একশো বছর আগের স্পেনিশ ফ্লু আর বর্তমানের করোনা ভাইরাস
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : জুন ০৬, ২০২০
বিল গেটসর দুই হাজার পনেরো সালে বলেছিলেন ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণের কথা। তার আরো আগে দু’হাজার সাত-আট সালের দিকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ একই কথা বলেছেন ভাইরাসের আক্রমণ সম্পর্কে। তিনিও বলেছেন, সামনের দিনে বিরাট বিপদ আসবে ভাইরাসের আক্রমণ দ্বারা। কিন্তু তিনি সতর্ক করে দিলে নিজে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি। শক্তিমান দেশগুলি যারা করোনার আগমন সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করেছিল, আক্রমণের আগেই তাদের দায়িত্ব ছিল এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নেয়া। ধনী এই দেশগুলি স্পেনিস ফ্লু সম্পর্কে যথেষ্ট ভালো করেই জানতো। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ মানে পঞ্চাশ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এই ভাইরাস দ্বারা। তখন মারা গিয়েছিল দুই থেকে পাঁচকোটি মানুষ। অনেকে ধারণা করেন, মৃতের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। সুনির্দিষ্টভাবে ঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব নয় এ কারণে যে, তখন হাসপাতালের নথিপত্র রক্ষার ব্যবস্থা সেরকম ছিল না। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষদিকে উনিশশো আঠারো সালে এই ভাইরাসের আক্রমণ ঘটে আর প্রথম মহাযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, স্পেনিশ ফ্লুতে মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ।
প্রথম মহাযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ধরা হয় এক কোটি সত্তর লক্ষ। প্রায় দেড় বছর ধরে ‘স্পেনিশ ফ্লু’ নামের এই ভাইরাসের সংক্রমণ চলে। যুক্তরাষ্ট্রেই সেবার ছয় লক্ষ পঁচাত্তর হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। জানা যায় যে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন তখন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যখন যুদ্ধ শেষে ভার্সাই চুক্তির আলোচনা চলছিল। সেই দিনগুলিতেও এর সামান্য চিকিৎসা ছিল না, ঠিক তখনো সকলকে মাস্ক পরে থাকতে বলা হয়েছিল। সে সময়ে দোকানপাট, হাটবাজার, সিনেমা হল, গির্জা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ ছিল। শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে তখন প্রধানত এটা সংক্রামিত করতো। ঠিক একইভাবে মানুষ হাত দ্বারা কিছু স্পর্শ করলে আর তার সেই হাত চোখ-মুখ নাক স্পর্শ করলে স্পেনিশ ফ্লুর ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হতে পারতো। সেই সময়ে ভাইরাসটি অধিক বিপজ্জনক ছিল ডায়াবেটিক রোগী, হৃদরোগী আর শ্বাসতন্ত্রের রোগীদের ক্ষেত্রে। বর্তমান করোনা ভাইরাসের সঙ্গে এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া যাবে স্পেনিশ ফ্লু ভাইরাসের।
যদিও এটাকে স্পেনিস ফ্লু বলা হয়ে থাকে, কিন্তু তার উৎপত্তি স্থল স্পেন ছিল না। প্রথম মহাযুদ্ধে য্দ্ধুরত দেশগুলির মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে এবং বহুজন আক্রান্ত হয়। কিন্তু যুদ্ধরত দেশের শাসকরা মনে করলো, এ খবর প্রচার হয়ে পড়লে একটা আতঙ্ক দেখা দেবে এবং যুদ্ধরত দেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেজন্য তারা এ সংবাদ প্রচারের উপর কড়াকড়ি নিষেধ আরোপ করে। প্রথম মহাযুদ্ধে স্পেন নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল, ফলে তার সংবাদ মাধ্যমের উপর তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সেখানে রোগটি দেখা দিলে পত্রিকায় খবর হয়। মাদ্রিদের পত্রিকায় এ খবরটি প্রথম ছাপা হলে, এই রোগ স্পেনিশ ফ্লু হিসেবে প্রচার পেয়ে যায়। কিন্তু পরে স্পেন মনে করতে শুরু করে ভাইরাসটির প্রথম উৎপত্তি স্থল হচ্ছে ফ্রান্স, ফলে সেটাকে ‘ফ্রেন্স ফ্লু’ নামকরণ করে স্পেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়ে কেউ বলতে পারেনি ভাইরাসটির উৎপত্তি স্থল কোনটি; ফ্রান্স, চীন, ব্রিটেন নাকি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু স্পেন যে নয়, এ ব্যাপারে সকলে নিশ্চিত। কারণ তার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগ সনাক্ত করা হয়। প্রথম রোগী সনাক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে সামরিক বাহিনীর মধ্যে উনিশশো আঠারো সালের এগারই মার্চ।
বহুজন মনে করতে শুরু করে, সৈনিকরা এই রোগ ছড়িয়ে ছিল। কারণ প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেত। যুদ্ধের কারণে তখন সৈন্যদের একসঙ্গে চলতে হতো, ফলে এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট সেনাবাহিনী এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে যে বিধ্বস্ত ইউরোপে যে রকম অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল সে প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র বহুদেশকে ঋণ প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্র তখন পৃথিবীর সর্বশক্তিমান দেশ। ইউরোপের দেশগুলি যুদ্ধশেষের নানা বিপর্যয়ে এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষি ছিল। ফলে যা ‘স্পেনিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত সে রোগটি যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরম্ভ হয়েছিল ইউরোপের পক্ষে কণ্ঠ উঁচু করে সে-কথা বলার সুযোগ ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত রোগটির নাম ‘স্পেনিশ ফ্লু’ হয়েই রইলো। স্পেন দায়ী না হলেও দোষ তার ঘাড়েই পড়লো ঘটনাচক্রে।
যখন এই ভাইরাস বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ মানুষকে আক্রান্ত করে তখনো এর কোনো চিকিৎসা ছিল না। মহাযুদ্ধের কারণে তখন বিভিন্ন দেশে প্রচুর চিকিৎসক মারা গিয়েছিল। যুদ্ধের কারণে বহু হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছিল। খুবই ভয়াবহ বিভৎস সময় পার করছিল মানুষ। ফলে বিভিন্ন ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নতুন করে হাসপাতাল বানানো হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগীদের দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়। ভিন্ন দিকে “কোয়ারেন্টাইন” ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছিল। চার্চিল নিজেও এ সময়ে “কোয়ারেন্টাইন” এ ছিলেন। রাস্তায় কেউ থুথু ফেললে রোগ ছড়াতে পারে সে বিবেচনায় রাস্তায় কেউ থুতু ফেললে জরিমানা করা হতো। যদিও অষুধ ছিল না, কিন্তু বায়ার কোম্পানির ‘অ্যসপিরিন’কে তখন অসুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রেই প্রথম এটা ব্যবহার শুরু হয়েছিল, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর সার্জন জেনারেল এবং ‘জর্নাল অফ দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ এই অষুধটা ব্যবহারের পক্ষে কথা বলে। তাদের পরামর্শ ছিল প্রতিদিন রোগীকে ত্রিশ গ্রাম অ্যাসপিরিন দিতে হবে।
পরবর্তীকালে এটাকে অতিরিক্ত ডোজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে তখন প্রচুর রোগীর মৃত্যু হয়েছিল আসপিরিনের বিষক্রিয়ায়। যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা ফিরে এলে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহভাবে স্পেনিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া তখন গা করেনি এই রোগটিকে নিয়ে। সেখানকার জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের মতোই বলেছিল, এটা একটা সাধারণ জ্বর বা ফ্লু। ফলে সেপ্টেম্বরের আটাশ তারিখে যুদ্ধ শেষে শহরের বিজয় প্যারেড দেখতে দশ হাজার লোক যোগদান করে আর তা ভয়াবহ রকমভাবে রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
সেই ঘটনার দশ দিনের মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং দুলাখ মানুষ সংক্রামিত হয়। ফিলডিলফিয়ার তখনি সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তী বছরের মার্চের মধ্যে ফিলডেলফিয়ায় পনরো হাজার মানুষ এই রোগে মারা গিয়েছিল। বহুরকম বিপর্যয় ঘটিয়ে, বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়ে বিশ্বব্যাপী উনিশশো উনিশ সালের গ্রীষ্মকালে স্পেনিশ ফ্লুর সংক্রমণ বন্ধ হয়। প্রাকৃতিকভাবেই তা ঘটেছিল, চিকিৎসার দ্বারা নয়। হয় মানুষ ততদিনে আক্রান্ত হয়ে মৃতুবরণ করেছিল না হলে শরীরে ততদিনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু স্পেনিশ ফ্লুর প্রতিষেধক ভেকসিন আবিষ্কৃত হয়েছিল উনিশশো চল্লিশ সালে। স্পেনিশ ফ্লুর ভয়াবহ আক্রমণে মানুষ কোনো অষুধ এবং কোনো “ভেকসিন” ছাড়াই পৃথিবীতে টিকে রইলো অনেক মর্মান্তিক ঘটনার ভিতর দিয়ে। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ আর ঠিক তার সমসাময়িক এই মহামারিকে ঘিরে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বিরাট অর্থনেতিক বিপর্যয় দেখা দেয়নি।
নিঃসন্দেহে যুদ্ধ শেষে খাদ্যসঙ্কট ছিল বিভিন্ন দেশে। যুদ্ধশেষে জার্মানিতে দেখা গিয়েছিল মুদ্র বিপর্যয় আর ভয়াবহ বেকারত্ব। সত্তর লক্ষ মানুষ কর্মহীন ছিল। কিন্তু মহাযুদ্ধের দশ বছর পর মহামন্দা নেমে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। ঠিক তার দশ বছর পর আরম্ভ হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি আর তা চলমান সময়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ আর স্পেনিশ ফ্লু ধ্বংস করতে পারেনি সেভাবে পাশ্চাত্যের অর্থনীতিকে, ঠিক বিশ বছরের মাথায় তাহলে মানুষ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে নিশ্চয় আর একটি যুদ্ধ আরম্ভ করতে পারতো না। যুদ্ধে যেমন ব্যয় হয়, ঠিক সেভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ও হয় ধনীদের। বিশ্বের সকল মানুষের মনে হয়, স্পেনিশ ফ্লুর ঘটনা থেকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে।