একটি রাজনৈতিক গল্প
নভেরা হোসেনপ্রকাশিত : জুলাই ২৪, ২০১৯
ঠিক একটা বেজে কুড়ি মিনিটে বোমাটা ফাটবে পানশালায়।
এখন মাত্র একটা ষোলো।
এখনো সময় আছে কারো কারো ভেতরে যাবার,
অথবা বাইরে আসার।
সন্ত্রাসী তিনি তাকিয়ে দেখেন, ভিস্লাভা শিমবরস্কা
দিনটি ছিল দুই হাজার চার সালের চতুর্থ মাসের নবম দিবস। আমাদের জানামতে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে এরকম সংখ্যার তারিখ পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। সম্ভব নয়। গেরুয়া বর্ণের রোদোজ্জ্বল এমন একটি রাজনৈতিক দিন কখনো আমাদের জীবনে এসে দেখা দেয়নি। ভবিষ্যতেও হয়তো দেখা দেবে না। বলশেভিক বিপ্লবের শীতপ্রাসাদ দখলের ঘটনা পৃথিবীতে একবারই ঘটেছে। মাওসেতুং এর লাল ঝাণ্ডাও ক্রমাগত ঝলসে ওঠে না। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসকল তাদের ধারালো ছুরির ফলায় তরমুজের ফালির মতো চাক চাক করে কেটে ফেলে অখণ্ড দিনগুলোকে।
নির্ধারিত দিনটিতে আর্মেনিয়ান ভাস্কর্য শোভিত সবুজ চত্বরটি সকাল হতেই গমগম করতে লাগল কমরেডদের পদভারে। প্রাক্তন কমরেডরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে এসেছে সম্মেলন প্রাঙ্গণে। সেখানে কচিকাঁচা কমরেডরা ঢাল-তলোয়ার উঁচিয়ে তাদের সম্ভাষণ জানায়। তরুণ কমরেডদের দেয়া রাজসিক সম্মানে পুরোনো যোদ্ধারা বুকের ভেতরে যেন কাস্পিয়ান সাগরের কলতান শুনতে পায়। তাদের চুপসে যাওয়া হৃদয় বাতাস পেয়ে সস্তা বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে ওঠে। ক্রমশ রোদের তেজ বাড়তে থাকলে সকলে ঘন হয়ে বসে।
তাদের পরস্পরের মাঝে হাত রাখার মতো কোনো স্থান অবশিষ্ট থাকে না। অতঃপর শুরু হয় নেতার ভাষণ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম নয়, এবারের সংগ্রাম বিপ্লবের লাল সুতোয় বাঁধা পড়বার সংগ্রাম। বক্তৃতাও সে মতে শাখা বিস্তার করে। তার ডালপালা সবুজাভ প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে আশ্রয় খোঁজে অর্থশাস্ত্রের জটিলতায়। বৃদ্ধ কমরেডরা চৈত্রের দাবদাহে বক্তৃতা শুনতে শুনতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়লে শিশু কমরেডরা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। এসময় নেতাজী মুখে তুবড়ি ছোটান। কমরেডরা কান খাড়া করে নেতার পুরোনো কথাগুলোই গোগ্রাসে গিলতে থাকে।
নেতাজীও রং না চড়িয়েই মুখস্থ কবিতার মতো আওড়ান ইস্তাহারের বিধিমালা। ফাঁকা ঘরে বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলো চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এসময় কমরেডদের অনেকে বদ্ধ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে পালাবার পথ খুঁজে বেড়ায়, কারো কারো দুই হাঁটু বেজে চলে কত্থক নৃত্যের তালে। আর তাদের সহধর্মীরা হাই তুলতে থাকলে ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠে ঘরের বাতাস।
সকাল গড়িয়ে মধ্যাহ্ন সমাগত হলে বেজে ওঠে বিরতি ঘণ্টা। এসময় কমরেডরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাড়ার ঘরের সম্মুখে অপেক্ষা করতে থাকে। সেখানে বিশাল আয়তনের ভাণ্ডার-রক্ষক প্রত্যেকের হাতে গুঁজে দেয় একটি করে বিরিয়ানির প্যাকেট আর বিশুদ্ধ মিনারেল ওয়াটারের বোতল। সেদিনের সেই বিশেষ মুহূর্তে পুরোনো কমরেডরা নেতার মর্মস্পর্শী বক্তৃতা শুনে এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে, যে বাসি বিরিয়ানিও তাদের কাছে অমৃতের মতো সুস্বাদু লাগে। সেদিনের ঘটনার ঐতিহাসিক গুরুত্বর কথা হৃদয়াঙ্গম করতে পেরে দু’চারজন কমরেডের বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলার দশা হয়।
তারা ভুলে যায় যে, সেদিনকার ঐতিহাসিক মিলন মুহূর্তটিও একসময়ে শেষ হয়ে যাবে। প্রত্যুষে জেগে উঠবে চিরচেনা অংশুমান যার রং টকটকে লাল নয়।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার বাতি জ্বলতে শুরু করলে বর্ষীয়ান নেতা দীর্ঘ বক্তৃতা শেষে মঞ্চ ত্যাগ করেন। নেতাজীর নির্গমনকালে বদ্ধ ঘরটিতে গুমোট একটা হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে নতুন ও পুরাতন কমরেডরা প্রাঙ্গণ ছাড়তে থাকে। ওই সময় তাদের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। বিরিয়ানি, প্রিয় নেতার ইন্দ্রজাল, অতিথিদের শরীরের উত্তাপ কমরেডদের ক্লান্ত করে তোলে। তারা ওইদিন এতটাই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, যে বাড়ির পথ চিনতেও তাদের ভুল হয়ে যায়। পুরোনো কমরেডরা অনেকেই পরদিন ভুল করে পার্টি অফিসে গিয়ে উপস্থিত হয়। তখনও তাদের বুক পকেটে শোভা পাচ্ছিল লাল পতাকা-খচিত নেতার ফটোগ্রাফ।
কিন্তু ওই নির্মল ভোরে কাঠের তৈরি চেয়ার টেবিলগুলো ছাড়া আর কেউ, কোনো বিপ্লবী কমরেড সেখানে অপেক্ষায় ছিল না। এমনকী বিপ্লবের লাল ঝাণ্ডাটিও শোভা পাচ্ছিল না দেয়ালের গায়ে।