প্রতীকী ছবি
ইউএনও সাহেবের কপাল, আমার নিয়তি
ফাতিহুল কাদির সম্রাটপ্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০১৯
‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকার একটি হেড লাইন আমার হেডকে হেট করে দিয়েছে। পত্রিকা হেড লাইন করেছে ‘গাড়ি থেকে নেমে শিশুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেললেন টিএনও’। সাথে আছে খেলার ছবি। সেই রিপোর্টে টিএনও-র মহতী কীর্তির স্তবগান শেষে তার মুখনিঃসৃত কিছু ওয়াজও তুলে ধরা হয়েছে। সাংবাদিকতার মান, খবরের আকাল এবং আমাদের সমাজে বিশেষ চাকুরিজীবী শ্রেণির অবস্থান কোথায় পৌঁছেছে তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় এই খবরের সূত্রে।
আমি প্রথমেই সেই টিএনও সাহেবকে এপ্রিসিয়েট করি তার মানবীয় ভাবাবেগ ও শিশুসুলভ মন ধরে রাখার জন্যে। সরকারি কর্মকর্তা হলেও তিনি যে আসলে মানবীয় সত্তাই, এ কথাটি তিনি প্রমাণ করেছেন। আমি চাইব তিনি মৃত্তিকাসংলগ্ন একজন মানুষ, স্রেফ মানুষই থাকবেন জীবনভর। কিন্তু রিপোর্টটির ধরন ও ট্রিটমেন্ট নানা অশুভ আলামতকে উস্কে দেয়।
ইতিহাসে অমর কিংবা ক্ষমতাধর মানুষেরাও কখনো কখনো নিজেদের নামিয়ে আনের মানবিকতার সমতল ভূমিতে। প্রটোকল-বিধিনিষেধ তখন হয়ে যায় অর্থহীন। মহানবি হযরত মুহাম্মদকে (স.) ঘোড়া বানিয়ে তাঁর পিঠে শিশু হাসান-হোসেন পালাক্রমে চেপে বসত। নবিজীর কর্ণদ্বয় হয়ে যেত ঘোড়ার লাগাম। নজরুলের ছেলেমানুষি নিয়ে অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। বারাক ওবামা মেয়েদের সাথে যখন খেলতেন তখন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকতেন না। বড় মানুষদের এই মানবীয় অনুরাগসিক্ত কারবার অবশ্যই প্রশংসার।
সংবাদপত্রে নিউজ ভ্যালু অনুযায়ী তার ট্রিটমেন্ট অর্থাৎ নিউজের আকৃতি, হেড লাইনের আকৃতি ও ধরন, এবং পত্রিকার পৃষ্ঠা ও স্থান নির্ধারিত হয়। এই রিপোর্টটির ট্রিটমেন্ট তার ভ্যালুকে ছাড়িয়ে গেছে। পেছনের কারণ অবশ্যই ভালোকিছু নয়। একজন টিএনও প্রজাতন্ত্রের জুনিয়র কর্মচারী, আমলাতন্ত্রের আধা নবীন সদস্য। চাকরি পেতে বিলম্ব না হলে কেউ বছর ত্রিশেক বয়সেই হয়ে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা ইউএনও। তার মধ্যে বয়সজনিত তারুণ্য ও চপলতা থাকাটাই স্বাভাবিক। এই নিউজে এমন একটা মেসেজ আছে যে, টিএনও সাহেব এমন উচ্চতার কিংবা ক্ষমতাধর এক মানুষ, যাতে তিনি আর রক্তেমাংসে গড়া মানবীয় সত্তা নেই। হেড লাইনে ‘গাড়ি থেকে নেমে’ কথাগুলো খুবই ইঙ্গিতবহ। সরকার জনস্বার্থে জনগণের টাকায় টিএনও সাহেবকে গাড়ি কিনে দিয়েছে। সেই গাড়ি থেকে নামাটাকে রাজরাজড়াদের লিমুজিন থেকে অবতরণের মতো করে তুলে ধরা হয়েছে।
আমরা বিশ্বদ্যিালয়ে পড়ার সময় কত বড় মাপের স্যারকে শিশু ও বন্ধুর মতো পেয়েছি। আমার বেশ কাছের এক সহপাঠী কবিবন্ধু ঢাবির অধ্যাপক। তার ছেলেমানুষি ও খেয়ালি জীবনাচরণ যারা কাছে থেকে দেখেছেন তারা ভালো জানেন, তিনি কেমন। আমার বাসার বারান্দাটা বিশাল। সেখানে বলব্যাট দিয়ে আমরা তিন বাপপুতে খেলি। বড় ছেলেটা ডাক্তার। বাড়িতে গেলে বাচ্চাদের নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ খেলি। ঘুড্ডির সুতো ধরে মাঠে দৌড়াই এখনো। আমার ছাত্ররা জানে, আমি তাদের সাথে যখন মিশি তখন কোথায় নেমে যাই। আমার অনেক সহকর্মীকে দেখি মাঠে বাচ্চাদের সাথে খেলে রীতিমতো খেলোয়াড়ি ভাবকায়দায়। কাদামাঠে ফুটবল খেলতে দেখেছি আমার এক অধ্যক্ষকেও। আমার এক বন্ধু ও তার দু-পুত্র সবাই ইঞ্জিনিয়ার। আমরা একসাথে বল নিয়ে দৌড়াই।
একদিন সিএনজিতে করে যাচ্ছি। এক জায়গায় দেখি দুটো বাচ্চা খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁড়ি থেকে টপটপ করে পড়া রসের ফোটা গিলছে হা করে। আমার খুব লোভ হলো। আমি নেমে গেলাম। মুখে দু-এক ফোটা পড়ল, কিন্তু জামায় লাগল অনেক। এ সবের কোনো নিউজ ভ্যালু নেই। কারণ আমি টিএনও প্রজাতির কেউ নই, অন্য কথায় হতে চাইনি। আমার ছাত্ররা কতকত বড় পদে আছে, রাষ্ট্র তাদের গাড়ি দিয়েছে, আমি নাচার মাস্টার (ফেলনা শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য), আমাকে দেয়নি, তাই আমি নামি ভাড়া করা সিএনজি থেকে। পাজেরোর পাঁজা-কোলে বসা আমার ছাত্ররা গাড়ি থেকে অবতরণ করেন, আর আমি বাস-ট্যাক্সির হাতল ধরে নামি। নামাটা সাধারণ, অবতরণটা উচ্চমার্গীয়। ইউএনও সাহেব গোত্রীয়দের যা কপাল, আমার জন্যে তা নিষ্ঠুর নিয়তি।
সংবাদপত্রের অপসাংবাদিকতা ওই টিএনও সাহেবের মাথা খাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তার সেই শিশুসুলভ চপলতাকে নিয়ে যেভাবে রিপোর্ট করেছে তাতে তিনি নিজেরে ভেতরের সুকুমার সত্তাটি ঝেড়ে ফেলতে পারেন। তিনি অনেক বড়কিছু এটা তাকে ভাবিত করতে পারে। টিএনও হিসেবে পাওয়া ট্রিটমেন্ট ভবিষ্যতে পদোন্নতির সাথে বাড়তে বাড়তে কোথায় যেতে পারে সেই ভাবনায় তিনি আচ্ছন্ন হতে পারেন। তাছাড়া এই খবর জনমনে ভুল বার্তা দিতে পারে। তারা একজন ইউএনওকে বিরাট ও মতত্ত্বের চূড়ায় থাকা একজন কর্মকর্তা ভাবতে পারে। তিনি যে জনগণের অর্থে পোষিত জনসেবক মাত্র, এ কথাটি ভাবতে জনগণ ভিরমি খেতে পারে। ফলে জনগণের কাছে তিনি তথা আমলাতন্ত্র ব্রাক্ষ্মণ্যত্বের অধিকারী বলে পরিগণিত হতে পারেন। গণমুখী, জনসেবী ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্তরায়।
সরকারি প্রশাসন ও জনগণের মাঝে ব্যবধানের দেয়ালসমূহ দূর করতে হবে। রাজা-প্রজার মনোভঙ্গি দূর করতে হবে সবার আগে। ইউএনও সাহেবের কপাল ও আমার নিয়তি নিয়ে কোনো অনুযোগ নেই, অনুযোগ আছে সুশাসন ও সমতা নিয়ে।