলে মাড়িয়ে
শহুরে লকলকে উঁদুরেরা এসে কলরব করে গোলায় গোলায়,
অন্ধকারে ধান কুরে কুরে খায়
এখানে পৌষালী উৎসব মৃত ইতিহাস
এখানে নদী ও নারী থেকে হারিয়েছে খুব নদী-নারী
রাত্রি থেকে মুছে গেছে গাজন আর শ্লোক
মোড় খুলে উড়ে গেছে
শীতভাঙা পিঠে আর হাঁড়ি ভরা মিঠে তাড়ি
ঘোর কৃষ্ণপক্ষ, অনিশ্চয়তার শীতল উল্লাস; তবু—
দৃশ্যকল্পে ভেসে আসে বারবার সোনার স্বদেশ
হাড়ে হাড়ে কথা হয়— অস্তিত্ব সংহারী আসন্ন দিনের—
নিতান্ত ভয়াবহ ভয় আরও যদি আসে ক্রমশ
আমাদের হাঁটা হোক আমাদেরই শেকড়ের দিকে
অবেলায় অমল বলছি
শান্ত শিশুর মতো পৃথিবী
রাত্রির গাঢ় নির্জনতার কোলে
যখন নেই কোনো আবশ্যক উদ্দামতা
নেই রক্তের অধিকারে বিদ্রোহ
নিসর্গে ভাসে না হেলাঞ্চ দল
যখন কাপালিক ভয়ানক ধ্যানে মগ্ন থাকে শ্মশানে
আর সভ্যতার বান এসে
স্মৃতির প্রদীপ নেভায় অন্ধকার হাতে
তখনও নিঃশব্দ—
সময়ের চাকায় ঘুরেঘুরে ফিরে আসা রাত
রাতের শিথানে কারা যেন কথা বলে—
আরও বেশি অন্ধকার টেনে আনার গোপন পরামর্শে
আর নীরব তৃষ্ণা পাঁজরে এঁকে কেউ কেউ জেগে থাকি
শুনি গভীর রাত্রে কাকের কর্কশ স্বর
সংসারের নিশ্চিত নির্বাক প্রহরে—
একি হৃদয়! নাকি বিবেক!
এক ঝটকায় চলে যাই পৈত্রিক পুরাতন ঘরে
সেখানেও অন্ধকারে ঢাকা জঞ্জাল
দ্রাবিড় যুগের দুর্গন্ধময় শবদেহ
পৈত্রিক ঘরটাতে শুয়ে কাকের মতো আমিও
বুভুক্ষু চিৎকারে জানাই সত্যতা-নায্য অবলুপ্তির যন্ত্রণা
তবু হৃদয়ের চূড়ায় ধীরে ধীরে জমছে শুভ্রতার কাঙ্ক্ষা
রিক্ততার অস্পষ্ট বেলায়
কোথায় কোনদিকে এতটুকু প্রত্যাশাবাহী নির্মলতা!