এক কাপ চা

বৈতরণী হক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৮

সামনে এক্সাম বা অফিসিয়াল আ্যাসাইনমেন্টের ডেডলাইন মিট করতে হবে, তাই রাত জাগতে হচ্ছে। আপনার সঙ্গী কে? এক কাপ চা। অলস বিকেলে গল্পের বই নিয়ে বসেছেন বা সিনেমা দেখছেন, আপনার চাই সেই এক কাপ চা। সন্ধ্যার পর বন্ধুদের জমজমাট আড্ডায় আপনার হাতে এক কাপ চা না হলেই নয়, তাই নয় কি? আজকের গল্প সেই এক কাপ চা নিয়েই।

বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় চাবাগান থাকলেও সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় সর্বাধিক চাবাগান অবস্থিত। আর শ্রীমংগল উপজেলা হলো মৌলভীবাজারের অন্তর্গত। শ্রীমংগল বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী। সুন্দর, ছিমছাম আর পর্যটকবান্ধব একটা থানা শহর। ২০১৩ সালে শ্রীমংগল ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু জায়গার কয়েকটা চাবাগান ঘুরে আর চা শ্রমিকদের সাথে কথা বলে প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলাম আমার ডিগ্রি লাভের খাতিরে। তার ভিত্তিতেই আমার আজকের লেখা।

চাবাগানের শ্রমিকদের পূর্বপুরুষরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। বাংলাদেশের আদিবাসী হিসেবে তাদেরকে ধরা যেতে পারে। দেড়শো বছর ধরে তাদের বাস আমাদের দেশের মাটিতে। চাবাগানের পাতা তোলার কাজটা সব থেকে কঠিন, সেটাই নারীরা করে। পুরুষরা প্রসেসিং ইউনিটে কাজ করে, পোকামাকড় মারার বিষ স্প্রে করে বাগানে, গাছে ওষুধ ছিটায়। রোববার বাদে সবদিন দৈনিক আট ঘণ্টা করে নারীদেরকে কাজ করতে হয়। দুপুরে অল্প সময়ের জন্য বিরতি। এসব নারীদের খাদ্যতালিকা কি জানেন?

সকালে ছোট একটা বা দুটো শুকনো রুটি, দুপুরেও তাই। কখনো থাকে শুকনো হাফ বয়েল ভাত, যাকে তারা দানা বলে। রাতের বেলা তারা ভাত খায় আলুভর্তা বা ডাল দিয়ে। তলবের দিন মানে সাপ্তাহিক বেতন যেদিন পায় সেদিন তারা ডিম বা ছোটমাছ দিয়ে ভাত খায়। বিজয়া দশমি আর হোলি-বছরে- এ দু’দিন তাদের কপালে মাংস বা বড়মাছ জোটে। বাগান থেকে যে রেশন দেয়া হয় তা দিয়ে তাদের চলে না, তাই আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। পানির ব্যাপারেও তাদের হিসাব করতে হয়। বাগানগুলোতে দিনে দু’বার পানির সাপ্লাই দেয়া হয় এক বা দুই ঘণ্টার জন্যে। ত্রিশ-চল্লিশটা পরিবারের পানির লাইন একটা কলের পিছনে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর পানির জন্য লাইন, সে কী কষ্ট, নিজের চোখে দেখা। এরপর সেই পানি জোগাড় করে ঘরের কাজ করা। রাতে যে খুব আরামের ঘুম হয় তাদের, তা-ও নয়। একটা ছোট ঘরে গাদাগাদি করে ছয়-সাতজন থাকে। কখনোবা খারাপ আবহাওয়ার সময় গবাদি পশুদেরও একঘরে আশ্রয় হয়।

এসব বাগানের নারীদের মাঝে পড়ালেখার কোনও ছাপ পড়েনি। নিজের নামটা তারা লিখতে পারে না। যদিও এখন সরকার, এনজিও আর বাগান মালিকদের তরফ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। তবে সেটা খুব বলার মতো কিছু নয়। স্কুল ড্রপ আউটের সংখ্যা বেশি। কারণ মায়েরা কাজ করতে গেলে ছোট ভাইবোনদের দেখতে হয় সেই ড্রপ আউট বাচ্চাগুলোকে।

এবার আসি তাদের স্বাস্থ্যকথাতে। নারী শ্রমিকদের কাজ সবসময় এক জায়গায় হয় না। বাগানের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তাদের পাতা তুলতে হয় একেক সময়। Tea Garden Labour Ordinance 1962 সাল অনুযায়ী, যে এলাকায় একসাথে ২৫ জন নারী কাজ করে, সেখানকার অদূরে টয়লেট থাকার কথা। কিন্তু মালিক শ্রেণির মতে, আইনের এ নিয়মটার বাস্তবায়ন তেমন সহজ নয়। এদিকে শ্রমিকদের ভোগান্তি কিন্তু থেমে নেই। পাতা তোলার কাজে নারীরা নিয়োজিত থাকলেও তাদের কাজের তদারকি যারা করে তাদের বলে সুপারভাইজার বা সর্দার, তারা তো পুরুষ। লজ্জায় আট ঘণ্টা তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চায় না। এমনকি বড়গাছ বা ঝোপের আড়ালে গিয়েও। একটু ভেবে দেখবেন, যে নারীটি সন্তানসম্ভবা বা যার মাসিক চলছে, তার কেমন লাগে? মাথার উপরে কখনো সূর্য আবার কখনো বৃষ্টি নিয়ে তারা কাজ করে পিঠে এক ভারি বোঝা নিয়ে। দৈনিক তাদের মিনিমাম ২২ থেকে ২৩ কেজি পাতা তুলে জমা দিতে হয়। এরপরে যা কিছু তুলতে পারে, সেটা বাড়তি ধরা হয়। জীর্ণকায় শরীরের হাড়গুলোয় কত না আঘাত লাগে এই ভার বইতে!

লেখাপড়ার ছোঁয়া না থাকায় তারা কুসংস্কারচ্ছন্ন। আগে না থাকলেও এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কাঁচা টয়লেট আছে। তাও নারীরা ব্যবহার করে না। কারণ স্বামী শ্বশুড় দেবতাতূল্য। এক জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করলে তাদের অসম্মান করা হয়। তাই কী আর করা! টয়লেট সিনেমার মতো লোটা পার্টির সদস্য হয়েই সব কাজ সারতে হয় তাদের। কিন্তু এই দেবতাতূল্য মানুষগুলো যখন প্রতিরাতে মদ খেয়ে এসে বউ পিটায় তখন নারীরা নীরব থাকে। তলবের দিনই সব টাকা তুলে দেয় স্বামীকে। তাও স্বামীর শান্তি হয় না। এদের মধ্যে প্রতিবাদী নারী যে নেই তা নয়। তবে খুব কম।

আজকাল চা বাগানে বাংলাদেশের সমতল ভূমি থেকে মানুষরা গিয়ে কাজ করছে। যেমন ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা। তারা মূলত ম্যানেজারের বাংলোর কাজকর্ম বেশি করে। এমনি এক মহিলা আমাকে দুঃখ করে বলছিল, আমরা কাজ পাই না বলে এখানে আসছি। আবার ভালো কাজের সন্ধান পেলে চলেও যাব। এরা না বোঝে আমাদের কথা, না আছে বাগানের বাইরের কোনও ধারণা। ওদের দেখে আমার সত্যিই খুব দুঃখ লাগে। কথা সত্য। ১৯৭১ সালের পর তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিক মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তারা ভোট দেয়, তবে বেশিরভাগ সময় তাদের বলে দেয়া হয় কাকে ভোট দিতে হবে। এছাড়া আর কী করার! প্রার্থীদেরকেও তো তারা চেনে না। চাবাগানের কলোনির ভিতরগুলো এক অদ্ভুত জায়গা। লেবার লিডারদের সহযোগিতা না পেলে এসব মহিলাদের সাথে কথা বলাও সম্ভব নয়। ওরা কথা বলতেও ভয় পায়। এ এক স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিতরে এক পরাধীন দেশ বলে আমার মনে হয়েছে। আসলে ব্রিটিশ আমলে এত কিছু চিন্তা করে বা এত মানুষকে ভেবে তো বাগান করা হয়নি। ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপে বাগান মালিকদের ওসব ম্যানেজ করতে বেগ পেতে হয় বলে মালিক শ্রেণির দাবি। কিন্তু তাই কি?

আজকে আমাদের দেশে শুধু শহর নয়, গ্রামের মেয়েরাও এগিয়ে গিয়েছে। এটা গর্বের কথা। কিন্তু আমাদের দেশের একটা কোণায় কিছু নারী শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করে যুগের পর যুগ কাটাচ্ছে, মেনে নিয়েছে তাদের নিয়তি, নিজেদের ভাগ্যবান ভাবে শুকনো রুটি খেয়ে, একট ছোট ঘরে গাদাগাদি করে মাথা গুঁজতে পারে বলে। ওদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওরা দাস আর দাসদের নিজস্ব চিন্তা চেতনা বিবেচনা কি আর থাকতে আছে?