উপেক্ষিত বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য

এম এম রেদোয়ান আহমেদ

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪

বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৯৫ সালের ১ অগাস্ট শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার লনসিং গ্রামে (তৎকালীন লনসিং থানা) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবার নাম অম্বিকাচরণ ও মায়ের নাম শশীমুখী। বাবার পেশা ছিল যমজানি ও মা ছিল গৃহিণী। অম্বিকাচরণ ও শশীমুখীর ছিল চারটি সন্তান। গোপালচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সেই বাবা অম্বিকাচরণ মারা যান। স্বামীর মৃতুতে শশীমুখী সন্তানদের নিয়ে বড় বিপাকের মধ্যে পড়েন। এ পরিস্থিতিতে মা তাদের অভাবের সংসারে চারটি সন্তান খুব কষ্ট করেই লালন-পালন করেছিলেন। এরপর গোপালচন্দ্রকে তার মা ভর্তি করে দেন ঐ গ্রামের একটি পাঠশালায়। পারিবারের বড় সন্তান হওয়ায় তাকে পড়াশুনার পাশাপাশি সংসারের নানা ধরনের কাজ করতে হতো। গ্রামের পাঠশালায় পড়া শেষে গোপালচন্দ্র ভর্তি হন লোনসিং স্কুলে। ১৯১৩ সালে গোপালচন্দ্র ঐ স্কুল থেকে ফরিদপুরের মধ্য সবচেয়ে বেশি মার্ক পেয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর গোপালচন্দ্র ভর্তি হন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। কিন্তু গোপালচন্দ্রের দুঃখ পিছু ছাড়ল না। যে ব্যক্তি তার পড়ালেখার ভার গ্রহণ করছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি তা বন্ধ করে দেন। প্রচণ্ড অর্থ সংকটে তিনি পড়ালেলখা ছেড়ে দেন। চলে আছেন গ্রামের বাড়ি লোনসিং এ। আর এখানেই গোপালচন্দ্রের পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটল। এরপর ১৯১৫ সালে গোপালচন্দ্র লোনসিং স্কুলে ‍ভূগোলের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানী অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু গোপালচন্দ্রের গবেষণার বিষয় ছিল একটু ভিন্ন রকমের। কেননা তিনি যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করে গেছেন, তাতে গ্রামের মানুষ তাকে প্রথমে পাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবত না। একটা শিক্ষিত লোক বা শিক্ষক যিনি শুধু ব্যস্ত থাকবেন তার ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা নিয়ে, সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অথবা অন্য কোনো গবেষনা নিয়ে; কিন্তু তিনি হঠাৎ করে পোকা-মাকড় ধরে নিয়ে আসতেন, পরীক্ষা করতেন আবার ছেড়ে দিতেন। আবার রাতের বেলায় অন্ধকারে চলে যেতেন ভূতের আগুন (আলেয়া) ধরানোর দৃশ্য দেখতে। কিন্তু সেই লোকটাই এক সময় হয়েছিলেন একজন মহান প্রকৃতি বিজ্ঞানী। আর যে জন্য তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন তাও আবার সেই গ্রামের পোকা-মাকড় ও লতাপাতা নিয়ে গবেষণার জন্যেই।

ছোটকাল থেকেই গোপালচন্দ্রের ছিল লতাপাতা, পোকা-মাকড় ইত্যাদি বিভিন্ন জীবের প্রতি প্রবল আগ্রহ। এজন্য তিনি বারবার চলে যেতেন ঝোপ-জংগল, খাল-বিল, নদী-নালায় কীটপতঙ্গের খোঁজে। সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করতেন কীটপতঙ্গের আচার-আচরণ ও গতিবিধি। তিনি যখন লোনসিং স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তখন সেখানে ছিলেন অন্য যোগেন নামে আরেকজন শিক্ষক যিনি খুব ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। এ সম্পর্কে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তার একটি বইতে লিখেছেন, মাঝে মাঝে যোগেন মাস্টার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাজিকের খেলা দেখাতেন। একটা মজার জিনিস দেখাবেন বলে একদিন তিনি সবাইকে ডেকে নিয়ে এলেন। পকেট থেকে গাঢ় খয়েরি রঙের কতকগুলি বিচি বের করে টেবিলের ওপরে রাখার পরেই একটি বিচি প্রায় চার ইঞ্চি উঁচুতে লাফিয়ে উঠল। তারপর এদিক-ওদিক থেকে প্রায় সবগুলি থেকে থেকে লাফাতে শুরু করে দিল।... অবশেষ মাস্টার মশাই ছুরি দিয়ে একটা বিচি চিরে ফেলতেই দেখা গেল তার ভেতরে একটা পোকা (লারভা)।

গ্রামের এই অভিজ্ঞতা থেকেই গোপালচন্দ্রের পোকামাকড়ের প্রতি আরও বেশি আগ্রহ জন্মে। স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তিনি জারি গান, পালা গান লিখতেন। নানা বিষয়ে জানার পর তিনি লেনসিং থেকেই একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছেলেন নানা বিষয়ে তার নানান অবিজ্ঞতার কথা। এরপর অর্থ সংকটের কারণে গোপালচন্দ্র চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে তিনি চাকরি নেন কাশিপুরে অবস্থিত বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে। চাকরি কারার সময় একদিন গোপালচন্দ্রের সাথে দেখা হয় মহান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে। তখন থেকে তার গবেষণার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ১৯২০ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণের ক্ষমতা’। যেটি প্রকাশ পায় বঙ্গবাসী পত্রিকায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, রাতের আঁধারে ‘আলেয়া’ নামক যে আগুন জলতে দেখা যায় তার কথা। গ্রামের মানুষ একে বলে ভূতের আগুন অর্থাৎ অন্ধকার রাতে ভুত আগুন জ্বালিয়ে ও নিভিয়ে খেলা করে। তবে তিনি তার ঐ লেখায় বলছেন লোনসিং স্কুলে শিক্ষকতা কারার সময় একদিন তিনি ভূতের আলো দেখার জন্য দুই বন্ধু মিলে রাতের আঁধারে গিয়েছিলেন ‘পাঁচীর মার ভিটা’ নামক একটি স্থানে। আগুনের (ভূতের আগুন) একবারে কাছে গিয়ে দেখেন আসলে সেটা কোন ভূতের আগুন নয়, গাছের গুড়ি থেকে এক ধরনের গ্যাস বের হচ্ছে যাকে বলা হয় ‘আলেয়া’। এ থেকে তিনি প্রমাণ করেন রাতের আধারে জংগলের মধ্যে অথবা দূর ক্ষেতের ধারে যে আলো দেখা যায় তা ভূতের আলো নয়, এগুলো মিথেন গ্যাসের আলো যা গাছের পচা জৈব পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়। গোপালচন্দ্রের এই লেখা একদিন বিজ্ঞানী জগদীশ্চন্দ্র বসুর দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি তার লেখা দেখে খুবই মুগ্ধ হন। এরপর জগদীশ্চন্দ্র বসু গোপালচন্দ্রকে নিয়ে আসার জন্য শরীয়তপুরের আরেক কৃতী সন্তান প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ পুলিনবিহারী দাসকে অনুরোধ করেন। জগদীশ্চন্দ্রের অনুরোধে পুলিনবিহারী দাস গোপালচন্দ্রকে নিয়ে যান জগদীশ্চন্দ্রের অফিসে। সেখানে জগদীশ্চন্দ্র গোপালচন্দ্রকে তার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য বলেন। ১৯২১ সালে গোপালচন্দ্র যোগ দেন জগদীশ্চন্দ্রের নব প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে। সেখানে তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় ও গাছপালা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান।

গোপালচন্দ্র যখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কর্মরত, তখন (১৯২১) সেখানে এসেছিলেন জার্মান প্রকৃতি বিজ্ঞানী হ্যানস মলিশ। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তার সহকারী হিসেবে ছয় মাস কাজ করেন। তিনি হ্যানস মলিশের সাথে কীটপতঙ্গের আচার-আচরণ, গতি-প্রকৃতি, খাদ্য সংগ্রহের কৌশল, তাদের বংশবিস্তার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সমন্ধে গবেষণা করেন। যার ফলে কীটপতঙ্গ ও লতাপাতা বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা আরও বৃদ্ধি পায়। গোপালচন্দ্র গবেষণা করেছেন বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড় নিয়ে। তার মধ্যে ছিল, ব্যাঙ্গাচি, শুইপোকা, মাছখোকো মাকড়াশা, বোলতা ইত্যাদি পোকা মাকড়ের জীবন ও বৈচিত্র্য। স্ত্রী ও পুরুষ মাকড়সার আচার আচরণ ও গতিবিধি, তাদের শক্তি ও অবস্থান, ডিম দেয়া ও এর যত্ন, স্ত্রী মাকড়সার প্রতি পুরুষ মাকড়সার আচরণ, স্ত্রী মাকড়সা কর্তৃক পুরুষ মাকড়সার গলাধঃকরণ। শুয়োপোকা, প্রজাপতি, পিঁপড়ে ইত্যাদির জীবন রহস্য। এছাড়া তিনি কীটপতঙ্গ সমন্ধে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা করে গেছেন। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি কীটপতঙ্গ ও লাতাপাতা বিষয়ে ১৬টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেন। সুবিখ্যাত ‘ভারত কোষ’ সম্পাদনায় ও গোপালচন্দ্রের ছিল অসামান্য অবদান।

১৯৪৯ সালে গোপালচন্দ্র যোগ দেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্র নাথ বসুর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদে। সম্পাদক হন মুখপাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান পত্রিকার। সেই পত্রিকায় তিনি শিশুবিষয়ক ৮০০ নিবন্ধ রচনা করেন। গাছ-উকুনের রস ও মুকুলের মধুতে থাকা ভিটামিন ‘বি’ এর প্রভাবে পিপড়ের শ্রেণিবিন্যাস হয়। তিনি গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন খাদ্যবস্তুর প্রভাবে পিঁপড়ের বাচ্চারা ডিম ফুতে কেউ হয় রাণী, কেউ হয় শ্রমিক আবার কেউ হয় পুরুষ। যারা ভিটামিন বেশি পায় তারা হয় রাণী, যারা কম পায় তারা হয় পুরুষ, আর যারা সবচেয়ে কম পায় তারা হয় শ্রমিক। তবে সবচেয়ে কম খাদ্য পওয়ার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি হয়। এ বিষয়ে দুটি মতবাদ আছে। একটি হলো জেনেটিক এবং আরেকটি হলো ট্রাফিক। উক্ত মতবাদ দুটি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ৪০ বছর আগেই দিয়ে গেছেন। কিন্তু তার এই মতবাদের কোনো স্বীকৃতি আজও মেলেনি। যা রয়ে গেছে অন্তরালে। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের গবেষণার কথা লিখে শেষ হবে না। তার লেখা অনেকগুলো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। তার লেখা কিছু ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সায়েন্স অ্যান্ড কালচার, ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির মুখপত্র, মডার্ন রিভিউ ইত্যাদি বিখ্যাত পত্রিকায়। তবে তার এই প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো যদি বিদেশি নামকরা পত্রিকায় প্রকাশ করা যেত, তিনি হতে পারতেন বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীর একজন।

১৯৫১ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা এতে বাধ সাধেন। তারা গোপালচন্দ্রের মতো একজন কম শিক্ষিত লোকের সাথে সম্মেলন করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এখানে একটি কথা হলো, গোপালচন্দ্রকে যারা কম শিক্ষিত বলে আলোচনায় অনীহা জানিয়েছিলেন, প্রকৃত পক্ষে তারাই অশিক্ষিতের পরিচয় দিয়েছেলেন। কেননা পৃথিবীতে বহু সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, মনিষী রয়েছেন যাদের অনেকেই ছিল অশিক্ষিত ও সাধারণ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। এমনকি অনেকের অক্ষর জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। “করে দেখা”(kara dakha) নামক একটি বই রচনা করে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য অনেক সুনাম কড়িয়েছিলেন। যে বইটি প্রকাশ পায় ৩ খণ্ডে। গোপালচন্দ্র কে শুধু একজন বিজ্ঞানী বললেই চলবে না। তিনি ছিলেন গবেষক-লেখক। তিনি ১০০০ টির মত বিজ্ঞান বিষয়ক আর্টিকেল রচনা করে গেছেন। তিনি সম্পাদিত পত্রিকায় শিশদের বিজ্ঞান বিষয়ক ৮০০ নিবন্ধ লিখেন। যার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৬৮ সালে লাভ করেন ‘আনন্দ পুরুস্কার’(আনন্দ সাহিত্য পুরুস্কার)। ১৯৪৭ সালে লাভ করেন আচার্য সতেন্দ্রনাথ বসু ফলক। ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তাকে দেওয়া হয় জাতীয় সংবর্ধনা। ১৯৭৫ সালে ‘কীটপতঙ্গ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন রবীন্দ্র পুরুস্কার। কলকাটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালের ২১ জানুয়ারী তাকে দেয়া হয় ডি এস সি উপাধি। ১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।