ঋত্বিক ঘটকের গল্প ‘কমরেড’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৪, ২০২৪
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী রণেশ দাশগুপ্তর আজ মৃত্যুদিন। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা ‘কমরেড’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
পরের দোকানের মোড়টা ঘুরছে ঝাব্বু।
চট করে গাছের আড়ালে চলে গেলাম। ও যেন আমাকে দেখতে না পায়। ও হনহন করে হেঁটে চলে আসছে চারদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিপাত করে। এক বার ক্ষণতরে আঁড়াল; একটা হাত তুলে ঘাড়টা মুছে নিল। এত দূর থেকেও আমার মনে হয়, তার হাতটা কাপছে।… ও চলে এল এদিকে, আমার অন্তরালের গাছটিকে অতিক্রম করে গিয়ে উঠল বস্তির সামনের বাঁধানো চাতালটাতে। বস্তির বেশিরভাগ দরজাই বন্ধ, লোকগুলো সব মুষড়ে নিরুৎসুকভাবে ঘরের মধ্যে পড়ে আছে, অনেকে চলেও গেছে। ছেলেপুলের কান্না শোনা যায় না, নেড়ি কুকুরগুলো পর্যন্ত অন্যত্র জীবিকার সন্ধানে রওনা দিয়েছে। মানুষ থেকেও নীরব, অন্ধকার পরিত্যক্ত মনে হয় সমস্ত মহল্লাটাকে।
আমার পরমবন্ধু ঝাব্বু। আমার জঙ্গি ইউনিয়নের প্রিয় নায়ক ঝাব্বু। কতদিনকার সুখ-দুঃখের সাথি ঝাসে চকিত চাহনিতে দেখে বস্তিটাকে, তারপর দ্রুতপদে গিয়ে ঢােকে তার ঘরে। দরজা বন্ধ করার শব্দ নীরব সন্ধ্যায় আমার কানে এসে বাজে।
আমি বেরোলাম গাছের আড়াল থেকে। হাতে এখনও কাপড়ের পোটলাটা। আমার সাধের মখমলের পাগড়ি, বউ-এর জংলা শাড়ি, আরও কী কী যেন ধরে দিয়েছে বউ। বিক্রি করতে চলেছিলাম সদর বাজারের লকিম মাড়োয়ারির ঘরে, হঠাৎ ওকে দূর থেকে দেখে আমার যাওয়া আর হলো না।
ও ঢুকছিল কলের মালিক শ্রীবাস্তবের সদর বাজারের নতুন বড় বাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে। সঙ্গে আর যে দুজন ছিল, তাদের আমি চিনি। একজন নয়া তাঁবেদার ইউনিয়নের নতুন আসা গুণ্ডাটা; আর একজন ম্যানেজারের পেটোয়া চুকলিখোর নন্দ মিস্ত্রি, শিকায়েত করার এক নম্বর ওস্তাদ। প্রথমে আমার ভয়ই লেগেছিল, দোকান ছাড়িয়ে ওদের দিকে এগিয়েছিলাম যদি কোনো সাহায্য লাগে ঝাব্বর, তাই জন্যে। ওরা কেন নিয়ে যাচ্ছে ওকে? কিন্তু গিয়ে দেখি ঝাব্বু হাসছে, ভীষণ আনন্দিতমুখে হাসছে। তখনই আমি দৌড়ে চলে এসেছি সোজা মহল্লাতে। মাথার মধ্যে সব কেন জানি বেহিসেবী হয়ে গিয়েছিল। থেকে থেকে প্রাণে ভেতরটা চমকে চমকে উঠছিল।
আমিও গিয়ে চড়লাম চাতালে। ওর ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। বস্তির সামনেরটা আর দরজাগুলো দেখলে কান্না পায়। গত একচিল্লশ দিন ধরে কলে লকআউট, দুর্দশাটা একেবারে চরমে এসে উপস্থিত হয়েছে। মজুরদের এ সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে ভাঙন ধরানোর জন্য কত চেষ্টাই তো করল মালিকপক্ষ, কিছুতেই কিছু হয়নি। কত মজুর দেশে চলে গেছে, বহু সংসারে নেমে এসেছে মহা-বুভুক্ষার ছায়া, কত মজুরকে এরই মধ্যে তার সব সম্বল বিক্রি করে ফেলে একবেলা আধপেটা খেয়ে থাকতে হচ্ছে, —তবু জনসংহতি অচল বিদ্রোহে উঁচু হয়ে থেকেছে। নয়া ইউনিয়নের মুষ্টিমেয় সভ্যকে দিয়ে টিমটিম করে চালু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তারা নিজেরাই ভয় পেয়ে রাজি হয়নি। মালিক নাকি বলেছে, তার টাকার আর দরকার নেই, কল সে বন্ধ করেই দেবে বেশি ঝামেলা হলে। অথবা বিলাসপুর না কোথা থেকে নতুন মজুর আমদানি করে কল চালাবে। গুণ্ডা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাবারও চেষ্টা করেছিল একবার। সবকিছুকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে আমরা অনমনীয় থেকে গেছি।
কিন্তু কষ্ট হয়। এইসব তিল তিল করে মরা শহীদদের অবর্ণনীয় কৃচ্ছসাধন মনকে বিচলিত করে তোলে ।… এদের সহিষ্ণুতার তুলনা কোথায়? চোখের সামনে অল্প অল্প জীবনীশক্তি নিভে আসছে প্রিয়জনের, এ দেখেও যাদের মুখ ফেরাতে হয়, চোখের জলকে দাবিয়ে দিয়ে দিবারাত্র লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা দৃঢ়তর করে তুলতে হয়, সেই জঙ্গি ফৌজের থেকে বড় কী আছে?
ঝাব্বুর ঘরের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। বন্ধ দরজা। মানুষ যেন ওর ওদিকে থাকে না, এমনই শব্দহীন ঘরটা। আলো নেই, আলোর বিলাসিতা করার সুযোগ কার আছে? ঝাব্বুর গলা পাই না।…ঠক ঠক করে দরজায় ঘা দেই।
দরজার ওপাশে কার পায়ের আওয়াজ জেগে ওঠে। দরজার খিল খোলার শব্দ হয়। ঝাব্বু পাল্লা খুলে দিচ্ছে। এখনও পর্যন্ত সকলের নেতা ঝাবু। শোষিত শ্রেণির সংগ্রামী সৈনিক ঝাব্বু।
আমাকে দেখে ছাইয়ের মতো যার মুখ হয়ে গেল, সে সেই ঝাব্বু? হতে পারে । আমি সর্বহারা ভুখা মজুর, আমাকে দেখে ওর মুখ ছাই হবে কেন?
হাসার চেষ্টা করে ও। এসো লালবাহাদুর, বোসো। তারপর, কী মনে করে?” আনন্দ এবং উৎসাহের অভাব ওর গলা দিয়ে যেন ঝরে পড়ছে। একটা হাত পাল্লা থেকে সরিয়ে কোণের তেলচিটে বিছানাটা দেখিয়ে দেয়।
ধূসর অন্ধকার ঘরটাতে। ভ্যাপসা গন্ধ। অভাব যেন হা হা করে এসে মুখে সজোরে চড় মারে। ও বলে —“দাড়াও, বাতিটা জ্বালি।… জানো তো, ও-পাট চুকিয়েই ফেলেছি প্রায়।”
আমি বাধা দেই — “থাক ভাই। আলোর দরকার নেই। এসসা, বসি।” আমি বসলাম বিছানার ওপর হাতের পোঁটলাটা পাশে রেখে। ও বসে কামিজের পকেট হাতায়, যেন একটা কিছু না করে ও স্থির থাকতে পারছে না — “বিড়ি খাবে?”
“দাও।”
বিড়িটা মুখে নিয়ে মাথাটা নিচু করি। দেশলাই বের করে নিজেরটা ধরায়, তারপর আমার মুখের কাছে জ্বলন্ত কাঠিটা অগ্রসর করে দেয়। ধরাতে ধরতে ওর চোখের দিকে তাকাই। দুটো শিখা জ্বলছে ওর চোখের তারা দুটোতে, চোখ কিন্তু নিষ্প্রভ, ভগ্নাশায় ভরতি। আমার ধরানো হয়ে গেলেও মুখ ঝুঁকিয়েই তাকিয়ে থাকি। ও কেমন অস্বস্তি বোধ করে, চোখটা সরে যায় অন্যদিকে। আবার আমার মুখের ওপর আসে। আবার আমার মাথার ওপরের জানালা দিয়ে বাইরে ন্যস্ত হয়।
মুখ তুলে আমি বলি — “বিড়ি কেনার পয়সা এখনও আছে তোমার?”“
না।” ও কাঠিটা ফেলে দেয় — “হঠাৎ ভয়ংকর ইচ্ছে হলো বিড়ি খাবার। তাই কিনে নিলাম দু-পয়সার। থাকতে পারলাম না।”
“বেশ।” একমুখ ধোয়া ছাড়ি আমি — “জরু কোথায় তোমার? ছেলেপুলে কারো তো গলা পাচ্ছি না আমি!”
“ওদের সব আজ সকালেই ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। কতদিন এমন থাকবে কে জানে বলো! সেখানে তাও দুমুঠো খেতে পাবে দুবেলা। তুমি তো গত কয়দিন এদিকে আসো না — আজ হঠাৎ?”
“বলছি” — মনে মনে হিসেব করি আমি। তা হলে আজ বিকেলের ঘটনাই প্রথম নয়, অন্তত দু-তিনদিন ধরে শলা পরামর্শ চলছে।… ছোটো ছেলেটা হবার পর থেকে ঝাব্বু নরম হয়ে পড়েছিল, বউ ছেলে পার করে দিয়েছে গণ্ডগোল আশঙ্কা করে।
মুখে বলি —“কাল আমেদ সাহেবের আসার কথা আছে। আজই সকালে আফিসে খবরটা এসেছে। তুমি তিনদিন ধরে ও পথই মাড়াওনি অথচ ব্যবস্থা করা দরকার—
ও ইতস্তত করে —“মানে শরীরটা বড় খারাপ যাচ্ছে কদিন থেকে। কোথাও যাচ্ছি না। খালি সকালে ইস্টিশনে ওদের তুলে দিতে গিয়েছিলাম। জানো, বাসন কোসন বেচে তবে ওদের যাবার পয়সা জোগাড় করতে হয়েছে। আর পথে বেরোলেই তো পয়সা।”
আমি বলি — “তবে ঘরে কামিজ পরে বসে কী করছ?”
—“উ” চিন্তাপূর্ণ চোখে ও আমার দিকে চায় — “এমনি। বেরোব ভাবছিলাম একা ঘরে যেন দম আটকে আসছিল।”
—“ওঃ” আমার কৌতুহল যেন নিবৃত্ত হয় — “কিন্তু বিড়ি কিনলে কখন ভাই চমকে উঠল ঝন্ধু। সোজা হয়ে বসল। “সকালে, বউকে উঠিয়ে দেবার সময়। এসব প্রশ্ন কেন করছ ভাই বলো তো?”
উত্তর দিই না। চুপ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। ও রূঢ় হবার মতো সাহসটুকুও সঞ্চয় করতে পারল না। হঠাৎ উঠে ঘরের অন্ধকার কোণে হাতড়ে কুঁজো থেকে এক গেলাস জল ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নেয়। আমি বিড়িটাকে মেঝেতে দাবিয়ে দাবিয়ে নিবিয়ে দিই।…ও ঘুরে আসে।
বলি —“হ্যাঁ, যেজন্য আসা। আমেদ সাহেব এলে কালকে একটা জমায়েতের আয়োজন করতে হবে। এ কাজ তুমি ছাড়া—”।
—“জমায়েত?” প্রশ্ন করে সে। “হ্যাঁ, জমায়েত তো ডাকতে হবে। দ্যাখো।” হঠাৎ ও ঝুঁকে পড়ে আমার কাছে —“লালবাহাদুর, একটা কথা বলব?
“হ্যাঁ, বলবে বই কী! লড়াইয়ের নতুন ধাপে, যখন মানুষের মনের বল পেটের ভুখ নরম করে দিচ্ছে, তখন ঝন্ধু ছাড়া আর কারো কথায় তো কোনো ফল হবে না ভাই।”
ঝাব্বু উদ্যত ভাবটা সংবরণ করে নেয়। খানিক চুপ করে থাকে। আমি বলি — “কী বলতে যাচ্ছিলে?”
ঝাব্বু মুখ না ঘুরিয়ে আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করতে থাকে। তারপর শান্ত গলায় বলে — “লালবাহাদুর, তুমি আমার সবচেয়ে বড় দোস্ত। কিন্তু সে সম্পর্ক ভুলে একবার মজুর হিসেবে আমার গোটাকয় কথা মন দিয়ে শোনো।”
কথা বললাম না। একটু চুপ থেকে আবার ধরে ও-“আমার ওপর মজুরদের বিশ্বাস আছে। আমার কথাগুলো মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা তারা নিশ্চয় করবে, আর মানবে।”
সেই-ই আমার ভয়। সেই আমার গৌরবও। হঠাৎ ঘরের মধ্যে তেরছা হয়ে একঝলক আলো এসে লুটিয়ে পড়ে, সামনের দোতলাটায় কে যেন আলো জ্বেলেছে।
ঝাব্বু বলে চলে। আমার কানে ওর উদ্গ্রীব, প্রায় মিনতি ভরা গলাটা কেমন বিশ্রী লাগে।
ও বলে —“দ্যাখো, এ মহল্লার সব কটা ধাওড়া আমি ঘুরে দেখলাম। এটা কী অবস্থা হয়েছে।… মানুষের সহ্যের তো একটা সীমা আছে।”
—“তুমি কী বলতে চাও?” নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করি আমি।
—“আমি বলি এভাবে চলবে না। চলতে পারে না। মানুষগুলোকে এ যন্ত্রণার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবার আমার কোনো অধিকার নেই। আমিই ডাক দিয়েছিলাম, তাই কল বন্ধ হয়েছিল। এত লোকের জানের দায়িত্বভার আমি আর বইতে পারছি না।…তাই বলছি, আমাদের দাবি সম্বন্ধে মালিকপক্ষের আলোচনা করে একটা ফয়সালা করে ফেলা যাক।”
জানালার টুকরো আলো ওর গালে পড়েছে। কত গেছে হাড়টা। মুখ ভাঙা, চোখ কোটরে। ঝাবু কত রোগা হয়ে গেছে।…
প্রশ্ন করি — “দাবি মানবে?.. তুমি কী করে জানলে কথাটা?” দ্রুত বলে যাই শেষ বাক্যটা সোজা ওর দিকে তাকিয়ে।
ও জিভ দিয়ে ঠোট চাটে। তারপর বলে –“আমার মনে হয়।” গলাটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে ওর।
জিজ্ঞাসা করি “পরকাশ ভাইয়াদের ছাঁটাই করেছিল, তাদের বহাল করবে ফের? তখা বাড়িয়ে দেবে কারিগরদের? সব মানবে?”
কিছুক্ষণ ধরে ভাবল কথাটা। তারপর বলল — “চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আমার মনে হয়, কিছু কিছু মানবে ওরা।”
“কিছু কিছু?” আমার কথা বলার ইচ্ছেটা ক্রমেই কমে আসে। ও বলে“কিন্তু তবু দ্যাখো, এভাবে তিলে তিলে মরা আর দেখা যায় না। কাল আহমেদ সাহেব এলে তাকেও বলব, জমায়েতকেও জানাব আমার সিদ্ধান্তের কথা। আমাদের ফের যোগ দেয়া উচিত।”
হঠাৎ কেঁপে উঠি। উত্তেজিত কণ্ঠে বলি — “এগোবার পথটা নষ্ট করে দিতে চাও? এতদিন জানের খুন দিয়ে যে সংহত শক্তি জমে উঠেছে, তার মূলে আঘাত করবে?”
ও বোঝায় —“ভুল করছ। আবার লড়াই হবে, আবার হবে। একটু সামলে উঠতে দাও। অল্প ত্যাগ করে এখন এতগুলো লোকের প্রাণ তা বাঁচাই।”
ওর দৃষ্টি আমার চোখের ওপর পড়ে। চোখ দুটো বোধ হয় আগুনের আঁটা হয়ে উঠেছিল। বলে করুণভাবে- “আমার পরম বন্ধু হয়ে তুমি এ কী সুরে কথা বলছ লালবাহাদুর? এতদিনের বুক ঢালা ভালোবাসা”—
—ভালোবাসা!… চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। আমার সঙ্গী ঝাব্বু। আমাদের সবচেয়ে বড়ো গৌরবের বস্তু জঙ্গি সিপাহী।… তাই-ই এই মুহূর্তে পর্যন্ত আছে সমস্ত মজুরের চোখে। আমার নবলব্ধ জ্ঞান এখনও অংশীদার পায়নি। বাবুর নামে এখনও সব পাগল।
ঝাব্বু বোধ হয় আমার চোখকে নরম হতে দেখছিল। গায়ে হাত দেয়। ঘাড়টা শির শির করে ওঠে। কিন্তু হাতটাকে সরিয়ে দিই না। বলে — “ভাই, আমার অনুরোধ, ভালো করে বুঝে দ্যাখো…”।
ওর গলাটা আমার কানে ছোটো হয়ে আসে। মনে পড়ে কতদিনকার কত কথা। কতবার দেখেছি, নিষ্পেষণের যন্ত্র চালু হলেই ঝাকুর গল্প বজ্রকণ্ঠে রণহুংকার দিয়ে উঠেছে। ওর চোখের দিকে চেয়ে সে সময় আমরা সব ভুলে যেতাম। সত্যিকারের অগ্নিহোত্রী। কোনোদিন কোনোখানে পাপের সঙ্গে সন্ধি করেনি।
আজ এত নরম হলে কী করে? পুরোনো বহু পোড়-খাওয়া যোদ্ধা আজ তার পৌরুষ হারিয়ে ফেলেছে। কেন? অর্থের কাছে শেষটা বিক্রি হয়ে গেল? এতই বড়ো পতন হলো ওর।
আমার ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ওর দু-হাত মুঠোয় নেই — “মাথা তোমার খারাপ হয়ে গেছে। কি ভালো, কী মন্দ, তা বোঝবার জ্ঞানও কি তোমার লোপ পেল? বিচার করে দ্যাখো, আপোস মানে মৃত্যু। এ চেষ্টা ছেড়ে দাও। সবাই কী বলবে?”
—“সবাই?” আমার মুখের থেকে ঘন অন্ধকারের দিকে চোখ ঘোরাল সে। মুখে অপরিসীম দৃঢ়তার ভাব। “আপোস করতে হবে…এতদিনকার নেতা আমি তোমার, আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।”
নেতা! চাবুক এসে পড়ল আমার মুখে। ঝাব্বু নেতা, সেই কথা তার শেষ যুক্তি! আমি ভাবতে পারছি না, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভালো লাগে না, হাঁপ ধরে আসে যেন বুকে কী নতুন প্রকাশ, কল্পনা করলে ও মনে হয় পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। অন্ধকারটা যেন দুলে ওঠে। আমার মনে যে আশঙ্কা জাগছিল বিকেল বেলা সদরবাজারে ওকে দেখার পর থেকে, সেটা সত্যে পরিণত হলো। সত্য! কী ঘৃণ্য, জঘন্য বাস্তব।
ঝাব্বু কথা বলছে। কী বলছে কে জানে! কে তোয়াক্কা রাখে! মরা মানুষের ভুতুড়ে কথা।… আমার খালি মনে হচ্ছে, সেবার হাঙ্গামায় সে মরল না কেন? গত বছরের আগের বছর যে গোল বেঁধেছিল মালিকের সঙ্গে, তখন সে এগিয়ে গিয়েছিল অত্যাচারের বুলেটের মুখে। একটা গুলি এসে কেন ওকে শেষ করে দেয়নি? কেন ও বেঁচে থাকল?
অমঙ্গল চিন্তা করছি না। ওর সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা চিন্তা করা এখনও আমার পক্ষে অসম্ভব। ও চলে গেলে বেঁচে যেত! আমরা ওর শব কাঁধে করে মিছিল করতাম, দু-চোখ বেয়ে আমাদের জল ঝরত, ঝাব্বু বেঁচে থাকত তার প্রতিটি ফোঁটায় — জলকে আগুন করে দিতে সে পারত। বেঁচে থাকত আমাদের আশায়, আমাদের নৈরাশ্যে, আমাদের শেষ অবশ্যম্ভাবী পরম জয়ে। আমাদের শোকে সান্তনা পেতাম তার কথা ভেবে, লড়াই-এ বল পেতাম তার কাছ থেকে, মৃত্যুকে তুচ্ছ করতাম সে মুখ স্মরণ করে। তাকে মনে পড়িয়ে দিয়ে ডাকতাম নবীনদলকে, প্রতিশোধের আগুনে তাদের ধরিয়ে নিতাম মশালের মতো, সেই হতো প্রেরণা। তারপর সমস্ত ঘটনার পর, নয়া দুনিয়ার বনেদ গড়তাম যখন, তার স্মৃতি হাওয়া হয়ে আমাদের চুলে নাড়া দিয়ে যেত।
সমস্ত মজুর কৃষাণ জমায়েতে তার হাসিমুখ জেগে উঠত। সেদিন সবচেয়ে বড় হয়ে বাঁচত সে।
সারাজীবন সংগ্রাম করা সেই তো আমাদের ঝাব্বু। এ লোকটা কে? নেতা? আমাদের কেউ নয়, অন্য জাত। এর চোখে রয়েছে ভীতি, বুকে রয়েছে লাভের লোভ, আর কামিজের জেবে রয়েছে টাকা। লোকটার চোয়ালটা ব্যায়ভাবে নির্লজ্জ হয়ে বেশ্যাবৃত্তির বেসাতির কাজ হাসিল করে যাচ্ছে, তাতে বাইরের টুকরো আলো পড়ে তেলতেলে চকচকে লাগছে আর খালি নড়ছে। ওর মতো বেঈমান এ তল্লাটে আর একটি নেই। একে আমি চিনি না। আমার পয়লা নম্বর দুশমন, আমার আব্বর সারাজীবনের ঘোর শত্রু, হাজারো ভুখা মজুরের রক্তচোষা ভাড়াটে নেতা।
হাত নেড়ে ও খুব বোঝাচ্ছে। এতক্ষণ স্থানুর মতো বসেছিলাম, এবার নড়ি। পাশের পোঁটলা থেকে আমার সাধের মখমলের নরম পাগড়িটা বের করতে থাকে আমার হাত।…
না। ও আমার বন্ধু। আমার সবচেয় প্রিয়বন্ধু। কতবার ওর নেতৃত্বে আমাদের দুঃখদুর্দশার জন্যে লড়েছি, কতবার কতভাবে ওর কাছে ঋণী হয়েছি। দুর্বল লাগে নিজেকে, এ আমার সাধ্যাতীত। পালিয়ে যই বরঞ্চ, কেন এলাম আমি? তলের ঠোটটা আমার অবরুদ্ধ কান্নাকে রুখতে গিয়ে থর থর করে কঁপে, মাথার পেছনটায় চাপ ধরে আসে।
তারপর ওর কথা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। রাত্রি গভীর হলো।
আমি প্রাণপণ শক্তিতে পেঁচিয়ে দিয়েছিলাম কাপড়টা। ওর মুখটা আমার খুব কাছে চলে এসেছিল। জিভ বেরিয়ে গেছে, কপালে বড় বড় ঘামের ফোঁটা, চোখ রক্তাভ। ভালো করে কাপড়টা আর একবার মুঠিয়ে নিয়ে জোর দিলাম। হাতপাগুলো ছড়িয়ে পড়ে, একটা হাত আমার জামাকে খামচে ধরে টানতে থাকে, পড়পড় শব্দে খানিকটা ছিড়ে যায়। সব আমি লক্ষ্য করি লালচে কালো একটা পর্দার ভেতর দিয়ে যেন। আর আমি যেন সমস্ত ঘটনাটার একজন দর্শক, এমনই ঠাণ্ডা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছে মনের ভেতরটা।
ছটফট করতে করতে ও নেতিয়ে পড়ল। ক্রমে ওর হাত-পায়ের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে এল। ছেড়ে দিলাম।
গড়িয়ে আমার কোলের ওপর ওর মাথাটা এসে পড়ে। জানালা দিয়ে আসা বাইরের আলো এবার ওর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। মুখের বীভৎস সংকোচন কমতে কমতে থেমে এল। ওর হাতটা আমার বুকের কাছে ছেড়া জামা ধরেই থাকে। একটানে কাপড়টা খুলে নেই গলা প্যাঁচ থেকে।
ওর কপালে কয় গোছা চুল এসে পড়েছে দেখছি তখন থেকেই। আর চওড়া কপালময় বড় বড় স্বেদবিন্দু। কেমন ধীর, কেমন তপ্ত দেখতে লাগছে ওকে; ঘুমের প্রশান্তি যেন ওকে ঘিরে নেমে এসেছে। চোখ দুটো ধীরে আনমিত করে বন্ধ করে দেই।
তখন থেকে দেখছি ঝুঁকে পড়ে, জলে ভেসে যাচ্ছে আমার সারা মুখ।
তারপর কম্পিত মৃদুহাতে ওর গুচ্ছ গুচ্ছ চুল কপাল থেকে সরিয়ে দিতে থাকি সযত্নে।