প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
এক গল্পের দুই ভার্সন
মেহেদি হাসানপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮
এক গল্পের দুই ভার্সন। একটা হচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ইন্টার্নির ভার্সন। এর ভার্সনে সে বলেছে, ডিউটিতে থাকা অবস্থায় নাকি তার সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষকের ধাক্কা লাগে। এ সময় সে ক্ষমা চাইতে বললে নাকি রাবি শিক্ষক তাকে `ফাক ইউ... ফাকিং গার্ল` বলে ইভটিজিং করেন। যার ফলে উনি বন্ধুবান্ধব ডেকে এনে শিক্ষককে হালকাপাতলা উত্তম-মাধ্যম দেন। এ পবিত্র কাজ সম্পাদনের জন্য `ইন্টার্নি পরিষদের` সভাপতির কাছে বিচারও দেন।
এবার গল্পের দ্বিতীয় ভার্সনে যাওয়া যাক। এ ভার্সন হলো প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষকের স্ত্রীর দেয়া ভার্সন। এখানে বলা হচ্ছে, হঠাৎ সমস্যা হওয়ায় শিক্ষকের মেয়েকে রামেকে ভর্তি করানো হয়। মেয়ের ওষুধের জন্য উনি যখন ছোটাছোটি করছেন তখন অসতর্কতায় ইন্টার্নি মেয়েটার সাথে ধাক্কা লাগে। এতে মেয়েটা নাকি বেশ ক্ষেপে যায়। এ সময়ে তর্কাতর্কিতে শিক্ষকের সময় নষ্ট হচ্ছিল, তাই শিক্ষক তাকে ইংরেজিতে বকা দেন। এই বকা দেয়ার সময় উনি কী বলেছেন, এ নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। শুরুর দিকে বলা হচ্ছিল, উনি নাকি `ননসেন্স` বলেছেন। পরে বলা হয়েছে, উনি নাকি `ফাক ইউ... ফাকিং গার্ল` বলেছেন। এরপর মেয়ে তার পরিষদের বন্ধুবান্ধব ডেকে এনে শিক্ষকে বেদম প্রহারের ব্যবস্থা করে, একথা আগেই বলা হয়েছে। শিক্ষককে বাঁচানোর জন্য ওয়ার্ডের নার্সরা তাকে একটা রুমে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দ্যায়। এতেও কাজ হয়নি। `ইন্টার্নি পরিষদের` দেশ সেবকেরা তালা ভেঙেই উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন ওই শিক্ষককে।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, মেয়েটার কথাই ঠিক। এখন প্রশ্ন হলো, তর্কের মুহূর্তে গালি দেয়াটা ইভ টিজিংয়ের মধ্যে পড়ে কীনা, তা বিবেচনা করে দেখা দরকার। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ নং ধারায় ইভ টিজিংয়ের কথা বলা আছে, Whoever, intending to insult the modesty of any woman, utters any word, makes any sound or gesture, or exhibits any object, intending that such word or sound shall be heard, or that such gesture or object shall be seen, by such woman, or intrudes upon the privacy of such woman, shall be punished with simple imprisonment for a term which may extend to one year, or with fine, or with both.
পাঠক, এখানে intending to insult the modesty of any woman ফ্রেইজটার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। শিক্ষক যদি তর্কের সময় সত্যিই `ফাক ইউ... ফাকিং গার্ল` বলে ঝগড়ার উদ্দেশ্যে না বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মেয়েটার শালীনতাবোধকে (modesty) অপমান করে থাকেন, তাহলে শিক্ষক অপরাধ করেছেন। এর শাস্তি কী? এর শাস্তি হলো সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই। এ শাস্তি কে দেবে? প্রমাণ সাপেক্ষে আদালত দেবে। এর শাস্তি কি কোনও পরিষদের নেতা ডেকে, তালা ভেঙে পিটিয়ে আহত করা? না, অবশ্যই নয়। এটা রাস্তায় হয়নি যে জনতা ধরে পিটুনি দিয়েছে। শিক্ষককে আহত করার জন্য প্ল্যান করে ফোন দেয়া হয়েছে, অন্যায় করার জন্য জমায়েত ঘটানো হয়েছে এবং অতি নৃশংসতার সাথে তাকে আঘাত করা হয়েছে তার ছোট বাচ্চা ও স্ত্রীর সামনে। হাসপাতালে আরও রোগী ছিল। তাদের এ্যাটেন্ডেন্টরা ছিল। এদের আতংকিত চেহারার সামনে নির্দয়ভাবে বয়স্ক একজন মানুষকে মারা হয়েছে। এ মানুষটাকে হয়তো মারতে মারতে মেরেই ফেলত, যদি না তাকে এসে উদ্ধার করা হতো।
শুধু এটা করেই ক্ষান্ত থাকা হয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্ধতভাবে আদালতে প্রমাণের আগেই একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে `ইভ টিজার` এর খেতাব দিয়ে উচিৎ শিক্ষা দেয়া হয়েছে বলে দম্ভ করা হয়েছে। হুকুমের আসামি মেয়েটাই এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এরপরে নানা পোস্টে সরকারি মেডিকেলে পড়ুয়াদের গৌরবগাথা, দেশে তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণহারে হেয় করে দেশের একমাত্র ভালো পেশা ও দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়ায় যত বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে, এর পিছনে কোনও দিন, কোনও যুগে কোনও ডাক্তার ছিল কীনা, সেই প্রশ্নটা এ সুযোগে সবার সামনে রেখে দিলাম। যে যে যার যার বিবেচনা দিয়ে উত্তর খুঁজে নেবেন। বিজ্ঞান ও টেকনোলজি থেকে দর্শন, সাহিত্য থেকে রাজনীতি, আইন থেকে শাসনের মতো বিষয়গুলো দিয়ে পৃথিবীকে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে নিয়েছে নাকি মেডিকেল কলেজ এগিয়ে নিয়েছে, এ প্রশ্নও থাকলো।
প্রথম ভার্সন অনুযায়ী, শিক্ষক যদি ইভ টিজিং করেই থাকেন, তাহলে মেয়েটা আইনের আশ্রয় নিতে পারত। `ইন্টার্নি পরিষদের` মানুষজন তাকে আটকে রেখেই পুলিশের হাতে দিতে পারত। একটা সরকারি হাসপাতালে পুলিশ, আনসার সবসময় থাকে। আইনের আশ্রয় নেয়া কিন্তু মোটেই কঠিন কিছু ছিল না। এরপরও উদ্দেশ্যমূলকভাবে, পরিকল্পনা করে, নৃশংসতার সাথে একজন রোগীর বাবার উপর হামলা করা হয়েছে। ইভ টিজিংয়ের মতো হাস্যকর অজুহাত কতখানি টেকে, নিজেরাই বিচার করে নেবেন। আর দ্বিতীয় ভার্সন যদি সত্যি হয়, তাহলেও অপরাধ কোন পর্যায়ের, হিসাব করে নেন এবার। আপনি গল্পের যে ভার্সনই বিশ্বাস করেন না কেন, ইন্টার্নিদের অপরাধ কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে একই হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আপনি হবু ডাক্তারদের এই আচরণ সাপোর্ট করেন কীনা। এরা চিকিৎসকের মতো সেবামূলক পেশায় থাকার যোগ্য কীনা, এটাও আপনাকে ভাবতে হবে। যারা শুরুতেই মানুষের উপর হায়েনার মতো হামলে পড়ে, তাদের দ্বারা দেশ ও দেশের মানুষ ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে কীনা, সেটাও ভাবতে হবে। এমনকি খোদ চিকিৎসকদেরও ভাবা উচিৎ এ ধরণের মানুষগুলো দিয়ে তাদের পেশা কলংকিত করা উচিৎ হবে কীনা। এ পেশা মানুষের সেবার পেশা, ধৈর্যের পেশা। এটা হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ার পেশা নয়। এ ধরণের মানুষদের এ পেশায় ঢোকার সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে এরা জীবন বাঁচানোর বদলে কত মায়ের কোল খালি করবে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।