এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুন

এলিজা খাতুনের ছয়টি ভালোবাসার কবিতা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২

প্রিয়-পরাজয়

আমাদের যুগল ফটোফ্রেমের বাইরে
যে ভঙ্গিতে তুমি সরে যাচ্ছ;
সময়ের সমান্তরালে ক্রমশ মনে হয়
অযাচিত অনাবশ্যক আমার ধূসর ছবিটা

অথচ আমি তো জানি,  যখন মনোযোগে পাঠ
কিংবা পরিমাপ করি— বিন্দু, তল, পরিধি, রেখা,
তোমার মেধা নিংড়ানো বিচিত্র সব অবস্থান;

তখন অন্ধকারের আড়ালে পরাজিত তোমাকে
চিনতে না চিনতেই নিদারুণ আবিষ্কার করি
আমারই চোখের আয়নায় দেখে নিচ্ছ—
তোমার নিজস্ব অসামর্থের প্রতিবিম্ব

আলোয় এত শঙ্কা! নিশ্চিত থাকো, আমি জানি—
প্রিয়-পরাজয় গোপন রাখার মোক্ষম উপায়

জানালার পর্দা তার ইস্ত্রি করা ভাঁজে ভাঁজে
কেমন আটকে রাখে ঘরের গোপন ধুলো!

তোমার বেলায় কুসংস্কার মানি

খর দুপুর, জানালার ওপারে নতুন উপদ্রব
সফেদা গাছের ডালে কাকের কর্কশ চিৎকার
আচমকা ঘুম ভেঙে ঘামসিক্ত চোখে দেখি
দুটো কাকের খুনসুটি, পিঁপড়া-পোকা শিকার

কখনো ওদের ব্যর্থ ঠোকর—
শাখায় বাকলে আঁকে চুম্বন সিলমোহর

নিদ্রাভঙ্গের ক্রোধ ঠেলে ঠেলে
ঘুমের অসাড় তল থেকে নিজেকে
ফিরে পাবার মুহূর্তে অনুভব করি তোমাকে
সেই কবে তুমিও আমার অন্তরের ক্যানভাসে
দুটো রক্তমোহর এঁকে রেখে
অযুত মাইল দূরে গেছ মোহর কুড়াতে

রোদ-তপ্ততার সাথে পাল্লা চলে কাকের আর্তনাদের
আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না কুসংস্কার!

তবু তোমার নিখুঁত ফেরার প্রতীক্ষায়
শামুকের ঠোঁটের মতো পুনঃ পুনঃ আটকে আসে
এবং মুক্ত হয় আমার শঙ্কাময় শ্বাস-প্রশ্বাস

অন্য জ্বর

শীত কাঁটা ফুঁড়ে ফুঁড়ে এসে
নিঃশব্দে উঠছে নামছে থার্মোমিটারের ঘাড় মটকে
আর বিধ্বস্ত করছে আমাকে

নীরব নই; কাঁপছি, পুড়ছি
একটা চাদর সাক্ষি আমার কুঁকড়ে যাওয়ার

কোন্ ক্ষণে, কেমন সুরে, কতবার
তোমার নাম আওড়েছি ভীষণ কাতরে
সে কথা জানে— আমার ঘরে ঘুলঘুলির চড়ুই
আর জানে— ছাদ কার্নিশের সবুজ শৈবাল

যদি চাও পুষে রেখে দেব এ জ্বর
ঘরে ফিরে দেখো
ওষ্ঠের সীমানা ঘিরে জ্বরঠুটোদের দারুণ মিছিল

ভাবছি— তখন বুকের কারফিউ ভঙ্গ করে
ঠোঁটের ভূমিতে কি তুমি খুঁজবে?
অন্য মিছিল কিংবা অন্য জ্বর!

অপেক্ষায় নিমগ্ন ছায়া

যেখানে অচেনা ট্রেন এসে উগরে দেয়—
অজস্র মানুষ; আবার তুলে নিয়ে যায়
রঙ বেরঙের সমাগম
ঠিক সেখানেই হারিয়েছি তোমাকে

প্রতীক্ষায় নিমগ্ন পথিক আমি
রোজ রোজ দাঁড়িয়ে থাকি নির্বাক নিরুপায়

ট্রেন আসার শব্দে শুধু প্লাটফর্ম কাঁপে না;
নিদারুণ কেঁপে ওঠে হৃদয়

স্টেশনে অপেক্ষারত হৃদয়ের ছায়া
চলন্ত ট্রেনের কাছে নিতান্ত বিরতির যতিচিহ্ন

দেখা

দুহাতে দারুণ যত্নে তুলে দেখেছিলে— এই সেই মুখ!
অগণিত সময় ধরে তাকিয়েছিলে
দৃষ্টিজোড়া কতক্ষণ ছিল চোখের পড়ে, মনে নেই
চোখের নিচে কালিপড়া ত্বকে আঙুল ছুঁয়ে বলেছিলে,
খাঁটি সুরমা!

আর মুখজুড়ে নাকি বিদ্যুৎ জ্বলছিল!
আবিষ্কারের ভাঁজ ছিল তোমার কপালে
দরাজ কণ্ঠকে পাশে সরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলে,
তোমাকে এভাবে দেখতে হয়; একদিন সমূদ্রে যাবে?

সরমে মাথা নত করিনি, মন ভরে দেখতে দিয়েছি মুখ
যদি মেঘ খুঁজে পাও!
ইদানীং তুমি না বললেও শ্রাবণের বাতাসে কাঁপে এ কথা—
তোমাকে এভাবেই ভুলতে হয়

তোমার বোঝা হলো না
বিদ্যুৎ ভেবে দেখছিলে যে মেঘমুখ; আজ তা ঝরে ঝরে
মাটিতে লুটায়, নদীমুখো যায় সমূদ্রের টানে

দূরের মায়া

বন্যতা কিংবা হিংস্রতা নেই পরিযায়ী সাদা বকের
আবার প্রাচীরবদ্ধ নও;
বসবাস ডাঙ্গায়; মোহনা কিংবা শুকনো ঘাসভূমি
অথচ উচ্ছ্বল বিচরণ দিঘি, খাল, জলাশয়, নরম স্রোত

প্রকৃতির ভারসাম্য রাখতে বছরভর—
খুঁটে খুঁটে ঠোঁটে তোলো পোকামাকড়-জলজ কীট

সাদা মেঘ আর উড়ন্ত সাদা বক মিলেমিশে একাকার
বয়স অথবা দূরত্ব যেমনই হোক, কেমন মায়াময়!
তোমার বয়সের পরিসংখ্যান এমন কোনো পরিবর্তন
বা অপরিবর্তন চোখের সীমানায় আনেনি

প্রাচীরের বয়স কম নয়! সামাজিক খড়কুটো-অজুহাতে
প্রাচীর ভাঙার অধীরতা কবেই ছেড়েছে আমাকে!

অতঃপর এই প্রবোধে থাকি যে—
বয়স নয়, বয়সের নির্যাস কাছের হয়ে থাকে
সাদাবকের মতোই দূর থেকে তোমার মায়া—
হেঁটে এসে খুঁটে নেয় আমার অন্তঃভূমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত