এলিজা খাতুন
এলিজা খাতুনের তিনটে কবিতা
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০২০
নির্বাসিত
অজস্রভাবে ভেঙে খণ্ড খণ্ড হতে হতে
চূর্ণ বিচূর্ণতায় খুঁজতে থাকি এক পরমাণু নিজেকে
দেখি,
ক্রমশ চলে যাচ্ছি ইচ্ছের কাছ থেকে দূরে...
বসতি ভীষণ অপ্রেমে
সমস্ত জানলা দরজা আঙিনা গলি শহর পৃথিবীর
ভৌগলিক পরিমাপ থেকে দূরে এবং দূরে...
অবিরত ভাঙছি সাধ-সাধনা
ছিঁড়ছি অধিকার না পাওয়া দলিল
দিনে দিনে অনিশ্চয়তার ধূসর পর্দা ওড়ে সম্মুখে
এ যাবৎ যাপনের সবটুকু অনুবাদ করে দেখি,
স্বপ্নহীন পোড়োভিটেয় কয়লার মতো জেগে আছি
কই! তবু তো দিব্য আছি!
পোড়া চোখ জোড়া
দারুণ দূরে আছে ঈর্ষার জল থেকে।
জনপ্রিয়তার আচ্ছন্নতা ঘুঙুর পরায়নি দু`পায়ে
গোলাপের কাঁটার মতো—
স্নায়ুর চারপাশে বিছিয়ে আছে নির্লোভ কাঁটা
গুঁড়িয়ে যেতে যেতে
`আমি` বলতে এক কণা `ধারণা`তে
নিসর্গের প্রগাঢ় নীরবতা বুনতে বুনতে এও ভাবছি—
কয়লাজীবনে কখনও হয়তো পড়তেও পারে
দক্ষ হাপরের টান, উথলিতে পারে লাল আভা
বেলাশেষে
সুদূরের ধু ধু রেখায় উড়ে গেছে ধূসর পাখি
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ মিশেছে বনের সিঁথানে
ক্ষেতফেরত সমূহ ক্লান্তি
দিগন্তের আইলে একা দাঁড়িয়ে
গোধূলির সোনালি গাড়ি আর কত দূরে!
আর কত প্রতীক্ষার বিরান প্রান্তর!
ঠিকানা লেখা কাগজখানা সময়ের ভাঁজে
এ পথের শেষ কোথায়!
অতল বোধে নেমে যাই
লতাগুল্মের আবডাল ছিঁড়েখুঁড়ে যদি পাই
জিরোনোর এতটুকু ঘাসের বিছান!
শীতার্ত ত্বক যেমন চাদর আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গোণে!
নবান্নের আত্মীয়
ভীষণ সন্ধ্যা; আমাদের মা ভাদ্রের হাসফেঁসে
অন্ধকারকে ঠেলে গুঁজে পাঠিয়ে দিচ্ছে উনুনের উদরে
লাল ঝোলে টগবগিয়ে ফুটছে পাতিহাঁসের হাড়মাংস
শহরের আত্মীয়রা বেলায় বেলায় এসে পৌঁছেছে
কালো কাচের জিপটা ধুলো উড়িয়ে ঢেকে দিলো
খালি গতরে জেগে ওঠা হাড়গুলো
পড়ন্ত বেলা আবছা হয়ে আসে গেরস্থের প্রাণবন্ত চোখে
বাড়ির গলিতে এসে ওরা গাড়ি থেকে নামে
ব্যাগপত্রের সাথে কাপড়ের বড় পোটলাটা দেখে
একদল ছেলেপুলে ঠিক চিনতে পারে ওটা
এরকম পোটলায় বেঁধে প্রতি বছরই শীতের কাপড়
আনা হয় ওদের জন্য; বাদ দেওয়া পুরোনো কাপড়
ঝকঝকে দেখে নতুন পুরোনো নির্ণয়ে সক্ষম হয় না ওরা
কাপড়গুলো ওদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় আত্মীয়রা
তাদের চর্বিযুক্ত হাসিসমেত; লকলকে জিভখানা
মুখের ভেতরে সামলে আত্মীয়সুলভ বিনয় টানিয়েছে
উঠোনে জ্যোৎস্নার গায়ে
চান্নিরাতে কাঁথা জড়িয়ে দড়ির খাটে কত গল্প, আহা!
চাষার বউঝি বৃদ্ধ বাপের কত ভালোবাসা আলাপন!
পিঠা পায়েস পাতে পেড়ে কত যত্নআত্তি!
নবান্নের ঘরে পরম আত্মীয় যে তারা!
ভোর হতেই তারা ব্যস্ত। বাৎসরিক চালডালের সমূহ
কয়েকটি বস্তা উঠতে থাকে ভাড়া করা ভিন্ন গাড়িটাতে
কালো কাচের জিপে উঠে যায় আমাদের আত্মীয়রা
বিদায় বেলায় নিবিড় শুভকামনা দেয় প্রাণ ভরে
কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুটে চলে গাড়ি
পেছনে ধুলো-হাসির আড়ালে পড়ে থাকে শূন্য গোলা