ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গল্প ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’

পুনর্মুদ্রণ

প্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০১৯

বেতাল কহিল, মহারাজ! শ্রবণ কর,
বারাণসী নগরীতে, প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবী নামে প্ৰেয়সী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে হৃদয়নন্দন নন্দন ছিল। একদিন রাজকুমার, একমাত্র অমাত্যপুত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। তিনি নানা বনে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে এক নিবিড় অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, ঐ অরণ্যের মধ্যবর্তী অতি মনোহর সরোবর সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, ঐ সরোবরের নির্মল সলিলে হংস, বক, চক্ৰবাক প্রভৃতি নানাবিধ জলচর বিহঙ্গমগণ কেলি করিতেছে; প্রফুল্ল কমলসমূহের সৌরভে চারিদিক আমোদিত হইয়া আছে; মধুকরেরা, মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া গুন গুন ধ্বনি করত, ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছে; তীরস্থিত তরুগণ অতিনব পল্লব, ফল, কুসুম সমূহে সুশোভিত রহিয়াছে; উহাদের ছায়া অতি স্নিগ্ধ; বিশেষতঃ, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার দ্বারা, পরম রমনীয় হইয়া আছে; তথায় উপস্থিতি মাত্র, শ্রান্ত ও আতপক্লান্ত ব্যক্তির শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর হয়।

এই পরম রমণীয় স্থানে, কিয়ৎক্ষণ সঞ্চরণ করিয়া, রাজকুমার অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং সমীপবর্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ববন্ধন ও সরোবরে অবগাহনপূর্বক, স্নান করিলেন; অনন্তর, অনতিদূরবর্তী দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দর্শন, পূজা, ও প্ৰণাম করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন। ঐ সময়মধ্যে এক রাজকন্যাও, স্বীয় সহচরী বর্গের সহিত, সরোবরের অপর পারে উপস্থিত হইয়া স্নান ও পূজা সমাপনপূর্বক, বৃক্ষের ছায়ায় ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। দৈবযোগে, তাঁহার ও বজ্রমুকুটের চারি চক্ষুঃ একত্র হইল। তদীয় নিরুপম সৌন্দর্য সন্দর্শনে, নৃপনন্দন মোহিত হইলেন। রাজকুমারীও, বজ্রমুকুটকে নয়নগোচর করিয়া, কৃতাৰ্থন্মন্য হইয়া, শিরঃস্থিত পদ্ম হন্তে লইলেন; অনন্তর, কর্ণসংযুক্ত করিয়া, দন্ত দ্বারা ছেদনপূর্বক, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিলেন; পুনর্বার গ্রহণ ও হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, বারংবার রাজতনয়ের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে, স্বীয় প্ৰিয়বয়স্যাগণের সহিত স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন।

কুমারী ক্ৰমে ক্ৰমে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, রাজকুমার বিরহবেদনায় অতিশয় অস্থির হইলেন, এবং সর্বাধিকারিকুমারের নিকটে গিয়া, লজ্জানম্র মুখে কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! আজি আমি এক পরম সুন্দরী রমণী নিরীক্ষণ করিয়াছি; তাহার নাম ধাম কিছুই জানিতে পারি নাই; কিন্তু প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহাকে না পাইলে, প্ৰাণত্যাগ করিব। সর্বাধিকারিতনয়, সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে গৃহে প্রত্যানীত করিলেন। রাজকুমার, দুঃসহ বিরহবেদনায় নিতান্ত অধীর হইয়া, শাস্ত্রচিন্তা, সদালাপ, রাজকাৰ্যপর্যালোচনা, ও স্নান ভোজন প্ৰভৃতি আবশ্যক ক্রিয়া পর্যন্ত পরিত্যাগপূর্বক, একাকী নির্জনে বিষন্ন মনে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন; পরিশেষে চিত্তবিনোদনের কোনও উপায় না দেখিয়া স্বহস্তে সেই কামিনীর প্রতিমূর্তি চিত্ৰিত করিলেন। দিন যামিনী, কেবল সেই প্ৰতিমূর্তির সন্দর্শন করেন; কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, উত্তর দেন না। সৰ্বাধিকারিপুত্র, নৃপনন্দনের এতাদৃশী দশা নিরীক্ষণ করিয়া, উপদেশচ্ছলে অশেষপ্রকার ভর্ৎসনা করিলেন।

প্রিয় বয়স্যের উপদেশবাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া, রাজকুমার কহিলেন, সখে! আমি যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিয়াছি, তখন আমার হিতাহিতচিন্তা ও সুখদুঃখবিবেচনা নাই। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, মনোরথ সম্পন্ন না হইলে, জীবনবিসর্জন করিব। রাজকুমারের ঈদৃশ আক্ষেপবাক্য কর্ণগোচর করিয়া, সৰ্বাধিকারিকুমার মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আর এখন উপদেশ দ্বারা ধৈৰ্যসম্পাদনের সময় নাই; ইনি নিতান্ত অধীর হইয়াছেন; অতঃপর কোনও উপায় স্থির করা আবশ্যক। অনন্তর, তিনি রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! প্ৰস্থানকালে, সেই সীমন্তিনী তোমাকে কিছু বলিয়াছিল, কিংবা তুমি তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে। রাজপুত্র কহিলেন, না বয়স্য! আমি তাহাকে কিছু বলি নাই; এবং সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরীও আমায় কোনও কথা বলে নাই। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, তবে তাহার সমাগম দুর্ঘট বোধ হইতেছে। রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি সেই সুলোচনা লোচনানন্দদায়িনী না হয়, আমি প্ৰাণত্যাগ করিব। তখন তিনি, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, পুনরায় কহিলেন, ভাল বয়স্য! জিজ্ঞাসা করি, প্ৰস্থানসময়ে, সে কোনও সঙ্কেত করিয়াছিল কি না।

রাজকুমার কমলবৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, সখে! আর চিন্তা নাই; আমি তৎকৃত সঙ্কেতের তাৎপর্যগ্ৰহ করিয়াছি, এবং তাহার নাম ধাম জানিতে পারিয়াছি। এখন প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, অল্প দিনের মধ্যেই, তাহার সহিত তোমার সমাগম সম্পন্ন করিয়া দিব। অধিক ব্যাকুল হইলেই, অভীষ্টসিদ্ধি হয় না; ধৈৰ্য অবলম্বন কর। তখন রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি বুঝিয়া থাক, সমুদয় বিশেষ করিয়া বল; শুনিলেও, আপাততঃ স্থির হইতে পারি। তিনি কহিলেন, বয়স্য! শ্ৰবণ কর, পদ্মপুষ্প, মস্তক হইতে নামাইয়া, কৰ্ণে সংলগ্ন করিয়াছিল; তদ্বারা তোমাকে ইহা জানাইয়াছে, আমি কর্ণাটনগরীনিবাসিনী; দন্ত দ্বারা খণ্ডিত করিয়া, ইহা ব্যক্ত করিয়াছে, আমি দন্তবাট রাজার কন্যা; তৎপরে, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, এই সঙ্কেত করিয়াছে, আমার নাম পদ্মাবতী; আর, হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, এই অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিয়াছে, তুমি আমার হৃদয়বল্লভ।

বয়স্যের এই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া রাজকুমার অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং ব্যগ্র হইয়া বারংবার কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! ত্বরায় আমায় কর্ণাটনগরে লইয়া চল। অনন্তর, উভয়ে সমুচিত পরিচ্ছদধারণ ও অস্ত্ৰবন্ধনপূর্বক অশ্বে আরোহণ করিলেন। কতিপয় দিবসের পরে, কর্ণাটনগরে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা রাজবাটীর নিকটে গিয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধ আপন ভবনদ্বারে উপবিষ্টা আছে। উভয়ে, অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিলেন, মা! আমরা বাণিজ্যব্যবসায়ী বিদেশীয় লোক; দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র পশ্চাৎ আসিতেছে; বাসার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত, আমরা অগ্রসর হইয়াছি; যদি কৃপা করিয়া স্থান দাও, তবে থাকিতে পাই। বৃদ্ধা, তাঁহাদের মনোহর রূপ দর্শনে ও মধুর আলাপ শ্রবণে প্ৰীত হইয়া, প্ৰসন্ন মনে কহিল, এ তোমাদের গৃহ, যতদিন ইচ্ছা, সচ্ছন্দে অবস্থিতি কর। এইরূপে, উভয়ে সেই বর্ষীয়সীর সদনে আবাসগ্রহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বৃদ্ধা, তাঁহাদের সন্নিধানে আগমন করিয়া, কথোপকথন আরম্ভ করিলে, অধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! কয়জন তোমার পরিবার, আর কি প্রকারে বা সংসার নির্বাহ হয়। বৃদ্ধা কহিল, আমার পুত্র রাজসংসারে কর্ম করে, রাজার অতি প্রিয় পাত্র। আর, পদ্মাবতী নামে রাজার এক কন্যা আছেন, আমি তাঁহার ধাত্রী ছিলাম। এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি, গৃহে থাকি; রাজা অনুগ্রহ করিয়া অন্ন বস্ত্র দেন। আর, রাজকন্যা আমায় ভালবাসেন; এজন্য, প্রতিদিন, এক একবার, তাঁহাকে দেখিতে যাই। এই কথা শুনিয়া, রাজপুত্ৰ কহিলেন, কল্য যখন রাজবাটীতে যাইবে, আমায় বলিবে; আমি তোমা দ্বারা রাজকন্যার নিকট কোনও সংবাদ পাঠাইব। বৃদ্ধা কহিল, যদি প্রয়োজন থাকে, বল, আজই আমি রাজকন্যাকে জানাইয়া আসি। রাজকুমার, এই কথা শুনিবা মাত্র, অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া কহিলেন, তুমি রাজকন্যাকে বলিবে, শুক্লপঞ্চমীতে, সরোবরতীরে, যে রাজকুমারকে দেখিয়াছিলে, সে, তোমার সঙ্কেত অনুসারে, উপস্থিত হইয়াছে।

এই বাক্য কর্ণগোচর হইবামাত্র, বৃদ্ধা যষ্টিগ্রহণপূর্বক রাজভবনে গমন করিল। সে কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, রাজকন্যা একাকিনী নির্জনে উপবিষ্টা আছেন। বৃদ্ধা সম্মুখবর্তিনী হইবামাত্র, রাজকন্যা সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিলেন। সে উপবিষ্ট হইয়া কহিল, বৎসে। বাল্যকালে, অনেক যত্নে, তোমায় মানুষ করিয়াছি। এক্ষণে, ভগবানের অনুগ্ৰহে, তুমি তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার অন্তঃকরণের একান্ত অভিলাষ এই, অবিলম্বে উপযুক্ত পাত্রের হস্তগতা হও। এইরূপ আড়ম্বরপূর্বক ভূমিকা করিয়া, বৃদ্ধা কহিতে লাগিল, শুক্লপঞ্চমীতে, বাপীতটে, যে রাজকুমারের মন হরণ করিয়া আনিয়াছিলে, তিনি আমার গৃহে উপস্থিত হইয়াছেন, এবং আমা দ্বারা এই সংবাদ পঠাইয়াছেন, কমলসঙ্কেত দ্বারা যে অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলে, তাহা সম্পন্ন কর; আমি উপস্থিত হইয়াছি। আর, আমিও কহিতেছি, এই রাজকুমার সর্বাংশে তোমার যোগ্য পাত্র; তুমি যেরূপ রূপবতী ও গুণবতী, তিনিও সর্বাংশে তদনুরূপ।

রাজকন্যা শ্রবণমাত্র, কোপ প্রকাশ করিয়া, হস্তে চন্দন লেপনপূর্বক, বৃদ্ধর উভয় গণ্ডে চপেটাঘাত করিলেন, এবং কহিলেন, তুমি এই মূহুর্তে আমার অন্তঃপুর হইতে দূর হও। বৃদ্ধা, এইপ্ৰকার তিরস্কার লাভ করিয়া, বিরক্ত হইয়া, বিষন্ন বদনে সদনে প্রত্যাগমনপূর্বক, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকুমারের কর্ণগোচর করিল। তিনি শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল ও হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, পার্শ্ববর্তী প্রিয় বয়স্যের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, সখে। এখন কি উপায় করি; নিতান্ত বুঝিলাম, বিধি বাম হইয়াছেন; মনস্কামসিদ্ধির কোনও সম্ভাবনা আছে, এরূপ বোধ হইতেছে না; নতুবা, সেই বামলোচনা, কি নিমিত্ত, তিরস্কার করিয়া, বৃদ্ধাকে বিদায় করিল। অন্তঃকরণে অনুরাগ সঞ্চার হইলে, দূতীর প্রতি এত অনাদর হয় না। তখন তিনি কহিলেন, বয়স্য! মৰ্মগ্রহ না করিয়া, অকারণে এত ব্যাকুল হও কেন। শ্ৰীখণ্ডরসে অভিষিক্ত দশ করশাখা দ্বারা প্ৰহারের তাৎপৰ্য এই যে, শুক্ল পক্ষের দশ দিবস অবশিষ্ট আছে; তদবসানে, অর্থাৎ কৃষ্ণ পক্ষে তোমার সহিত সমাগম হইবেক।

শুক্ল পক্ষ অতিক্রান্ত হইল। বৃদ্ধা, পুনরায় রাজকুমারীর নিকটে গিয়া, রাজকুমারের প্রার্থনা জানাইল। তিনি শুনিয়া সাতিশয় কোপপ্ৰকাশ করিলেন; এবং, গলহস্তপ্রদানপূর্বক, বৃদ্ধাকে, অন্তঃপুরের খড়কী দিয়া, বিদায় করিয়া দিলেন। সে, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারের নিকটে গিয়া, এই বৃত্তান্ত জানাইল। তিনি শুনিয়া, নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। তখন সৰ্বাধিকারীর পুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! কেন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, আর ভাবনা নাই; এ অনুকুল গলহস্ত, অপ্ৰশস্ত নহে; তুমি পূর্ণমনোরথ হইয়াছ। অন্য রজনীযোগে, তোমায়, সেই খড়কী দিয়া, তাহার অন্তঃপুরে যাইতে সঙ্কেত করিয়াছে। রাজপুত্র, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, নিতান্ত উৎসুক চিত্তে, সূৰ্যদেবের অস্তগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

রজনী উপস্থিত হইল। রাজকুমার, বিহারযোগ্য বেশভূষার সমাধান করিয়া, প্রিয় বয়স্যের সহিত, অন্তঃপুরের খড়কীতে উপস্থিত হইলেন। সর্বাধিকারীর পুত্র বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিলেন; তিনি, তন্মধ্যে দিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, রাজকুমারী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হওয়াতে, উভয়ে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলেন। রাজকুমারী, পার্শ্ববর্তিনী বয়স্যার প্রতি, দ্বার বদ্ধ করিবার আদেশ দিয়া, রাজকুমারের করগ্রহণপূর্বক, বিলাসভবনে প্রবেশ করিলেন, এবং সুশোভিত স্বর্ণময় পল্যঙ্কে উপবেশনানন্তর, বল্লভের কণ্ঠদেশে স্বহস্তসঙ্কলিত ললিত মালতীমালা সমৰ্পণ করিয়া, স্বয়ং তালবৃন্তসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন রাজকুমার কহিলেন, প্রিয়ে! তোমার বদনসুধাকরসন্দর্শনেই, আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইয়াছে, আর এরূপ ক্লেশস্বীকারের প্রয়োজন নাই; বিশেষতঃ, তোমার কোমল করপল্লব শিরীষ কুসুম অপেক্ষাও সুকুমার, কোনও ক্রমে তালবৃন্তধারণের যোগ্য নহে; আমার হস্তে দাও; আমি তোমার সেবা দ্বারা আত্মাকে চরিতার্থ করি। পদ্মাবতী কহিলেন, নাথ! আমার জন্য, তোমায় অনেক ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছে; অতএব, তোমার সেবা করাই আমার উচিত হয়।

উভয়ের এইরূপ বচনবৈদগ্ধী শ্ৰবণগোচর করিয়া, পার্শ্ববর্তিনী সহচরী, পদ্মাবতীর হস্ত হইতে তালবৃন্ত গ্রহণপূর্বক, বায়ুসঞ্চারণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাজকুমার ও রাজকুমারী সহচরীদিগকে সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, দাম্পত্যবন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। অনন্তর, উভয়ের সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব দেখিয়া, সহচরীগণ, কার্যান্তরব্যপদেশে, বিলাসভবন হইতে বহির্গত হইলে, কান্ত ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন করিলেন।

রজনী অবসন্না হইল। রাজকুমার অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিলেন। তখন রাজকুমারী কহিলেন, নাথ! আমার এ অন্তঃপুরে, সখীগণ ব্যতিরেকে, অন্যের প্রবেশ করিবার অধিকার নাই; তুমি নিৰ্ভয়ে অবস্থিতি কর। আমি, তোমায় বিদায় দিয়া, ক্ষণমাত্রও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। রাজকুমার, প্রিয়তমার ঈদৃশ প্রণয়রসাভিষিক্ত মৃদু মধুর বচন পরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিয়া, তদীয় প্ৰস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং তাঁহার সহচর হইয়া, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে, রাজকুমার রাজধানীপ্ৰতিগমনের অভিপ্রায়প্ৰকাশ করিলেন। রাজকন্যা, কোনও মতে, সম্মত হইলেন না। ক্রমে ক্রমে, প্রায় মাস অতীত হইয়া গেল; রাজকুমার তথাপি প্ৰস্থানের অনুমতিলাভ করিতে পারিলেন না। এইরূপে, স্বদেশপ্ৰতিগমনবিষয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, তিনি একদিন, নির্জনে বসিয়া মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, আমি নিতান্ত নরাধম; অকিঞ্চিৎকর ইন্দ্ৰিয়সুখের পরতন্ত্র হইয়া, পিতা মাতা জন্মভূমি প্রভৃতি সকল পরিত্যাগ করিলাম; আর, যে জীবিতাধিক বান্ধবের বুদ্ধিকৌশলে ও উপদেশবলে, ঈদৃশ অসুলভ সুখসম্ভোগে কালাহরণ করিতেছি, মাসাবধি তাহারও কোনও সংবাদ লইলাম না; বোধ করি, বন্ধু আমায় নিতান্ত স্বার্থপর ও যার পর নাই অকৃতজ্ঞ ভাবিতেছেন।

রাজকুমার একাকী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে রাজকন্যা তথায় উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে সাতিশয় বিষন্ন দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, নাথ! আজি কি জন্যে তুমি এমন উন্মনা হইয়াছ। তোমার চন্দ্ৰবদন বিষন্ন দেখিলে, আমি দশ দিক শূন্য দেখি। অসুখের কারণ কি, বল; ত্বরায় তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। বজ্রমুকুট কহিলেন, পিতার সর্বাধিকারীর পুত্র আমার সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন। তিনি আমার পরম সুহৃৎ; মাসাবধি তাঁহার কোনও সংবাদ পাই নাই; জানি না, তিনি কেমন আছেন। তিনি অতি চতুর, সর্বশাস্ত্ৰে পণ্ডিত, ও নানা গুণরত্নে মণ্ডিত। তাঁহারই বুদ্ধিকৌশলে ও মন্ত্রণাবলে, তোমার সমাগম লাভ করিয়াছি। তিনিই তোমার সমস্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ভেদ করিয়াছিলেন।

পদ্মাবতী কহিলেন, অয়ি নাথ! ঈদৃশ বন্ধুর অদর্শনে, চিত্ত অবশ্যই উৎকণ্ঠিত হইতে পারে। এত দিন তাহার কোনও সংবাদ না লওয়ায়, যৎপরোনাস্তি অভদ্রতা প্ৰকাশ হইয়াছে। রহস্যবিদ বন্ধু প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তুমি তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ অপরাধী হইয়াছ, এবং, যার পর নাই, অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছ। এক্ষণকার কর্তব্য এই, তাহার পরিতোষার্থে, আমি স্বহস্তে নানাবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া পাঠাই; এবং তুমিও, একবার, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, তথায় গিয়া, সমুচিত সদ্ভাবপ্রদর্শন করিয়া আইস। রাজপুত্র, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়কী দিয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলেন, এবং, বহু দিবসের পর, অকপটপ্রণয় পবিত্র মিত্র সহ সাক্ষাৎকারলাভে অশ্রুপূর্ণলোচনা হইয়া, তাঁহার নিকট পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন।

রাজপুত্রকে বন্ধুদর্শনে প্রেরণ করিয়া, রাজকন্যা মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, এ কেবল বন্ধুর বুদ্ধিকৌশলেই কৃতকাৰ্য হইয়াছে; অতএব অবশ্যই সকল কথা তাঁহার নিকট ব্যক্ত করিবেক; আর, সে ব্যক্তিও আপনি বান্ধবগণের নিকট, সমস্ত প্ৰকাশ করিবেক, সন্দেহ নাই। এইরূপে আমার কলঙ্কঘোষণা, ক্রমে ক্রমে, জগদ্ব্যাপিনী হইবার সম্ভাবনা। অতএব, এতাদৃশ ব্যক্তিকে জীবিত রাখা, কোনও ক্ৰমে, শ্রেয়স্কর নহে। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া, পদ্মাবতী, অবিলম্বে নানাবিধ বিষমিশ্ৰিত মিষ্টান্ন প্ৰস্তুত করিয়া সখী দ্বারা রাজকুমারের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

মিষ্টান্ন উপনীত হইলে, সর্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। এ সকল কি। রাজপুত্ৰ কহিলেন, মিত্র। আজ আমি তোমার জন্য অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। রাজকন্যা, আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, কারণজিজ্ঞাসু হইলে, আমি তোমার সবিশেষ পরিচয় দিয়া ও অশেষবিধ প্ৰশংসা করিয়া বলিলাম, প্রিয়ে! আমি এই বন্ধুর অদর্শনে বিষন্ন হইতেছি। রাজকন্যা, তোমার সবিশেষ পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় সন্তষ্ট হইয়াছেন, এবং আমায় অগ্ৰে পাঠাইয়া দিয়া, স্বহস্তে এই সমস্ত প্ৰস্তুত করিয়া, তোমার জন্য প্রেরণ করিয়াছেন। আমায় বলিয়া দিয়াছেন, তুমি আপন সমক্ষে তাঁহাকে মিষ্টান্ন ভোজন করাইয়া আসিবে। অতএব বয়স্য! কিছু ভক্ষণ কর, তাহা হইলে পরম পরিতোষ পাই, এবং যাইয়া তাঁহার নিকটে বলিতে চাই, আমার বন্ধু, মিষ্টান্ন আহার করিয়া, তোমার শিল্পনৈপুণ্যের অশেষপ্রকার প্রশংসা করিয়াছেন।

এই সকল কথা শুনিয়া, সর্বাধিকারিপুত্র, কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর রাজপুত্রের মুখে পুনর্বার মনোযোগপূর্বক পূর্বাপর সমস্ত শ্ৰবণ করিয়া কহিলেন, বয়স্য! তুমি আমার জন্যে কালকূট আনিয়াছ; এ মিষ্টান্ন নহে, সাক্ষাৎ কৃতান্ত, জিহ্বাস্পৰ্শমাত্রই প্ৰাণসংহার করিবেক। আমার পরম সৌভাগ্য এই, তুমি খাও নাই। তুমি নিতান্ত ঋজুস্বভাব, কাহার কি ভাব, কিছুই বুঝিতে চেষ্টা কর না। তোমায় এক সার কথা বলি, স্বৈরিণীরা, স্বভাবতঃ, আপনি প্ৰিয়ের প্ৰিয় পাত্রের উপর অতিশয় বিষদৃষ্টি হয়। অতএব, তুমি, তাহার নিকট আমার পরিচয় দিয়া, বুদ্ধির কার্য কর নাই।

রাজকুমার কহিলেন, বয়স্য। আমি তোমার এ কথায় বিশ্বাস করিতে পারি না। তুমি তাঁহার স্বভাব জান না, এজন্য এরূপ কহিতেছ। এমন সদাশয় স্ত্রীলোক তুমি কখনও দেখ নাই। তাঁহার নাম করিলে, আমার রোমাঞ্চ হয়। আর, আমি, সমবেত সখীগণ সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি; এমন স্থলে, স্বৈরিণীশব্দে তাঁহার নির্দেশ করা, কোনও মতে, ন্যায়ানুগত হইতেছে না। সে যাহা হউক, তিনি যেমন চারুশীলা, তেমনই উদারশীলা, তিনি তোমার প্রাণসংহারের নিমিত্ত, মিষ্টান্নাচ্ছলে কালকূট পাঠাইয়াছেন, তুমি কেমন করিয়া এমন কথা মুখে আনিলে, বুঝিতে পারিতেছি না। বলিতে কি, তুমি আর বার এ প্রকার কহিলে, আমি তোমার উপর যার পর নাই, বিরক্ত হইব। ভাল, কথায় প্রয়োজন নাই, আমি তোমার সন্দেহ দূর করিতেছি। এই বলিয়া, এক লাড়ু লইয়া, রাজকুমার বিড়ালকে ভক্ষণ করাইলেন। বিড়াল তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন রাজপুত্ৰ চকিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, এরূপ দুর্বৃত্তার সহিত পরিচয় রাখা কদাচি উচিত নহে। আর আমি, জন্মাবচ্ছেদে, সে পাপীয়সীর মুখাবলোকন করিব না। মন্ত্ৰিপুত্র কহিলেন, না বয়স্য। তাহারে একবারে পরিত্যাগ করা হইবেক না; কৌশল করিয়া, রাজধানীতে লইয়া যাইতে হইবেক। রাজপুত্র কহিলেন, তাহাও তোমার বুদ্ধিসাধ্য।

অমাত্যপুত্র কহিলেন, বয়স্য! এক পরামর্শ বলি, শুন। আজ তুমি, পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া, পূর্ব অপেক্ষা অধিকতর প্রণয়প্রদর্শন করিবে, এবং বলিবে, বন্ধু, মিষ্টান্ন ভক্ষণের অব্যবহিত পরক্ষণেই, অচেতন্যপ্ৰায় হইয়া, নিদ্রাগত হইয়াছেন। আমি, তোমায় দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইয়া, তাঁহার নিদ্ৰাভঙ্গ পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, চলিয়া আসিয়াছি। আমি এখন, তোমায় এক ক্ষণ নিরীক্ষণ না করিলে, দশ দিক শূন্য দেখি। ফলতঃ, আর আমি, বন্ধুর অনুরোধে এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিব না। এবম্প্রকার মনোহরবাক্যপ্রয়োগ দ্বারা, তাহারে মোহিত করিয়া, দিবাযাপন করিবে; অনন্তর, রাত্রিতে সে নিদ্রাগিতা হইলে, তদীয় সমস্ত আভরণ হরণপূর্বক, তাহার বাম জঙ্ঘাতে ত্ৰিশূলের চিহ্ন দিয়া, চলিয়া আসিবে। রাজপুত্র সম্মত হইলেন, এবং পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া বিলক্ষণ প্রীতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। পরে, রজনীযোগে, উভয়ে শয়ন করিলে, রাজকন্যা ত্বরায় নিদ্রাভিভূত হইলেন। তখন রাজকুমার, মন্ত্রিপুত্রের উপদেশানুরূপ সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন করিয়া, বৃদ্ধার আবাসে উপস্থিত হইলেন।

পর দিন, প্রভাতে, মন্ত্রিপুত্র, সন্ন্যাসীর বেশধারণপূর্বক, এক শ্মশানে উপস্থিত হইলেন, এবং স্বয়ং গুরু হইয়া রাজপুত্রকে শিষ্য করিয়া কহিলেন, তুমি নগরে গিয়া এই অলঙ্কার বিক্রয় কর। যদি কেহ তোমায় চোর বলিয়া ধরে, তাহারে আমার নিকটে লইয়া আসিবে। রাজপুত্র, তদীয় উপদেশ অনুসারে, নগরে প্রবেশ করিয়া রাজসদনের সমীপবাসী স্বর্ণকারের নিকট, রাজকন্যার অলঙ্কারবিক্রয়ার্থে উপস্থিত হইলেন। সে, দর্শনমাত্র, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, কিছুদিন হইল, আমি রাজকন্যার নিমিত্ত এই সকল অলঙ্কার গড়িয়া দিয়াছি; ইহার হন্তে কি প্রকারে আইল। এ ব্যক্তিকে বৈদেশিক দেখিতেছি। অনন্তর, সাতিশয় সন্দিহান হইয়া, স্বর্ণকার কারিকরদিগকে জিজ্ঞাসা করাতে, তাহারা কহিল, হ্যাঁ, এ সমস্ত রাজকন্যার অলঙ্কার বটে। তখন সে, রাজকুমারকে চোর স্থির করিয়া, কহিল, এ রাজকন্যার অলঙ্কার দেখিতেছি, তুমি কোথায় পাইলে, যথার্থ বলো।

স্বর্ণকার, ভয়প্রদর্শনপূর্বক, বার বার এইপ্ৰকার জিজ্ঞাসা করাতে, রাজপথাবাহী বহুসংখ্যক লোক, কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, তথায় সমবেত হইল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যেই ঐ অলঙ্কার লইয়া, বিলক্ষণ আন্দোলন হইতে লাগিল। পরিশেষে, নগরপাল, এই সংবাদ পাইয়া, রাজকুমার ও স্বর্ণকার, উভয়কে রুদ্ধ করিল। পরে, সে অলঙ্কারের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে, রাজকুমার কহিলেন, শ্মশানবাসী গুরুদেব আমায় এই অলঙ্কার বিক্রয় করিতে পাঠাইয়াছেন; তিনি কোথায় পাইয়াছেন, আমি তাহার কিছুই জানি না। যদি তোমাদের আবশ্যক বোধ হয়, শ্মশানে গিয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর। পরিশেষে, নগরপাল, গুরু শিষ্য উভয়কে, অলঙ্কার সমেত রাজসমক্ষে লইয়া গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত বিজ্ঞাপন করিল।

রাজা, অলঙ্কার দর্শনে, নানাপ্রকারে সন্দিহান হইয়া, যোগীকে, নির্জনে লইয়া গিয়া বিনয়বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! আপনি এই সমস্ত অলঙ্কার কোথায় পাইলেন। যোগী কহিলেন, মহারাজ! কৃষ্ণচতুর্দশী রজনীতে, আমি নগরপ্রান্তবর্তী শ্মশানে ডাকিনীমন্ত্র সিদ্ধ করিয়াছিলাম। মন্ত্রপ্রভাবে ডাকিনী, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, প্ৰসাদস্বরূপ স্বীয় অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া দিয়াছেন; এবং আমিও তাঁহার বাম জঙ্ঘাতে, যোগসিদ্ধির প্রমাণস্বরূপ ত্ৰিশূলের চিহ্ন করিয়া দিয়াছি। এ সমস্ত সেই অলঙ্কার। রাজা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন, এবং রাজমহিষীকে বলিলেন, দেখ দেখি, পদ্মাবতীর বাম জঙ্ঘাতে কোনও চিহ্ন আছে, কি না। রাজ্ঞী সবিশেষ অবগত হইয়া, রাজার নিকটে আসিয়া কহিলেন, এক ত্ৰিশূলের চিহ্ন আছে।

রাজা, এবম্প্রকার অঘটনঘটনা দর্শনে, হতবুদ্ধি ও লজ্জায় অধোবদন হইয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এতাদৃশী দুশ্চারিণীকে গৃহে রাখা কদাচি উচিত নহে; ইহাতে অধৰ্ম আছে। অতএব, এখন কি কর্তব্য। অথবা, পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া, সবিশেষ কহিয়া জিজ্ঞাসা করি; তাঁহারা, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন, তদনুরূপ কাৰ্য করিব। কিন্তু, শাস্ত্ৰে গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিতে নিষেধ আছে। পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া ব্যবস্থা জিজ্ঞাসিলে, আমার এই কলঙ্ক, ক্রমে ক্ৰমে দেশে বিদেশে প্রচারিত হইবেক। তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই, সেই সন্ন্যাসীকেই ইহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। সন্ন্যাসী সবিশেষ সমস্ত অবগত আছেন; ধর্মতঃ প্রশ্ন করিলে, অবশ্যই যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিবেন। অনন্তর, রাজা সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! ধর্মশাস্ত্ৰে দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিষয়ে কিরূপ দণ্ড নিরূপিত আছে। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে স্ত্রীলোক, বালক, ব্ৰাহ্মণ ইহারা অত্যন্ত অপরাধী হইলেও, বিধার্হ নহে; রাজা ইহাদের নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন।

রাজা, এই সমস্ত শ্রবণ করিয়া, অন্তঃপুরে গিয়া, রাজ্ঞীকে কহিলেন, পদ্মাবতী অতি দুশ্চরিত্রা; এজন্য শাস্ত্রের বিধান অনুসারে, আমি উহারে দেশবহিস্কৃতা করিব। রাজ্ঞী কন্যার প্রতি নিরতিশয় স্নেহবতী ছিলেন; কিন্তু, পতিব্ৰতাত্বগুণের আতিশয্যবশতঃ রাজার মতেই সন্মতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। অনন্তর নরপতি, কন্যাকে শিবিকারোহণের আদেশ দিয়া, তাহার অগোচরে, বাহকদিগকে আজ্ঞা দিলেন, তোমরা, পদ্মাবর্তীকে কোনও অরণ্যানীতে পরিত্যাগ করিয়া, ত্বরায় আমায় সংবাদ দিবে। বাহকেরা রাজাজ্ঞাসম্পাদন করিল। অমাত্যপুত্রও, তৎক্ষণাৎ, রাজকুমারকে সঙ্গে লইয়া, রাজকুমারীর উদ্দেশে চলিলেন; এবং, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে সেই অরণ্যানীতে প্রবেশিয়া দেখিলেন, পদ্মাবতী, একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া, যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, বিষন্নবদনে রোদন করিতেছেন। অশেষবিধ আশ্বাসপ্রদান দ্বারা তাঁহার শোকাবেগনিবারণ করিয়া, সঙ্গে লইয়া, উভয়ে স্বদেশ অভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন। তাঁহার রাজধানীতে উপস্থিত হইলে, প্ৰজাগণ অতিশয় আনন্দিত হইল। রাজা প্রতাপমুকুট, বধূ সহিত পুত্ৰ পাইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া, নগরে মহোৎসবের আদেশ করিলেন।

এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। রাজা ও মন্ত্রিপুত্র, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি, নিরপরাধে রাজনন্দিনীর নির্বাসনজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে, রাজা। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। রাজা কহিলেন, শাস্ত্রকারেরা আততায়ীর বধে ও বিদ্রোহাচরণে দোষাভাব লিখিয়াছেন। অতএব, বিষপ্রদায়িনী রাজতনয়ার প্রতি এরূপ প্রতিকূল আচরণের নিমিত্ত, মন্ত্রিপুত্রকে দোষী বলিতে পারা যায় না। কিন্তু, রাজা যে, অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, প্রমাণান্তরনিরপেক্ষ ও বিচারবহির্মুখ হইয়া, অপত্যস্নেহবিস্মরণপূর্বক, অকৃত অপরাধে, কন্যাকে নির্বাসিত করিলেন, ইহাতে তাঁহার, রাজধর্মের বিরুদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠানজন্য, পাপম্পৰ্শ হইতে পারে।

ইহা শুনিয়া, বেতাল পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, শ্মশানে গিয়া, পূর্ববৎ বৃক্ষে লম্বমান হইল; রাজাও, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া, তাহাকে, বৃক্ষ হইতে অবতারণপূর্বক, স্কন্ধে করিয়া, সন্ন্যাসীর আশ্রম অভিমুখে চলিলেন।