একসময়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল সবচেয়ে আধুনিক

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২১

মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি আছে বাংলাদেশ তথা ভারতের এখনকার মানুষদের মধ্যে। বর্তমান কালের মাদ্রাসার দিকে তাকিয়ে আগের দিনের মাদ্রাসাকে চেনা যাবে না। মাদ্রাসা কথাটার মানে হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা শিক্ষা আরম্ভ হয় মুসলমানদের হাত ধরে। ইসলামি দুনিয়ায় একদা বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়েছে মহিলাদের দ্বারা। মনে করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটা এসেছে মুসলমানদের মাদ্রাসার শিক্ষাকে ঘিরে। মুসলমানরা প্রথমদিকে চিন্তাচেতনায় অনেক বেশি উদার ছিল। বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে গ্রহণ করতে কার্পণ্য করেনি। বিশ্বের বিরাট এলাকাজুড়ে ছিল মুসলমানদের শাসন। মুসলমানরা তখন অন্য ধর্মের প্রতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহনশীল ছিল। খ্রিস্টানদের অত্যাচারের হাত থেকে বারবার রক্ষা করেছিল ইহুদিদের, সেটা ইতিহাস।

মুসলিম জগতে প্রথম এতটা বিলাস বৈভবের জায়গা ছিল না। ফলে তারা একের পর এক সাফল্য পেয়েছে। পরে তারা হয়ে দাঁড়াল ভয়াবহ কূপমণ্ডুক আর ভোগিবলাসী। নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। নিজ নিজ পক্ষে অনেকেই দাঁড় করালো কট্টর সব মতবাদ। দিনে দিনে নানা ঘটনার ভিতর দিয়ে তা আরো কট্টর আর জঙ্গিরা চরিত্র লাভ করলো। মুসলমানদের জঙ্গি হয়ে ওঠবার জন্য অনেক বেশি দায়ী পাশ্চাত্যের দখলদার শাসকবর্গের নোংরা আর হিংসাত্মক কূটনীতি আর মুসলমানদের এক পক্ষের চরম গোড়ামি। ফলে মুসলমানদের মাদ্রাসা শিক্ষার উপর তার প্রভাব পড়ে আর সে শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষণশীল হয়ে দেখা দেয় সারা বিশ্বে।

মাদ্রাসা  শিক্ষা ভারতে তুর্কি শাসনে আরম্ভ হয়, মুঘল শাসনে আরো বিকশিত হয়। পাশ্চাত্যের শিক্ষা বা ভারতের পূর্বের বেদকেন্দ্রিক শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল তখন অনেক আধুনিক শিক্ষা। পাশ্চাত্যের শিক্ষা তখন ছিল চার্চকে ঘিরে বাইবেল নির্ভর। খ্রিস্টধর্ম প্রথমে ছিল উদার ধর্ম, অনেকটাই বিপ্লবী। তাই শুরুতে তারা খ্রিস্টান ধর্ম  গ্রহণ করে। যখন রোমান সম্রাট কন্সটানটাইন খ্রিস্টান ধর্মকে সাম্রাজ্যের সরকারি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তারপর তা হয়ে দাঁড়াল চার্চের নিয়ন্ত্রিত অত্যাচারের ধর্ম। বাইবেলের বিশ্বাসের বাইরে তখন চার্চ নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার সামান্য সুযোগ ছিল না। প্রায় সাত আটশো বছর চলেছে এমনটা। সেজন্য পাশ্চাত্যের সে যুগটাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্যের ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শিক্ষা নামক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সম্পূর্ণ চার্চের অধীন।

মনে থাকবে অনেকের, সে যুগে ব্রুনোসহ অনেককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল চার্চের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানচর্চা করা হয়েছিল বলে। গ্যালিলাই গ্যালিলিকে বিজ্ঞানচর্চার অপরাধে কারাগারের ভিতরে বন্দি অবস্থায় মরতে হয়েছিল। চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করার জন্য ফরাসি বিপ্লবের পর সেদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দেয়া হয়। সর্বস্তরে নতুন ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে ভারতের মাদ্রাসায় এমন পুড়িয়ে মারার ঘটনা কি আছে? তার আগে কিন্তু আছে, চার্বাকরা বেদবিরোধী নতুন কথা বলার জন্য তাদের রক্তাক্ত করা হয়, মেরে ফেলা হয়। চার্বাক দর্শনের সব গ্রন্থ নিশ্চিহ্ন করা হয়। ফলে মুসলিম শাসনের সবটাই খারাপ বা তাদের ইতিবাচক কিছু নেই, এমনটা ভাবার কারণ নেই। ভারতে যথেষ্ট ইতিবাচক অবদান আছে তাদের।

মাদ্রাসার আগে ভারতের শিক্ষা ছিল বেদকে ঘিরে ধর্মীয় শিক্ষা। মূলত মানব জন্মের উদ্দেশ্য, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য, মৃত্যুর পরের জীবন, পুনর্জন্ম  এসব নিয়ে ভাববাদী কথাবার্তা ছিল মূখ্য ব্যাপার। আর এসব পরলৌকিক চিন্তার সীমা পরিসীমা ছিল না। ফলে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরেও অনেকের এসব নিয়ে তর্কের বা শিক্ষা সমাপ্ত হতো না। আর মুখস্থ করতে হতো সম্পূর্ণ বেদ। শূদ্র আর নারীদের আবার এ শিক্ষা গ্রহণের অধিকার ছিল না। মাদ্রাসা শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে সেখানে সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, জ্যামিতি ও চিচিৎসাশাস্ত্রসহ নানা বিষয়ে পড়ানো হতো। প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞান বিজ্ঞানের বহু কিছু মাদ্রাসা গ্রহণ করেছিল। মাদ্রাসার প্রথম শিক্ষার বাহন ছিল আরবি ও ফারসি। হিন্দুরা মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করলে সম্রাট আকবর মাদ্রাসা শিক্ষায় সংস্কৃত ভাষা অন্তর্ভুক্ত করেন। হিন্দুরা তখন মাদ্রাসার শিক্ষা গ্রহণ করে সরকারের বড় বড় পদ লাভ করতেন নিজ যোগ্যতায়। ওয়ারেন হেসটিংস কলকাতায় মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা করেন সরকারি কর্মচারীদের ফারসি ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য। কারণ তখনো এবং পরের আরো সত্তর বছরের বেশি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি। বলতে গেলে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত।

সত্যি বলতে, আজকের মাদ্রাসা শিক্ষা আর আগের মতো নেই। আজকের মাদ্রাসার শিক্ষা ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষা, অতীতের মাদ্রাসার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা এখন ভয়াবহ এক শিক্ষার নাম। মাদ্রাসা এখন চরমভাবে নারী শিক্ষার বিরোধী। কারণ এখনকার মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্তরা জানেই না, মাদ্রাসা শিক্ষা আসলে কী। অতীতে নারীদের দ্বারা বহু মাদ্রাসা পরিচালিত হয়েছে। আর বর্তমান কালে বাংলাদেশের মাদ্রাসা নারীর অগ্রগতিকে আটকে তাদের বন্দি করে রাখতে চায়। অথচ নবিজির প্রথম স্ত্রী ছিলেন তৎকালের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীদের একজন। ভারতে আগের মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল সে যুগের তুলনায় খুবই আধুনিক। বাংলার রামমোহন রায় তৎকালে মাদ্রাসার পড়াশুনা করেছেন। তার রচিত প্রথম গ্রন্থটি আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা।