ঋত্বিক ঘটকের গল্প ‘এজহার’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৪, ২০২০
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ও গল্পকার ঋত্বিক ঘটকের আজ জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ৫ নভেম্বর রাজশাহীর মিয়াপাড়ায় তার জন্ম। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘এজাহার’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
হ্যাঁ, আমিই করেছি এ কাজ। আমি ভবেশরঞ্জন বাগচী, পিতা গোপেশরঞ্জন বাগচী, নিবাস রামপুর বোয়ালিয়া; সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে; এবং সমস্ত ফলাফল বুঝে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। নিজের থেকেই বলছি আমি; কারো চাপে পড়ে নয়, আমিই দোষী। আচ্ছা, দারোগাবাবু, ভালো করিনি আমি?-ও ছাড়া যে উপায় ছিল না।
জয়া ভয় পেত। মরতে ওর ভয় ছিল।
তাই আমায় এ পথ বেছে নিতে হলো।
আচ্ছা, তুমি বল। আমার কষ্ট হবে না?
একসঙ্গে দুজনে মানুষ হয়েছি, ও মোটে বছর দুই-এর ছোটো আমার থেকে। ছোটোকাল থেকে ওকে দেখে আসছি, বড় ভালোবাসতাম জয়াকে। ওর দুঃখ দেখলে কষ্ট আমার হবেই।
দুঃখ কীসের?-বাঙালি মেয়ের দুঃখের কারণ কী হতে পারে মনে কর? -স্বামী।
জয়ার বিয়ে দিতে কিছু দেরি হয়েছিল। বয়স আঠারো পার হয়ে যাবার পর ওর বিয়ে হয়। রূপ ওর ছিল, তাই অর্থবান পাত্র জুটে যায়। পাত্রের বয়স কিছু বেশি, চল্লিশের ওপরে। তা ছাড়া দোজবরে। পয়সার অভাবে এ পাতই সকলের কাছে ভগবানের দান বলে মনে হয়েছিল।
শুধু আমি মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি এসে একথা শুনে আপত্তি করি। সে আপত্তিতে কোনো ফল হয়নি। রাগটা আমার চিরকালই বেশি। একটু রাগলে কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না। সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে পশ্চিমে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম।
কয়দিন আগে মার পত্র পেলাম বাবার অসুখটা বেড়েছে। অসুখ বরাবরই ছিল, গ্রীষ্মকালে বাড়ত। তবে শুনলাম এবার নাকি একটা বাড়াবাড়ি। বাড়ি এলাম। ও-রোগের কোনো ওষুধ নেই, কাজেই চুপচাপ বসে থাকা। হঠাৎ ইচ্ছে করল জয়াকে দেখতে যাব। অনেকদিন দেখিনি।
ছোট্ট জায়গাটি। মেল থামে না। প্যাসেঞ্জার। চব্বিশ ঘণ্টায় আসার একটি ও যাবার একটি। নামলাম যখন তখন বিকেল। বড় ভালো লাগল আমার, চমৎকার জায়গা।
জায়গা চমৎকার হলেও চৌধুরী মশাইকে ঠিক তেমন ঠেকল না আমার। বিরাট সেকেলে ভাঙা চক-মেলানো বাড়ির সামনের ঘরে নথিপত্র সামনে করে ভদ্রলোক বসেছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল একটা কচ্ছপ। মোটা ঘাড়ে-গর্দানে ঠাসা, বিরাট কালো চেহারা, ছয় ফুট লম্বা হবে, অথচ পা দুটো কেমন সরু সরু, ভারি বিসদৃশ লাগে। ঘাম পড়ছে কপাল বেয়ে। যেন আলকাতরা চুইয়ে পড়ছে।-চেহারা দেখলে লোকটা যে শিক্ষিত, তা মনেই হয় না। কথাবার্তা বেজায় রুক্ষ, চাষিদের চক্রবৃদ্ধি হারে ধার দিয়ে তেজারতি ব্যবসা করলে বোধ হয় অমনই হয়।
ওরই মধ্যে যতটা সম্ভব বন্ধুভাবের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোক উঠে আমায় ভেতরে নিয়ে যান আলো আঁধারির ছক কাটা লম্বা বারান্দা দিয়ে। কদর্য কথাটা তখনই সন্দেহ করেছিলাম। সঙ্গে যেতে যেতে অপাঙ্গে লোকটার লক্ষণগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। উনি বাঁ-পাটাকে মাটির ওপর দিয়ে টেনে টেনে চলছিলেন, একটা পা বিকৃত।
নানা রকম কথা বলছিলেন ভদ্রলোক।
আজ উনি একটু দূরের গাঁয়ে যাচ্ছেন, বিষয় সংক্রান্ত কাজে, আমি নিশ্চয়ই দু-চারদিন থাকব এখানে। এ সময়ে এদিকের জলহাওয়াটা ভালো থাকে। বর্তমানে সামনের ওই ঘরটায় আমায় বসিয়ে উনি একটু বাইরে যাবেন, কতকগুলো কাজ আছে, সেরে ফেলতে হবে। ওটা জয়ার ঘর। জয়া নেই? আছে কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে, আসবে এখুনি। তা হলে উনি চললেন। আমি ততক্ষণ একটু-
বসেছিলাম কিছুক্ষণ। সামনে ভেতর বাড়ির উঠোনটা দেখা যাচ্ছে, এ পাশে নারকেল দড়িতে কতগুলি কাপড় ঝুলছে ঘরের একপাশে কতকগুলো বোতল পড়ে, মদ।-অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎ শুনলাম কাংস্যকণ্ঠে কে কাকে বলছে-‘মাগির বড় বাড় বেড়েছে। বলি, কতক্ষণ লাগে এ কটা বাসন মাজতে? ঘাটের ধারে সে ঘোষেদের ছোঁড়াটা এসেছিল বুঝি”
অস্ফুট স্বরে কে যেন কী উত্তর দিল। আবার ঝংকার ওঠে।-“থাক, আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না। তা আর হবে না?-ওই বাপের মেয়ে তো!- ছোটোলোক, ছোটোলোক নজর কোনোদিন তো আর উঁচু হলো না।-বলি পয়সা নেই তো বামুন হয়ে চাঁদে হাত কেন?-আমার ঢং কতরকম। পড়াশুনা। বড় পণ্ডিত, শাস্তর পড়ে মোক্ষলাভ করবেন। ঝাঁটা মার।” হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। কথ্যমানেরা আমার দৃষ্টিরেখার মধ্যে এসে পড়ে। পুরোনো সেই কাহিনী। আমাদের ভাষায় যাকে খোঁটা দেয়া বলে।
জয়া। একগাদি বাসন হাতে ছেঁড়া কাপড় পরে জয়া ঘামছে, আর কোমরে হাত দিয়ে মামুলি সেই কোঁদলের ভঙ্গিতে এক প্রৌঢ়া অপরূপ ভাষা ব্যবহার করে যাচ্ছেন। ফুলের মতো মেয়েটার গা দিয়ে খড়ি উঠতে আরম্ভ করেছে, চুল রুক্ষ, চোখ গর্তে, গায়ের রং কেমন রোগগ্রস্ত হলদে। রক্ত কমতে শুরু করেছে।
জয়া। আমার ছোটোবেলা থেকে কত সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে মেয়েটার সঙ্গে। মায়ের একটা অংশ যেন জড়িয়ে ছিল মেয়েটার সর্বাঙ্গে। দোজবরে চৌধুরীমশাই রূপ দেখে বিয়ে করেছিলেন তাকে। সাক্ষাৎ কল্যাণী লক্ষী যে ও। ওর স্পর্শে একটা সংসার যে শান্তিতে ভরে উঠত। সে-খোঁজ নেননি তিনি দেখছি।
জয়া। হাসি পেল আমার।-অজান্তেই বারান্দায় চলে এসেছিলাম।
জয়া আমাকে দেখ অবাক হয়ে যায়।-“তুমি। চলো, ঘরে চলো।”
প্রৌঢ়ার বোধহয় লজ্জা হয়েছিল। সর্বাঙ্গ খালি রেখে এক হাত ঘোমটা টেনে ফিসফিস করে আমার পরিচয় নেন, তারপর তাড়াতাড়ি চলে যান। আমি ঘরে আসি। বাসনগুলো রেখে আসে জয়া।-শুনলাম, চৌধুরীমশাই-এর পিসি উনি। বাড়িতে এই তিনটি প্রাণী। এত বড় বাড়িটার জায়গায় জায়গায় বট-অশ্বত্থ-ওঠা ভাঙা দালানের মধ্যে নিঃসঙ্গ জয়া ঘুরে বেড়ায়, গৃহকর্ম করে, পিসিমা মালা জপেন আর অকথ্য ভাষায় জয়াকে গাল দেন এবং চৌধুরীমশাই তেজারতির টাকা গোনেন বসে বসে।
জয়া আমাকে দেখে একেবারে আনন্দে উচ্ছল হয়ে ওঠে। দু-হাতে উলটোপিঠ দিয়ে ঘর্মাক্ত কপালের চূর্ণকুন্তল সরিয়ে দেয়। বলে-‘কখন এলে তুমি? বাবা কেমন আছেন? খুকুর অসুখ লিখেছিলেন যে, কেমন আছেন সে?” আমাকে মুখের ওপর চোখ বোলায় ও।-“কী রোগাই হয়ে গেছ! খালি অনিয়ম আর অত্যাচার, শরীর টিকবে কেমন করে! একটু শাসনের অভাব হয়েছে। আর যা ইচ্ছে তাই আরম্ভ করেছ। এই কয় মাসেই যেমন হয়ে পড়েছ তুমি, আর কিছুদিনে অসুখে পড়ে যাবে যে!”
বলি না আর, আমার থেকেও রোগা আর অসুস্থ দেখাচ্ছে কাকে। তিলে তিলে মৃত্যু একেবারে অবধারিত।
বাপের বাড়ির খবর নেবার জন্য জয়া উদ্গ্রীব। ফুঁ দিয়ে বারান্দার কোণের কাঠের উনুনে চায়ের জল করতে করতে খোঁজ নিতে থাকে সঙ্গীসাথির। একটা মোড়ায় বসে যতদূর জানি বলে যাই। জয়ার কথাবার্তা এখনও তেমনি আছে। সেই ঘাড় একটু হেলিয়ে কথা বলা। কী সুঠাম ঘাড়, ঠিক হাতির দাঁতের তৈরি মনে হয়।
চৌধুরীমশাই ভেতরে এসে চা খেতে খেতে পলিটিক্স আলোচনা করেন। তাঁকে আবার এখনই রওনা হতে হবে সেই দূর গাঁয়ে। আমি আসাতে ভালোই হয়েছে। ওরা একা থাকত। অবশ্য তাঁকে এরকম দূরে প্রায়ই যেতে হয় এক-আধদিনের জন্য। জয়াদের একা থাকা অভ্যাস আছে। তিনি ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে বিদেয় নেন।
জয়াকে তারপর থেকে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করতে থাকি অনেক কথা জানবার আছে আমার।
চৌধুরীমশাই মদ খান। প্রচুর খান মাঝে মাঝে। পিসিমা ও ধরনের কথা বলে থাকেন প্রায়ই। আমি যা শুনছি তা তো কিছুই নয়, ওর থেকে অনেক বেশি ওকে বলে থাকেন। বাপের দৈন্য নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ তাঁর প্রতিপদে।-মেয়েটাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক কিছু এই কয় মাসে।-হঠাৎ আমার মুখের দিকে চেয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল।-আমার মুখটা বোধ হয় শক্ত হয়ে উঠছিল ক্রমে।
অন্য কথা পাড়ে ও। বাড়ির কথা, আমার চাকরির কথা।-সন্ধ্যা হয়ে আসছিল।… জয়া রান্না করতে যায়। আমি একা বসে থাকি। কী পৈশাচিক ব্যাপার! এত মিষ্টি মেয়েকে কেউ লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দিতে পারে এ আমার ধারণার অতীত ছিল। মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে যায়, উঠে পায়চারি করতে থাকি।
জয়ার বিয়ের সময়কার একটা কথা আমার মনে পড়ল। কথাটা ভীষণ এবং এ বিয়েতে আমার আপত্তির প্রধান কারণ একটা।
চৌধুরীমশাইয়ের প্রথমা স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। কেন করেছিলেন এখন বুঝতে পারি। শুনেছিলাম, তিনি উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
কিন্তু এ যে কিছুই নয়, এর থেকে জঘন্য আরও আছে, তা তো জানতাম না। খানিক পায়চারি করার পর ভেতরে গিয়েছিলাম, যেখানে জয়া বসে আছে। পিসিমাকে দেখলাম না, কোথায় কে জানে! খালি পায়ে ছিলাম, আমার আসা সে টের পায়নি। আমার দিকে পেছন ফিরে সে রান্না করছিল।-আমি আর একটা প্রশ্ন করতে এসেছিলাম। কথাটা আগে মনে ছিল না। চৌধুরীমশাইয়ের এক পা টেনে টেনে হাঁটার কথা মনে পড়ছিল।
নোনাধরা ঝুলে বোঝাই রান্নাঘরের দেওয়াল। কুপিটার শিখা কাঁপছিল বারে বারে, তার সঙ্গে দেওয়ালে কাঁপছিল জয়ার ছায়া। তার অঙ্গাবরণীর পিঠের কাছের ফাঁক দিয়ে ওর অনাবৃত দেহের অংশ বের হয়েছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছিল একটা কালো বিশ্রী মারের খানিকটা।
প্রশ্ন করলাম, ওটা কী জয়া?
চমকে উঠে সে আমার দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টি- এ তো জয়া নয়! এ যে-এক মুহূর্তের জন্য জয়ার সেই চোখ দুটো দেখেছিলাম। তারপরই স্বাভাবিকভাবে সে বলল-“ওঃ, হঠাৎ চমকে গিয়েছিলাম।-ও কিছু না।”
কিছু না কী? পরিষ্কার দেখলাম-
পীড়াপীড়ির ফলে বেরিয়ে এল কথাটা। চৌধুরীমশাই রাতে মাতাল হয়ে ওকে প্রায়ই মারেন। জুতো দিয়ে।
উঃ, মাথাটা কীরকম দপ দপ করছে। কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। জয়া উঠে দাঁড়িয়ে শ্লথ বসন সামলে নেয়।
আগে ওদিকে নজর ছিল না বলেই হোক, কী এখন কুপিটার শিখা অমন কোনাচে করে পড়েছে বলেই হোক, এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝলাম কথাটা। রাগে দৃষ্টিশক্তি আমি হারাইনি। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। এক ঝলক বুঝলাম তখন, জয়া সন্তানসম্ভাবা।
আমি যে-প্রশ্ন করতে এসেছিলাম, তা করা হলো না আর। জয়ার কাছে জিজ্ঞাসা না করেই বুঝেছিলাম।-সে কলুষিত, অপবিত্র হয়ে গেছে।
জ্ঞান হারাইনি আমি। আমার সামনেটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে আসে। আগুনের লাল আভা আর কুপির কম্পিত শিখায় কেমন থমথমে লাগছিল সব। অনুভব করলাম জয়া কাতরভাবে আমার হাত ধরেছিল, আর মনে আছে, উনুনে তরকারিটা পুড়ে ঝামা হয়েছিল, একটা উৎকট গন্ধ বের হচ্ছিল।-গন্ধটা আমার সব জায়গাতে তাড়া করে ফিরেছে। আঃ…
হ্যাঁ, কী বলছিলাম? -ও, -তারপর শুনলাম জয়া বলছে-“আমার পথ আমি খুঁজে পেয়েছি। বাবার কাছে শিক্ষা আমার, মন কেমন করে সংযত শান্ত করতে হয় জানি আমি। গীতা, বেদসার, উপনিষদের তর্জমা বিয়ের সময় বাবা দিয়েছিলেন, নীরবে সব অপমান আমি বহন করতে পারব। করছিলামও, কেবল তোমাকে দেখে কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। আমার ধৈর্যের স্খলন হয়েছিল। ও কিছু নয়, সাময়িক ব্যাপার মাত্র-”
নিচু, আগ্রহান্বিত গলায় খুব তাড়াতাড়ি কথাটা বলি। এখনো হয়তো সময় আছে।-“আমার সঙ্গে চল জয়া। চলে যাই আমার ওখানে।”
“তা হয় না”-কম্পিত গলায় উত্তর দেয় জয়া-‘তা হয় না। হলে খুবই ভালো হতো। বেঁচে যেতাম আমি। না, হাজার হলেও শ্বশুরের ভিটে-”
“ইচ্ছে করছে চৌধুরীমশাইকে মেরে ফেলি-”
“ওকথা বলে না। আমাকে বিধবা দেখতে চাও?”
আস্তে আস্তে চিন্তান্বিত হয়ে উঠি। রাগের আগুন মাথায় নেই আর।
পশুটার কথা কেবল ভাবছিলাম আমি। ও কী করবে তবে?
“তবে তো তোমার এক আত্মহত্যা ছাড়া পথ দেখছি না।”
জয়া কেমন ছিটকে সরে গিয়েছিল। বড় বড় চোখ মেলে আমায় দেখছিল স্থিরভাবে।
“আত্মহত্যা মহাপাপ।”
আমি হাসলাম।-“কেন?”
“কখন কোন দরকারে আসবে তুমি তাঁর তা তো জান না তুমি!”
“কার?”-অসম্ভব হাসি পাচ্ছে আমার।
“বাবার কাছেই তোমারও শিক্ষা, সে-শিক্ষা একেবারেই তুমি গ্রহণ করনি।”
সত্যিই। সে-শিক্ষা মোটেই গ্রহণ করিনি। একেবারেই না। খুব ধীরে বলি-“আর এক পথ আছে-”
কাছে সরে আসি জয়ার। ও আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি। ওর গলাটা বড় নরম। এত শোকে তাপেও মর্মর পাথরের মতো সুগঠিত, ঠাণ্ডা। বেশি জোর দিতে হয়নি, ওর গলায় আমার লম্বা আঙুল বসে গিয়েছিল।
ও চেয়ে ছিল বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে, হাত দিয়ে সজোরে আমার হাত টিপে ধরেছিল… এই দেখো নখের ক্ষত এখনও যায়নি।
এক গেলাস জল খাওয়াবে দারোগাবাবু?
হ্যাঁ। জয়া মরে গেল। আমার কোন অনুভূতি ছিল না। ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম ওর অসাড় দেহটা কোলে করে। পিসিমা কোথায় ছিল? – জানি না।
জয়াকে মেরে ফেলা আমার উচিত হয়েছিল কি না বলতে পারি না। তবে ওকে সুখ ও সম্মানদায়কভাবে মুক্তি দেবার ওই একমাত্র উপায় বলে আমার মনে হয়েছিল।
হঠাৎ বাঁচবার ইচ্ছে প্রবল হলো। তাই বেরিয়ে এলাম।-পেছনে ফিরে তাকালাম ওই বাড়িটার দিকে। সে তার আবছা আলো-আঁধারি নিয়ে, তার লম্বা, টানা বারান্দা আর স্তূপীকৃত দালান নিয়ে কেমন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হলো অকস্মাৎ। যেন পরিত্যক্ত গোরস্থান। জয়াকে কোলে করে চলে গিয়েছিলাম রেললাইনের ধারে। একটা গাড়ি আসবেই কোনো-না কোনো সময়ে।
কোনোদিন রাতে একা অচেনা রেললাইনের ধারে অতি প্রিয়জনের মৃতদেহ কোলে করে বসে থেকেছ, দারোগাবাবু? আমি থেকেছি। আমার কাছ থেকে শোনো।
কালোয়-নীল মিলে আকাশটা শ্লেট রঙের লাগছিল। সাদা মেঘেরা লম্বা লম্বা সারি দিয়ে কোথায় চলে গেছে-। চাঁদ নেই। ওঠেনি। কিন্তু তারার মৃদু চাপা আলোয় দেখা যাচ্ছিল কিছুদূর পর্যন্ত। পাশে অন্ধকারে পাতাহীন শীর্ণ ডালওয়ালা বাবলা গাছ, ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। পায়ের কাছে বড় বড় সেবাই গাছের ঝোপ, কিছু সবুজ, কিছুটা পাঁশুটে। সামনে একটা গর্তে জল কালির মতো লাগছে। লাইন দুটো বেঁকে মিশে গেছে আঁধারে, -তাদের ওপর রাতের শিশির পড়ে চকচক করছে। অস্পষ্ট সব আওয়াজ আসছিল দূরে-কাছে থেকে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস একটা উঠেছিল।-
জয়ার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি। সত্যি বলছি, শেষ মুহূর্তটাতে ওর ভীত, অবাক দৃষ্টি চলে গিয়ে কেমন শান্ত হয়ে এসেছিল তারা, জিভ ওর বেরোয়নি। অমন সুন্দর গলাটা খালি ফুলে গিয়েছিল।-তা হোক, এমন পবিত্র, তৃপ্ত লাগছিল ওকে দেখতে। ওর মাথায় অনেকক্ষণ ধরে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। রুক্ষ চুলগুলো, হতাদরে, অনাদরে তেল পড়েনি কতকাল। সীমন্তের সিঁদুর মুছে দিলাম। ওটা মানায় না ওকে। এখন বেশ লাগছে! জয়া কুমারী জয়া। কল্যাণী, মঙ্গলময়ী। যতক্ষণ বসেছিলাম, তার মধ্যে নানাকথা একটার পর একটা মনে পড়তে লাগল। কতদিনের কত বিস্মৃত ঘটনা মনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। ওপরে প্রেমময় আকাশ তার অজস্র তারার দল নিয়ে ভালোবাসার চাউনি দিয়ে ছেয়ে রইল বিশ্বচরাচর। জয়ার মাথা কোলে করে আমি বসে রইলাম। কতক্ষণ যে কেটে গেল, নিখিল-দৃষ্টি-পরিব্যাপ্ত শান্তি ভঙ্গ করল না কেউ।
অনেক পরে চাঁদ উঠল। আস্তে আস্তে পুবদিক আলো করে চাঁদ উঠল। আর উত্তর দিক উদ্ভাসিত করে একটা ট্রেন দেখা দিল। আমি সপ্তর্পণে জয়াকে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম লাইনের ওপর, তারপর কপালে স্নেহময় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম।-
লাইনগুলো যখন থরথর কাঁপছিল, তখন শেষবারের মতো ওকে স্পর্শ করে বাবলা গাছটার পেছনে এসে দাঁড়ালাম।
দারোগাবাবু, ট্রেনটা চলে যাবার পর বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। সব ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই। জয়ার তিন টুকরো দেহটা চাঁদের আলোয় পড়ে রইল, তাকাইনি সেদিকে আমি।
আচ্ছন্নের মতো স্টেশনে এলাম লাইন ধরে। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ওপাশে নতুন চাঁদের তির্যক হয়ে পড়া আলোয় রেল কোম্পানির কোয়ার্টারগুলো দেখা যাচ্ছিল। লোকজন ক্রমে এসে জমল প্ল্যাটফর্মে। উঠে একেবারে কিনারে চলে গেলাম। গন্ধটা কি ওখান থেকে আসছে? ওই যে কোয়ার্টারটা! -নাঃ সব আলো তো নেভা ও-বাড়ির। পারছি না আর, মাথাটা চেপে আসছে গন্ধে।
কোনো একসময় ট্রেন এল। সেটায় উঠে বসলাম কলকাতার টিকিট কেটে। বাড়ি যাব না। হ্যারিসন রোডের মোড়ে একজন পরিচিত লোক আছে, তার কাছ থেকে চোরাই রিভলবার একটা কিনতেই হবে। যেমন করে হোক, যত দাম লাগুক। গায়ের জোরে আমি পারব না চৌধুরীমশাইয়ের সঙ্গে। থানার ওপাশে ওই কি তোমার বাড়ি দারোগাবাবু? বেশ তো বাড়িটি।
কী? তারপর? -তোমরা ধরলে রানাঘাটে। একবারটি ছেড়ে দেবে না আমায়? শুধু একটি বার। একবার দেখি চৌধুরীকে! পশু একটা। সারাটা যৌবন অত্যাচার করে শরীরে জঘন্য কুৎসিত ব্যাধি এনেছে। স্ত্রীর দেহে সেই ব্যাধি সে সঞ্চারিত করেছে। তার বংশধর বিকলাঙ্গ হোক, কিন্তু সারাটা জীবন জয়াকে অসহ্য যন্ত্রণা পেতে হতো।-
অথচ চৌধুরী নিজের রোগের কথা এবং তার ফলাফল জানত! -তোমরা ছেড়ে দিলে রিভলবারের সব কটা গুলি ওর গায়ে পরপর মারব, প্রথমে পায়ে, তারপর হাতে, তারপর পেটে, তারপর বুকে… তোমরা তো ছাড়বে না।
কিন্তু ওকে মেরেই বা কী হতো বলো তো? কী হতো? -কিছু না। জয়াকে মেরেও অন্যায় করেছি। কত মেয়ে আছে জয়ার মতো, কত পশু আছে চৌধুরীর মতো।
কিন্তু অন্যায় করেছি কি? বাবার চাকরি হঠাৎ যাবার পর প্রতিবছর পাগল হয়ে তিনি যা কষ্ট পান, তা তো দেখেছি। জয়াকে সে নরক যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করেছি। তার রান্নাঘরে এক মুহূর্তের চাউনি আমার কাছে বাবার মুখ মনে করিয়ে দিয়েছিল।…
তোমরা আমায় ফাঁসি দেবে জানি। দাও। দু-হাতে সাঁড়াশির মতো গলা টিপে মারার কষ্ট সহ্য করতে হয় কি তাকে?
আমার ভালো লাগছে না।
আর কিছু বলার নেই।
ওঃ দারোগাবাবু-তোমার বাড়িতে বারণ করো তো, কী যেন ভারি বিশ্রী গন্ধ ছাড়ছে। ঠিক। তরকারি। ছুটে যাও তো!