চিত্রকর্ম: মকবুল ফিদা হুসেন
এই মোম জোছনায়
মারিয়া সালামপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৬, ২০১৮
অপলার একটু শীত শীত লাগছে। শীত আসতে যদিও মাসখানেক লাগবে। কিন্তু এই পরিবেশের জন্য কীনা বুঝতে পারছে না, বেশ ঠাণ্ডা লাগছে তার। ও এখন যে বাড়ির ছাদটায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা নাকি প্রায় ১৩০ বছর পুরানো। বিশাল দোতলা বাড়ি, বড় বড় সব ঘর, বেশির ভাগই ব্যবহারের অযোগ্য। এখানে সেখানে সমানে পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। তবে এক কালে যে এই বাড়ির জৌলুস ছিল, সেটা বোঝা যাচ্ছে বেশ। অন্য সব পুরানো বাড়ির মতোই চার দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিশাল বিশাল ঘর আর সামনে মস্ত বারান্দা। মাঝ খানে অনেক বড় উঠান। বাড়ির মাঝখানে দুই দিক দিয়ে ইটের ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে একদম ছাদে। ছাদের রেলিং গুলোও ইটের গাঁথুনি, কোমর পর্যন্ত উঁচু। বাড়ির চারপাশ ঘিরে সারি সারি নারকেল গাছ সেই রেলিং টপকে মাথা বের করে দাঁড়িয়ে আছে।
অপলা এখন ছাদেই, ও দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির পেছনের দিকটায়। সেখান থেকে চোখ যতদূর যায় কেবল গাছ আর ঝোপঝাড়ের জঞ্জাল। বেশ কিছু দূর পরে একটা পুকুর। ডোবা বলা ভালো হবে বরং, এক কালে সেটা বিশাল ছিল হয়তোবা, ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটপাড় দেখে সেটা বোঝা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে কেবল, চাঁদের আলোতে পুকুরের পানি চকচক করছে। দারুণ রোম্যান্টিক দৃশ্য হতে পারতো এটা, কিন্তু...
অপলার মনে চাইছে সিগারেটে লম্বা কয়েকটা টান দিতে, কিন্তু সে সিগারেট একদম খায় না। আসলে ছেলেবেলায় বাবাকে দেখেছে টেনশন হলেই সিগারেট ধরাতে। সেই থেকে কোনো কারণে অস্থিরতা কাজ করলেই ওর এরকম লাগে। ট্রাউজারের পকেটে বাম হাত ঢুকিয়ে, ডান হাত দিয়ে সিগারেট টানার ভংগি করে, নিজেই হেসে ফেললো ও। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল একবার, কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাবে।
নিজের কথা ভেবেও ওর কিছুটা বিরক্ত লাগছে, এই অস্থিরতার কোনো মানে হয় না। কেন রেহান নামের ছেলেটা কে ভুলতে পারছে না, ওর নিজের মাথাতেই সেটা আসছে না। রেহানের সাথে ফেসবুকে পরিচয় এক বছর, তবে নিয়মিত কথা হচ্ছিল তিন মাস ধরে। সারাদিন ঘুরেফিরে টুকিটাকি রাজ্যের কথা, কখন যে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে, সেটা তার নিজেরও মনে নাই। ভালোই চলছিল সব, কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে রেহান একদম গায়েব। কথা নেই বার্তা নেই, ফোন বন্ধ, ফেসবুক একাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ। মিউচুয়াল বন্ধুদের কারো কাছেও কোনো ইনফরমেশন নেই। অথচ রেহান বলেছে আগামী বৃহস্পতিবার সে ককক্সবাজার যাবে বেড়াতে। অপলাও যেন চলে আসে ঠিক সময় ইস্টিশনে, একসাথে যাবে। তবে শর্ত হলো, কাউকেই জানানো যাবে না আসল ব্যপারটা। বাসায় অন্য কোনো বাহানা করে এসে পড়তে হবে। প্রথমে ব্যপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেও, অপলার খুব ইচ্ছে সে যাবে। আর বাসায় মিথ্যা বলেই যাবে, সত্য বললে যাওয়া হবে না, এটা একশ ভাগ নিশ্চিত।
কিন্তু রেহানের কোনো খোঁজ নেই। অপলা কী যাবে ইস্টিশনে না যাবে না, বুঝে উঠতে পারছে না। এতটা অসহায় অপলার আগে কোনোদিন লাগেনি, নিজেও অবাক হচ্ছে। সামান্য ফেসবুকে কথা, তার জন্য এতটা পাগল পাগল লাগবে, আগে বুঝেনি অপলা। আর্দ্র চোখে চারপাশটা আবার দেখে নিল। বেশ অন্ধকার নেমেছে আর বাতাসটাও বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়িঘরের দেয়াল হাতরে হাতরে নিচে নামতে লাগলো ও।
বেশ কিছু দূর নামতেই মোমবাতি হাতে লীনা এসে বাকি পথটা এগিয়ে নিচ্ছে। লীনা আর অপলা ইউনিভার্সিটির বন্ধু, একেবারে মানিকজোড়। অপলার মনটা খারাপ দেখে প্রায় জোর করে ওকে নিয়ে এসেছে নিজের সাথে। এই বাড়িটা লীনাদের পুরানো বাড়ি, ওরা উঠে গেছে শহরের কাছাকাছি নতুন আরেকটা বাড়িতে। তবে মাঝে মাঝে সবাই মিলে এখানে বেড়াতে আসে। এবার এসেছে ভূত চতুর্দশী পালন করতে।
লীনাদের যৌথ পরিবার। চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফু, নিজের ভাইবোন আর কাজিনদের নিয়ে হবে প্রায় ৪০ জন, সবাই কাজকর্ম ফেলে এসে পড়েছে ভূত চতুর্দশী পালন করতে। এরা এরকমই পাগলাটে সব, এই আধুনিক যুগে লোকে সত্যি সত্যি যে ভূতে বিশ্বাস করে, সেটা এদের না দেখলে বোঝার উপায় নেই। অপলারা এসেছে আজ দুপুরে, এর মধ্যে ছোট বড় মিলিয়ে দশটার মতো ভূতের গল্প শুনে ফেলেছে, আর তার সাথে হৈচৈ তো বোনাস! অনেকটা বিরক্ত হয়েই শেষে অসময়ে ছাদে উঠে এসে ছিল অপলা।
তোকে দিদা একবার ডেকেছে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল লীনা। কেন? আবার কি নতুন ভূতের গল্প মনে পড়েছে? অপলা একটু বিরক্ত হয়েই বলল। সে আমি কিভাবে বলি, গিয়েই দেখ। দিদার ঘরটা দোতলার সিড়ির পাশ ঘেষেই, ভেতরে মোমের আলোতে আসলেই ভূতুরে লাগছে পরিবেশটা। অপলা বুঝতে পারছে না, ইলেক্ট্রিসিটি থাকতেও উনি মোমবাতি জ্বালিয়ে কেন বসে আছে! আস বুবু, আস আস, লীনার দিদা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, শুনলাম তুমি নাকি পূবদিকের ঘরে উঠেছ? ঐ ঘরে ওরা খুব বিরক্ত করে সারা রাত, তুমি আর লীনা বরং আমার ঘরের পাশেরটায় এসে পর, কোনো ঝামেলা হলে আমি আছি।
কথাটার মাথামুন্ডু না বুঝে অপলা লীনাকে প্রশ্ন করলো, ওই ঘরে কারা বিরক্ত করবে? দিদাই উত্তরটা দিয়ে দিলেন, ওইসব খারাপ জিনিস বুবু, রাতে নাম মুখে আনতে নেই। অপলা হাসবে না বিরক্ত হবে নিজেই বুঝছে না। তবু হাসিহাসি মুখে বলল, দিদা ঐ ঘরটা থেকে পুকুরটা দেখা যায়, আমি ওটাতেই থাকবো। এটাইতো আসল সমস্যা, থাক তবে লীনা রাতে জানালাগুলা ভাল করে বন্ধ করে রাখবি, বাগানে কোনো শব্দ পেলেও ও গুলো খুলিস না, দিদা বিড়বিড় করে বলল কথা গুলো। অপলা নিজেও আর কথা বাড়াল না।
লীনাদের খাবার ঘরটা অনেক বড়, তবে খাবার টেবিল বলতে কিছু নাই, তার বদলে জলচৌকির মত নিচু কিন্তু বেশ বড় বড় চারটা চৌকি। সে গুলোর উপরে পাটি পেতে সবাই যে যার মতো বসেছে খেতে। তবে দিদার জন্য একটা ছোট টেবিল আর হাতলওয়ালা মস্ত একটা কাঠের চেয়ার রাখা হয়েছে ঘরের এক কোণে। খাবার সময়ও সমান তালে চলল ভূত, প্রেত, জ্বীন, রাক্ষস আর দৈত্যের গল্প। গল্প না বলে রিয়াল লাইফ টেল বললে বরং ভাল, কারণ ঘটনাগুলো নাকি সব বাস্তবে তাদের সাথে ঘটে গিয়েছে, তাও আবার এই বাড়িতেই।
বুঝেছ বুবু, আমি তখন নতুন বউ, পুকুরে নামলাম গোসল করতে। ডুব দিয়ে উঠবো ঠিক তখনই এক বিশাল দেও আমার পা চেপে একদম নিচে নিয়ে গেল। আমরা যেয়ে ধাক্কা খেলাম একটা কাঁচের দেয়ালে। কি সুন্দর নগরী দেয়ালের ওপাশে! আমরা ভেতর ঢুকতে যাব, অমনি ওপর থেকে জাল ফেলে আমাকে তুলে আনা হল, সাথে সেই দেও এসে গেল। সে আর আমাকে ছাড়ে না, দিন রাত জ্বালাতন, পেটের ভিতরে দুইটা বাচ্চা মেরে ফেললো। অনেক তাবিজ-কবজ করে তাকে তাড়ানো হল ঠিকই কিন্তু সুযোগ পেলেই এসে নানা অশান্তি করে যেত। এখনও সুযোগ পেলেই এসে নানা ভাবে জ্বালাতন করে।
শুধু আপনাকেই না আম্মা, ওইটা আমাকেও একবার ধরেছিল, সেঝ কাকা খাবার চিবাতে চিবাতে বলল। বুঝেছ মা, শীতের রাতে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছি। হঠাৎ, দেখি পুরা গা ঘামে ভিজে শেষ। ভাবলাম পুকুরে একটা ডুব মেরে আসি, তখন রাত ৩ টা। রাত ৩ টা কিন্তু সাংঘাতিক সময়, যাকে বলে সেটানিক আওয়ার, মানে যত ভূত, প্রেত, দৈত্য, রাক্ষস ঐ সময়টাতেই পাওয়ারফুল হয়ে উঠে, অপলার দিকে তাকিয়ে উনি কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। তো হলো কি, আমি পুকুরে নেমে গেলাম, দুটা ডুব দিয়ে উঠবো কি, দেখি এক বিশাল দেও পা চেপে পানির নীচে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার সাথে শক্তিতে পেরে উঠছে না কোনমতে। শুরু হলো ভীষণ লড়াই, আমার শক্তি শেষ, শরীর অসাড় হয়ে আসছে, এমন সময় চার দিকে আযান শুরু হলো, সে দেও তাড়াতাড়ি করে পাতালে নেমে গেল বলে রক্ষা। অপলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো সবার দিকে কিছুক্ষণ। কী অবলীলায় এরা এসব গল্প বলেই চলেছে!
লীনাও বেশ সিরিয়াসলি গল্পগুলো শুনে যাচ্ছে, অপলা কাকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওর মন এসব কোন কিছুতেই নেই এখন, কেবল রেহানের কথা ভেবে ভেবে মনটা উদাস হয়ে উঠছে। শোবার ঘরে ঢোকার পর থেকেই আরো গুমোট লাগছে চারপাশ। দরজা, জানালা সব বন্ধ, লাইটও জ্বালাতে মানা, লীনা বেশি আলোতে ঘুমাতে পারে না একদম। দম বন্ধ হয়ে আসছে অপলার, ভাবলো একবার ছাদে যেয়ে হাওয়া খেয়ে আসা যায়।
দরজা খুলে পেছনের বারান্দায় যেতেই পেল মেজ আর ছোট ফুফুকে। দুইজন ফিসফিসিয়ে কি গল্প করছে আল্লাহ জানে, হবে কোনো পেত্নীর গল্প, পেত্নীর সাথে কবে কার চুলাচুলি হয়েছে, কে জানে! অপলার দিকে চোখ যেতেই হাতের ইশারায় ডাক পরলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো ওর। এত রাতে এ বাড়িতে ভুলেও একা ঘুরাঘুরি করবা না, বিশেষ করে আজ রাতে, মেজ ফুফু গলা নামিয়ে বলল। যত দূর সম্ভব গলা নামিয়ে অপলাও জিজ্ঞেস করলো, আজ রাতে কি? ভূত চতুর্দশী কি আজ? আমি কি কাল শাড়ি বা কামিজ পরে আসবো? ভূতে দের প্রিয় রঙ কি? তুমি কি ইয়ার্কি মারছো আমাদের সাথে, মেজ ফুফুর গলায় সন্দেহ।
না না, আমি আসলে ভাব ছিলাম আজ রাতে কি, অপলা কোনো রকমে হাসি লুকিয়ে ফেলে। মনে মনে ভাবে, এক দিকে ভালই হয়েছে এসে, একটু হলেও হালকা লাগছে মনটা, যদিও প্রাইভেসির কোনো বালাই নেই এখানে। বললেন নাতো আজ রাতে কি?
প্রশ্ন শুনে দুই বোন চোখাচোখি করে, কয়টা সেকেন্ড যেন ভাবে দুইজন, তারপরে গলাটা আরো নিচে নামিয়ে ছোটফুফু বলে, আজ পারুল আসে আমাদের সাথে দেখা করতে। আমরা দুইজন যে সব কাজ ফেলে, অফিস ছুটি নিয়ে এখানে এসেছি, তার একটাই কারণ, পারুল আজ আমাদের না দেখলে খুব দুঃখ পায়। পারুল কে? আপনাদের বান্ধবী? উনি কি দূরে থাকেন? এত রাতে আসবেন কেন? অপলার প্রশ্নে চোখের পানি মুছতে মুছতে ছোটফুফু বলে, হুম আমাদের ছোট কালের বান্ধবী, কোথায় থাকে জানি না, কেন আসে জানি না, ওকে দেখলে আমাদের ভয় ভয় করে, কিন্তু ওর জন্য এত মায়া লাগে, আমরা আসি।
অপলা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, তবে ফুফুদের কান্না দেখে মনটা ভার হয়ে উঠে, নিজের কষ্ট, পরিবেশ, ফুফুদের কান্না সব মিলিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না ও। চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চার দিকে সাবধানে একবার দেখে নেয় ফুফুরা, তারপর দ্রুত অপলার চোখের পানি মুছে দিয়ে মেজ ফুফু বলে, কি বোকামি করে ফেললে মা, পারুলের জন্য চোখের পানি ফেললে? ও জেনে গেলে তোমাকেও যে বারবার এখানে টেনে আনবে!
মেজফুফু বলে চলে, আমাদের বয়স তখন ১০ কি ১২। আব্বা একদিন ভোর রাতে ঢাকা থেকে ফেরার পথে, বাগানে দেখে ১৪/১৫ বছরের একটা মেয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে কাঁদছে। কাছে যেতেই মেয়েটা রীতিমত চিৎকার শুরু করে, আব্বার কোনো কথাই শুনতে চায় না। বাধ্য হয়ে আব্বা বাড়ি এসে আম্মাকে আর বড় বুবুকে ডেকে নিয়ে যায় বাগানে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তারা মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। আমাদের ডাক পরে আম্মার ঘরে, আমরা চোখ ডলতে ডলতে আম্মার ঘরে যেয়ে দেখি, পারুল মেঝেতে বসে আছে, সারা শরীরে মারের দাগ, জামাকাপড় ছিড়ে বাজে অবস্থা আর পাজামাটাই রক্তের দাগ। আম্মা আমাদের বলে, যা তোদের একটা জামা এনে একে পড়তে দে আর সাথে করে গোসল খানায় নিয়ে যা। তোদের ঘরেই রাতে থাকবে ও।
পারুল গোঙাতে গোঙাতে গোসলখানা থেকে বার হয়। বার হয়েই আমাদের ধরে কাঁদতে থাকে, বাকি রাত টুকু আমরা আর ঘুমাতে পারি না। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, ওরে এমন পিটানিটা কে দিল, কেনই বা দিল, সে কেবল কাঁদে, নিজেও কিছু বলে না। তবে, সে রাতেই আমাদের খুব মিল হয়ে গেল। পরদিন বাড়িতে পুলিশ আসলো, আরো কিছু লোকজনকে আব্বা ডেকে আনলো। তারা সবাই পারুলকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছিল, আমাদের আম্মা ওই দিকে যেতে দিল না। তারপরে, তারেক ভাই মানে আমাদের মামাতো ভাই পারুলকে নিয়ে হাসপাতালেও গেল, আমরা এর কোনো কিছু বুঝে উঠি না। আম্মাকে বা বুবুকে বললে ধমক খাই আর পারুল খালি কাঁদে দেখে ওরে আর আমরা কিছু বলি না।
পারুল সারাদিন আমাদের দুইবোনের সাথে সাথে থাকে আর মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে ঐ পুকুরপাড়ে বসে তারেক ভাইয়ের সাথে গল্প করে, এই হাসেতো এই কাঁদে। একদিন গলায় কলসি বেঁধে সে দিল পুকুরে ঝাঁপ, তারেক ভাই কিভাবে বুঝতে পেরে কোনো রকমে টেনে ওঠালো। এরপর ক`দিন ভালো থেকে আবার একদিন দুপুরের দিকে বাগানে ঢুকে গলায় ফাঁস নিল। এলাকার ছেলেরা তখন বাগানে আড্ডা দিচ্ছিল বলে তাড়াতাড়ি ওকে নামিয়ে এনে বাড়িতে দিয়ে গেল। সে দিন মা ওকে বেশ ভালো একটা পিটুনি দিয়ে রাত অবধি ঘরে শেকল তুলে রাখলো। রাতে আব্বা বাড়িতে এসে সব শুনে, তারেক ভাইকে বলল, শোন তুই পারুলকে বিয়ে করবি, আগামী শুক্রবার রাতে বিয়ে, ওকে দেখে রাখবি। তারেক ভাই ঘাড় নেড়ে নিজের ঘরে চলে গেল, মুখে কিছু বললো না। তবে, আমাদের মহা আনন্দ, আম্মা আর বুবু এটা সেটা কিনে, আমরা রঙিন কাগজ কাটি। পারুল আর তারেক ভাই একদম চুপচাপ, তাদের পুকুর পাড়ের গল্পও বন্ধ হয়ে গেল। ভাইরা সবাই বাইরে থাকে, বাড়িতে পুরুষমানুষ বলতে আব্বা আর তারেক ভাই, বিয়ের সব কাজ তাদের করতে হচ্ছে, তারেক ভাই এর গল্প করার সময় কই?
একদমে কথা গুলো বলে মেজফুফু বাগানের দিকে বার কয়েক তাকিয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো, একটা বাজে, যাও মা ঘুমিয়ে পড়ো। অপলা এতক্ষণ এমন ভাবে গল্পে হারিয়ে গেছিল, সময়ের দিকে খেয়ালই করেনি। ওর ঘুম উবে গেছে, গল্পটা পুরাটা না শুনে উঠবে না ভাবলো মনে মনে। এবার ছোট ফুফু খেই ধরলো, এদিকে সব আয়োজন প্রায় শেষ, কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকেই তারেক ভাইকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। আব্বা সব দিকে লোক পাঠাল, তার কোন খবর নাই। বাড়িতে থমথমে এক অবস্থা! রাতে যে যার মতো ঘুমাতে গেলাম আমরা। সকালে জেগে দেখি, পারুলও বাড়িতে নাই। সারা বাগান খোঁজা হলো, পুকুরে জাল ফেলা হলো, পারুলের কোনো হদিস নাই। দুপুরের দিকে বাড়িতে পুলিশে এলো। তারা পারুলের লাশ এনেছে সাথে। পারুল রাতের ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়েছিল। পুরো শরীর দুইভাগ হয়ে গেছে। আমাদের আর লাশ দেখতে দেয়া হলো না। আমরা দুই বোন অনেক কাঁদলাম, তারপরে এক দিন ভুলেও গেলাম।
পারুলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে আব্বা মিলাদ দিল। আমরা রাতে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেলাম। রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ, আমি মেজবুকে ডাকলাম, বুবু ওঠ, বাগানে চোর ঢুকেছে, ভারি কিছু নিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। আমরা চুপিচুপি জানালাটা সামান্য ফাঁক করেছি কেবল, পূর্ণিমার রাত, বাইরে সব চকচক করছে, অনেক আলো চার দিকে। প্রথমে দেখলাম, পারুল আমাদের দিকে সোজা তাকিয়ে আছে, মাটিতে উপুড় হয়ে দুইহাতে শরীরের ভর দিয়ে পেট থেকে মাথা উঁচু করে আমাদের দিকে তাকিয়ে। ভালো করে দেখে বুঝলাম, ওর শরীরে পেটের নিচে আর কিছুই নেই, দুই হাতে হেচড়ে হেচড়ে ও পুকুরের দিকে যাচ্ছিল বোধহয়। আমরা দুই বোন চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
বাড়ির কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করলো না, আম্মা শুধু লোক ডেকে জানালাটা আটকে দিল। কিন্তু প্রতি বছর একই ঘটনা ঘটে চললো। পরের বার শব্দ শুনে আমরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, ওই একই দৃশ্য। আমরা আবার জ্ঞান হারালাম। প্রথম প্রথম ভয় পেলে, পরে আমরা নিজেরাই ওর জন্য অপেক্ষা করতাম, আমরা ছাড়া কে আর আছে ওর। আজ সেই রাত, ও আসবে।
অপলা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। আসলে কী বলবে বুঝতেই পারছিল না। এটা আসলে বানানো গল্প কিনা, তাও অন্তত এই মুহূর্তে বুঝার উপায় নেই। তবে কি যেন একটা আছে, ও জানে না, তবে কিছু একটা অস্বস্তি তৈরি করে রেখেছে আজ সন্ধ্যা থেকেই।
পারুল আপনাদের বাগানে কেন এসে লুকিয়ে ছিল, ওর কি হয়েছিল সেটা জানতে পেরেছিলেন পরে, অপলা এইবার কৌতূহল লুকাতে পারে না। আমরা জেনে ছিলাম সেটা বেশ পরে, মেজ ফুফু বলে চলে। পারুলের প্রেম হয় অন্য এলাকার এক ছেলের সাথে। সেটা সেই পাকিস্তান আমলের কথা, সে সময় মফস্বলে না ছিল ফোন না ছিল চিঠি। পারুলের ঐ ছেলের সাথে দেখা হত নদীর ঘাটে গোসলের সময়। ছেলেটা অনেক বুঝিয়ে পারুলকে রাজি করিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে ওর সাথে শহরে পালিয়ে যেতে। একদিন পারুল পালিয়ে রাজশাহীর ট্রেনে চড়ে বসে, কিন্তু, তার প্রেমিকের দেখা মেলে না কোথাও। ট্রেন রাজশাহী ইস্টিশনে থামলে পারুল বাজে লোকদের হাতে পড়ে। ওকে রেপ করা হয়, সেখান থেকে পালিয়ে কোনো রকমে সে আমাদের বাগানে এসে লুকিয়ে পড়ে।
অপলার বুকের ভেতরে ধক করে ওঠে, কী যেন একটা কষ্ট হৃদপিণ্ডটাকে খাঁমচে ধরে। নিজের অজান্তেই চোখ ফেটে পানি গড়াতে থাকে। ছোট ফুফু খুব সাবধানে চোখের পানি মুছে দেয়, চারদিকে তাকিয়ে আবার গলা নামিয়ে ফেলে, খবরদার কেঁদো না মা। পারুল বুঝতে পারলে রেহাই নাই, তোমাকে বারবার টেনে আনবে এখানে। এই মমতার বন্ধন ওকে বারবার ফিরিয়ে আনবে, সাথে তোমাকে, যাও ঘরে চলে যাও।
অপলা ভারি পায়ে ঘরে এসে ঢোকে। বিছানায় এলিয়ে পরে কাঁদতে থাকে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে উঠে, চোখ মুছতে মুছতে জানালাটা খুলে দেয়। চাঁদের আলোয় চারপাশ মোহময় হয়ে উঠেছে, এই আলোতে কোনো অমঙ্গল থাকতে পারে না। পৃথিবীর সব কিছুকে ভালবাসতে ইচ্ছে হয় অপলার। রেহানের জন্য মনটা নরম হয়ে ওঠে, পারুলের জন্যও। চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ভালবাসার অশ্রু।