নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ ও নুহাশ

নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদ ও নুহাশ

একজন হুমায়ুন আহমেদ এবং তার সাথে অন্তর্গত কথোপকথন

নভেরা হোসনে

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২০

লেখালেখির জগতে মূলত দুধরনের সাহিত্যিক দেখা যায়। একশ্রেণি মানব মনের জটিল মনস্তত্বকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেন এবং সেক্ষেত্রে ভাষা একটা প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। ভাষার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। নতুন ধরনের জীবন দর্শন অথবা যা সাধারণের চোখ এড়িয়ে যায় তেমন সব বিষয় উঠে আসে ভাষার নানারকম প্রয়োগের মাধ্যমে। মাইকেল মধুসূদন বা জীবনানন্দ দাস, শহীদুল জহির, ফ্রান্জ কাফকা, আলবের কাম্যু, বর্তমানের মার্কেজ এরা সব পাঠকের মনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না বা পাঠকরাও অন্য স্বাদ খোঁজে। আরেক ধরনের লেখা চলতে থাকে খুব সহজ ভাষায়, উপস্থাপনা এখানে সরল, প্রতীক বা রূপকের ব্যবহার কম। এই ধরনেরর লেখক, কবিরা সহজে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে যান। হুমায়ূন আহমেদ এই দ্বিতীয় ঘরানার লেখক। তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে, থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ২০১২ সালে একটা লেখা লিখেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর। তাকে নিয়ে লিখতে দেখে আমার অনেক লেখক বন্ধুই আড়ালে হেসেছে বা আমার রুচি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমি লেখককে পড়ি, বিচার করি নিজের বোধ-বুদ্ধি দিয়ে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। একজন হুমায়ূন আহমেদ কেন এতটা পঠিত তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। তার মৃত্যুদিনে লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

২০১২ সালটা অনেক কারণেই আমার জন্য আনন্দদায়ক হয়নি। এখন চলছে নভেম্বর মাস। বছরের শেষ মাসে এসেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। এ বছরের মাঝামাঝি চলে গেলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ, অগাস্টে প্রিয় খালা সাকী, আর এই নভেম্বরে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের মাইজপাড়া আমার বাবার জন্মস্থান ত্রিভাগদী হতে বেশি দূরে নয়। ছোটবেলায় মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে অনেক যেতাম। নানাবাড়ির একটি বাড়ি পরেই সঞ্জয়, বিজয় মামাদের বাড়ি। বাড়ি না বলে বাসা বলাই ভলি। এরা হচ্ছে সুনীলের কবিতায় যে লস্কর বাড়ির ছেলেরা লাঠি লেবেঞ্চুস খায় সেই বাড়ির বর্তমার প্রজন্ম। তারা আজ নিঃস্ব, এমনকী তাদের পৈত্রিক ভিটা-বাড়িও হারাতে বসেছেন। লিখতে বসেছি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কিন্তু সুনীল প্রসঙ্গ এড়াতে পারছি না। শৈশবে হুমায়ূন আহমেদের গল্প, উপন্যাস যখন গোগ্রাসে পড়েছি ঠিক একই সমান্তরালে পড়েছি সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদার। এটা বাংলাদেশেন পাঠকদের একটা কমন চরিত্র। আশির দশকে স্কুলে পড়ার সময়টা বই পড়ার স্বর্নযুগ। একদিনে পারলে কয়েকটা বই শেষ করে ফেলেছি। রাতে না ঘুমিয়ে দরজা বন্ধ করে বই পড়েছি। মশারির ভেতর ছোট বোনের ঘুমের যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য মশারির উপর চাদর বিছিয়ে দিয়েছি আলো আড়াল করার জন্য। হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, ফেরা, অনন্ত নক্ষত্রবিথীসহ অসংখ্য উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে যে বইগুলো কখনোই ভুলে যাবার মতো নয়। বিশ-পঁচিশ বছর আগে পড়া বইয়ের কাহিনী, চরিত্র সব মাথায় গেঁথে আছে। ঐ সময়টায় রাত-দিন ভুলে হুমায়ূন আহমেদ পড়েছি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি একেকটি বই। প্রত্যেকটিই যেন ভিন্ন কোনো কথা বলতে চাইত, বলত।

সাহিত্যপ্রেমী তাদের কাছে বৈচিত্র্য একটা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। শুধৃ সাহিত্য পাঠ করার জন্য কেউ বই পড়ে না। সাহিত্য ভাল না লাগলেও সাহিত্যের ছাত্রদের যা করতে হয় সাধারণ পাঠকের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে না। তারা একজন কবি বা লেখকের লেখার প্রতি তখনই আকৃষ্ট হন যখন সে সাহিত্য পড়ে পাঠকের মনে ভাল লাগার জন্ম নেয়, নতুন কোনো চিন্তা বা জীবনবোধের দেখা পায় পাঠক। যে লেখক, কবি বা শিল্পীর নতুন কিছু দেবার সামর্থ্য আছে তিনি সমকালীন থেকে কালোত্তীর্ন হয়ে ওঠেন, পঠিত হন বার বার, পাঠকের মনে এক পরাবাস্তব স্বপ্ন বুনে দেন যা পাঠককে নিয়ে যায় অনেকদূর পর্যন্ত। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় এই বৈশিষ্ট্য প্রকট। স্কুল ছেড়ে নব্বইয়ের শেষের দিকে কলেজে যাবার সময়টাতে নানা দেশের ক্লাসিক সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটতে থাকে। চেখভের গল্প পড়ার পর সব লেখাকেই জলো মনে হতে থাকে। আর ফ্রানজ কাফকার মেটামরফসিস, কাম্যুর আউটসাইডার, তলস্তয়ের রেজারেকশন, আনা কারেনিনা মনের ক্ষুধাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের ভূতও তখন ঘাড়ে চেপে বসেছে। সুবিমল মিশ্রর ভাইটো পাঠার ইসটু পড়ে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। সেই সময় হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে কিছুটা দূরে সরে পড়ি। হুমায়ুন আহমেদ তখন দুহাতে লিখতে শুরু করেছেন। হিমু, মিসির আলী চরিত্র হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তবে পাশাপাশি তিনি আরও অসংখ্য গল্প, উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন যা তার পুর্বের লেখা থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে নিলো অনেকটা। অনেক লেখা স্বস্তা সাহিত্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করল। জলের মতো লিখে গেলেন তিনি। এটা তার লেখার একটা পর্যায়। মেধাবী লেখক, কবিরাও বহু লেখা লিখে থাকেন যা পড়লে পাঠকরা ছি ছি করে উঠবে।

এক্ষেত্রে আসে লেখকের নিজের লেখা বাছাই, পরিমার্জনা, বিরতির বিষয়টি। অনেক লেখকই নিজের সব লেখা ছাপতে দেন না বা সম্পাদনা করে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদ যা লিখেছেন তার বেশিরভাগ লেখা বা পুরাটাই ছেপেছেন। প্রকাশক, সাহিত্য সম্পাদক, পাঠকরা তাঁর ঘরের দরজায় অপেক্ষা করেছেন। হয়তো এদের পিড়াপিড়িতে তিনি এই কাজটি করতেন, অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি প্রকাশক, সম্পাদক, লেখকদের সন্তষ্ট করেছেন। এক রাতের মধ্যে লেখা শেষ করে সকালে প্রকাশকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর ক্লাসিক বইয়ের সংখ্যা কমেছে, এক ধরনের হাল্কা মেজাজের লেখার সংখ্যা বেড়ে গেছে। হিমু চরিত্রটি যে সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল তা একসময় ভাড়ামিতে পূর্ণ হয়ে যায়। পাঠক হিসেবে একজন লেখকের লেখা নিয়ে যা মনে আসে তা লিখতে পারাটাও জরুরি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হুমায়ুন আহমেদের যে বইগুলো সস্তা, জনপ্রিয় বলে সমালোচিত হয়েছে বা হচ্ছে সে বইগুলোর পাঠকপ্রিয়তা বাংলাদেশের সকল লেখকের জন্য বিব্রতকর। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম হুমায়ূন আহমেদ এবং তার লেখাকে আইকন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জনপ্রিয় সাহিত্যকে যতই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হোক না কেন এই সাহিত্যে গণমানুষের কোনো না কোনো আকাঙ্খা পুরণ হয়ে থাকে। হয়তো পাঠক কখনো বাস্তবতা হতে অবাস্তবতা বা পরাবাস্তবতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা ঘটে থাকে তখনই যখন পাঠক রিয়েলিস্টিক সাহিত্য বা সিরিয়াসধর্মী সাহিত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না, তার সে পাঠ-অভ্যাস তৈরি হয় না অথবা সিরিয়াস সাহিত্য পড়তে পড়তে তার মধ্যে ভিন্ন ধরনের কিছু পড়ার, জানার ইচ্ছে তৈরি হয়। আবার কু-রুচি বা সস্তা রুচি বলেও একটা বিষয় রয়েছে যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাঠক বা দর্শকের মনে। এছাড়া আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ সমাজের প্রেক্ষিত, অর্থাৎ যে সমাজের প্রেক্ষিত যেমন সেখানকার লেখক, কবি, শিল্পীরা সেই প্রেক্ষিত বা কনটেক্সটের চাহিদা পূরণ করে থাকে বা সেই কনটেক্সটে লিখে থাকে। যেমন ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল সোভিয়েত সমাজের প্রেক্ষিতকে আশ্রয় করে। তবে যত যাই হোক হুমায়ুন আহমেদ প্রায় সব ধরনের, সব বয়সের পাঠকের হৃদয়ে দীর্ঘ বা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অবস্থার করেছেন।

হুমায়ূন আহমেদের শক্তি তিনি নতুন গদ্য ভাষা নির্মাণ করেছেন। ছোট ছোট ডায়লগের মাধ্যমে একটা সময়কালকে এঁকেছেন, শক্ত বুননের চরিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি গদ্য ভাষার নতুন নতুন ব্যবহার করেছেন যা অনেককে তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলেছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখার বিষয় নির্বাচনেও মেধার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। ইতিহাস, মিথ, বিজ্ঞান, যাদুবিদ্যা, কসমোলজি, মনস্তত্ত্ব অনেক কিছুই হুমায়ুনের লেখার বিষয়। মিসির আলী সিরিজে তিনি মানুষ ও প্রকৃতির অজানা, রহস্যপূর্ণ দিক নিয়ে ডিটেইলসে কাজ করেছেন। যেখানে বিজ্ঞানের ব্যাখ্য পাওয়া যায় না প্রকৃতির সেই অধ্যায় নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। অন্য ভূবন উপন্যাসটিতে তিন্নি চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে তিনি জগতের রহস্যময়, অজানা শক্তিকে দেখাতে চেয়েছেন। যে শক্তি সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তিন্নি তার ক্ষমতা দিয়ে মিসির আলীর মতো রহস্য উদঘাটনকারীকে চমকে দিয়েছে। দেবীও তার একটি অসাধারণ কাজ। হুমায়ূনের গল্প উপন্যাসের আরেকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সমাজে যারা শোষিত, বঞ্চিত সেই মানুষগুলো এবং শাসকের মনস্তত্ত্ব, সামাজিক প্রেক্ষপটকে তিনি নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন। তার লেখায় প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর জীবনের খুঁটিনাটি, চাওয়া-পাওয়া, প্রতিবাদ, সংগ্রামের বিষয়টি বাস্তবিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বিপরীতভাবে শাসক, মালিক শ্রেণীর নিষ্ঠুরতার দিকটিও এসেছে। একজন মানুষ কেন অপরাধ করে, কীভাবে ধীরে ধীরে সে অপরাধীর মনস্তত্ত্বকে নিজের মধ্যে ধারন করেন হুমায়ূন এই বিষয়টি নিয়ে ডিটেইলসে কাজ করেছেন।

চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন নাটকে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, ঘেটুপুত্র কমলা বাংলা চলচ্চিত্রে হুমায়ুনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মধ্যবিত্ত দর্শককে অনেকদিন পর তিনি হলে ফিরিয়ে এনেছেন। টেলিভিশন নাটকেও অসাধারণ কাজ করেছেন। সকাল সন্ধ্যা, বহুব্রীহি, অয়োময়সহ অসংখ্য নাটকে তিনি দর্শকের মনে গভীর দাগ কেটেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শকরা সকাল সন্ধ্যার টুনি চরিত্রটিকে কখনো ভুলতে পারবে না। টুনির মৃত্যুতে সকলেই মনে গভীর দুঃখবোধ অনুভব করেছেন। অয়োময় নাটকের জমিদার,তার দুই স্ত্রী, মায়ের চরিত্র, কাশেমের চরিত্র অত্যন্ত বলিষ্ঠ। নিমফুল নাটকের নান্দাইলের ইউনুস এবং খেঁজুর কাটা দিয়ে তার চোখ উপরে ফেলার উপাখ্যান বাংলা নাটকের সম্পদ হয়ে থাকবে। তিনি একই নাটকে বা গল্প, উপন্যাসে নৃশংস, হিংস্র মানুষকে যেমনভারে এঁকেছেন ঠিক বিপরীতভাবে কোমল, আবেগী, মানবতাবাদী চরিত্রকেও ঠিক একইভাবে এঁকেছেন। হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই নাটকটি এতোটাই দর্শককে আন্দোলিত করেছিল যে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হলে তার মুক্তির জন্য মিছিল বের হয়। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশীদের চিন্তা করা যায় না। সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সকলক্ষেত্রে স্বাধীনতার চেতনার বিস্ফোরন ঘটেছিল ৭১ সালে।

হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তিগত জীবনে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি খুব স্পর্শকাতরভাবে এসেছে। আগুনের পরশমনি , ১৯৭১, জোৎস্না ও জননীর গল্পসহ বহু লেখায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার নির্মম বাস্তবতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আগুনের পরশমনি উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। ঐতিহাসিক পটভূমিকায় লেখা বা ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে লেখায় হুমায়ূন আহমেদ সিদ্ধহস্ত। বিশেষ করে তার বাদশা নামদার উপন্যাসটি মোগল সম্রাট হুমায়ূনকে কেন্দ্র করে লেখা যা বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সংযোজন। প্যারানরমাল সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রি,ভূত-প্রেত হুমায়ূনের লেখার একটি বড় জায়গা দখল করে আছে। মিসির আলী সিরিজ ছাড়াও আরও অসংখ্য গল্প, উপন্যাসে তিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন, যা হুমায়ূন আহমেদকে একটি স্বতন্ত্র ধারার লেখক হিসেবে সাহিত্য জগতে পরিচিত করে তুলেছে। লীলাবতী তাঁর একটি অসাধারণ কাজ। ভীনগ্রহবাসীদের নিয়েও তাঁর লেখা রয়েছে। অঁহক বইটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি বিজ্ঞানের সাথে ফিকশনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তার লেখায় মহাকাশে অন্য প্রাণীর উপস্থিতির বিষয়টি এসেছে।
অঁহক নামের এক সম্প্রদায় মহাকাশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী যারা পৃথিবীর মানুষের মাথায় ঢুকে পড়তে পারে, মানুষকে দিয়ে জটিল জটিল অঙ্ক করিয়ে নেয়, এক সময়ে সেই মানুষটিকে মেরে নিজেদের দলের সদস্য করে নেয়। অঁহকের মতো হুমায়ূন আহমেদের আরও অসংখ্য সায়েন্স ফিকশন আছে যা বিশ্বমানের। এই সায়েন্স ফিকশনগুলো একই সাথে পাঠকের কাছে জনপ্রিয় এবং বোদ্ধা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তাঁর ভাই লেখক জাফর ইকবালের লেখা। তিনি কল্প-বিজ্ঞান নিয়ে বাংলা ভাষায় যে ধরনের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তা ব্যতিক্রমধর্মী এবং সৃজনশীল কাজ। হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন এবং এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি ডিগ্রিও নিয়েছেন। বিজ্ঞান তাঁর নখদর্পনে। এছাড়া সারা বিশ্বের নানা কল্প-কাহিনী সম্পর্কে তাঁর অনেক পড়াশোনা আছে। যে কারণে লেখায় তিনি বিজ্ঞান ও মিথের অপূর্ব সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ পড়ালেখা ও ভ্রমণসূত্রে অনেক দেশে গিয়েছেন যা তার লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। অত্যন্ত সংবেদনশীলতার জন্য তিনি যে কোনো স্থানে কাজ বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গেলেও সে দেশ বা স্থানের সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা, তাদের অকথিত কাহিনীগুলোকে নিজের লেখায় স্থান দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের পায়ের তলায় খড়ম বইয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইস্তাম্বুলের মিউজিয়ামে অটোমান সম্রাটদের হেরেমখানায় হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন হেরেমখানার মেয়েদের কান্নার শব্দ শোনার জন্য। হুমায়ূন আহমেদ যে কোনো সংস্কৃতির মানবিক বিষয়গুলোকে নিয়ে কাজ করেন বা এই বিষয়গুলো তাকে বেশি আকৃষ্ট করে।

হুমায়ূন আহমেদ তার লেখার জন্য যতটা প্রশংসা কুড়িয়েছেন ততটাই সমালোচিত হয়েছেন। তার সাহিত্য এবং অন্যান্য কাজ নিয়ে অল্প কথায় বলতে গেলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যা কাম্য নয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সাহিত্য ও নাটক, সিনেমার কাজে এতোটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশাটি ত্যাগ করেন। তিনি পুরোপুরি শিল্পে ম‎গ্ন হয়ে থাকতে চেয়েছেন অনেকটা ঋষির মতো আর ব্যক্তিগত জীবনে যা ভাল লেগেছে তাই করেছেন। কোনো সমালোচনাই তাঁকে নিজের ইচ্ছে মতো জীবনÑযাপন করা থেকে সরাতে পারেনি। যখন ইচ্ছে হয়েছে বন্ধুদের নিয়ে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছেন অথবা জোৎস্না স্নান করেছেন অথবা বেড়িয়ে পড়েছেন হাওরের দেশের গান শোনার জন্য।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক