এলিজা খাতুনের গল্প ‘ঘেরাটোপ’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১
অর্চিশা হাতের তালু দিয়ে ঢেলামাটি গুড়ো গুড়ো করছে। কয়েক ঝুড়ি এভাবে স্তূপ করেছে। পাশে আধা শুকনো গোবরের আরেকটি স্তূপ। চার-পাঁচটি টব রেডি করবে আজ। গুড়ি বৃষ্টির কারণে জমাকৃত গোবর ক’দিন ধরে ভিজেছে, পোকাও জন্মেছে তাতে। পোকা বেছে ফেলে গোবরের দলাগুলো গ্লাভস্ পরা দু’হাতে পিষ্ট করে ভাঙছে আর মেশাচ্ছে গুড়ো করা মাটির সাথে। কিছু কিছু পোকা টবের গাছে গজানো নরম শেকড় খেয়ে ফেলে। ক্ষতিকর কীট বাছতে মন্দ লাগছে না! বাছাইয়ে ওর মনোযোগ, নাকি অভ্যস্ততা, তা পৃথকভাবে প্রকাশ করা কষ্টসাধ্য। অনেকক্ষণ ধরে মাটি থেকে বড় ঝিল, ইট-সুরকি, ঘাসের শক্ত শেকড় খুঁটে সরাচ্ছে অর্চিশা। এরই মধ্যে শেফালী নিচ থেকে এক ঝুড়ি মাটি ছাদের উপরে তুলে দিয়ে নিচে গেছে পুনরায়।
অর্চিশার মনে পড়ে, ওর মা যখন বারান্দার মেঝেতে এক ধামা চাউল ঢেলে ওকে বাছতে বসিয়ে দিতেন, অর্চিশা নিখুঁতভাবে ধান-সুরকি বেছে ফেলতো। মা নিজে বেছে বের করে দেখিয়ে বোঝাতেন, চাউল-রঙের পাথর কেমন মিশে থাকে চাউলের সাথে। আধভাঙা চাউলের মতো হুবহু দেখতে চাউল রঙা পাথর। মা বলতেন, মানুষের মধ্যেও এরকমটা। তবে এক্ষেত্রে মিশ্রণটা উল্টো। চাউল সদৃশ পাথর যেমন সংখ্যালঘু, তেমনি মানুষও হাতেগোণা। মানুষের মতো দেখতে হাজার হাজার প্রাণীর ভেতরে তাদের দেখা পাওয়া দুরুহ।
মোবাইল বেজে ওঠে। শেফালী কাঁখের মাটির ঝুড়ি নামিয়ে মোবাইলটা অর্চিশার কাছে এনে দেয়। গ্লাভস্ খুলে রিসিভ করে অর্চিশা। গ্রাম থেকে ফোন এসেছে। মামাতো ভাই আতাউল জিজ্ঞাসা করে, গ্রামে যাবে কবে? আম পেড়ে পাঠাবে কিনা? নদী তীরের জমিতে খেসারি বুনবে কিনা? আতাউলের হড়হড় করে বলা একগাদা প্রশ্নের উত্তর একে একে দিতে থাকে অর্চিশা। জেনে নেয়, মামা-মামির শরীর কেমন, গতবারের বন্যায় কয়টা গাছ মরেছে, গাছের গোড়ায় মাটি দেয়া হয়েছে কিনা, ছেলেপুলেগুলো স্কুলে যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওপাশ থেকে আতাউল দ্বিধাজড়ানো স্বরে খবর দেয়, অর্চিশার দাদার ভিটেয় তার ফুফাতো ভাইয়েরা এসে বেদখল নেবার পাঁয়তারা করছে। গলির সামনে কবরস্থানের পাশে বড় ফাঁকা জায়গায় ঘর উঠানোর পরিকল্পনা করছে। জলকোরেরা সব ভুঁইক্ষেত ইজারা নিয়ে মাছ চাষের কারবার করতে লেগেছে। খবরটা শুনে অর্চিশার মন বিষণ্ণ হলো। দক্ষিণাঞ্চলের ফসলের ক্ষেতগুলো আজ মৎস্য-ঘেরের কবলে। উত্তরেও পৌঁছে যাচ্ছে তার হানা!
প্রয়াত বাবার স্বপ্ন ছিল, অর্চি ডাক্তার হবে। গ্রামে দাদার ভিটেয় স্বাস্থ্যসেবা চেম্বার বসিয়ে গ্রামের দুস্থ মানুষ ও গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবে। ডাক্তার হয়ে ওঠা হয়নি, না হওয়ার পেছন-কথার পিছু পিছু না হেঁটে অর্চিশা ভেবেছে, দাদা-দাদির কবরের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় একটা পাঠাগার করবে। সাথে একটা কথাঘরও বানাবে, যেখানে গ্রামের বৃদ্ধরা এসে মন খুলে একে অপরের সাথে কথা বলবে। নিজেদের সুখ-দুঃখ আদান-প্রদান করবে। বাবার এবং নিজের স্বপ্ন পূরণে, পন্থা আলাদা হলেও উদ্দেশ্য একই। মূলত এদের পাশে বসে দুটো কথা শোনার অবসর সংসারে কারও নেই এখন। অর্চিশা অনেক বৃদ্ধকে দেখেছে, তারা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। নিজের কথা নিজেকে শোনায়। আতাউলের দেয়া শেষ খবরে অর্চিশা কোনো জবাব দেয় না। আলাপ শেষে জানিয়ে দেয় আগামী শীতে অর্চিশা গ্রামে যাবে।
ফোন পাশের টুলে রেখে আবার গ্লাভস্ পরে অর্চিশা। শেফালী বুঝে নেয়, আরও খানিক সময় ছাদে কাজ করবে অর্চিশা। জিজ্ঞাসা করে, কফি এনে দেব? অর্চিশা সম্মতি দেয়। আজ অফিস ছুটি, নিচে নামার তাড়া নেই। অফিসডে’তে সন্ধ্যায় এসে পানি দেয় গাছে। শুধু পানি নয়, কথাও দেয়; পাতারা কান পেতে শোনে। আলো-আঁধারিতে জল-ছিটে পেয়ে আবছা আলোর ঝিকিমিকি ভাষায় পাতারাও উত্তর দেয় নড়েচড়ে। মনে পড়ে, দাদার পেয়ারা বাগানে হেলে থাকা গাছটার মোটা কাণ্ডের কথা। ওটাতে উঠে কত শুয়ে থেকেছে! গালভরা রোদ্র-হাসি ঝরানো আলাপ করতো পাতারা। ঘন পেয়ারা বাগানটা নেই এখন, ভাগের করাতে জীবন গেছে তার। অর্চিশার স্মৃতিতে সেসব এখনও জীবন্ত। কাঠিতে জমানো একবাক্স বরফ মাথায় নিয়ে গ্রাম্যপথে বরফওয়ালার ফেরি করা হাঁক শুনে, কিশোর-কিশোরীর বায়না দাদি-নানির কাছে, মা তেড়ে আসলেও কে শুনতো কার কথা! অতঃপর ধানভরা কুঁঠির মুখ আলগা করে একমুঠো ধান তুলে ফ্রকের কোণে মুড়িয়ে ছুটতো আম-পেয়ারা বাগানের ধুলোময় পথ ধরে।
কোমরে হাফ প্যান্টের রাবার উল্টে চার আনা বের করে দিলে কিশোর ছেলেটির হাতে এককাঠি বরফ ধরিয়ে দিত বরফওয়ালা। এমন চারআনা জমানোরও কত মজার মজার চেষ্টা! বাবা-মায়ের সাথে একবার গ্রামে যেয়ে অর্চিশা নিজেও চার টাকা আয় করেছিল। নিম গাছের নিচে ঝরে ছড়িয়ে থাকা নিমপাতার মেরুদণ্ড স্বরূপ ধুলোয় লুটোপুটি খাওয়া শুকনো সরু ডাটাগুলো একটা একটা করে কুড়িয়ে একমুঠো হলেই আটআনায় বেচা যেত। মিঞাবাড়ির বউদের মুঠো মুঠো খিলাল কিনে বারান্দার পিলারে সুতো বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা মিঞাবাড়ির আভিজাত্যের প্রকাশ ছিল হয়তো! নতুন গজানো নিমপাতারা উঁচু বড় নিমগাছকে কেমন অপরূপ সাজিয়ে দিত, উপরমুখো অবাক হয়ে দেখতো অর্চিশা। ছাদের পাশে মাথা চেঁড়ে বেড়ে ওঠা নিমগাছে চোখ পড়তে অর্চিশা দ্যাখে, পাতারা ঝলমল করছে রোদ মেখে। বেশ কড়া রোদ টের পাচ্ছে এখন। ছাদে ওঠার মাঝসিঁড়ি অব্দি উঠে গলা উঁচিয়ে শেফালীর ডাকে সম্বিত ফিরেছে অর্চিশার।
দীর্ঘ ক’বছর ধরে আছে শেফালী। এ বাড়িতে নিজের মতোই থাকে, কাজ করে, খায়দায়। বছরে দু’বার নতুন জামাকাপড়, অন্যান্য সময়ে পুরোনো কাপড়ও বেশ কিছু পায়। শেফালী মাসের বেতন পুরোটা গ্রামে পাঠায় ওর মায়ের খাওয়া পরার জন্য। অর্চিশার অনুগত। খবর দিল, নিচে গেস্ট এসেছে, পাপিয়া আন্টি। অর্চিশার সাথে দরকারি কথা। গ্লাভস্ খুলে ফোন হাতে নিচে নেমে এলো অর্চিশা। ড্রয়িংরুমে বেশ গরম, সিলিংফ্যানের ঠিক নিচে কুশনে ভর দিয়ে পায়ের উপরে পা তুলে সোফায় বসা পাপিয়া সিকদার। হাতে-পায়ে পুষে রাখা হাফ ইঞ্চি নখ, স্লিভলেস ব্লাউজ, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পাঞ্চক্লিপ এঁটে রাখা কোঁকড়া চুল, বৃত্তাকার সানগ্লাস, কড়া পারফিউম সমেত বিদঘুটে সাজ পোশাক সহজে চোখে পড়ার মতো। অর্চিশার অস্বস্তি হলো। সৌজন্যের হাসিটুকুও হাসতে মন চাইলো না। আসার কারণ আঁচ করতে পারেনি অর্চিশা। জিজ্ঞাসা করলো, আপনি হঠাৎ?
সানগ্লাস খুলে ঘাড় নাড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অতি বিনয়ী কণ্ঠে অনুরোধের সুর, ওই যে বলেছিলাম না! আমরা পাড়ার গরিব খেটে খাওয়া নারীদের নিয়ে একটা সংগঠন করবো, তাদের জন্য মানবিক সাহায্য তহবিল গঠন করছি, অভাবী মহিলারাই এর সদস্য। আমরা যারা একটু পয়সাওয়ালা আছি তারা মিলে এ কাজে নেমেছি। আপনাকেও কিছু পার্টিসিপেট করতে হবে। বলতে পারেন সমাজসেবা।
সমাজসেবা শব্দের শেষের ‘আ’ উচ্চারণের প্রত্যয়ের সাথে খানিকটা বিনয়ের হাসি যোগ হয়ে যে সময়ক্ষেপণ হলো, তাতে বত্রিশ দাঁত প্রদর্শনীর মাধ্যমে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন হয়ে যায়। অর্চিশা নিষ্পলক চেয়ে মহিলার অঙ্গভঙ্গি সহকারে কথা শুনে উত্তর দিল, তাই! শেফালীর দিকে তাকিয়ে মহিলা আবার বলল, হ্যাঁ আপা, আমার উপরে সদস্য বাড়ানো আর টাকা কালেকশনের দায়িত্ব পড়েছে। শেফালীকে সদস্য করে নিচ্ছি।
শেফালী দূরে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলে ওড়নার কোণা পেঁচিয়ে চলেছে। অর্চিশা বলল, তা বেশ তো, ভালো উদ্যোগ। তহবিল গঠনে অংশগ্রহণের ব্যাপারটা জানলাম, ভেবে পরে জানাবো।
নিশ্চিত জবাব না পেয়ে পাপিয়া সিকদার একটু ভ্যাবাচ্যাকা হয়েই উঠে গেল। সে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিতেই বাইকের স্টার্ট থামার শব্দ হলো। অর্চিশা দরজার বাইরে তাকিয়ে খেয়াল করলো, অখিল সরকার, পাপিয়ার সাথে তার একটু কথা বিনিময় হলো। অখিল সরকার ভেতরে এলো। কোনো মেসেজ ছাড়াই অখিল সরকারের আগমনে আশ্চর্য অর্চিশা। এখনও হাতে কাদা। বলল, এই সকালে হঠাৎ? অখিল সোফায় বসতে বসতে পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করলো। তার বক্তব্য এরকম যে, শহরের মেইন রাস্তার পাশে সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় একটা প্রজেক্ট করা হচ্ছে, প্রায় কোটি টাকার প্রজেক্ট। যেখানে শহরের অনেক নামি ব্যক্তিদের শেয়ার থাকছে। তাদের সংগঠনে দু’একজন নারী থাকা প্রয়োজন, কোটা পূরণের বিষয় আছে। অর্চিশাকেও একটা শেয়ার হোল্ডার হওয়ার আহ্বান করছে সেখানে। তাছাড়া ব্যাংক লোন এবং সরকার থেকে ট্রেড লাইসেন্স পাবার ক্ষেত্রে সুবিধা নিতে নারীর স্বাবলম্বিতা তুলে ধরে প্রজেক্টের বিভিন্ন ডিপারটমেন্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারীদের নিয়োগ দেয়া হবে।
অর্চিশা জানতে চাইল, এ আহ্বান কি আপনার? নাকি তথাকথিত নামি ব্যক্তিবর্গের?
অখিল প্রথমেই নিজের কথা বলল। অর্চিশা তাতে জবাব দিল, আপনি বলছেন বলেই আমি থাকবো কেন? কোনো ব্যক্তিগত আহ্বানে দলগত ব্যাপারে জড়াতে যাওয়া যায়?
অখিল আমতা আমতা করে বলল, না, আসলে অনেকের মধ্যে থেকেই আপনার নামটা উঠেছে, তবে আমি কিন্তু মনেপ্রাণে চাইছি।
অর্চিশা বুঝলো, অখিল সরকার নিজেকে মহিয়ান করে তুলতে এবং অর্চিশার অতি আপনজন হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা কিছু কম করছে না। হাতের কাদামাটি শুকিয়ে চড়চড় করছে, ধোবে বলে উঠে যেতে উদ্যত হলে অখিলও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে তালিকায় আপনার নাম রাখছি।
অর্চিশা বলল, ভেবে নিয়ে জানাবো আপনাকে।
বিকেলে কলিংবেলের শব্দে হঠাৎ ঘুম ভাঙে অর্চিশার। দরজা খুলে দ্যাখে, পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত একঝাঁক কিশোর ছেলে। উচ্চকণ্ঠে সমস্বরে সালাম দিল। পাড়ায় মাহফিল হবে আগামী শুক্রবার, চাঁদা দিতে হবে। এসব ব্যাপারে অর্চিশা প্রশ্নত্তোর পর্বে না গিয়ে কিছু দিয়ে দেয় মুখ বুজে। কাঁচা ঘুম ভাঙায় মাথা ধরেছে, চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ড্রয়িংরুমে ফ্যান ছেড়ে সোফায় মাথা হেলিয়ে বসে অর্চিশা। সামনে বড় করে বাঁধানো বাবার ছবি। পাশে বড় জানালা, মৃদু বাতাসে পর্দা নড়ছে। বিকেলে কতদিন বাবার পাশে এমন বসে থেকেছে অর্চিশা। চা-পর্বের সাথে কথা-পর্ব চলতো সারাবিকেল। জীবনের খুঁটিনাটি সমস্যা আলোচনা করতেন। বুদ্ধিমত্তার সাথে কীভাবে মোকাবেলা করতে হয়, সরাসরি দেখতো বাবার সেসব কথা ও কাজে।
আজ সকাল থেকে তিন তিনটে দলের হয়ে এসেছে তিন প্রকারের মানুষ। বাবার কাছেও আসতো এমন। একবার মহল্লার প্রতি বাড়ির গেটে নম্বর প্লেট বসানোর কাজ নিয়ে এসেছিল উঠতি বয়সের একটা দল। তখন অর্চিশাদের বাড়ি গেট ছিল না। রাস্তার দিকে পুরোনো বাড়ির পেছনের দেয়াল ছিল। ক’দিন বাদেই পুরোনো ঘর ভাঙতে হবে বলে নম্বর প্লেট দেয়ালে বসানোর বদলে ওটা নিয়ে রেখে দিতে চেয়েছিলেন বাবা, নতুন গেট হলে নিজেই লাগিয়ে নেবেন, এ কথা বলেন। ওরা দেয়নি, ওদের নিজে হাতেই লাগাতে হবে। মজুরিসহ নম্বরপ্লেটের দাম নাকি ফিক্সড্।
অর্চিশার বাবা সেদিন ছেলেগুলোকে বুঝাতে চেয়েছিল, পৃথিবীতে ফিক্সড্ বলে কিছু নেই। প্লেনসিটে বসানো নম্বরটা নিতে চেয়েছিলেন দাম দিয়েই। দু’পক্ষের যুক্তিতর্কের কিনারে পৌঁছে নম্বর প্লেটটি আর নেয়া হয়নি। সেদিন অর্চিশার বাবা অর্চিশাকে চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়েছিলেন, সম্মুখে হাজির হয়ে যারা নানা রকম সুবিধা দেবার কথা আওড়ায়, তা নিছক বাণিজ্য ওদের। বাড়ি বয়ে এসে উপকার করবে, এমন কারণ দুস্প্রাপ্য। আজ বাবা নেই, ঘরে বসে বিভিন্ন অফার আসায় অর্চিশা যদিও সেসবের গূঢ় উদ্দেশ্যে স্পষ্ট নয়, তবে এসবকে সন্দেহের প্রাচীরের বাইরে পাঠায়নি। অর্চিশা নিশ্চিন্ত-যাপন করতে পারে কেবল গাছগাছালি আর পশুপাখির সাথে কাটানো সময়গুলোয়।
ছাদের গাছে ফুল-ফল আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণেনি কখনও অর্চিশা। গাছে সার-পানি দেয় ফুল-ফল প্রাপ্তি প্রধান উদ্দেশ্যে নয়, গাছেদের সবুজে-সহজে বেড়ে ওঠা দেখতে ভালোলাগে ওর। অর্চিশার স্মৃতিতে মেখে থাকা ছোটবেলায় দাদার বাগানের সবুজ-মায়ার টানেই শহরের এই ছোট্ট বাড়ির ছাদে গাছগাছালি লাগানোর প্রয়াস। সেকারণে কিচমিচ করা পাখিদেরও আনাগোণা এখানে। কিছু কিছু কাল্পনিক বিষয় বাস্তবতার স্বাদে উন্মোচনের মাধ্যমে রহস্যগন্ধি-আনন্দ গ্রহণের শৈল্পিক-ব্যবস্থা করেছে ইদানীং। এ হয়তো জীবনের ছোটছোট অপ্রাপ্তিগুলোকে প্রাপ্তির স্বাদে পরিণত করার সাধ। শেফালীর কাছে তা বিস্ময়!
খোলা ছাদের এক কোণে ডালিম গাছের মোটা কাণ্ডে গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধা মাটির ভাড়ের গায়ে লাল অক্ষরে লেটার বক্স লেখা দেখে শেফালী জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা কেন ঝুলিয়ে রেখেছে? অর্চিশা বলেছিল, এতে চিঠি আসে। শেফালীর চোখেমুখে প্রশ্নচিহ্ন স্থায়ী হয়ে উঠতে দেখে, অর্চিশা আরেকটু ভেঙে বলেছিল, পাখি ঠোঁটে করে অন্তরীক্ষ থেকে হাহাকারপূর্ণ তৃষ্ণার্ত চিঠি এনে এর ভেতরে রাখে, যাবার সময় শীতল প্রাণে তৃপ্ত ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে যায় নিভৃতে লেখা জলসিক্ত চিঠি। শেফালীর হা করে তাকিয়ে থাকা দেখে অর্চিশা বলেছিল, খাড়া দুপুরে এসে দেখিস!
শেফালী দেখেছিল, সত্যিই ঘটেছিল ব্যপারটা। কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে শেফালী ওখানে উঁকি দেয়, ভাড়ে হাত রাখে; ওর মধ্যে কি চিঠি আছে? হাত তুলে দ্যাখে, জলে ভেজা আঙুল। এরপর থেকে শেফালী প্রায় খেয়াল করে, ভাড়ের মুখে পাখির ঠোঁট ডুবানো দৃশ্য। পাখিরা চিঠি দিতে আসে, নাকি জল খেতে আসে! এ প্রশ্নে পা বাড়ানোর সাহস করেনি শেফালী।
এ বাড়িতে একা থাকে অর্চিশা। ভাইবোনেরা যার যার কর্মসংস্থানে দূরে থাকে। লেখালেখির সুবাদে শহরের সাহিত্য-খালের স্রোতহীন জলে সাঁতার প্রতিযোগীরা অর্চিশাকে নামে চেনে। এদের কেউ কেউ সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ক দৈনন্দিন তথ্য সরবরাহের কাজে অলিখিতভাবে নিয়জিত। এমন দায়িত্বশীল একজন ইদানীং অর্চিশার জীবন বৃত্তান্ত জেনে নিয়েছে। অখিল সরকার, নিজেকে এরই মধ্যে অর্চিশার শুভাকাঙ্ক্ষী প্রমাণিত করার নিত্য প্রচেষ্টারত। যেমন বিনয়ী, তেমন উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন। উভচর প্রাণীর মতো জল স্থল উভয় স্থানেই নিজেকে এডজাস্ট করে চলায় জুড়ি নেই তার।
অর্চিশার খোঁজখবর নেয়ার পরিধি তড়িৎ গতিতে বেড়ে চলছে। সকাল থেকে দারুণ মেঘ-ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভিজবেন না, আপনি চাইলে বাইকে করে পৌঁছে দেব বাসায়, শুনেছি আপনার টনসিল। ঠাণ্ডা খাবেন না, অমুকের সাথে মিশবেন না, লোকটার মধ্যে সমস্যা আছে, আজ খুব গরম। ছাতা নিতে ভুলবেন না, অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নেবেন, আজ ও রাস্তায় জ্যাম প্রচুর, মিছিল হচ্ছে, অন্য রাস্তা ঘুরে যাবেন, কোনো সমস্যা হলে প্লিজ ফোন করে জানাবেন। আপনি খুব সরল, যে কোনো মানুষ ঠকাবে, আপনার জন্য খুব চিন্তা হয়... ইত্যাদি ইত্যাদি অখিল সরকারের বিশেষ সমাজ চিন্তক শুভকামনাময় বাক্যভাণ্ডার।
অর্চিশা তার স্বাভাবিক স্বভাবে অন্যের আন্তরিকতার প্রতিদানে সৌজন্যতা প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। অখিলের নানাভাবে খোঁজখবর নেয়াকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপযুক্ত কারণও চোখে পড়েনি অর্চিশার। মানুষ মানুষের জন্য বন্ধুসুলভ হয়ে থাকে, ওর এমন বিশ্বাসে এখনও ঘূণ ধরেনি। টানা ছ’দিন অফিস করে হাঁপিয়ে ওঠে অর্চিশা। ঘুম থেকে একটু বেলা করেই উঠেছে। বালিশের পাশ থেকে মেসেজ এলার্ট টোন বাজতেই ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ অপশন দেখল, লাইব্রেরির সেক্রেটারি সিরাজ ভাইয়ের মেসেজ। আগামী সপ্তাহে তিন দিনব্যাপী বই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে পাবলিক লাইব্রেরি। সেখানে অর্চিশাকে ওর প্রকাশিত বইগুলো দেবার আহ্বান জানিয়েছে এবং অমন্ত্রণ করেছে প্রদর্শনীর শেষদিনে লেখক সমাবেশে অংশগ্রহণের।
সপ্তাহ ঘুরে ছুটির দিন এলে বাড়তি কাজও জুটে যায়, কড়া রোদ দেখে শেফালীকে দিয়ে সেলফের বইগুলো ছাদে ওঠালো। বিছিয়ে রাখা বইগুলো কোনো কোনোটির মলাট ঠিক করছে, কোনোটির ছেঁড়া অংশ গাম লাগিয়ে জুড়ে দিচ্ছে। শেফালীকে নিমপাতা পেড়ে আনতে বলল। শেফালী মুঠো ভরে নিমপাতা এনে খবর দিল, পাপিয়া আন্টির বাড়িতে অখিল সরকার এসেছে, সাথে আরও দুজন লোক। বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সমিতি বানানোর মাধ্যমে গরিব মেয়েলোকগুলোর সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করেছে এই সরকার। পাড়ার জনমজুরি খাটা আর লোকের বাড়ি কাজ করা মেয়েলোকদের নিয়ে মিটিং করবে শুনলাম, আমাকেও যেতে বলেছে।
বইয়ের পাতার ভাঁজে ভাঁজে নিমপাতা রাখতে রাখতে অর্চিশা বলল, মিটিং যখন, আরও অনেকেই নিশ্চয়ই থাকবে। প্রথমদিন যাচ্ছিস বারণ করছি না, আগে শুনেবুঝে দ্যাখ। তবে পাপিয়া সিকদার মহিলাটিকে আমার সুবিধা লাগে না। অর্চিশার অনাগ্রহময় বাক্যে শেফালীর মুখ গোমড়া হওয়া অর্চিশার চোখ এড়িয়ে যায়নি।
বই প্রদর্শনীর আজ শেষদিন। পাঁচটা নাগাদ একে একে লোকজন এসে ভরে উঠেছে লাইব্রেরির পাশের রুম। অর্চিশা কালো পাড়ের অ্যাশ কালারের শাড়ি পরেছে। সাদামাটা সাজ, আঁচলে ঢাকা কাঁধে ঝুলোনো ব্যাগের কালো ফিতা ব্লাউজের কালো রঙের সাথে বিশেষ মানিয়েছে। মেইন দরজায় ঢুকতেই ভেতর থেকে অখিল সরকার এগিয়ে এলো। আরও দু’একজন চেনামুখ দূর থেকে হাত নেড়ে, কেউ আবার মাথা কাঁত করে সম্ভাষন জানালো। পেছনে পরপর আরও দুজন চেনা ব্যক্তি। তাদেরও সম্ভাষন জানালো। উপস্থিত পরস্পর পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। পরিবেশটা ভালো লাগছে অর্চিশার। কিন্তু অখিল সরকার এখানেও! অর্চিশা ভাবছে, কী জানি! হয়তো পাঠকও যুক্ত আছে। অখিল সরকার কথায় কথায় বহুবার অর্চিশার সামনে বলেছে, সে প্রচুর বই পড়ে। হয়তো এ কথা বহুজনের কাছেও অজানা নয়।
লাইব্রেরির মধ্য দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে দ্যাখে, আরও জাকজমক পরিবেশ। সামনের সারিতে স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, তাদের স্ত্রীগণ, জেলা প্রশাসক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দু’তিনটি পত্রিকার মালিক, এদের চারপাশ ঘিরে কিছু লেখক, সাংবাদিকের ঘোরাফেরা। অবশ্য প্রবীন দু’একজন সাহিত্যিক বসে আছেন; অর্চিশা পেছনদিকের একটা চেয়ারে বসলো। এই ছোট্ট শহরে সাহিত্যের গোড়াপত্তন সম্পর্কে প্রবীন সাহিত্যিকগণ যে যার নিজের মত করে বলছেন। সাহিত্যের প্রথমদিকের অবস্থা আর বর্তমান অবস্থার ভালোমন্দ দিক নিয়েও কেউ কেউ বলছেন। তাদের বক্তব্য আসলে ভালোমন্দের মাঝখানে ড্যাশের উপরেই সীমাবদ্ধ। গড় নির্ণয় অংকের মতো বলা যায়।
এরই ফাঁকে আশপাশের অচেনা দু’একজন যেচে অর্চিশার পরিচয় জানছে। কারও কারও কথা এমন, আপনার লেখা পড়ে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। আবার, আপনার লেখা অন্য সবার থেকে আলাদা। কেউবা বলছে, আপনার লেখার ভীষণ ভক্ত আমি, পত্রিকায় পড়ি।
একটু দূরে পায়ের উপর পা তুলে বসা সহাস্য সেঁজুতি পারভীন। স্লিভলেস এর কালারের সাথে ঠোঁটের কড়া লিপস্টিক আর বড় টিপের একটা অদ্ভুত ম্যাচিং— আবেদনময়ী করে তুলেছে তাকে। গলায় বড় ভারি পুঁথির মালা বুকের পরে শাড়ির ভাঁজে সেঁটে মৃদু নড়ে চড়ে ঢেউ তুলছে। আলাপের গতিধারা লেখার বিষয়বস্তু থেকে ধীরে ধীরে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে প্রবাহিত হয়ে গেছে কখন, অর্চিশা টের পায়নি। বোধহয় সুত্রপাতটা ঘটেছে— গতবার কোন্ লেখক, কোন্ শিল্পী, কোন্ কোন্ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মাথার খুশকিতে চিরুনি চালনা করে কিংবা কোমরে ব্যথানাশক বাম লাগিয়ে পদক-পুরস্কার লাভ করেছেন। এখানে আলোচনাগুলো এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নাম উচ্চারণ ছাড়াই অনেকের কাজের ফিরিস্তি-বর্ণনা চলছে। এগুলো প্রশংসা নাকি তিরস্কার, তা বুঝার পক্ষে সমাবেশে দু’একবার আসা যথেষ্ট নয়। এসবের আদ্যপান্তে অর্চিশার প্রবেশ ঘটেনি পূর্বে।
ওদিকে অখিল সরকার একে ওকে ডেকে অর্চিশার পরিচয় দিচ্ছে। অর্চিশার মনে অজানা বিরক্তিবোধ জন্মেছে কিনা, তা ওর কাছে অনাবিস্কৃত। একসময় আলোচনার জমজমাট বিষয়বস্তু গড়াতে গড়াতে সেঁজুতির পায়ের কাছে কুচিতোলা পাড়ে এসে ঠেকলো। জমকালো শাড়ির কালেকশন কোথা থেকে, কতদিন আগে, কত বাজেটের ছিল— তার বর্ণনায় ভাসতে ভাসতে সেঁজুতিই হয়ে উঠলো সমাবেশের মধ্যমনি। এর মধ্যে এসপির কাছে কতবার ফোন এসেছে রাত্রে কোন্ অঞ্চলে কোন্ অপরাধী পাকড়াতে অপারেশনে যেতে হবে। এমপি ফোনে ফোনে তার আগামীকালের সিডিউল কাকে যেন জানালো। জেলা কর্মকর্তার স্ত্রীর প্রেশার বেড়েছে, তার ভাগনে ফোনে জানাতেই সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে বাসায় ফেরার জন্য। এরই মধ্যে সাংবাদিকগণ বেশ শ’খানেক ছবি তুলেছে রুমের বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে। আশপাশের বলাবলিতে আঁচ করা গেল— পরদিন হয়তো কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম হবে— সাহিত্য সমাবেশে লেখক-প্রশাসনিক কর্মকর্তা-রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অপূর্ব মিলন মেলা।
রাত আটটা বাজলো সমাবেশ শেষ হতে। প্রত্যেকের যাবার জন্য দরজায় ভিড়, পাশে মুখগুলোর গুঞ্জনে শোনা গেল— ওদের আসল আয়োজনে যাবার পূর্ব-ভূমিকা স্বরূপ এই সমাবেশে আগমন। রাত ন’টার পরে এমপির বাড়িতে পার্টি। সিলেক্টেড ব্যক্তিদের লেখক সমাবেশে এসে জড় হওয়া এবং সাংবাদিক দ্বারা লেখক সমাবেশে তাদের উপস্থিতিকে হাইলাইট করার অর্থ খুঁজে পেল না অর্চিশাসহ আরও কেউ কেউ। তবে বিষয়টা বেশিরভাগজনের কাছেই সাবলীল বলে মনে হচ্ছে। দুটো জায়গার মধ্যস্ততা করছে কারা কোন্ উদ্দেশ্যে তা বোধগম্য হলো না, অনুসন্ধানেও এগোয় না অর্চিশা। বস্তুত কয়েকজন প্রবীন সাহিত্যিকের সাথে সাক্ষাৎ ব্যতীত, তার নিজেরও এখানে আসার বিশেষ কোনো কার্যকারিতা খুঁজে পায় না।
অন্ধকার বেশ ঘন। অর্চিশা রাস্তায় উঠে অটো নেবে ভাবছে, এরই মধ্যে হঠাৎ অখিল সরকার সম্মুখে এসে বলল, ম্যাডাম আমি পৌঁছে দিলে আপত্তি?
অর্চিশা ক্ষণিকেই অনুভব করলো, কারো বাইকে করে রাতে বাসায় ফেরাটা মন থেকে সায় দিচ্ছে না। বলল, না-না, অটো নিয়ে চলে যাব আমি।
অখিল বিনয়ের সাথে বলল, দেখুন, আপনাদের পাড়াতেই আমার একটু কাজ আছে, আসলে একটু পরে আরেকটা প্রোগ্রাম তো, ওখানে আমার উপর কিছু দায়িত্ব আছে, পার্টিতে গেস্টদের আপ্যায়নের জন্য কিছু মাল রাখা আছে একখানে, আনতে হবে, তাই বলছিলাম— এমনিতেই আমাকে যখন ওপথেই যেতে হবে...
পাশ থেকে কে যেন অখিল বলে ডাকলো।
সরি, একটু দাঁড়ান, বলে অখিল সরকার ভেতরে গেল। ডাকের ধরনে মনে হলো, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কেউ হবে। অর্চিশার দাঁড়াতে মন চাইছে না, অখিলের মুখে ‘মাল’ শব্দটা অর্চিশাকে যথেষ্ট অস্বস্তি দিচ্ছে। লাইব্রেরির সামনের মাঠটুকু হেঁটে রাস্তার দিকে যেতে লাগলো। খালি অটো দেখে উঠে পড়ল।
মিনিট দশেকের মধ্যে বাড়ির গলিতে পৌঁছে গেল অর্চিশা। পাপিয়া সিকদারের বাড়ির সামনে সরু গলির মাঝখানে বাইক দাঁড় করানো, অটো ওখানেই আটকে গেল। অর্চিশা নেমে পড়ল, বাইকের নম্বরটি চোখে পড়তেই আশ্চর্য হলো। অখিল সরকারের বাইক! এখানে কখন এলো! পরের তিনটি গেট পরে অর্চিশার বাড়ির গেট, তালাবন্ধ বাইরে থেকে। বাইরের দিকে তালা ঝুলোনো কেন! কয়েকবার কলিংবেল টিপে সাড়া না পেয়ে, ভাবছে ঘুমিয়ে পড়েছে শেফালী। ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করল অর্চিশা। চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ভেতরে ঢুকে এ ঘর, ও ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম সবখানে উঁকি দেয়, শেফালী ভেতরে কোথাও নেই। ওর ফোনে কল দেয় অর্চিশা, পাশের কামরায় বেজে ওঠে রিংটোন। ফোন নিয়ে যায়নি শেফালী! দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল অর্চিশার, এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটা!
শেফালীদের নিয়ে সমিতির মিটিংয়ের কথা মনে পড়ল অর্চিশার। শেফালীর ফোনটা হাতে নিয়ে কল ডিউরেশনে গেল, লাস্ট কল ছিল পাপিয়া সিকদারের। ওই নাম্বারেই কল দিল অর্চিশা। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ, পাপিয়ার ফোনোকণ্ঠ আগে শোনেনি অর্চিশা। যেই হোক শেফালীর কথা জানতে চাইলে ওপাশ থেকে উত্তর এলো, পাপিয়া সিকদারের সাথে মিটিংয়ে আছে। শেফালীর প্রতি বিরক্তিভাব জেগে উঠলেও অর্চিশার সারাদিনের ক্লান্তির ভারে তা চাপা পড়লো। রাত বাড়ছে ফেরার নাম নেই, শেফালী একছড়া চাবি নিয়ে গেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ফোন বাজলো, মামাতো ভাই আতাউল। প্রথমেই জানতে চায়, অর্চিশা কবে গ্রামে যাবে? জায়গাটা ওরা খোঁড়ার প্লান করছে। জলকোরদের কাছে ইজারা দিচ্ছে তাদের অংশ; অর্চিশার বাবার অংশও ধসে যাবে তাতে। দু’একদিনের মধ্যে গিয়ে হাজির হতে পারলে শরিকদের সাথে বসে একটা সুরাহা হবে হয়তো। ওটুকু বাঁচাতে হলে ওদের অংশ কিনে নিতে হবে এখুনি। মূলত ওরা তাই চাচ্ছে। অর্চিশা দু’চারদিন থামিয়ে রাখার কথা বলে ফোন রাখলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। অর্চিশার চোখ চেপে এলো।
ভোরে ওঠা অভ্যেস অর্চিশার। কেন যেন আজ তারও অনেক আগে ঘুম ভেঙেছে! পরপর শুনেছে, কাছের দূরের কয়েকটি আযান। মনটা কেমন অস্থির! বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে জলছিটে দিলো। তোয়ালেয় মুখ মুছতে মুছতে ওর কামরাটায় উঁকি দিলক, শেফালী ফিরেছে কিনা। অন্ধকার ঘর, সুইচ দিল অর্চিশা। রাতে যেখানে রাখা ছিল শেফালীর ফোন, ওখানেই আছে। নড়চড় হয়নি। গেটে গেল, অর্চিশার বাঁহাতি লাগানো ঝুলন্ত তালা স্পষ্ট করলো শেফালী ফেরেনি। নিজের ঘরে ফিরে নিজের ফোন তুলে দেখলো, আননোন নম্বর থেকে অনেকগুলো মিসকল আর মেসেজও। মনে করার চেষ্টা করলো, আতাউলের সাথে কথা শেষ করে ফোন সাইলেন্ট করেছিল কিনা। যা হোক, জেনারেল মুডে এনে মেসেজ অপশন খুললো। রাত ১টায় দেয়া মেসেজ, অনেক রাত, ফেরা হচ্ছে না, ভোর হলেই ফিরবো।
মনকে সান্ত্বনা দিতে চাইলো অর্চিশা। ভাবছে যাকগে, ওদের কী সব প্রোগ্রাম টোগ্রাম, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল হয়তো, শেষ হতে রাত হয়েছে বোধহয়। তাছাড়া পাপিয়া সিকদার যেমন মানুষই হোক, মহল্লার চেনাজানা তো! অর্চিশা জটিল কিছু ভাবতে চাইছে না। শান্তি ও স্বস্তি সবসময় সহজ পথেই প্রকাশ হতে চায় বোধহয়।
রোদ-ঝলমলে সকাল। মেইন গেট ও জানালা খুলে দিল অর্চিশা। বাইরে বৃষ্টিধোয়া ঝকঝকে পাতার ঝিরিঝিরি দোল। সামনের রাস্তার ধুলো ধুয়ে গেছে ঠিকই, তবে নর্দমার জল উপচে উঠেছে কানায় কানায়। মাঝরাতে বৃষ্টি ঝরা বেড়েছিল বোধহয়। পৌরসভার দায়িত্বশীলতার উন্নতি হয়েছে নাকি! রাত পোহাতেই ময়লার গাড়ি এসে হাজির। আরেকটু এগিয়ে তিন রাস্তার মোড়ে কিসের যেন জটলা। মাঝে মাঝেই ওখানে মহল্লাবাসির পাণ্ডিত্যের বাজনা বাজে। অর্চিশা গুরুত্ব দেয় না, প্রায়ই শোনে এমনটা। এসব অগণিত চেনা ঘটনা যখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, কখনও কখনও সেখানে অজানা দুর্ঘটনাও তেমনই যোগ হয় নিত্যকার গুরুত্বহীনতায়। বিশেষ স্পেস পেতে বা দুর্ঘটনা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে সময় খরচ হয় খানিক। তেমন সময়ের ফাঁকে অর্চিশাও ডুবে যায় সকালে অফিস বের হওয়ার ব্যস্ততায়।
তিনটি নর্দমার সংযোগস্থলের চওড়া গভীর জলাবদ্ধতা থেকে স্তূপাকার কী যেন টেনে তুলছে পৌরসভার কয়েকজন পরিচ্ছন্ন কর্মী। সরু গলি পেরিয়ে মোড়ে এগাতে এগোতে চোখ পড়ল অর্চিশার। ততক্ষণে বস্তা খুলে কলসের জল ঢালায় কাদা পরিষ্কার হয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটা মৃতদেহ। যুবতী নারী শরীর! উপস্থিত লোকজন হৈচৈ করে উঠলো। অর্চিশা স্তম্ভিত! শেফালী!
সর্বনাশের এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে শেফালীর গতরাত কেটেছে! মহল্লার অনেকে অর্চিশার কাছ থেকে জানলো, রাতে শেফালীর না ফেরার কথা। পাড়ার দিনমজুর খাটা মহিলারাও এতে সম্মতি দিল। কিন্তু ওর তো বাড়ি ফেরার কথা ছিল ভোরে! ভোরের ফেরা এভাবে! নানা প্রশ্নে অর্চিশা শুধু হতভম্ব নয়, আহত। রাতে কোথায় ছিল শেফালী? কেনই বা গিয়েছিল? কীসের মিটিং ছিল? পাপিয়া সিকদারের কথা উঠতেই কোথা থেকে হুট করে এলো সে? নিজের সাফাই ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারা পাপিয়ার কাছে কোনো ব্যাপার না। অর্চিশা তা বুঝে গেল এতক্ষণে তার কথার ধাঁচে। গতকাল সন্ধ্যায় তার বাসার সভা শেষে সবাই একসাথে বেরিয়েছে নাকি। পাপিয়া সিকদারের সমাজ সেবার জোয়ারে ব্যাপারটা থেমে থাকলো না। জলে ধোয়া শেফালীর গায়ের নর্দমার কাদাপানি গড়িয়ে ছিটে বহুদূর এগোলো। বাতাসের বেগে প্রসাশনের দুয়ারেও পৌঁছে গেছে।
এরই মধ্যে এলাকার সাংবাদিক, মেম্বার, প্রবীন মহল্লাবাসি জড়ো হয়েছে। অর্চিশা পরিস্থিতির কথা অফিসে জানিয়ে দিল, অফিসে যাচ্ছে না আজ। পুলিশে খবর গেছে। জানা গেল, লাশ পোস্ট মর্টেম হবে। ভিড়ের মধ্যে অখিল সরকারকে দেখা গেল। মোড়ের গাছতলায় শিশু থেকে বৃদ্ধ শ’খানেক লোকের শোরগোল।
পুলিশ অর্চিশার বাড়িতে এলে শেফালীর ফোন, মেসেজ, বিগত কয়েকদিনের তার চলাচলের যাবতীয় তথ্য প্লেস করলো অর্চিশা। খাকি পোশাক পরা লম্বা ফর্সা লোকটির কথায় বোঝা গেল, ডিপার্টমেন্টে ইনি নতুন অফিসার, কিছুদিন আগে জয়েন করেছেন। কয়েকদিনে অস্বাভাবিক কোনো কিছু ঘটেছে কিনা, বা চোখে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে, অর্চিশা উল্লেখযোগ্য দু’একটি বিষয় তুলে ধরলো— দিনমজুরি খাটা দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে পাপিয়া সিকদারের সমিতি গঠন কার্যক্রম, গতকালের মিটিং, শেফালীর তাতে অদম্য আগ্রহ, এ বাড়িতে অখিলে সরকারের অনাহুত আগমন, পাপিয়া সিকদারের বাড়িতেও তার আসা-যাওয়া, গতকালের লেখক সমাবেশ ইত্যাদি আরও খুঁটিনাটি সব মিলে প্রায় সপ্তাহখানেকের সিচুয়েশন সম্পর্কে ধারণা নিতে পড়লো সাব-ইনসপেক্টর। অর্চিশা খেয়াল করলো, অখিল সরকারের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে ইনসপেক্টর অন্য অফিসারের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলো— সবখানেই একটা কমোন এটেন্ডেন্স খেয়াল করেছেন?
কথাটা অর্চিশার মাথায় বাজলো। অন্য অফিসারটি চুপ করে থাকলো। একটা ধোঁয়াশার মধ্যে থাকলেও অর্চিশার মনে কীসের যেন ঈঙ্গিত টের পাচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার এত এত মানুষ থাকতে এই অখিল সরকারই শেফালীর বিভৎস ছবি পোস্ট করেছে। এবং তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে নারী নির্যাতন, নারী পাচার, ধর্ষণ, হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদি আন্দোলন ও মানব বন্ধনের আহ্বান— ছাত্র-শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক, নবীন-প্রবীণ, নারী-পুরুষ সর্বোপরি শহরের বিভিন্ন পেশার অসংখ্য মানুষ বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়েছে।
অর্চিশা একা ড্রয়িংরুমে, মেইন গেটে তালা খোলা, ওবেলা কিছুক্ষণ পরপর পাড়ার দু’একজন করে এসে শেফালীর জীবনবৃত্তান্ত মুখস্ত করে গেছে। তালা দিতে ইচ্ছে হয়নি আর। সোফায় শুয়ে শেফালীর সাথেই নিঃশব্দ কথোপকথন চলছে মাঝে মাঝে আনমনা হওয়া অর্চিশার সাথে। কত নিজের হয়ে ছিল এবাড়িতে শেফালী মেয়েটা। অর্চিশা এখন একা হয়ে গেল। আকাশের সব মেঘ অর্চিশার মাথার উপরে, অথবা মনটা তার মেঘভরা আকাশ এখন, অস্থির সে মেঘপুঞ্জ! শেফালীর বিগত ক’দিনের কথা বাজছে অর্চিশার বুকের কোথায় যেন— বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সমিতি বানানোর মাধ্যমে গরিব মেয়েলোকগুলোর সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করেছে এই সরকার।
কোন্ সরকার? নিভৃতে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। উহ্! নীরবতার মাঝে জীবনের উত্তর নির্ণয় কী কঠিন! জানালার বাইরে গোধূলির রক্তিম আভা, খানিকটা অর্চিশার চোখে মুখে মিশেছে। বড় শূন্য মনে হচ্ছে বুকের ভেতর, তা কি কেবল শেফালীর অনুপস্থিতিতে! নাকি শূন্য ঘরও তার ভার নিয়েছে কিছুটা! নীরবতা ফুঁড়ে রিংটোনসহ অখিল সরকার নাম উঠে এলো মোবাইল স্ক্রিনে। দু’এককথায় কুশল বিনিময়ের পরে অখিল সরকার বিনয়ের সাথে বলল, আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না। শরীর খারাপ করবে, এমন মানসিক অবস্থায় একা একা ঘরে না থেকে আমাদের সাথে কথা বলুন, বাইরে বের হয়ে একটু ঘুরবেন। আগামী সাহিত্য-আড্ডা খুব শিঘ্রই আসছে। অবশ্যই আসবেন। দেখবেন ভালো লাগবে।
অর্চিশার কাছে এসব কথাবার্তা বালখিল্য শোনাচ্ছে। কপাল কুঁচকে শোয়া থেকে উঠে বসে বলল, না, না, সম্ভব হবে না। কোনো জরুরি কথা থাকলে বলুন, একটু ব্যস্ত আছি।
অখিল সরকার শহরের নতুন কমপ্লেক্স মার্কেটে শেয়ার থাকার অনুরোধে দুই লাখ টাকা দ্রুত ইনভেস্ট করতে হবে জানালো। অর্চিশার জবাবের অপেক্ষা না করে পুনরায় বলল, যদি এ মুহূর্তে আপনার ম্যানেজ করা প্রবলেম হয়, আমি হেল্প করতে পারি। আগামী কাল আপনি আসতে পারলে এ নিয়ে আলাপ সেরে নেয়া যেত।
অর্চিশা বেশ অবাক, উপকার করতে এত মরিয়া হয়ে ওঠে কেউ! এমন অফার কি কোনোকিছু আড়ালের উদ্দেশ্যে! নাকি কোনো গন্তব্য আছে! অখিলের কথায় অর্চিশা সোজাসোজি বলল, না, দরকার নেই। এ নিয়ে ভাবছি না, পরে কথা বলবো। ফোন রেখে দিল। মনে পড়লো বাবার কথা, সম্মুখে হাজির হয়ে যারা নানা রকম সুবিধা দেবার কথা আওড়ায়, তা নিছক বাণিজ্য ওদের। বাড়ি বয়ে এসে উপকার করবে— এমন কারণ দুঃস্প্রাপ্য।
মনে পড়ল গতকাল রাতের আতাউলের কথা। প্রফিডেন্ট ফান্ড থেকে যে টাকাটা ঋণ তুলেছে তা দিয়ে গ্রামের জমিটা ছাড়ানো যাবে মাত্র, দুদিক ঠেঁকানো যাবে না। বস্তুত এদিকটা ঠেকানোর বদলে উদঘাটনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পুলিশ সে দায় নিয়েছে। সাহিত্য আড্ডায় যে হারে সমাজসেবা, কেস তদন্ত, দরিদ্রতহবিল গঠন, নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়াদি জায়গা করে নিয়েছে তাতে শেফালীর কেসটাও হয়তো নিস্পত্তির দিকে যাবে একদিন। তবে পাপিয়া সিকদারের নিচতলার নতুন সংগঠনের ঘরটি পুলিশ কেন সিলগালা করে গেছে, বোঝা গেল না।
পরদিন সন্ধ্যার গাড়ির টিকিট পেয়েছে অর্চিশা। সারারাত গাড়িতে চোখবুজে, ঘুম নয়। মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে সদ্য বিগত ঘটনাসমূহ। কথা ছিল, গ্রামের বাড়িতে শেফালীও সাথে যাবে, পাশাপাশি সিটে বসে। পাশের সিটটা খালি। কিন্তু অর্চিশা শেফালীকে অনুভব করছে ওর পাশে, আচ্ছা শেফালী, তুই কি, দুর্ঘটনার আগে খবর দেয়া যায় এতটুকুও সময় হাতে পাসনি? একটুও টের পাসনি— পাপিয়া সিকদার কিংবা অখিল সরকার কিংবা অজ্ঞাতজনের মনোভাব বা উদ্দেশ্য কী? তোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে, একটুও কি প্রশ্ন জেগেছিল মনে? কী করে হলো তোর এমন ভুল? তোর মতো একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নিয়ে এতবড় অন্যায়! এরা কারা? একটি মানুষের ভুলের যোগফল তার জীবন থাকাকালীন নির্ণয় করা সম্ভব নয়। সে জীবন নিয়ে যখন কথা হয়, তখন চতুর্মুখী আলোচনা চলে আসে। ভুল, অন্যায়, তঞ্চকতা, দাসত্ব এগুলো এক কথা নয়। ভুলের মাশুল অনুশোচনা হতে পারে, তোর জন্য সে সুযোগটাও থাকেনি!
কিন্তু অন্যায় ও দাসত্বের কোনো পরিমার্জনা হতে পারে না এ কারণে যে, মানুষ লোভ ও স্বার্থের বশবর্তী হয়েই অন্যায় করে, দাসত্ব করে। আর তঞ্চকতা! অযোগ্যদের নিজেকে শো করার মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে এর জুড়ি নেই! এর মাধ্যমেই সেই সমস্ত প্রত্যেক মানুষ তার করা হীন কাজগুলোর পেছনে নিজের ইচ্ছেমতো একটা লজিক দাঁড় করায়। যার ফলে তারা হীন কাজ করেও হীনমন্যতায় ভোগে না। অতএব শ্রেফ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু যাদের স্বার্থ-অন্যায়-তঞ্চকতা-দাসত্বের শিকার তুই হয়েছিস তাদের কৈফিয়ত আছে কোথাও?
একসময় গন্তব্যের সম্ভাব্য দৃশ্যপটগুলো ভেসে আসতে শুরু করলো। দাদার আমবাগানের উঁচু মাচা করা বাঁশের ধাওটে পাতার ছায়ায় কাটানো দিনমান, ছায়াময় বাগানজুড়ে রোদের ঝিকিমিকি লুকোচুরি, বাগানপথে নদী-ঘাট, স্বচ্ছজল, জলের নিচে শৈবালের সবুজ মায়া মনে পড়ছে সব। রাতের বাগানে আম-বৃক্ষের ডালপাতার ফাঁক-ফোঁকরে ঝরে পড়া জ্যোৎস্না-আধুলি কেমন করে গ্রাম্য-পথ-শরীরে মিষ্টি আলোর চাদর জড়িয়ে রাখতো শৈশবে দেখা সেসব ভোলেনি অর্চিশা। গ্রামের প্রান্ত-আঁকা নদীতীর কেমন সেজে উঠতো বাদাম-খেসারি, মাসকলাইয়ের সবুজ সজ্জায়, মাঠের পরে মাঠ ঢাকা থাকতো কুশারের ক্ষেত, টমেটো-বেগুনের ভূঁই, সেসব আটকে আছে অর্চিশার দৃষ্টি-ফ্রেমে। অমন ঘ্রাণ পায় সে এখনও টাটকার মতো। কত জমানো কথা ওদের সাথে অনর্গল অবিরাম বলতে থাকবে সে। শোনাবে আর শুনবে ওদেরটাও। জলকোরের গ্রাস থেকে জমিগুলো রক্ষা করে ফসল অথবা গাছগাছালি ফলাবে। শুনবে মাটি আর মাটির মানুষের মেটো কথা।
পাঠ্যঘর আর কথাঘর, দুটো ঘরই বানাবে অর্চিশা। এ স্বপ্নপূরণে স্বার্থক করবে নিজেকে। সফলতা অর্জনের চেয়ে স্বার্থকতা অর্জনকে বড় বেশি উপলব্ধি করছে অর্চিশা। শীতভাব পড়েছে। ভোর পাঁচটায় গাড়ি পৌঁছালো। মোড় থেকে গ্রামের দিকে সিঁথির মতো ঢালু পথে ভেজা দূর্বা মাড়িয়ে নেমে আসছে অর্চিশা। দু’পাশে মাঝে মাঝে কিছু ঘর উঠলেও ফাঁকা ক্ষেতগুলো ফসলের সজ্জায় অবশিষ্ঠ তারুণ্যচিহ্ন ধারণ করে আছে এখনও। শিশির ঝরা স্বর ব্যতীত নৈঃশব্দ্য চারপাশ। ভোরের পরিচ্ছন্নতা পায়ে পায়ে স্বাগত জানাচ্ছে অর্চিশাকে। মাটির বুকে থুতনি ঠেঁকিয়ে আছে ফুলকপির বিকশিত ধবধবে মুখ! ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে গ্রাম্য নীরবতা, আবছা সরে সরে সূর্যের মুখ উঠে আসছে; ক্ষেতের আইল ছেড়ে অর্চিশাও উঠে এলো দাদাবাড়ির বাগান পথে। বাড়ির গলিতে উপস্থিত হতেই দাদার কবরের বেড়ার পাশে হেলিয়ে রাখা বাইক দেখে থমকে দাঁড়ালো অর্চিশা। মনে পড়ে গেল শহরে ফেলে আসা বাড়ির গলিতে ঢুকতে সেদিন রাতে দেখা বাইকটার কথা, শেফালীর সরল মুখটা ভেসে উঠতেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো, আচমকা মনের কোণে আশংকা জাগলো, এটা সেই বাইকের মতো নয় তো! ক্ষণিকে আবার নিজেকে নিজে প্রবোধ দিলো, হয়তো না!