ইসলাম, শিল্প-সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতা

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২৩

ধর্মীয় ও জাগতিক, স্যাক্রিড ও সেকুলার এগুলো কোনো জলনিরোধ ভাগে বা ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত না। প্রেমের আকুতি, যৌনতা, জাগতিক বাসনা পূর্ণ নিধর্মীয় বস্তুও নয়। ধর্মীয় পরিসরে এগুলোও আলোচ্য, তবে বিশেষ ডিকশন ও মুডে, যে ভাষা বা ভঙ্গিও স্থির, নির্দিষ্ট নয়, এতে বৈচিত্র্য আনারও সুযোগ আছে। ধর্মের নামাশ্রয়ে যে আধ্যাতিকতা তার প্রতি সহৃদয় আকুতি আছে অগণন মানুষের। এই আধ্যাতিক বাসনা পূরণ করতে পারে এমন কাব্য ও গল্প এ দেশে লেখাই হয়নি, যেখানে মুমিন নিজদের ছবি দেখতে পায়, দেখতে পায় তাদের ধর্মবোধজাত দ্বিধা ও দোটানা। উপন্যাসকে যে বহুস্বরিক বা polyphonic হওয়ার কথা কইছিলেন বাখতিন, তা আমাদের এইখানে প্রায় কেউই আমল করে নাই। উপন্যাস নামক এই শিল্প মাধ্যমে যে-বিচিত্র ভোজের আয়োজন থাকার কথা, সাহিত্যের উচ্চতা নির্ধারণকারী আপনাদের মহাত্মা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তা কই? খোদার সাথে বান্দার প্রেমিকের মতো ঝগড়া নিয়ে তো গল্প রচিত হইলো না। ধর্ম ও জাগতিক জীবনের নানা বিচিত্র টানাপোড়েন নিয়ে তো মহাকাব্যিক উপন্যাস লিখিত হওয়ার কথা। হইলো না তো। জগৎ ও ধর্ম উভয়কে নিয়া মোমিনকে প্রতি নিয়ত যে বিচিত্র ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটা তো কারো কথাসাহিত্যে আসলো না,ক্যান? একজন মোমিন-মুসলমানের যে টানাপোড়েন সেটা সকল ধর্মের ধার্মিক মানুষদেরই টানাপোড়েন। বোঝেন কিনা জানি না, আস্তিকেরও নাস্তিক্য অনুভূতি আছে। প্রবল বিশ্বাসীও জীবনের সন্ত্রস্ত কোনো মুহূর্তে বলে ফেলতে পারে, ‘কই, আল্লাহ্‌ আছে নাকি? থাকলে আমার জীবনে এইটা হইলো ক্যান?’ এক্ষুণি পড়ে ফেলেন George Herbert এর The Collar কবিতাটি। বুঝবেন। বিশ্বাসীর এই মাহূর্তিক অনুভবকে কথাসাহিত্যে-কাব্যে আপনি ধরবেন না? নাস্তিকও বহু মুহূর্তে অনুভব করেন পরমকে। তিনি অনুভব কি একেবারেই করেন না যে, নিশ্চয় কোনো গতিমান সত্তা অধিষ্ঠিত ওই অন্তরীক্ষে, অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিতে! কোনো এক চকিত অনুভবে নাস্তিবাদী ভাইও বোধ করেন, হয়তোবা জগতের কোনো পরিচালক শক্তি থেকে থাকবেন, আছেন। বোধ করেন, জানি আমি। জীবনের কোন তুরীয় মুহূর্তে তারও আছে এমতো পরমার্থিক অনুভব। ধর্মসম্পৃক্ত এই বিচিত্র জগতকে তুলে আনার দায়িত্ব কথাসাহিত্যিক বা গাল্পিকরা কেউ না কেউ নেবেনই। অপর হয়ে থাকা `অনুভব`, `অপর` হয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে যারা তুলে আনবেন তারা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা পাওয়ার যোগ্য বটে।


‘কল্পনাকে` ইসলামিক ঐতিহ্যে কিভাবে দেখা হয়, গল্প বলার আরবীয় ঐতিহ্যে ইসলামের ইন্টারভেনশন কি, ‘সিরাত ও আছার’ এ বর্ণিত `কল্পনাকেও হার মানায় এমন কাহিনি-গাঁথা`কে নতুন ন্যারেটিভ মোডে কিভাবে উপস্থাপন করা যায়, বা ইসলামের কাঙ্ক্ষিত ও অপছন্দনীয় গুণাবলিগুলোকে ফিকশনে কিভাবে আনা হয়েছে বা আনা যায়, নৈতিক ও নান্দনিক বিবেচনার সম্পর্ক ও বিভেদ, শিল্পমূল্যের মানে— ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে প্রায়োগিক ও তত্ত্বীয় লেখালেখি দরকার। যেমন, অনেকে মেরাজের ঘটনার ভেতরে `সাইন্স ফিকশন মোটিভ‘ ও `ফাউন্ডেশনাল ইউজ অব ইমাজিনেশান` লক্ষ্য করছেন। মেরাজের ঘটনা কল্পনাকে হার মানায়, কিন্তু মূলধারার ইসলামি ডিস্কোর্সে মিরাজ নবিজীর (সা.) এক শারীরিক বাস্তবতা। কারবালার ইতিহাসে ইসলামি বিশ্ববীক্ষার `রুট-প্যারাডাইম’ ইত্যাদি আবিষ্কারের কথাও বলেন অনেক শিল্পসমালোচক। নরওয়েজিয়ান লেখক ইয়স্তেন গার্ডার পশ্চিমা দর্শন নিয়ে যে উপন্যাস লিখেছেন, ইসলামি চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাস বা ইসলামের মৌলভাব ও প্রতিপাদ্য নিয়ে গল্পের সাসপেন্সে রচিত ওমন কোনো প্রচেষ্টার সাক্ষাৎও আমরা পাই না। অথবা, কমপক্ষে ফরহাদ মজহারের ‘তিমির জন্যে লজিকবিদ্যা’ ঘরানার কোনো কিছু ইসলামি চিন্তার ইতিহাস নিয়েও লক্ষণীয় নয়। আরো সৃজনশীল রচনা তো পরের কথা।

 

তবে অনেকে মনে করেন, ইসলাম ধর্মের যে নেচার তাতে ইসলামের নানা প্রসংগকে ‘শিল্পরূপ’ দেয়া অসম্ভব। কারণ মুসলিমরা এ ব্যাপারে অসহিষ্ণু, আর এ ব্যাপারে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কেও বেশ প্রচার আছে। কিন্তু হিন্দুধর্মে এ সমস্যা নাই। কারণ হিব্দু ধর্মে ধর্ম ও মিথলজি হাত ধরে ধরে চলে। শুনেছিলাম যে, তৌফিক আল হাকীমের এক নাটকে `আল্লাহ` নিজেই এক চরিত্র। আমাদের দেশে এমন কোনো নাটক ভাবা যায়? খুব সম্ভবত সৈয়দ জামিল আহমেদের In Search of Niranjan: Islam, Theatre and Bangladesh গ্রন্থে পড়েছিলাম এই কথাটি, নবিজী (সা:) সারাজীবন কোরানের স্ক্রিপ্টে পারফর্ম করে গেছেন। কোরানের স্ক্রিপ্টই নবির (সা:) জীবন। যাই হোক, আমাদের বিভিন্ন মাজহাবের ইমামগণকে নিয়ে মুভি হতে পারে, ইমাম গাজ্জালীর জীবন ও চিন্তা নিয়ে উপন্যাস হতে পারে। ভাবলে এমন আরো ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যাবে। বামপন্থী তাত্ত্বিক ও লেখক-এক্টিভিস্ট তারিক আলি ইসলামের ইতিহাস, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তার সংঘাত ও সমকালের সংকট নিয়ে সিরিজ উপন্যাস লিখেছেন, The Islam Quintet নামে। তবে এগুলোতে বামপন্থীয়ো আইডিওলজিকাল আন্ডারপিনিংস আছে। বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র রচনার আধার ও আধেয়কে আত্মস্ত করে নতুন বয়ান ও বর্ণনারীতিতে ইসলামের তত্ত্ব ও ইতিহাস কিংবা জীবনবীক্ষা নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা সম্ভব। এর জন্য কোনো এক প্রবল প্রতিভাবানের জন্যে প্রতীক্ষা আমাদের।

 

কাব্যক্ষেত্রে এখনো রুমি ও ইকবালের বাইরে এমন কেউ কি এসেছেন, যারা ঈশ্বরহীন পৃথিবীর ব্যক্তিমানুষের ক্লেদ, কালিমা আর আধুনিক একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের বাইরে যেয়ে অন্যতর এক হার্দিক জগতের ইশারা ও আকুতি নিয়ে হাজির হয়েছেন কাব্য-মঞ্চে? কবি অমিয় চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে আল্লামা ইসরার আহমেদ হয়ে কট্টর সালাফি আলেম আসাদুল্লাহ গালিব পর্যন্ত ইকবালের কবিতাকে কোট করেন। এ দেশে ফররুখের বিকাশ ঘটেনি, আল মাহমুদ প্রায়শই শারীরিকতায় ফুরিয়ে যায়, নজরুলের প্রতিভার বিবিধগামিতা নতুন কাব্যের দিশা দিতে পারেনি। আধ্যাত্মিকতা এক সম্পর্ক ও নৈকট্যের অনুভূতি, অদেখা জগতের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, বা দেখা জগতের বাইরের কোনো পরমার্থের সপ্রাণ ও সজীব অনুধাবন ও ভাবমগ্নতা। এই জগতের ভাষিক রূপায়ন জটিল। এই জটিলতার বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষাগত উপস্থাপন ব্যতীত মুমিনের কাব্য বাসনা ও উপলব্ধির মুক্তি নেই! এ পরিমণ্ডলেও অভাব রয়ে গেল সেই প্রবল কবিপ্রাণের যিনি ‘বিশেষ হইয়াও নির্বিশেষ’ হইবেন!