উপন্যাস হওয়ার পথের উপন্যাস
মাজেদা মুজিবপ্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০
হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাস ‘সুলতান’। তিনি এটিকে উপন্যাস হওয়ার পথের উপন্যাস বলেছেন। শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনীভিত্তিক লেখা। অনেকটা ইতিহাসও। এইসব ফিকশনের প্রধান সমস্যা হলো, না হতে পারে জীবনী আবার না হতে পারে ইতিহাস। তিনি অবরোহন পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেন। সুলতানের শেষ বয়স থেকে ক্রমে শৈশবে গিয়েছেন। আবার স্মৃতিচারণ আছে মাঝেমধ্যে। সুলতানকে শিল্পী ও বড় মানুষ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা আছে। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বাংলাদেশে তার প্রথম ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। আহমদ ছফা সুলতানের ছবি নিয়ে অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং তিনি লিখেও ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, বাংলাদেশে সুলতানের জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে ছফার লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সুলতানের ছবিতে গ্রামীণ জনপদের মানুষের যে ফিগার দেখানো হয়েছে তা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে তার ছবির বিষয় ও শিল্পসত্তা নিয়ে ততটা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে সুলতান পরিচিত হয়েছেন মধ্য বয়স অতিক্রম করে যখন তার ছবি লাহোর, করাচি, লন্ডনে প্রদর্শিত হয়েছে। সুলতানের একটা চাপা অভিমান ছিল এ বিষয়ে। তিনি ক্লেইম করেছেন জয়নুল প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে তার জন্য বিশেষ কিছু করেননি। অবশ্য তার বিরুদ্ধেও তৎকালীন শিল্পীদের ক্লেইম ছিল। নেশার প্রতি নেশার কারণে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, এটি বলা হলেও সুলতানের ব্যাখ্যা ছিল অন্য। তিনি শ্রেণিচ্যুত কিংবা চিত্রশিল্পের সমঝদার শ্রেণির শ্রেণিতে তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি একাডেমিক শিক্ষা কিংবা তার ছবির পটভূমির কারণে।
তার ছবিতে উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবন। ধানভানা, মাছ কাটার আনন্দময় মুহূর্ত, কাস্তে হাতে কৃষকের মাঠে গমন, চরদখলের দৃশ্য কিংবা যুদ্ধের সময় শিশুকোলে পালানো ভয়ার্ত মা, বর্শা বল্লম হাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি। এসব ছবির হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে সমালোচনা করা যায় কিংবা ব্যাকরণ মেনে আঁকেননি, এসবও বলা যায়। তবে সুলতানের ছবির শক্তি অন্য জায়গায়। তার আঁকা স্ফিত ফিগার। হরিপদ দত্ত তার `জন্ম জন্মান্তর` উপন্যাসে বাঙালির কৃশকায়াকেই চিরকালীন কায়া বলে চিহ্নিত করেছেন। নিহাররঞ্জন রায় `বাঙালির ইতিহাস`এ বাঙালিকে শুধু স্বভাবে বেতসলতা বললেও বাঙালির চিরকালীন অভাবের শরীরও বেতসলতাই বটে। কিন্তু সুলতান এখানে ব্যতিক্রম হলেন। তিনি বাঙালির ভেতরের পুঞ্জিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। যে নিম্নবর্গের বাঙালি কৃষক, শ্রমিক হাজার বছর ধরে সংগ্রাম করে টিকে আছে প্রকৃতি, মহাজন, জোতদার, ব্রিটিশ শাসন কিংবা এখনের আমলা মুৎসুদ্দি, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, তাদেরকে তিনি শক্তির প্রতীক হিসেবে স্ফীতকায় করে দেখালেন।
সুলতানের জীবনযাপন পদ্ধতি মিথ হয়ে আছে। শাড়ি পরতেন। নূপুর পরে নাচতেন। বাঁশি বাজাতেন। সঙ্গীত নিয়ে তার গভীর অনুরাগ ছিল। তারেক মাসুদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন আদমসুরাত। যারা সুলতানকে জানতে চান, তার জীবন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাদের জন্য `সুলতান` আগ্রহোদ্দীপক বই।