ইসলামে ৭৩ দল, কোনটি সঠিক?
জুয়েল মিলকিপ্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০
ইসলামের মধ্যে নানা দল, নানা মত, নানা পথ! সবাই বলছে, আমার দল বা মতই সঠিক, অন্যগুলি ভুল। তাহলে কিভাবে বুঝতে পারবো কারটা ঠিক অথবা কার কতটুকু ঠিক, আর কতটুকু ভুল? এ প্রশ্ন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের।
জগৎ-সংসারে সব বিষয়েই আমরা যাচাই-বাছাই করি যাতে ঠকে না যায়। কিন্তু ইসলামের বেলায় অনেক সময় যাচাই-বাছাই না করে নানা রকমের ভেজাল আমল, শিরক, বিদআত নামক আগাছা নিয়ে আমরা পড়ে থাকি। আর ভাবি, সঠিক ইসলামি আক্বিদার ওপর আছি। অথচ পরিষ্কার কথা হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিরা যেভাবে যে আমল করেছেন, তা-ই সঠিক ইসলাম। এর বাইরে যা, সবই বিদআত। সুতরাং সেসব বাতিল।
একটা উদাহরণ দিই। আমরা যখন আম কিনতে যাই তখন দেখি যে, বাজারের সব আমবিক্রেতাই বলে যে, তার আমটাই সেরা। তখন কিন্তু আমরা তাদের কথা শুনি না। বরং আমাদের জ্ঞান দিয়ে যাচাই করে আম কিনি। অথচ ইসলাম মানার ক্ষেত্রে আরও বেশি যাচাই-বাছাই করা উচিত। কারণ এটা চিরস্থায়ী জীবনে লাভ-ক্ষতির বিষয়। এজন্য মিনিমাম এবং অতি আবশ্যক কুরআন-হাদিসের জ্ঞান লাভ করতে হবে। না-হলে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হবে না। মহানবির (স.) এজন্যই বলেছেন, প্রত্যেক নর-নারীর জন্য দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।
একটা ভেজাল বা শিরক বা বিদআত (নতুন উদ্ভাবন) ও পরিভাষার নামের বিকৃতি হয়তো কয়েকশো বছর আগে শুরু হয়েছে। এজন্য জন্ম থেকে বাপ-দাদার আমল থেকে দেখে ও শুনে আসার জন্য তা এত ফেমিলিয়ার লাগে, এত আপন লাগে, এত ভাল লাগে, সঠিক মনে হয়। যদিও তা শিরক, কুফর ও বিদআত নামক ভেজাল এবং আগাছা। জমিতে আগাছা বেশি হলে তখন আসল ফসলকেই নতুন লাগে, অবান্তর লাগে, উদ্ভট লাগে, বেখাপ্পা লাগে, অনাকাঙ্ক্ষিত লাগে, অযাচিত ও অশোভন লাগে। ঠিক এভাবেই হারিয়ে যাওয়া রাসুলুল্লাহ (স.) ও তার সাহাবিদের আমলটি ও সুন্নাহটি ইসলামের আসল পরিভাষার শব্দটি বলা হলে অনেকের কাছে বেখাপ্পা, বেমানান এবং নতুন আমদানি বলে ভ্রম হয়।
অনেকেই তখন বলে, বাপ-দাদারা কি এতদিন ভুল করেছে, এত বড় বড় আলেমরা কি ভুল করেছে? এমন কথা বলে বাপ-দাদার দোহাই কিন্তু মক্কার আবু জাহেলরাও দিয়েছিল। নবি-রাসুলদের কথার বিপরীতে তাদের যুগের জাতির লোকরাও এমন কথাই বলেছে। এতদিন আলিমরা ভুল করেছে কিনা, এর উত্তর হলো, তারা কি মানুষ ছিল না? তা তো অবশ্যই। তাইলে বলেন, উনারা তো বড় আলিম হলেও ফেরেশতা না। আর মানুষেরই তো ভুল হয়, এটাই স্বাভাবিক। ভুল না হওয়াই তো অস্বাভাবিক।
ছোটবেলায় দেখেছি, স্থানীয় হুজুররা যা বলেছে তাকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইসলাম ভেবে নিয়েছি। যেমন, প্রত্যেক সালাতের জন্য আলাদা নিয়ত শিখানো হয়েছে। নাউওয়াইতুআন উসালিয়া... কিন্তু এখন জানতে পেরেছি, হাদিসে এভাবে নিয়ত মুখে পড়ার কথা নেই, নিয়ত অন্তর দিয়ে করলেই হয়। অথচ এক সময় এসব পড়ে বানোয়াট নিয়ত মুখস্থ করতে করতে অনেক সময় ব্যয় করেছি। এখন জানা অনেক সহজ হয়েছে। কারণ কেউ ইসলাম শিখতে চাইলে সে সহজেই সারা দুনিয়ার আলিমদের কথা ও বক্তব্য জানতে পারছে। সহজেই যেকোনো কুরআনের তাফসির, হাদিসের কিতাব হতে হাদিস জানতে পারছে। আগে স্থানীয় হুজুর যা জানতো, ঠিক বেঠিক যা বলতো, তা-ই ছিল ভরসা।
এজন্যই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার পরে মহান আল্লাহ আর নবি-রাসুল পাঠাবেন না। কিন্তু সংস্কারক পাঠাবেন প্রতি শতাব্দীতে যারা ইসলামের মধ্যে ঢুকে পড়া বিভিন্ন ভেজাল শিরক, বিদআত পরিষ্কারে কাজ করবে এবং ইসলামকে মূল রুপে ফিরিয়ে আনবে।
এভাবেই যুগে যুগে চার ইমাম, হাদিসের ইমামরা, ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ., আবদুল কাদির জিলানী রহ., ইমাম গাজ্জালী রহ. ইমাম সুয়ুতি রহ., ইমাম নববি রহ., ইমাম ইবনে হাজার আসকালান রহ. ইমাম ইবনে কাসির রহ., ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ., শেরে হিন্দ মুজাদ্দেদে আল ফেসানী রহ., মঈনউদ্দিন চিশতি রহ., ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রহ.,শাহ জালাল রহ., শাহ সুলতান রহ., হাজী শরিয়তুল্লাহ রহ., মুন্সি মেহেরুল্লাহ রহ. প্রমুখ মনীষীরা ইসলাম সংস্কারের কাজ যুগে যুগে করে গেছেন।
ইসলামে কীভাবে ভেজাল ঢুকে পড়ে? অজ্ঞতা, দুনিয়ায় নিজের আখের গোছানোর জন্য ইসলামের নামে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে না জানলেও ফতোয়া দেয়া, লিখিত না রেখে এক মুখ থেকে অন্য মুখে স্থানান্তরিত হয়ে তথ্য বিকৃত হয়ে যাওয়া, একরোখা এবং অহংকার করতে গিয়ে যা বলেছি তাই ঠিক বলা, নিজেকে সংশোধন না করা, অতি আবেগে নিজের পছন্দের পির ও উলামাকে আসমানে তুলে ফেলা এবং তার সব কথাকে নির্ভুল মনে করা ও প্রচার করা, দুনিয়ার সামান্য পোলাও, মুরগী, গরু, খাসির বিরানি, নগদ টাকার লোভে এগুলো হাত ছাড়া হয়ে যাবার ভয়ে অনেক সময় আসল কথা জানলেও চেপে যাওয়া।
এজন্য সঠিক পথ পাবার জন্য এবং সঠিক পথে থাকার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। মহানবির তিনটি হাদিস অনুসরণ করলে তা কষ্ঠিপাথরের মতো কাজ করবে। ক. তোমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ শক্তভাবে ধরে রাখো তাহলে পথভ্রষ্ট হবে না। খ. আমার যুগ শ্রেষ্ঠ যুগ, উত্তম যুগ। এরপর আমার সাহাবিদের যুগ উত্তম যুগ। সে হিসেবে ইসলামের ইবাদতের বিষয়গুলো রাসুলুল্লাহ ও তার সাহাবিদের যুগ অনুসরণ করলেই আমরা সঠিক পথে থাকবো। ইসলামের ইবাদতে এর পরে আবিষ্কৃত বিভিন্ন পদ্ধতি পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য, আপাতদৃষ্টিতে তা যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন।
এই কষ্ঠিপাথরে ফেলে যেকোনো আমল করার আগে আমরা যাচাই করে দেখবো, মহানবি ও তার সাহাবিরা আমল ও ইবাদত করেছেন কিনা।
তিন নম্বর হাদিসটি হচ্ছে, ইহুদিদের মধ্যে ৭১টি দল হয়েছে। খ্রিস্টানদের মধ্যে ৭২টি দল হয়েছে। আর ইসলামের মধ্যে ৭৩ দল হবে। ইসলামের এই ৭৩ দলের মধ্যে একটাই সঠিক এবং জান্নাতি দল। বাকিগুলো পথভ্রষ্ট ও জাহান্নামি দল। সাহাবিরা জিগেশ করলেন, কোন দলটা সঠিক? নবির জবাব, যারা আমাকে ও তোমাদেরকে অনুসরণ করবে তারাই সঠিক পথে থাকবে এবং তারাই জান্নাতি দল।