ইংরেজ শাসনে বাংলার পাঠশালা শিক্ষার ধ্বংস সাধন
শেষ পর্ব
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০২০
লর্ড বেন্টিঙ্কয়ের পর আঠারশো উনচল্লিশ সালে লর্ড অকল্যান্ড ভারতের বড়লাটের ক্ষমতাভার গ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজী ভাষায় শিক্ষার পক্ষেই তাঁর দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, লর্ড অকল্যান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের দ্বারা সরকারের শিক্ষা প্রচেষ্টাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তিনি সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেয়ার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, নিম্নশ্রেণীর জন্য পড়াশুনা নয় কারণ উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই পঠনপাঠনের জন্য পর্যাপ্ত অবসর রয়েছে। দরকার মতো উচ্চশ্রেণীর সংস্কৃতিই সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সাধারণের জন্য আলাদাভাবে শিক্ষাদানের প্রয়োজন নেই। ইংরেজ সরকার ছিল তখন নিম্ন পরিস্রা বণ নীতির কল্পিত মহিমায় আচ্ছন্ন। নিম্ন পরিস্রাবণ বলতে বোঝায়, উচ্চতর শিক্ষাকে গুরুত্ব দিলেই তা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিম্নে নামবে। ইংরেজদের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চস্তরকে ঘিরেই আরম্ভ হলো, মাধ্যমিক শিক্ষাকে যতোটা গুরুত্ব দেওয়া হলো প্রাথমিক শিক্ষাকে তা দেওয়া হলো না। বরং অবহেলা করা হলো। সাংবাদিক এ্যাডাম ছিলেন ইংরেজদের এসব শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আর পাঠশালা টিকিয়ে রাখার পক্ষে। পাদ্রীর চাকরি ছেড়ে এ্যাডাম সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিলেন।
তিনি পাঠশালা শিক্ষার পক্ষে তিনটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। শিক্ষা সমাজের উপরের স্তরে শুরু হবে এবং পর্যায়ক্রমে নিচের দিকে জনগণ পর্যন্ত পৌঁছাবে এই মতবাদের তিনি তীব্র নিন্দা করেন। সাংবাদিক এ্যাডাম গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার উপর সরকারে দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। বাংলা সরকার এ্যাডামের প্রস্তাবলী বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সরকার তার পরিকল্পনা অনেকটা অবাস্তব বলে মনে করেছে, আবার বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের কথা ভেবেও সরকার তা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে। এ্যাডামের প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণের পর নতুন গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ড বলেন, জনাব এ্যাডামের প্রতিবেদন পাঠ করে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তিনি দেশীয় শিক্ষার ব্যাপারে যা লিখেছেন তারজন্য অভিভূত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার উপায় নেই। সরকারের এখনো ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো সক্ষমতা সৃষ্টি হয়নি। তারমানে আমি এটা বলতে চাই না যে, ভারতবর্ষের জনগণের শিক্ষার কাজ উপেক্ষা করা হোক বা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যাক। কিন্তু এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী আমি উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারেই নজর দেবো। পরবর্তীকালে কাউন্সিল আব এডুকেশন স্পষ্টই ঘোষণা করে, সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, সমাজের বুদ্ধিমান সম্প্রদায়কে শিক্ষিত করে তোলা আমাদের উদ্দেশ্য। এই মতবাদের প্রবক্তারা বিশ্বাস করতো যে শিক্ষা সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে বিস্তারের প্রচেষ্টা নিবদ্ধ রাখতে হবে এবং উপর দিক থেকে নিচের দিকে স্বাভাবিকভাবেই তা পরিশ্রুত হবে। ‘নিম্নগামী পরিশ্রুতকরণ প্রক্রিয়া’ মতবাদ অনুসারে বিভিন্ন জেলা সদর দপ্তরে ‘জিলা স্কুল’ খোলা হয়। ইংরেজির মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদানই ছিল এই বিদ্যালয়সমূহের উদ্দেশ্য। লর্ড অকল্যান্ডের পর গভর্নর জেনারেলের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হন লর্ড এলেনবরা। তিনি ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করলেন, সরকারী চাকরি পেতে গেলে ইংরেজী জানতেই হবে।
ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়ায় ফলে দেশের মানুষ স্বল্পকালের মধ্যেই ইংরেজী জানা এবং ইংরেজী না জানা এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হতে লাগলো। দুপক্ষের মধ্যে বিভেদ বাড়তে বাড়তে এমন দুস্তর হয়ে উঠলো যে একের জন্য অপরের কোনো সহৃদয়তা বা সমবেদনা রইলো না। সেই করুণ অবস্থা প্রসঙ্গে বঙ্কিম বাংলার লোকশিক্ষা প্রবন্ধে বলছেন, ‘শিক্ষিত অশিক্ষিতের হৃদয় বুঝে না। শিক্ষিত অশিক্ষিতের প্রতি দৃকপাত করে না। মরুক রামা লাঙ্গল চষে, আমার ফাউলকারী সুসিদ্ধ হইলেই হইল। রামা কিসে দিন যাপন করে, কি ভাবে, তার কি অসুখ, তার কি সুখ, তাহা নদের ফঁটিক চাঁদ তিলধি স্থান দেয় না। রামা চুলোয় যাক্, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। তাহার মনের ভিতর যাহা আছে, রামা এবং রামার গোষ্ঠী; ছয় কোটি ষাটলক্ষের মধ্যে ছয় কোটি ঊনষাট লক্ষ উননব্বই হাজার নয়শো; তাহারা তাহার মনের কথা বুঝিল না।’ নিম্ন পরিস্রাবণ শিক্ষানীতির সমালোচনা করে বঙ্কিম বলছেন, কথাটির তাৎপর্য এই যে, কেবল উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সুশিক্ষিত হলে নিম্নশ্রেণীর লোকদের পৃথক শিক্ষার দেবার প্রয়োজন নেই, তারা সংস্পর্শে এসেই বিদ্বান হয়ে উঠবে। বিদ্যা জল বা দুগ্ধ নয় যে উপরে ঢাললে নীচে চোষণ করে নিবে। তিনি ইংরেজী শিক্ষার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, বিদ্যানের ভাষা মূর্খে বুঝিতে পারে না, তাহলে সংসর্গের ফল পাবে কী করে?
লর্ড হার্ডিঞ্জ আঠারশো চুয়াল্লিশ সালে বললেন, ইংরেজী শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা গুণ ও যোগ্যতা অনুসারে সরকারী চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবেন। স্বভাবতই এতে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। তিনি আরো বলেন যে, নিম্ন পদগুলিতেও নিরক্ষর ব্যক্তিদের নিয়োগ না করে দেশীয় ভাষায় লিখন পঠনক্ষম ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। লর্ড হার্ডিঞ্জ বাংলার বেশ কয়েকটি জেলায় গ্রামীণ বিদ্যালয় খোলার অনুমোদন দান করেন এবং এসব বিদ্যালয় দেশীয় ভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হার্ডিঞ্জ, মেকলে ও অন্যান্যদের চুঁইয়ে পড়া শিক্ষানীতি যে কতোটা ভ্রান্ত ছিল তা প্রমাণ করে লালবিহারী দে আঠারশো আটষট্টি সালে এক বক্তৃতায় স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, জনসাধারণকে বাদ রেখে সামান্য সংখ্যক ব্যক্তিকে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়ায় দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ সাধিত হবে না। তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার দীর্ঘ ইতিহাসে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, উচ্চশিক্ষিতরা ভারতের জনশিক্ষা বিস্তারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গত পঞ্চাশ বছরের শিক্ষার ইতিহাসেও দেখা যায় ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিতরা বাংলার জনশিক্ষা বিস্তারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাননি। সাধারণ মানুষের শিক্ষার দিকে ব্রাহ্মণরা নজর দেননি। চুঁইয়ে পড়া নীতির উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখলে জনসাধারণের শিক্ষার সুরাহা হবে না।
লর্ড হার্ডিঞ্জের সিদ্ধান্তে একশো একটি বিদ্যালয়ের জন্য একশো একজন শিক্ষক নিযুক্ত করা হলো। হার্ডিঞ্জ প্রবর্তিত বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে দেশীয় ভাষা পড়া-লেখা, পাটিগণিত, ভূগোল এবং ভারত ও বাংলার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সর্বনিম্নস্তরে ছেলেমেয়েদের বর্ণমালা পড়া ও লেখা, যুক্তাক্ষর ও সংখ্যা শেখানো হতো। পরবর্তী পর্যায়ে অক্ষরের সঠিক ধ্বনি শেখানো সহ শ্রুতলিপি শেখানো হতো এবং পর্যায়ক্রমে পাঠ্যপুস্তকের সাথে ছাত্রদের পরিচিতি ঘটতো। উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রচনা, পত্রলেখা, ইতিহাস, ভূগোল, পাটিগণিত, শব্দের বানান এবং বাক্যের অন্তর্গত শব্দ সমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশকরণ শিক্ষা দেওয়া হতো। পাঠশালার তুলনায় হার্ডিঞ্জের বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তিন চার বছরের মধ্যেই বিদ্যালয়গুলোর দুর্দশা দেখা দিলো। এই ব্যর্থতার কারণ ছিল সেখানে পড়তে হতো অর্থ প্রদান করে। হার্ডিঞ্জ প্রবর্তিত বঙ্গবিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাসিক বেতন দিতে হতো এবং নিজেদেরই অর্থ ব্যয় করে বইপত্র কিনতে হতো। যদিও হার্ডিঞ্জের বিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গ্রামে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার প্রসারেই এসব বিদ্যালয় ভূমিকা রেখেছিল। বাংলা সরকারের বিশেষাধিকার সচিব হার্ডিঞ্জ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সরকারের ইচ্ছা এই যে এসব বিদ্যালয়ে যারা শিক্ষাগ্রহণ করতে আসবে তাদেরকে প্রতিমাসে যতো সামান্যই হোক কিছু বেতন দিতে বাধ্য করা এবং সরবরাহকৃত পুস্তকের মূল্যও আদায় করা। বিনামূল্যে শিক্ষার কদর থাকে না। বেতন প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে সম্ভ্রান্তশ্রেণীর সন্তানেরাই সরকারি বিদ্যালয়ে পড়তে আসবে। তা না হলে নিম্নশ্রেণীর ছাত্র দিয়েই বিদ্যালয় ভরে যাবে। সকলের জন্যই সমানভাবে শিক্ষার প্রয়োজন, তবে যারা শিক্ষার জন্য কিছু ব্যয় করতে পারবে তাদের দিয়েই শুরু করা উচিত।’ ফলে স্পটতই গ্রামের সাধারণ জনগণের জন্য এই বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং তাদের মধ্যে এই বিদ্যালয়গুলো কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। একথা স্পষ্ট যে হার্ডিঞ্জের বিদ্যালয়ের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো মোটেই সরকারের উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু হার্ডিঞ্জের চেষ্টা সত্ত্বেও তিন চার বছরের মধ্যেই বিদ্যালয়গুলির দুর্দশা দেখা দিলো। আঠারশো চুয়ান্ন সালের দেখা গেল একশো একটি বিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র তেত্রিশটি বঙ্গ বিদ্যালয় টিকে আছে আর সেখানে মাত্র চোদ্দশো ছাত্র লেখাপড়া শিখছে। আঠরশো চুয়ান্ন সালের জুন মাসে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে লেখা হয়, বাংলাদেশে তিন কোটি সত্তর লক্ষ লোকের বাস। আর এদেশের সরকার বাংলা শিক্ষার জন্য খরচ করে বছরে মাত্র আট হাজার টাকা। এ টাকা হচ্ছে একজন কালেক্টারের বার্ষিক বেতনের এক তৃতীয়াংশ। সারা বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র আট হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয় অথচ শুধুমাত্র সংস্কৃত কলেজের জন্য সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ত্রিশ হাজার টাকা।
যাই হোক আঠারশো চুয়ান্ন সাল পর্যন্ত সমাজের উচ্চশ্রেণীর শিক্ষার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই জোরালো ছিল। ফলে পাঠশালার কার্যক্রমে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সত্যিকার অর্থে আঠারশো চুয়ান্ন সালে বাংলার শিক্ষা নীতিতে আবার ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়। এই সময় ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সনদের মেয়াদ শেষ হলে বৃটেনের সংসদ ভারতে কোম্পানীর কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করার জন্য দুটি পর্ষদ গঠন করে। পর্ষদ দুটি অনুসন্ধানপূর্বক ভারতের শিক্ষা পদ্ধতিকে আরো সুসংহত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুসংঘবদ্ধ করার পরামর্শ দেয়। সেই প্রতিবেদনের প্ররিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল’-এর সভাপতি চালস উড ভারত সরকারে কাছে একটি শিক্ষা বার্তা প্রেরণ করে। চার্লস উডের নামানুসারে তা ‘উডের শিক্ষা বার্তা’ নামে খ্যাত হয়। চার্লস উড-এর প্রেরিত শিক্ষা-বিষয়ক নির্দেশেই ইংরেজ সরকার সর্বপ্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একটি তথাকথিত শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তনের চেষ্টা করে। আগের মতো কেবল উচ্চশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার সুযোগকে সীমাবদ্ধ না রেখে তা সর্বস্তরে প্রসারিত করার সরকারি নীতির পরিবর্তন এই নির্দেশ থেকেই সূচিত হয়।
সকলের মনে হতে পারে, এটা ছিল চার্লস উডের মহত্বের লক্ষণ। ব্যাপারটি আসলে তা ছিল না। ভারত তথা বাংলার জনগণের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রসারে চার্লস উডের ভীতি ছিল। সে কারণেই তিনি তাঁর দৃষ্টিকে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে নিয়ে যান। ভারতীয়দের জন্য উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে তাঁর অনীহার অন্ত ছিল না। তিনি বড়লাট ডালহৌসিকে লিখেছিলেন, উচ্চশিক্ষা পেলে ওরা বিপজ্জনক হতে পারে। তিনি বাংলার ছোটলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডেকে লিখেছিলেন, এরা যদি নিজেদের শিক্ষার ব্যবস্থা নিজেরা করে নেয় ভালো কথা, কিন্তু যারা ভবিষ্যতে আমাদের অপবাদ দেবে, বিরোধিতা করবে এবং আমাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা করার আমি বিপক্ষে। চার্লস উডের বার্তা অনুসারে যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার কাজ ছিল শুধু পরীক্ষা নেওয়া আর সনদ দেওয়া। সেখানে কোনো অধ্যায়ন বা শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল না বহুদিন পর্যন্ত। একটা অধ্যায়ন-অধ্যাপনা বিবর্জিত বিশ্ববিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আসলে উচ্চশিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের জন্যই উড প্রাথমিক শিক্ষার দিকে জোরালোভাবে নজর দিতে বলেন।
বিলাত থেকে আঠারশো চুয়ান্নর প্রেরিত উডের নির্দেশে ঘোষণা করা হয়েছিল যে শিক্ষা ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হবে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই উদ্দেশ্য সাধিত হবে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে এবং জনসাধারণের মধ্যে এই উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে দেশীয় ভাষার মাধ্যমে। প্রতিটি প্রদেশে একটি করে নতুন শিক্ষা বিভাগ খোলার প্রস্তাবও এই নিদের্শে করা হয়। জনশিক্ষা পরিচালক হবে এই বিভাগের প্রধান; তাকে সাহায্য করবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিদর্শন-কর্মকর্তা। জনশিক্ষা পরিচালকেরই দায়িত্ব হবে শিক্ষা-সংক্রান্ত সকল বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান এবং তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করা। বৃটেন থেকে উড প্রেরিত বার্তার চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, এদেশের অগণিত অসহায় মানুষকে ব্যবহারিক এবং কার্যকরী শিক্ষাদানের ব্যাপারে সরকার এ যাবৎ নিদারুণ অবহেলা করেছে। সরকার যেন উপরোক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য উদ্যোগী হয় এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করে। সন্দেহ নেই এটা ছিল এক ধরনের মায়াকান্না বা লোক দেখানো ব্যাপার। যাই হোক উডের শিক্ষাবার্তায় বিদ্যমান দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাই বাংলা সরকার পাঠশালার প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব ত্যাগ করে এই প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে এগিয়ে আসে। দীর্ঘ একশো বছর ধরে বৃটিশ শাসকরা স্থানীয় পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা িথেকে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছিল। আঠারো চুয়ান্ন সালে উড সাহেবের নির্দেশের পরই বৃটিশ সরকার প্রথমবার নিজেদের মতলব মতো প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারে দৃষ্টি দেন।
বাংলার ছোটলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডে আঠারশো চুয়ান্ন সালে খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে অসংখ্য দেশী পাঠশালা আছে। এই পাঠশালাগুলির সংস্কার ও উন্নতি সাধন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। তিনি বলেন, দেশীয় পাঠশালাগুলিকে কীভাবে আদর্শ স্থানীয় করে তোলা যায় তার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের পাঠশালাগুলির উন্নতির জন্য হ্যালিডের এই প্রস্তাবের ভিত্তি হলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বাংলা শিক্ষার পরিকল্পনা’। হ্যালিডে বলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেছেন তা মোটামুটিভাবে আমি অনুমোদন করি।’ বাংলা শিক্ষার পরিকল্পনায় বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, বাংলা শিক্ষার সু ব্যবস্থা ও বিস্তার একান্ত প্রয়োজন। তা নাহলে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ হবে না। কেবল লিখন, পঠন ও সরল অঙ্ক কষার মধ্যে বাংলা শিক্ষা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যতোদূর সম্ভব বাংলা ভাষাতেই সম্পূর্ণ শিক্ষা দিতে হবে এবং তার জন্য ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শরীরতত্ত্ব বাংলায় শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। সাধারণ জনসাধারণের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য ইশ্বরচন্দ্র শর্মা যে বিরাট পাঠক্রম দিয়েছেন তার সাথে সনাতন পাঠশালার মিল ছিল না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষে তা গ্রহণ করাও সম্ভব ছিল না। তার পরিকল্পনার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তবে তা বাস্তবসম্মত ছিল না। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য তার এই পাঠক্রম হয়তো সঠিক ছিল। প্রাথমিক শিক্ষায় এত বিশাল পাঠ্যক্রম খুবই ভুল, বিভ্রান্তিকর আর অবাস্তব ছিল। ইশ্বরচন্দ্র সনাতন পাঠশালাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন না। তিনি চাইছেন নতুন ধরনের বিদ্যালয়। তিনি আসলে শিক্ষার গুণগত মান বা কিছু উচ্চস্তরের পণ্ডিত সৃষ্টির কথা ভেবেছিলেন, সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় শিক্ষা পৌঁছে দিতে চাননি। তাঁর এই শিক্ষাচিন্তা ছিল পাঠশালা ব্যবস্থার বিপরীত স্রোতে বহমান। হ্যালিডের ইচ্ছা অনুসারেই ঈশ্বরচন্দ্র দক্ষিণ বাংলার সহকারী ইস্কুল পরিদর্শক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং আঠারশো পঞ্চান্নর আগস্ট মাস থেকে আঠারশো ছাপ্পান্নর জানুয়ারীর মধ্যে নিজ এলাকা বর্ধমান, হুগলী, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলায় পাঁচটি করে মোট কুড়িটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হ্যালিডে ও বিদ্যাসাগরের এ প্রচেষ্টা বঙ্গদেশের প্রাথমিক শিক্ষা সমস্যার প্রান্তদেশও স্পর্শ করলো না। সাধারণ ঘরের সন্তান বিদ্যাসাগর আসলে শিক্ষাকে অভিজাতদের ঘরানায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
সত্যিকার অর্থে আঠারশো চুয়ান্নর প্রেরিত নির্দেশমালার প্রেক্ষিতে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের পথ খুঁজে বের করার দিকে বাংলা সরকার দৃষ্টি ফিরাতে বাধ্য হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যসাধনে পাঠশালাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হলো। এর একমাত্র কারণ ছিল এটা সস্তা, জনপ্রিয়, অধিক সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত এবং এখানে নিম্নশ্রেণীর ছাত্ররা যোগদান করে। ইংরেজ সরকার নতুন করে আর বিদ্যালয় স্থাপনে টাকা ঢালতে চায়নি। উড সাহেবের নির্দেশ অনুয়ায়ী বাংলা সরকার জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালককে সভাপতি করে একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা বিভাগ গঠন করেন। এছাড়া জেলা বোর্ড গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় শিক্ষা বিস্তারে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আঠারশো সাতান্ন সালের মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষিতে সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাধা প্রাপ্ত হয়। মহাবিদ্রোহের ফলে ব্যাপারটা সে সময় আর আগাতে পারে না। মহাবিদ্রোহ দমন করার পর সরকার উনিশশো চুয়ান্ন সালের শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশ অনুযায়ী গৃহীত কার্যক্রম আঠারশো উনষাট সালে পুনর্বিবেচনা করা হয়। আঠারশো উনষাট সালের সাতই এপ্রিল লর্ড স্টেনলির প্রেরিত বার্তা বা নির্দেশে বলা হলো যে, দেশীয় শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা প্রণয়নে বিদ্যমান বিদ্যালয়সমূহ এবং তাদের শিক্ষকদের পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। কেননা, সে শিক্ষক যতো অদক্ষই হোক না কেন স্থানীয় লোকেরা তাঁদের সম্মানের চোখে দেখে থাকে। এই নির্দেশমালা আরও পর্যবেক্ষণ করে যে, প্রচলিত শিক্ষা অনুদান ব্যবস্থায় বিদ্যালয় স্থাপনে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় সমর্থন যোগাতে সক্ষম হচ্ছে না। তাই জনসাধারণের মধ্যে দেশীয় শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষা অনুদান ব্যবস্থার প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং প্রাথমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষাকর ধার্যের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। সরকার নিজে শিক্ষার জন্য টাকা বরাদ্দ না দিয়ে জমিদারদের উপর কর বসানোর কথা ভাবে।
বঙ্গদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল তাই জমির উপর কর ধার্য বাংলা সরকার করতে পারলো না। এই শিক্ষাকর ধার্যের ব্যাপারে নিয়ে বঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের মতবিরোধ দেখা দিল। ইতিমধ্যে বঙ্গদেশে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হলো এবং কমিশন কৃষকদের উপর কোনো প্রকার কর ধার্য করা সমীচীন নয় বলে মত দিলেন। তাই শিক্ষা-কর ধার্যের ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। বাংলার গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক পাঠশালার অবস্থিতির কারণে বাংলা সরকার এই প্রতিষ্ঠানকেই সাধারণ গণশিক্ষার প্রতিষ্ঠানরূপে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাঠশালায় স্বল্প খরচে শিক্ষার সুবিধা ও এর জনপ্রিয়তা, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্যতম কারণ ছিল। পাঠশালাকে কি করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে বিষয়ে শিক্ষা বিভাগ সচেষ্ট হয়। পাঠশালাকে বাদ দিয়ে বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়নি কারণ তাহলে নতুনভাবে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হতো। যেহেতু সরকার শিক্ষাখাতে বিরাট অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে উচ্ছুক নয়, তাই তারা সনাতন পাঠশালা ও তার গুরুদেরই বহাল রাখতে চাইলো। কিন্তু স্থানীয় পাঠশালা ব্যবস্থাকে পূর্বের মতো স্বাধীনভাবে চলতে না দিয়ে সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে বা সরকারের কেন্দ্রীয় একটি দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করলো। সরকারে শিক্ষা পরিকল্পনা ছিল চাতুর্যপূর্ণ। টাকা-পয়সা ব্যয় না করেই নামমাত্র অনুদানে তারা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাদের মতো করে ঢেলে সাজাতে দৃঢ়বদ্ধ হলো। প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তাদের নকশা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণে নেবার জন্য একটার পর একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকলো। পরীক্ষা নিরীক্ষা বা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের নামে তারা আর পুরানো পাঠশালার কাঠামোকে টিকে থাকতে দিলো না।
সরকার প্রথমেই ধরে নিলো বাংলার প্রচলিত পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল বা মান সম্পন্ন নয় এবং গুরুরাও দক্ষ নয়। শাসকদের একপেশে বিচার এটা, কোন মাপকাঠিতে সেটা ঠিক করা হলো সে ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। সরকারের যাই ভাবুক না কেন তারজন্য এটা ছিল উভয় সঙ্কট। পাঠশালাসমূহের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণে সচেষ্ট হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিকল্পে নানা রকম সংস্কার সাধনের চেষ্টা করা হয়। দুটি পর্যায়ে এই সংস্কারকে ভাগ করা যায়। প্রথমত আঠারশো পঞ্চান্ন থেকে আঠারশো বাষট্টি সাল পর্যন্ত উড্রো এবং গ্রান্ট অনুসৃত সংস্কারমূলক পরীক্ষা নিরীক্ষা, দ্বিতীয়ত আঠারশো বাষট্টি থেকে আঠারশো একাত্তর সালের মধ্যে গৃহীত ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘উন্নীত পাঠশালা’ পরিকল্পনা। সরকার প্রথমে চক্রাকার বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রচলন করে। এই পদ্ধতি অনুসারে কাছাকাছি কতোগুলি বিদ্যালয়ের জন্য একজন প্রধান গুরু নিয়োগ করা হতো। বৃত্ত বা চক্র পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলে তিন বা চারটি পাঠশালা নিয়ে একটি একক গঠন করা হতো, যেখানে একজন সরকারি পণ্ডিত নির্ধারিত মাসিক মাত্র পনেরো টাকা বেতনে নিযুক্ত হতেন। কাছাকাছি অবস্থিত ঐ বিদ্যালয়গুলির উপরের শ্রেণীতে তিনি পাঠদান করতেন এবং কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা নিরসনে সহায়তা দিতেন। পণ্ডিতদের দায়িত্ব ছিল আবর্তিতভাবে সপ্তাহে দুদিন পাঠশালা পরিদর্শন এবং পাঠশালার অপ্রধান গুরুদের উন্নতমানের শিক্ষাদান-পদ্ধতি অবলম্বন করতে উৎসাহিত করা।
প্রত্যেক পাঠশালা চক্রে একশো বিশ জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আবশ্যক ছিল। একেক ‘বৃত্তে’ তিনটি পাঠশালা ধরলে প্রতি পাঠশালার জন্য ছাত্রের প্রয়োজন ছিল চল্লিশ জন। অতীতে পাঠশালাগুলোতে গড়ে বিশ থেকে ত্রিশ জন ছাত্র হতো। পাঠশালার জন্য চল্লিশ জন ছাত্রের পরিকল্পনা গতানুগতিক পাঠশালা থেকে চক্রপদ্ধতির পাঠশালার আয়তন বৃদ্ধির জন্য গ্রহণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে যদিও একশো বিশ জন ছাত্রের সাধারণ প্রয়োজন সকল ‘চক্রে’ সব সময় পূরণ হতো না। আবার অনেক চক্রে পাঠশালায় চল্লিশ জনের উপরও ছাত্রের সংখ্যা দেখা যেতো। এই পরিকল্পনায় গুরুদের সহযোগিতা লাভের জন্য পুরস্কার প্রদানের প্রথাও প্রচলিত হয়। অর্ধবার্ষিকী অগ্রগতির অনুপাত অনুযায়ী ছাত্র-গুরু সকলের জন্যই এ পুরস্কার দেওয়া হতো। কিন্তু পুরানো পাঠশালায় শিক্ষক বা ছাত্র কেউ পুরস্কারের জন্য বিদ্যালয়ে যুক্ত হতো না। নিজেদের বাস্তব প্রয়োজনের সঙ্গে সেখানে পাঠশালার সম্পর্ ছিল। চক্রাকার এই পদ্ধতিতে কোনো অভিপ্রেত ফল পাওয়া গেল না। পরিকল্পনাটি প্রাথমিকভাবে আঠারো হাজার টাকার অনুদান দিয়ে শুরু হয়েছিল। লজ্জার ব্যাপার, আঠারশো তেষট্টি-চৌষট্টি সালে এই অনুদানের পরিমাণ বেড়ে হলো মাত্র সাতাশ হাজার টাকা। চক্রপদ্ধতির এই পরিকল্পনায় আঠারশো পঁয়ষট্টি সাল পর্যন্ত মাত্র দুশো তিনটি বিদ্যালয় সরকারের অনুদান লাভ করলো। যার অর্থ দাঁড়ায় সরকার দশবছরে এক হাজার ছাত্রকেও শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিতে পারেনি।
‘সার্কেল’ বা বৃত্ত পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিল গুরু ও তাঁদের ছাত্রদের পুরস্কার প্রদান করে পাঠশালার উন্নতি বিধান করা। তবে এই পদ্ধতি প্রণয়নকারীরা একথা আগে থেকে বুঝতে পারেনি যে ব্যাপক উন্নতি পাঠশালাগুলোকে উচ্চতর দেশীয় ভাষার বিদ্যাপীঠে পরিণত করবে, যেখানে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের চেয়ে প্রধানত উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাই জায়গা করে নেবে। ফলে অনেক সময়ই স্থানীয় জনসাধারণ গুরুর পরিবর্তে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের দাবি তুলেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি পণ্ডিতদের নিয়োগদান করা হয়েছে; পনেরো টাকার পরিবর্তে দশ টাকা বেতনে, বাকি টাকাটা ছাত্র বেতন থেকে ব্যবস্থা করতে হতো। ফলে দরিদ্রদের শিক্ষা ব্যয় বেড়ে যায় এবং তারা বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। সেখানে অধিক সংখ্যায় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে ছাত্ররা আসতে থাকে এবং সাধারণ নিম্নশ্রেণীর ছাত্রের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এটাও ধারণা করা হয় যে, যখন চক্র-পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে উন্নতি লাভ করবে তখন তা অযথা ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। প্রতিটি চক্র-পদ্ধতির পাঠশালার ব্যয় দাঁড়ায় বছরে ন্যূনতম একশো আশি টাকা টাকা অর্থাৎ বাংলার প্রতিটি জেলায় গড়ে এক হাজার পাঠশালা যদি ধরা হয় তাহলে প্রতি জেলায় বার্ষিক খরচ দাঁড়ায় এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। এই খরচ বহন করতে বাংলা সরকার অসম্মত ছিল। ফলে স্বভাবতই এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা একটা ক্ষুদ্র স্তর পর্যন্ত গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপারগুলো উর্বর মস্তিষ্কের ফল হয়ে দাঁড়ায়, পাশাপাশি সনাতন পাঠশালা পদ্ধতিকে তা ক্ষতিগ্রস্থ করে।
চক্র-পদ্ধতি কার্যক্রমে তিনটি বাঁধার সৃষ্টি হয়। প্রথমটি হলো বৃত্তাঞ্চলের পাঠশালার উন্নতির সাথে সাথে সেগুলো ক্রমান্বয়ে নিয়মিত সরকারি বিদ্যালয়ে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং সাধারণ লোকের চেয়ে উচ্চশ্রেণীর ছাত্রদের আকর্ষণ করতে থাকে। দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল পরিকল্পনাটির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যে খরচের প্রয়োজন ছিল তা বাংলা সরকারের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে ছিল এবং তৃতীয়ত প্রকল্পটির অর্জিত অগ্রগতির হার খুবই শ্লথ বলে মনে করা হয়। সরকার তাই বিবেচনা করলো যে, এই প্রকল্পের অধীনে দেশীয় পাঠশালাসমূহের উন্নয়ন এবং বৃহৎ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। ফলে বাংলার ইংরেজ সরকার সহজলভ্য পদ্ধতির মাধ্যমে কম খরচে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নততর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য একটি বিকল্প পদ্ধতি উদ্ভাবনে সচেষ্ট হলো। সরকারের দিক থেকে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল জনগণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে এমন একটি প্রকল্প গ্রহণ করা যাতে সহজে এবং স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়। সরকারের পকেট থেকে আবার অধিক টাকা বের হয়ে না যায়।
বাংলা সরকার পাঠশালাকে ঘিরে বিভিন্ন পরীক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণে সচেষ্ট হয়। জনশিক্ষা প্রসারের নামে আঠারশো ষাট সালে বাংলা পাঠশালায় নতুন নিয়ম চালু হয়ে গেল; প্রাথমিক শিক্ষার শুরু থেকেই ইংরেজী ভাষাকে স্থান দেয়া। যেভাবে এটা চালু করা হলো তা লক্ষণীয়। কলকাতার জনসাধারণের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি ঝোঁক অনেকদিন থেকেই ছিল। এই সময়ে বাংলা পাঠশালায় ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনের কথা উঠলে ছাত্রদের অভিভাবকদের নিকট হতে মতামত গ্রহণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, শতকরা নব্বই জন অভিভাবক পাঠশালায় ইংরেজী শিক্ষার অনুকূলে মত দেন। তারপরেই পাঠশালায় ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন করা হলো। স্মরণ রাখতে হবে, ছাত্রদের অভিভাবকরা যাঁরা ইংরেজী শিক্ষার পক্ষে মত দেন তাঁরা গ্রামের কৃষক ছিলেন না, ছিলেন শহুরে ভদ্রলোক। বাংলা পাঠশালায় অবশ্য ইংরেজীর জন্য কম সময় থাকতো। বাংলা শিক্ষার জন্যই বেশি সময় দেওয়া হতো। তার ফলে ইংরেজী বিদ্যালয়ে নিম্নশ্রেণীতে আর ছাত্র ভর্তির প্রয়োজন ছিল না। বাংলার মাধ্যমে অন্যান্য বিষয় আয়ত্ত হওয়ায়, ইংরেজী কম জানলেও তা পূরণ করা কষ্টকর হতো না। সুতরাং এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা-ব্যবস্থা যেভাবে গঠন করা হয়, অনেকটা তার সাথে সঙ্গতি রেখেই পাঠশালায় ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইংরেজ সরকার প্রাথমিক শিক্ষা প্রচেষ্টা শুরু থেকেই জটিল আকার ধারণ করে। পূর্বে পাঠশালা শিক্ষা ছিল একজন শিক্ষকের অধীন। পাঠশালাকে উন্নত করার নামে ইংরেজদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে শিক্ষক ছাড়াও একদল আমলার দেখা মেলে যাঁদের হাতে প্রাথমিক শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হয়। এইভাবে ইংরেজদের প্রবর্তিত প্রাথমিক শিক্ষা আমলাতন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আমলা নতুন নতুন নিয়ম জারি করতে থাকে। আঠারশো বাষট্টি সালে ভূদেব মুখোপাধ্যায় সহকারী পরিদর্শক হিসেবে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। তিনি পরিকল্পনা দিলেন, বর্তমান পাঠশালাগুলিকে ঠিক রেখে গুরুকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠশালাকে উন্নত করা হবে। পাঠশালায় বিভিন্ন ধরনের মুদ্রিত পুস্তক প্রদান করে পাঠ্যক্রম বাড়ানো হবে। পাঠশালার পাঠ্যক্রম বাড়ানো হলে স্বভাবতই পুরানো গুরুরা তা পাঠদান করতে পারবেন না। বাংলার যে-সব পাঠশালাগুলি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হবে, ভূদেব সে-সব পাঠশালার গুরুদের প্রশিক্ষণ দানের উপর জোর দেন। প্রশ্ন হলো পুরানো গুরুদের পক্ষে সে-সব প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্ভব হবে কিনা। কিংবা যে-সকল গুরুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর পাঠশালায় ফিরে যাবেন কিনা; এরকম নানা জটিলতা দেখা দেয়। পাঠশালার পুরানো শিক্ষক যে-সময়কালে প্রশিক্ষণ নেবেন, সে-সময়ে বিদ্যালয়ে পাঠদান করার বিষয় কী হবে। ইত্যকার সমস্যার সমাধানে যে-সব উদ্যোগ নেওয়া হয় সেগুলিও নানা সঙ্কট সৃষ্টি করে।
মূল শিক্ষকের প্রশিক্ষণকালীন সময়ের জন্য পাঠশালায় একজন অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগদানের কথা বলা হয়। মূল শিক্ষক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে ফিরে গেলে, অস্থায়ী শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকবেন। শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য নানারকম নিয়ম কানুন চালু করে। পূর্বে পাঠশালার গুরু স্বাধীনভাবে শিক্ষাদানের ব্রত নিয়ে পড়াতেন। ইংরেজদের শিক্ষানীতি বা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণ গুরুদের উপর কতোগুলি নিয়ম কানুন চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষাদান যে ব্রত সে ধারণাকে বাতিল করে দেয়। গুরুকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তিনি শিক্ষা দপ্তরের একজন কর্মচারী মাত্র। স্বভাবতই তাতে শিক্ষাদানের প্রকৃতি পাল্টে যায়। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রমের এই অতিরিক্ত বোঝা ছাত্রদের জন্য বিরাট সমস্যা তৈরি করেছিল। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠশালাসমূহের উপর গুরু পূর্বে শিক্ষাদানে যে নিরঙ্কুশভাবে স্বাধীনতা ভোগ করতেন স্পষ্টত তা তিরোহিত হতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে তিনি একজন সামান্য সরকারী ভৃত্যে পরিণত হতে থাকলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি সাধারণ মানুষের সন্তানদের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ইংরেজ প্রবর্তিত প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান সঙ্কটের একটি ছিল, কর্তৃত্বের প্রকাশ এবং শিশুর অনধিগম্য বিশাল পাঠক্রম ‘ছাত্র-শিক্ষক’ সম্পর্ককে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিল।
শিক্ষক ছাত্রকে সব বিষয় ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারছিলেন না, ঠিক আবার তেমনি শিক্ষক ছাত্রের অনেক সমস্যারই সমাধান দিতে পারছিলেন না। পূর্বে পাঠশালার প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রধান একটি আকর্ষণ ছিলো শিক্ষার সময়সূচী। মাঝখানে চারপাঁচ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে পাঠশালা দুবেলা বসতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে সুযোগ ছিল না। শরৎকুমারী চৌধুরানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচীর সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ‘সেকালের ছেলেরা কিঞ্চিত জলযোগ করিয়া, একমাত্র বস্ত্র পরিধান করিয়া, পাড়ার পাঁচ সাতটি ছেলে একত্রে পাঠশালায় হাজির হইত। দ্বিপ্রহরে বাড়ি আসিয়া খাওয়া দাওয়া করিত। কিন্তু এ-কালের ভিন্ন প্রথা, বেলা নয়টার সময় যেমন আহারাদি সম্পন্ন করিয়া বাড়ির কর্তাকে আপিস যাইবার জন্য হুড়াহুড়ি করিতে হয়; তেমনি ছেলেদেরও বিদ্যালয়ের তাড়াতাড়ি পড়িয়া যায়। এখন ‘পাঠশালা’ পরিবর্তন হইয়া যেমন বিদ্যালয় হইয়াছে, তেমনি বেশভূষারও পরিবর্তন হইয়াছে। জামা জুতা, ছাড়া, কত কি চাহি। অনেক সময় জুতার অভাবে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হইয়ার পড়ে। কিন্তু সেকালে গৃহস্থ-বালকের মধ্যে কয়জন বারো মাস জুতা ব্যবহার করিতে পাইত?’
শরৎকুমারীর লেখা থেকে বোঝা যায় পাঠশালার সাথে বিদ্যালয়ের শুধু সময়সূচীর পার্থক্যই ছিল না, বিদ্যালয়ে একধরনের বাবুগিরিও আরম্ভ হয়েছিল। দরিদ্রদের পক্ষে সেই বাবুগিরি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সনাতন পাঠশালা বাইরের বা ভিন্ন কারো নিয়ম-নীতির বন্ধনে বাঁধা ছিল না। ফলে প্রবল বর্ষণে পাঠশালা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল গুরু মশায়ের, সে ক্ষমতা ইংরেজদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের ছিল না। শিক্ষাদপ্তরের নির্দিষ্ট ছুটির বাইরে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার ক্ষমতা শিক্ষকের কর্তৃত্বের বাইরে চলে গেল। প্রবল বর্ষণে তাই ছাত্ররা উপস্থিত না হলেও শিক্ষককে বিদ্যালয় খোলা রাখতেই হতো। পূর্বে ছাত্রদের উপস্থিতির সংখ্যাও খাতায় লিপিবদ্ধ রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। পাঠশালার গুরু সামাজিক দুর্যোগ কিংবা ফসল কাটার সময় ছাত্ররা যে বিদ্যালয়ে আসতে পারবে না সেটা জেনে সেভাবেই পাঠশালা ছুটি ঘোষণা করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাস ছিলেন না। শারীরিক অসুস্থতার কারণে যদি কোনো ছাত্র পাঠশালায় উপস্থিত না হতো এবং লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়তো, গুরু সে বাস্তবতা উপলব্ধি করে সেই শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ যত্নবান হতেন যাতে সে অধিক পিছিয়ে না পড়ে। পূর্বে নিয়মকানুনের বেড়াজাল তৈরি করে ছাত্রের লেখাপড়া শেখার কাজে পাঠশালা কোনো বিঘ্ন তৈরি করেনি।
স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাঠশালা প্রতিটি শিক্ষার্থীর এবং তার পরিবারের সমস্যাগুলির এবং পারিপার্শ্বিকতার খবর রাখতো। শিক্ষার্থীর লেখাপড়া যাতে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেভাবেই সকল পরিকল্পনা করা হতো। পাঠশালা এসব ব্যাপারে যে সহমর্মিতা দেখাতো, ইংরেজদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি স্বাধীন একক ছিল না, সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো কেন্দ্রীয়ভাবে ঊর্ধ্বতনদের দ্বারা। সেখানে শুধু একজন ঊর্ধ্বতন নয়, ঊর্ধ্বতনদের ক্রমোচ্চ একটি সোপান ছিল। ঊর্ধ্বতনদের নানা স্তর পার হয়ে যখন যে সিদ্ধান্ত আসতো সেটাই ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের জন্য পালনীয়, ছাত্রের কিংবা তার অভিভাবকদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দেয়া নয়। পাঠশালায় যদি সামান্য পাঠ্যক্রম বৃদ্ধি করা হতো মান উন্নয়নের জন্য এবং পুস্তক প্রবর্তন করা হতো পাঠশালাগুলিকে স্বাধীন রেখে, তাহলে কিন্তু বড় সঙ্কট সৃষ্টি হবার কারণ থাকতো না। কিন্তু শাসকদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন।
সনাতন পাঠশালার মুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়ার বাঁধাধরা কোনো নিয়ম ছিল না, সেখানে বার্ষিক কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থাই ছিল না। গুরু যদি বুঝতেন যে, ছাত্র প্রয়োজনীয় মেধা অর্জন করেছে তাহলে বছরের যে-কোনো সময়েই তাকে উপরের শ্রেণীতে তুলে দিতেন। দিনপঞ্জীর কোনো বালাই ছিল না বা পরীক্ষারও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ছিল না। কিন্তু সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ভূদেব শর্ত দেন যে, উপ-পরিদর্শক তাঁর এলাকার পাঠশালার প্রতি শ্রেণীর জন্য একটি দৈনিক পাঠক্রম তৈরি করে দিতে বাধ্য থাকবেন যা গুরুরা অনুসরণ করবেন। এটা কার্যকরভাবে বোঝান হলো যে, গুরুগণ তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী আর শ্রেণীর কাজ পরিচালনা করতে পারবেন না। এখন থেকে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশনা বা হুকুম মেনে তাঁদের কাজ করতে হবে। এখন থেকে দৈনিক হাজিরা বহি, যা পূর্বে কোনদিনই পাঠশালায় ব্যবহার করা হয়নি তা রক্ষা করতে হলো। শিক্ষক বা গুরুকে পড়াশুনার দিকে নজর দেওয়ার চেয়ে বহুগুণ প্রশাসনিক দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে হলো। গুরু স্বাধীনভাবে পড়াবেন না কি সরকারী আমলাতন্ত্রের নিত্য নতুন তৈরি করা হুকুম বা বিধিবিধান মেনে চলবেন সেটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিলো। বিদ্যা শিক্ষাদানের চেয়ে নিয়ম মেনে চলাটাই যেন প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ালো। নানারকম নিয়ম-কানুন তৈরি করার ভিতর দিয়ে সনাতন পাঠশালার সহজ স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করা হলো।
সনাতন পাঠশালা বা নতুন বিদ্যালয়গুলোকে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা চললো। হাজিরা খাতার কথা স্মরণ করলে অনেক কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় প্রকাশ পায়। পাঠশালার সকল ছাত্রকেই, এমন কি তাদের অভিভাবকদের পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে জানা থাকায় পূর্বে গুরু কোনো হাজিরা রাখার প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ এখন তাঁকে যে শুধু সকল ছাত্রের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির হিসাব রাখতে হচ্ছে তাই নয়, পৃথকভাবে কতজন হিন্দু ও কতজন মুসলমান ছাত্র তাও দেখাতে হচ্ছে। পাঠশালায় আগে কার কী ধর্ম তা বিবেচ্য ছিল। না। গুরুর কাছে ছাত্রের পরিচয় ছিল সে গ্রামের বালক। ইংরেজদের প্রবর্তিত বিদ্যালয়ে ছাত্ররা হিন্দু-মুসলমান পরিচয়ে পরিচিত হতে থাকলো। সরকারীভাবে বিদ্যালয় মোট বন্ধের দিনেরও তালিকা গুরুকে রাখতে এবং প্রকাশ করতে হচ্ছে। অধিকন্তু গুরুকে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার জন্য অনুমোদন নিতে হচ্ছে। এতে স্পষ্টত তার কর্তৃত্ব খর্ব হচ্ছে এবং তাঁকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে হচ্ছে।
সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা নির্দিষ্ট জেলাসমূহের খুব সীমিত সংখ্যক পাঠশালায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়। স্পষ্টত সরকারী শিক্ষা বিভাগের অধীনে আনীত তথাকথিত উন্নত পাঠশালা ও ছাত্রের সংখ্যা খুবই নগণ্য ছিল। তখনো অধিকাংশ পাঠশালা পূর্বের ন্যায় তাদের পুরাতন রীতি-নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছিলো। সরকারী নিয়ন্ত্রণে বহু পাঠশালা বন্ধ হয়েও যাচ্ছিলো। পাঠশালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো কেন তার কয়েকটি কারণ এখানে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জনশিক্ষার প্রতি সরকারের আন্তরিক কোনো সমর্থন ছিল না। হ্যালিডে আঠারশো বাষট্টি সালে চলে যাবার পরে একজনও প্রভাবশালী সরকারী কর্মকর্তা জনশিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাননি। বস্তুত শিক্ষাবিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জনশিক্ষার প্রসার চাননি। যতটুকু নিয়ম রক্ষায় কাজ করেছেন, তা আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের শাসনের উপযোগী করে পরিচালনা করেন। সরকারী নীতির ফলে বাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে চাকরি পাওয়া কষ্টকর ছিল। স্বভাবতই বাঙালী ভদ্রলোকরা বাংলা বিদ্যালয়গুলির প্রতি বিমুখ ছিলেন। সাধারণ ঘরের সন্তানরাও পাঠ্যপুস্তক আর নিয়মকানুনের কারণে বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে। সত্যিকারভাবে বাংলার সুবিধাভোগীরা চাইছিল না বাংলার পুরানো পাঠশালাগুলি টিকে থাকুক। নিম্নশ্রেণীর লোকেরা বাংলাভাষায় শিক্ষিত হয়ে তাঁদের চাকরি-বাকরির ভাগীদার হবে তা মানসিকভাবে তাঁরা মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলাভাষায় শিক্ষার প্রসার না ঘটাতে তাঁরা খুশিই হন। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের ব্যাপারটা অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের মতো মহান ব্যক্তিও তাই বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা বাদ দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার চেষ্টা চালানো উচিৎ নয়। কোনো দেশেই গণশিক্ষা সম্ভব হয়নি, এদেশে তা অসম্ভব।’
শিক্ষিত বাঙালীরা গুরুত্ব সহকারে জনশিক্ষার বিষয়টি দেখেননি এবং ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে সমগ্র বাঙালী সমাজের ওপর তাঁর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়েও তাঁরা কোনো সুচিন্তিত আলোচনা করেননি। নিজেদের স্বার্থরক্ষা নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। গ্রাম বাংলায় উনিশ শতকে যে এক নতুন বিত্তবান শ্রেণীর আবির্ভাব হয় তাঁদের সম্পর্কে আঠারশো ছিষট্টি সালে ভূদেব মুখোপাধ্যায় এবং আঠারশো সাতষট্টি সালে হান্টার যে মন্তব্য করেন তা খুবই গুরুত্ববহ। বাংলার সতেরশো সত্তর সালের মন্বন্তরের সাথে আঠারশো ছিষট্টি সালের মন্বন্তরের পার্থক্য আলোচনা প্রসঙ্গে হান্টার লেখেন, আঠারশো ছিষট্টি সালের মন্বন্তরের সময় দেখা গেছে গ্রামে একটি ধনীক শ্রেণী আছে মন্বন্তর যাদের সামান্যমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। গ্রামের জমিদার, মহাজন, বিত্তবান দোকানদার ও ধনী কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর সন্তানরা যথারীতি বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় লেখেন, আঠারশো ছিষট্টি সালের মন্বন্তরের সময় যখন দরিদ্র লোকেরা ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত তখন গ্রামের বিত্তবান মানুষ নিজেদের সন্তানদের যথারীতি ভালোভাবে শিক্ষাদানের জন্য উদগ্রীব। গ্রাম সমাজের এই শ্রেণীর অধ্যয়নরত ছাত্রদের বিদ্যালয়সমূহের উন্নতিও যথেষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে দুর্ভিক্ষের সময় এই শ্রেণীর কোনো ক্ষতি হয়নি। উল্লিখিত ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলার ধনী গরিব মানুষের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। এই ধনী মানুষরা সাধারণের শিক্ষার নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতো না।
পাদ্রী জেমস লঙ উইলিয়াম এ্যাডামের মতোই চাইতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার হোক। তিনি সরকারের কাছে প্রেরিত এক মন্তব্যে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। তিনি পুনরায় আঠারশো সাতষট্টি সালের আগস্ট মাসে গভর্ণর জেনারেল স্যার জন লরেন্সের নিকট মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রস্তাব পাঠান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা না করা হলে বৃহৎ সংখ্যক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ শিক্ষা-বঞ্চিত থাকবেন। শুধু মাত্র স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হবে। তিনি লক্ষ্য করেন মুসলমানদের শিক্ষার বিষয়টি অবহেলিত হওয়ায় সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো দেখলেন যে, জমিদার ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের বিরোধী। লঙ স্পষ্টই মনে করেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তনের ফলে কৃষকেরা যেভাবে অর্ধদাসে পরিণত হয়েছে তাতে সামাজিক উন্নতি ব্যহত হচ্ছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, খুব কম সংখ্যক জমিদার ও শিক্ষিত ব্যক্তিই কৃষকের অবস্থার উন্নয়নে আগ্রহী। সুতরাং দরিদ্র ও অসহায় কৃষক সম্পর্কে সরকার তার দায়িত্ব পরিহার করতে পারে না। এই অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করার জন্য তিনি শিক্ষাখাতে আরো অর্থ ব্যয় করতে বলেন। তিনি প্রয়োজন হলে জমিদাদের উপর শিক্ষাকর বসিয়ে শিক্ষার জন্য অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন ইংরেজী বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ধনী শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি করে সে টাকা দরিদ্রদের শিক্ষার জন্য তা ব্যয় করা যেতে পারে।
সরকার লঙের প্রস্তাব সম্পর্কে প্রতিনিধি স্থানীয় জমিদারদের মতামত চেয়ে পাঠান। জমিদার ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা লঙের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। লঙের প্রস্তাবে উত্তর পাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সরকারের নিকট প্রেরিত বক্তব্যে জানান, নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তা থেকে তিনি বলতে পারেন, নিম্নশ্রেণীর লোকরা নিজেদের বৃত্তি নিয়ে এতাটাই অনুরক্ত যে শিক্ষা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উৎসাহ বোধ করে না। তিনি বলেন, নিম্নশ্রেণীর মানুষের ঠিক উপরে যারা রয়েছে তারা যাতে ভালোভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যদি তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো যায়, তারফলে হয়তো নিম্নশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষার আগ্রহ বৃদ্ধি করা সম্ভব। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় আরো জানান যে, বর্তমানে গ্রামে পাঠশালার দরজা সবার জন্য খোলা রয়েছে, যদিও হাড়ী ডোম ও চণ্ডালদের সাথে একসঙ্গে বসে পড়বার ব্যাপারে কিছু ভ্রান্তসংস্কার রয়েছে। কিন্তু মোট ছাত্র সংখ্যার খুবই অল্প হাড়ী, ডোম ও চণ্ডাল সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনি স্পষ্ট করেই লিখলেন, বর্তমানে এই দেশে নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ নেই। অবস্থাপন্ন ও বুদ্ধিমান উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই শিক্ষার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং কর বসিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাভাষায় শিক্ষা প্রসারের কোনো প্রয়োজন নেই। পাঠশালাগুলি বাংলাভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা বিতরণের পক্ষে যথেষ্ট। ইংরেজ শাসনের আগে পাঠশালায় চণ্ডালরা সহ সকল নিম্নবর্গের মানুষকে বেশি পড়তে দেখা গেছে, গুরুরা বেশির ভাগ ছিলেন নিম্নবর্ণের; সে অবস্থাটা তাহলে ভেঙে পড়লো কেন?
জমিদার জয়কৃষ্ণ বেশ জোর দিয়েই বলেন, জমিদাররা কিছুতেই শিক্ষাকর দিতে রাজী হবেন না এবং আইন করে এই ধরনের কর চাপানো অন্যায় হবে। আঠারশো আটষট্টি সালে মানিকতলার রাজেন্দ্রলাল মিত্র সরকারের নিকট প্রেরিত এক দীর্ঘপত্রে জেমস লঙের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তিনি লেখেন, যতদিন পর্যন্ত জাতিভেদ প্রথার প্রভাব সমাজজীবনে থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই আশা করা নিতান্তই ব্যর্থ প্রয়াস হবে যে, নিম্নশ্রেণীর লোকেরা শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করবে। বেশির ভাগ কৃষকরাই দরিদ্র এবং তারা নিজ সন্তানকে অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে চাষের কাজে নিযুক্ত করাই বেশি লাভজনক মনে করে। খুব শীঘ্র বা অনেকদিন পর্যন্ত নিম্নশ্রেণীর অধিবাসী সহ শ্রমজীবী জনসাধারণকে শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হবে না। তাছাড়া পারিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় দেশের প্রয়োজন স্থানীয় ভাষার শিক্ষা দ্বারা মেটানো যাবে না। সুতরাং বিজিত জাতির প্রজাদের শাসকদের ভাষা আয়ত্ত করা প্রয়োজন। প্রধানত তার উপরেই রাষ্ট্রের মঙ্গল নির্ভরশীল। রাজেন্দ্রলাল এ কথাও বলেন, সরকার জমিদারদের নিকট থেকে শতকরা দুইভাগ শিক্ষাকর আদায়ের পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু বেশিরভাগ জমিদার ধনী নন। স্বভাবতই তাঁরা বাধ্যতামূলক শিক্ষা কর দিতে অস্বীকার করবেন।
ব্যাপারটা ঘটেও ছিল তাই। ভূম্যধিকারীদের এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়, বর্তমানে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অর্থদানে ও সরকারী সাহায্যে শিক্ষার অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে এবং লঙ প্রস্তাবিত বাধ্যতামূলক শিক্ষাকর বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে কোনো উন্নত ব্যবস্থা নয়। তাই তারা লঙের প্রস্তাব গ্রহণে অপারগ।
বাংলার জমিদারদের বক্তব্যে খুব অবাক হবার ব্যাপার এই যে, সরকার যেখানে নিজে শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে হাতাশা প্রকাশ করছে, সরকারের প্রতিবেদনে যখন সামান্য অগ্রগতির কথাই বারবার বলা হচ্ছে; সেখানে জমিদাররা বলছেন শিক্ষার অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা। জমিদারদের বিরোধিতার মুখে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যাপক ভিত্তি গড়ে না ওঠায় নিম্নশ্রেণীর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা প্রসারিত হয়নি। ইংরেজি নিয়মে শিক্ষাদানকে সুস্পষ্ট অগ্রাধিকার প্রদান করে এবং মানসাঙ্ক কষা ও দেশীয় হিসাব-পদ্ধতি, যা পাঠশালা শিক্ষাক্রমের শক্ত ভীত ছিল, তা ক্রমে অবহেলিত হতে হতে শেষে পরিত্যক্ত হয়। ব্যাকরণ, ভূগোল ও ইতিহাস পাঠ প্রবর্তন করার ফলে পুরনো পাঠশালাসমূহের তুলনায় পাঠক্রমের উল্লেখযোগ্য উন্নতি বলে মনে করা হয়। নিশ্চিতভাবেই গুরুদের পক্ষে সেসব বিষয়ে পাঠদান সহজসাধ্য ছিল না। ফলে, পরিকল্পনা কার্যকর করতে যতোই অগ্রসর হওয়া যাচ্ছিল ততই তার মধ্যে নানা সঙ্কট দেখা দিচ্ছিলো। সনাতনী পাঠশালার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবজ্ঞান প্রদান করা। এক্ষণে ভূগোল, ইতিহাস ও সাধারণ বিষয় যেমন পৃথিবীর আকৃতি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় “শিক্ষার জন্যই শিক্ষা” এমন অভিপ্রায় প্রকাশ পায়। পাঠশালার যথাযথ ব্যবস্থাপনার উপর নতুন করে গুরুত্ব প্রদান ও জ্যামিতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, যা পূর্বে পড়ানো হতো না, ইউরোপীয় আদর্শ বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা স্পষ্ট হয়।
বিভিন্নরকম অনাকাঙ্ক্ষিত নিয়মকানুনের ফলে নিম্নশ্রেণীর লোকের সন্তানেরা উন্নত পাঠশালা পরিত্যাগ করতে থাকে। ইংরেজদের মধ্যে অনেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিদ্যালয় পরিদর্শক মেডেলিকট বলেছিলেন, ‘সাবেক অবস্থার পাঠশালা থেকে যে কেউ শিক্ষক-প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে গেলে উভয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের চেহারায় দর্শনীয় পার্থক্য লক্ষ্য করতে পারবেন। প্রথমোক্ত পাঠশালায় আমি দেখতে পেয়েছি কৃষকদের ন্যাংটো সন্তানদের এবং নিম্নতম শ্রেণীর বালক যারা উন্নততর দুর্লভপ্রকৃতির মানুষের কাছ থেকে কোনো প্রকারের শিক্ষাই পায়নি। পক্ষান্তরে দ্বিতীয়োক্ত ক্ষেত্রে আমি যথানিয়মে দেখতে পেয়েছি কেবল ব্রাহ্মণ এবং লেখক গোত্রের কায়স্থ ছেলেদের। যার সাথেই আমার দেখা হয়েছে তাকেই এর কারণ জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পেয়েছি যে, নিম্নশ্রেণীর বালকগণ একেবারেই পাঠশালা থেকে বিদায় নিয়েছে।’ গুরুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে পেরেছিল কিনা সেটা একটা প্রশ্ন, কিন্তু সাধারণ মানুষকে শিক্ষার আঙ্গিনা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। সত্যিকারভাবেই অতিরিক্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং কিছুটা ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র ছাত্ররা পাঠশালা ছেড়ে চলে যায়। সেখানে অধিক সংখ্যায় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে ছাত্ররা আসতে থাকে এবং সাধারণ নিম্নশ্রেণীর ছাত্রের সংখ্যা কমে যেতে থাকে।
ইংরেজ শাসকদের শিক্ষার কয়েকটি চিরন্তন কুফল ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় থেকে গেছে। প্রাথমিক আর মাধ্যমিক শিক্ষায় অকারণে বইয়ের বোঝা বাড়ানো আর গৃহশিক্ষক প্রথা চালু করা, সকল ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুখস্থবিদ্যার ধারা আর ভয়াবহ পরীক্ষা-ভীতির প্রবর্তন। পূর্ব যুগের শিক্ষায় পরীক্ষাভীতি ছিল না আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার প্রবণতা ছিল। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতে সকল শিক্ষায় বিতর্ক, মতাবিনিময় আর প্রশ্ন তোলার এ ধারাটা চমৎকারভাবেই ছিল।