ইংরেজ শাসনে বাংলার পাঠশালা শিক্ষার ধ্বংস সাধন
পর্ব ১
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ০২, ২০২০
বৃটিশরা বাংলা তথা ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করার আশি বছর পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষা ‘পাঠশালা’ ব্যবস্থার স্থলে ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের পর বহু বহু বছর পর্যন্ত ইংরেজরা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। সত্যিকার অর্থে বৃটিশ সরকারের জনগণের শিক্ষা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বাংলা থেকে রাজস্ব হিসেবে তারা যে বিপুল অর্থ লাভ করতো, শিক্ষা বা জনকল্যাণে তা ব্যয় করার কোনো উদ্দেশ্য বা কর্মসূচি তাদের ছিল না। বাংলাদেশের দেওয়ানি পাবার পর সতেরশো পঁয়ষট্টি সালে ক্লাইভ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের কাছে লিখে পাঠালেন, বাংলার বাৎসরিক রাজস্ব এখন মোট দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা হবে। সামরিক ও বেসামরিক বিভাগ দুটির জন্য খরচ হবে ষাট লক্ষ টাকা আর নবাবকে দিতে হবে বিয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। মুঘল সম্রাটকে কর দিতে হবে ছাব্বিশ লক্ষ টাকা, তারপর কোম্পানির উদ্বৃত্ত থাকবে মোট এককোটি বাইশ লাখ টাকা; এই টাকাটা কোম্পানির পরিষ্কার লাভ। প্রতিবছর কোম্পানির লাভ বেড়ে যেতে লাগলো এবং ছয় সাত বছ পর তার পরিমাণ দাঁড়ালো চার কোটি টাকার বেশি। বলা বাহুল্য টাকাটা ইংল্যাণ্ডে চলে যেত।
বৃটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর খ্রীস্টান পাদ্রীরা এদেশে আসতে শুরু করে খ্রীস্টধর্ম প্রচারের জন্য। ধর্মপ্রচারের স্বার্থেই তারা বাংলার জনগণের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রসার চেয়েছিল। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া সর্বোস্তরে ইংরেজি ভাষার প্রসার সম্ভব নয় বলেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষা বা জনশিক্ষার পাশাপাশি পাদ্রীরা মিশনারি বিদ্যালয়গুলো গড়ে তুলতে শুরু করে। বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবার পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বঙ্গদেশে বাণিজ্য আরম্ভ করে ঠিক তখনি অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চাকরি লাভ করার জন্য কাজ চালাবার মতো ইংরেজী বলতে শিখেছিলেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন ঠাকুর উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন কর্মতৎপর ও উপায় সন্ধানী মানুষ; জাতপাতের বালাই তাঁর ছিল না। গোরা সাহেবদের রসদ জোগানো এবং ফাইফরমাস খাটা ছিল তাঁর কাজ। খ্রীস্টান ফিরিঙ্গীদের মুখে তাঁর ঠাকুর নামটা বিকৃতভাবে ‘টেগোর’ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাননের উপর গোরা সাহেবদের নেকনজর থাকায় তিনি তাঁর দুই পুত্রকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসালো চাকরি জুটিয়ে দেন। বিশেষ করে পঞ্চানন ঠাকুরের পুত্র জয়রাম ইংরেজদের নানা কাজ কারবার তদারকী, ঠিকাদারী ও দালালীতে নিযুক্ত থেকে বেশ টাকা-পয়সা বানান। ইংরেজরা তখনো বাংলা দখল করেনি। জয়রামের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণে হাত দেয় মাত্র। ধর্মাধর্ম নিয়ে যাঁরা তখন খুঁতখুঁতে ছিলেন না, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানে যাঁরা তৎপর ছিলেন, তাঁদের পক্ষে সে সময়ে রোজগারের নানারকম নতুন পথ খোলা ছিল। জয়রামের দুই পুত্র নীলমণি ও দর্পনারায়ণ পিতার সুবাদে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে যুক্ত হন ঠিক সেই সময় বাংলার শাসনভার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সতেরশো পঁয়ষট্টি সালে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, সে-বছরই নীলমণি উড়িষ্যার সেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। নীলমণিই পরবর্তীকালে জোড়াসাকো ঠাকুর পরিবারের পত্তন করে। নীলমণিরই নাতি হলেন বাংলার বিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথের নাতি হলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাংলা সতেরশো সাতান্ন সালে ইংরেজদের অধীনে যাবার পরের বছর আঠারশো আটান্ন সালে জ্যাকারিচ কিয়েরচন্দর নামে এক ধর্মযাজক কলকাতায় একটি ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিদ্যালয়ে দেশীয় ছাত্রগণ পড়ালেখার সুযোগ লাভ করে। সতেরশো উনষাট সালের জানুয়ারী পর্যন্ত আটচল্লিশ জন ছাত্র এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তার মধ্যে ছয়জন ছিল বাঙালী। সবকিছু সত্ত্বেও শাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে কলকাতায় সতেরশো সত্তর সালে ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ স্থাপিত হয়। কলকাতা মাদ্রাসা ছিল এদেশে ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য ছিল আরবি ফারসি শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং মুসলমানদের সরকারী কাজের জন্য যোগ্য করে তোলা। যেহেতু ইংরেজ শাসনে তখনো এদেশের আইন-আদালত ও রাজস্ব বিভাগে ফারসি ভাষা প্রচলিত ছিল, সেহেতু ঐসব বিভাগের নিম্নস্তরে ফারসি ভাষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশীয় লোকেদের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো মাদ্রাসাতে। সুতরাং কলকাতা মাদ্রাসা হেস্টিংসের বদান্যতায় স্থাপিত হয়েছিল একথা বলা যায় না, সরকারী প্রসাশনিক ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্য এখানে ক্রীয়াশীল ছিল। বাংলার শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর সতেরশো চুয়াত্তর সালে কলকাতায় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট মানে তখন যেখানে শুধুমাত্র ইংরেজদের বিচার হতো। সামান্য কিছু রদবদল সহ দেশীয়দের বিচার আগের দেশীয় আদালত ব্যবস্থাতেই চলতো। সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষার অর্থকরী শক্তি বেড়ে যায়। ইংরেজী শিক্ষার তখনো কোনো মান সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান না থাকলেও আঠারশো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে বেশ কিছু বাঙালী ইংরেজী শেখার চেষ্টা করে কিছুটা কৃতকার্য হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের অনুসৃত নীতি অনুসারে এদেশের ধর্ম-সমাজ-শিক্ষার ব্যাপারে প্রথম দিকে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেনি। বরং খ্রীষ্টান মিশনারীদের ধর্ম ও শিক্ষা প্রচারে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে। ইংরেজ সরকার চায়নি স্থানীয়দের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে হাত দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বিরোধ বা ঝামেলা সৃষ্টি করতে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসন ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশবাসী শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন থাকে। প্রথমত ইংরেজ শক্তি এদেশের জনসাধারণকে কোনোপ্রকার শিক্ষা প্রদান কোম্পানীর স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে। শিক্ষাখাতে অর্থ ব্যয় করে তারা নিজেদের মুনাফা কমাতে চায়নি। পাশাপাশি মনে করেছে, শিক্ষার আলোকে আলোকপ্রাপ্তরা আত্মসচেতন হয়ে রাষ্ট্রে প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ পাবে। এ সময় থমাস নামে এক চিকিৎসক চিকিৎসাদানের পাশাপাশি শিক্ষাদান ও ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করলে কোম্পানী তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করে। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে উৎসাহী এবং যথেষ্ট প্রভাবশালী গ্রান্টের অদম্য প্রচেষ্টায় উইলিয়াম কেরী, জন ক্লার্ক মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড প্রমুখ মিশনারীরা সতেরশো নিরানব্বই সালে আমেরিকার এক জাহাজে চড়ে বাংলায় আগমন করে। সতেরশো বিরানব্বই সালে চার্লস গ্রান্ট ‘অবজারভেশন’ নামে একটি বই লেখেন। সে বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ভারতীয়দের জীবনে দুর্দশার কারণ দুটি; অজ্ঞানতা ও উপযোগী ধর্মের অভাব। গ্রান্ট তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেন, অজ্ঞানতাই যেহেতু ভারতীয়দের নীতিহীনতার কারণ সেহেতু এই অবস্থার উন্নতির জন্য প্রথমেই দরকার তাদের শিক্ষিত করে তোলা। সেই শিক্ষা অবশ্যই হতে হবে পাশ্চাত্য শিক্ষা। আর ভারতীয়দের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করতে হবে, কারণ খ্রীস্টধর্মই ভারতীয়দের জীবনে নৈতিক পুনর্জন্ম আনবে। তিনি আরো বলেন যে, ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ধীরে ধীরে ভারতীয়দের খ্রীস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করবে।
সরকারিভাবে শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তখন বেসরকারী উপায়ে বিভিন্নভাবে বাংলায় ইংরেজী শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের কাজটা এগিয়ে যায়। প্রধানত খ্রীস্টান মিশনারীদের চেষ্টায় এটা আরম্ভ হয়। ইংরেজ শাসকরা তখনো চাচ্ছিলো না এসব করতে গিয়ে জনগণের সাথে কোনো বিরোধিতার মুখোমুখি হতে। ইতিমধ্যে আঠারশো আট সালে ইংল্যান্ডে ভারতের শিক্ষা বিস্তার ও মিশনারীদের কার্যক্রমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস, চালর্স গ্রান্ট, স্যার থমাস মনরো, স্যার জন ম্যালকম ও ভারতের অন্যান্য কয়েকজন কর্মকর্তাবৃন্দ। সদস্যদের অধিকাংশই ভারতে শিক্ষাদানের বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং রাষ্ট্রের পক্ষে এর তত্ত্বাবধান কিংবা দায়িত্ব নেয়া উচিৎ নয় বলে মত পোষণ করেন। তা সত্ত্বেও আঠারশো তেরো সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সনদ নবায়নের সময় উইলবারফোর্স সংসদে সরকারকে ভারতবাসীর শিক্ষার দায়িত্ব নিতে বলেন। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সংসদ ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে আর উদাসীন থাকতে পারেনি। চার্লস গ্রান্ট ও উইলসবারফোর্সের মতো শিক্ষাবিদ ও মিশনারীদের দাবির মুখে শেষপর্যন্ত ঐ বছর ভারতীয়দের শিক্ষাখাতে বার্ষিক মাত্র একলক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তাতে বলা হয়, গভর্নর জেনারেল পরিষদকে এই নির্দেশ দেবে যে, সামরিক ও বেসামরিক ব্যয় বহন করার পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকবে সেখান থেকে প্রতিবছর একলাখ টাকা ভারতীয় সাহিত্য শিল্পকলার জন্য প্রদান করা হবে, যাতে এখানকার অধিবাসীরা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে পারে। বাংলা থেকে তার মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে কয়েক কোটি টাকা কিন্তু সারা ভারতের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয় মাত্র এক লক্ষ টাকা।
প্রধানত খ্রিষ্টান মিশনারীদের দাবির মুখেই সরকার ভারতবাসীর শিক্ষা বিস্তারের এই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মিশনারীদের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষা প্রসারের মধ্য দিয়ে ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটানো। আঠারশো তেরো সালে শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল কোম্পানীর পরিচালক মণ্ডলীর প্রবল বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে। সেই বছর তাই একলাখ টাকা বরাদ্দ ছাড়া এরপর আসলে তারা শিক্ষার জন্য আর বিশেষ কিছু করেনি। পরবর্তী বাইশ বৎসরে এই নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। যা কিছু হয়েছিল খ্রিষ্টান পাদ্রীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের দ্বারা। এঁরা বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আঠারশো সতেরো সালে মধ্যেই শ্রীরামপুরের চারদিকে কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশটি পাঠশালা স্থাপিত হয়েছিল। এগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল ধর্ম প্রচার। তাই সাধারণভাবে গরীব ঘরের ছাত্র মিশন বিদ্যালয়ে যোগদান করতো, ধনী ঘরের ছাত্র পাঠশালাতেই যেতো। বাংলার সুবিধাভোগী হিন্দু সমাজে এ সময়ে ইংরেজী শিক্ষা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই অবস্থায় কলকাতায় অবস্থানরত কয়েকজন শিক্ষানুরাগী একটি উচ্চমানের ইংরেজী মহাবিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা করেন। এ প্রেক্ষিতে আঠারশো সতেরো সালের বিশে জানুয়ারী কলকাতায় ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আঠারোশো সতেরো সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজে শুধু হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তানরাই পড়ার সুযোগ পায়। হিন্দু কলেজে মুসলিম কিংবা খ্রিস্টানদের বা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শিক্ষা লাভের সুযোগ ছিল না। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের জন্য ভারতীয় ও ইংরেজী ভাষায় শিক্ষাদান এবং এশিয়া ও ইউরোপের সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বঙ্গদেশে ইংরেজী স্কুলের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। হিন্দু কলেজই বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
কলকাতার বাবুদের কারো কারো দেশীয় শিক্ষার প্রতি সামান্য সহানুভূতি থাকলেও তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি শিক্ষার প্রসার। কলকাতার ধনী ব্যক্তিবর্গ ছিল দ্বিতীয় গোষ্ঠীভুক্ত যাদের পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষেই দেখা গেছে। এই গোষ্ঠীর মধ্যে একদিকে ছিল ধর্ম ও সামাজিক ক্ষেত্রে উদারপন্থী ব্যক্তিবর্গ, যেমন রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। আর অন্যদিকে ছিলেন রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির ব্যক্তিবর্গ, যেমন বাধা কান্তদেব ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাধাকান্ত দেব ও দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল হলেও দুজনেই নারী শিক্ষার প্রচুর কাজ করেছেন। দেবেন্দ্রনাথ আবার রাধাকান্তের মতো অতোটা রক্ষণশীল ছিলেন না। শিক্ষা উন্নয়নে তৃতীয় গোষ্ঠী ছিল খ্রীষ্টধর্ম প্রচারকরা। তিন গোষ্ঠীর সহযোগিতার ফলে আঠারশো সতেরো সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ এবং আঠারশো আঠারশো সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’। ‘কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রধানত বিদ্যালয়ের পাঠ্য বাংলা বই প্রকাশ করতো এবং সেইসঙ্গে কিছু সংস্কৃত, আরবী ও ইংরেজী বইও প্রকাশ করা শুরু করে। কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির উদ্যোগে পরবর্তী বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’। হিন্দু কলেজ ও কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষা প্রসারে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কলকাতা স্কুল সোসাইটির কাজ ছিল জনশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার সাধন করে ছাত্রদের উচ্চস্তরে ইংরেজী শিক্ষা লাভের জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া। স্কুল সোসাইটি পরিচালিত ‘আদর্শ বিদ্যালয়’-গুলিতে ইংরেজী শিখে ছেলেরা হিন্দু কলেজে ভর্তি হতো। ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’র উদ্দ্যোগে হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির পরিবর্তে মুদ্রিত পুস্তকের প্রবর্তন এবং শিক্ষা কার্যক্রমে ভূগোল, ইতিহাসের মতো বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করে কার্যক্রমকে প্রসারিত করা হয়।
মিশনারীরা কেবল কলকাতায় নয়, প্রত্যন্ত জেলাগুলোতেও তারা জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। মিশনারীরা শিক্ষাকে ধর্মান্তরিতকরণের মাধ্যম বলেই মনে করতো এবং তারা বিশ্বাস করতো যে, শিক্ষাপ্রাপ্তরা স্বাভাবিকভাবে পরবর্তীকালে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি আগ্রহশীল হবে। বাংলার বিভিন্ন অংশে মিশনারীরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখেই পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন করতে তারা আগ্রহ দেখায়। পাটিগণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় জমিদারি সংক্রান্ত বিষয়াদি; যেমন, হিসাব রক্ষণের স্থানীয় পদ্ধতি, ভূসম্পত্তি হস্তান্তরের দলিল রচনা ইত্যাদি। বিবিধ সত্য ঘটনা সম্বলিত কাহিনী সংকলন ‘দিগদর্শন’ পাঠ্য বিষয়ে স্থান পায়। পাঠ্যবিষয়ে আরো অন্তর্ভুক্ত হয় সৌরজগৎ সম্পর্কে ধারণা, মানচিত্রসহ ভূগোল, কালানুক্রমিক ইতিহাস এবং প্রযুক্তিগত শব্দের ব্যাখ্যা সম্বলিত তালিকা। মিশনারীরা তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষার দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করে। মার্শম্যান স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন যে, জনগণকে তাদের নিজের ভাষার পরিবর্তে অন্য কোনো ভাষায় উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করার আশা সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তিকর। মিশনারীরা শিক্ষাপ্রণালীতে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করতে চেষ্টা করেছিল। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা মুদ্রিত পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক ছিল। বলা যায় যে, শ্রেণীকক্ষে ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকমালা প্রণয়ন করে মিশনারীরা সনাতনী পাঠশালার তুলনায় মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চমানের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।
রামমোহন ইংরেজী বা পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে ছিলেন। আঠারশো বাইশ সালে তিনি নিজে ‘এ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ নামে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আঠারশো তেইশ সালে কোম্পানীর সনদ নবায়নের বছর ছিল। তার পূর্বের নয় বছর শিক্ষাখাতে আর কোনো টাকা বরাদ্দ করেনি বলে সনদ নবায়নের সময় এসে গেলে নতুন করে সনদ নবায়ন করার কথা মাথায় রেখে কোম্পানী তড়িঘড়ি করে এই সময়ে ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশসন’ বা ‘জনশিক্ষা পরিষদ’ গঠন করে। হল্ট ম্যাকেঞ্জি পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ স্থানীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তিনি পরামর্শ দেন যে, সরকারের আশু কর্তব্য হলো শিক্ষিত ও প্রভাবশালী শ্রেণীরূপে পরিচিতদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। তিনি অবশ্য সম্পূর্ণরূপে প্রাচ্য জ্ঞান বাদ দেয়ার বিরোধিতা করে পাশ্চাত্য জ্ঞানের সাথে প্রাচ্য জ্ঞানের সংমিশ্রনের কথা বলেছিলেন। সদস্যদের মধ্যে আবার উইলসন ছিলেন প্রাচ্য তথা সংস্কৃত শিক্ষার ঘোর সমর্থক। জনশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গদেশে প্রাচ্যবিদ্যা প্রসারে মনোযোগী হলে নদীয়া ও কলকাতায় পরবর্তী বছর সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। সরকার সংস্কৃত কলেজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ত্রিশ হাজার টাকার বার্ষিক অনুদান মঞ্জুর করে। কিন্তু সরকার কলকাতা মাদ্রাসার উন্নয়নে আর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। রামমোহন কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন। ইংরেজ শাসকদের নিকট তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে একটি পত্রও লিখেছিলেন। পত্রটির সারমর্ম ছিল যে, সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার দ্বারা দেশের ছাত্ররা কিছুই শিখবে না। সুপ্রাচীনকাল থেকে যে ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন মীমাংসা এবং বেদবেদান্তের পঠন-পাঠন ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে, তাই নিয়েই প্রস্তাবিত সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা বারো বছর অতিবাহিত করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শিক্ষা পাশ্চাত্যে যুগান্তর এনেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে সংস্কৃত শিক্ষা সহজেই অসার বলে প্রতীয়মান হবে। ইংরেজ সরকার যদি ভারতবাসীকে অজ্ঞানের অন্ধকারে রাখতে চায়, তবে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সাধিত হবে। রামমোহন যে সংস্কৃত শিক্ষাকে অসার মনে করতেন, তা তাঁর এই মন্তব্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ সেখানকার সব শিক্ষা ছিল জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন, যা পূর্বে কিছুটা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু না করে সংস্কৃত শিক্ষা বজায় রাখার জন্য সুধাকর নামে একটি বাংলা পত্রিকাও ইংরেজ সরকারের সমালোচনা করে।
সুধাকর প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধে বলা হয়, বিস্তৃর্ণরূপে বিদ্যা প্রচারের জন্য সমাচারপত্র সম্পাদকরা যতোই লেখেন না কেন, সরকার তাতে কর্ণপাত করে না। নিজেরা যে বিদ্যায় খরচ করা উচিত মনে করে তাই করা হয় কিন্তু ঐ শিক্ষার দ্বারা ভারতবর্ষের সর্বসাধারণ মানুষের কী উপকার হবে বলা যায় না। সংস্কৃত বিদ্যালয়ে সরকার খরচ করে বটে তাতে সর্বসাধারণের বিশেষ উপকার হয় না। যে বিদ্যা শিক্ষায় লোকের মনের অন্ধকার দূর হয়ে রাজ্যশাসনে নৈপুণ্য জন্মায় দয়ালু রাজার উচিৎ সেই বিদ্যা চালু করা। ইংরজী শিক্ষার পক্ষে এই পত্রিকায় জোরালো মতামত প্রচারিত হয়। দেখা যাচ্ছে, ইংরেজী শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য বিদ্যা শেখার জন্য সম্ভ্রান্ত দেশবাসীর আগ্রহ ছিল প্রবল বরং ইংরেজ শাসকরা তার স্বীকতি দিচ্ছিলো না। রামমোহন বা ভদ্রলোকরা যে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে সুপারিশ করছিলেন তার একটি ইতিবাচক দিক নিঃসন্দেহে ছিল। হিন্দুধর্মের নানারকম কুসংস্কারের স্থানে তাঁরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার চাইছিলেন। কিন্তু পাশ্চাত্যের এই শিক্ষা শুধুমাত্র ভদ্রলোকদের জন্যই চাইছিলেন এবং একই সাথে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। বিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষায় অবশ্যই পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান চালু করা প্রগতিশীল চিন্তারই অংশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ভদ্রলোকরা নিজশ্রেণীর স্বার্থ দ্বারা অন্ধ ছিলেন। নিজেদের সন্তানদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে ওকালতি করেন। নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের কথা বা গ্রামের সাধারণ মানুষের সন্তানদের কথা তাঁরা ভাবেননি। যদি সাক্ষরতার লাভের জন্য পাঠশালা বা তদরূপ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করার কথা ভাবতেন, তাহলে সেই চিন্তা অনেকবেশি বাস্তবসম্মত হতো। পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করতে গিয়ে তাঁরা পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেন এবং নিম্নশ্রেণীর সন্তানদের নিরক্ষর করে রাখলেন। ভারতের বড়লাট ছিলেন লর্ড ময়রা। আঠারশো পনের সালের দোসরা অক্টোবর তিনি তাঁর দিনলিপিতে মন্তব্য করেছিলেন, ‘পাঠশালা শিক্ষকগণ ছেলেদের লেখাপড়া ও অঙ্ক কষা শেখান। এঁরা যে সামান্য বেতন নেন, গ্রামে কারো পক্ষেই তা দেওয়া কঠিন নয় এবং এঁরা ছাত্রদের যতটুকু বিদ্যা শেখান তা গ্রামের জমিদারের সেরেস্তার কাজ, হিসাব-রক্ষকের কাজ এবং দোকানদারির কাজের পক্ষে যথেষ্ট।’ লর্ড ময়রা পাঠশালাগুলির উপযোগিতা উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু সরকার লর্ড ময়রার সে কথায় কর্ণপাত করেননি। কারণ সরকার সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার চায়নি।
ব্রিটিশ সরকার আঠারশো তেত্রিশ সালে কোম্পানীর সনদ নবীকরণের সময় জনশিক্ষা পরিষদের অনুদান এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ টাকায় বৃদ্ধি করে বাংলা তথা ভারতবাসীর শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। ফলে এ সময় ভারতবাসীর শিক্ষা সম্পর্কে বিতর্ক নতুন মোড় নেয়। এ টাকা কী ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যয় করা হবে তা নিয়ে পরিষদের সদস্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কারণ পরিষদের সদস্যরা প্রথমে প্রাচ্যপন্থী থাকলেও পরে দেশীয় উচ্চবর্গের, খ্রিষ্টান মিশনারীদের, দেশী বিদেশী বণিকদের ও একশ্রেণীর ইংরেজ কর্মকর্তাদের চাপে দশজন সদস্যের পাঁচজনই পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে পড়েন। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যপন্থী শিক্ষাদানে সদস্যরা সমান দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা কাজকর্ম পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। দুপক্ষের কেউ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা না ভেবে নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় রইলো। শিক্ষার ধরন নিয়ে জনশিক্ষা পরিষদের সদস্যদের মতভেদ থাকলেও একটি বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল না। তাঁরা সবাই মনে করতেন যে, এদেশে প্রথম শুধু উচ্চ ও মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং পরে তাদের প্রভাবেই তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের শিক্ষা লাভের দরকার আছে তা তারা মনে করতেন না। কিন্তু বাংলার পাঠশালায় তখন নিম্নবর্গের মানুষকে প্রাথমিক শিক্ষা সহ পেশাগত শিক্ষা দান করে যাচ্ছিলো।
ব্যাপারটি লক্ষ্য করবার মতো, ইংরেজ শাসকরা কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বা আমদানী চায়নি, সেটা চেয়েছিল বিশেষ করে বাংলার বর্ণহিন্দু সমাজ। বাংলার মুসলমানরা প্রথমে কখনোই ইংরেজী শিক্ষা বা পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষার কথা বলেনি। হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের চাপের মুখেই ইংরেজ শাসকরা এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়। আঠারশো পঁয়ত্রিশ সালে এ ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত মত পাওয়া যায়। সরকারের তখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি ছিল না। বৃটিশ সংসদের চাপে তারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। ঠিক এই সময়ে জনশিক্ষা পরিষদের মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষা নিয়ে বিরাট এক বিতর্ক দেখা দেয়। পাশ্চত্যপন্থীরা ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত দেয়। ইংরেজ কর্মকর্তারা বুঝতে পারে যে, বেসরকারী উদ্যোগে যেভাবে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার ঘটছে এরপর সরকারের নিষ্ক্রিয় থাকা অনুচিত। তারা হিসেবে করেছিল যে, ভারতে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার হলে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য জীবন ধারায় অভ্যেস্ত হবে এবং ভারতে ব্রিটিশ শিল্পদ্রব্য বেশি বিক্রি হবে। সরকারের কিছু রাজপুরুষরা মনে করতেন, সরকারের নিচু পদে কম বেতনে ইংরেজী শিক্ষিত ভারতীয়দের নিয়োগ করলে কোম্পানী আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে। এজন্য তারা ইংরেজী ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে রায় দেয়। জনশিক্ষা পরিষদের সভাপতি হিসেবে মেকলে যোগ দিলে পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে এই পরিষদের শক্তি বেড়ে যায়। সভাপতি নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, ইংরেজী কেবল শাসকশ্রেণীর ভাষা নয়, ইংরেজী হচ্ছে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে উন্নত ভাষা।
ইংরেজী শিক্ষার পক্ষে মেকলের সুদীর্ঘ মন্তব্য ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ দলিল হয়ে আছে। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ভারতে ইংরেজী শাসকশ্রেণীর ভাষা কিছুদিনের মধ্যেই প্রাচ্য সমুদ্রের সকল তীরবর্তী দেশসমূহের বাণিজ্যের ভাষারূপে গৃহীত হবে। ভারতীয়দের সম্পূর্ণভাবে ইংরেজী ভাষায় সুপণ্ডিত করে তোলা সম্ভব এবং সরকারী শিক্ষা প্রচেষ্টার সেই লক্ষ্যই থাকবে। ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্য শিক্ষার প্রবর্তন করলে ভারতবর্ষে একটা নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হবে যারা জন্মসূত্রে এবং চেহারায় ভারতীয় থাকবে কিন্তু যাদের রুচি, মতবাদ, নীতিজ্ঞান, বুদ্ধি-শুদ্ধি সবই হবে ইংরেজদের মতো এবং যাদের শিক্ষা চুইয়ে জনসাধারণের উপর পড়বে।’ খুব চমৎকারভাবেই মেকলে বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যর শিক্ষা যারা লাভ করবে তারা হবে ইংরেজ শাসকদের অনুকারক এবং বশংবদ এবং সমাজের সাধারণ মানুষের উপরও তাদের শিক্ষার প্রভাব পড়বে। স্বনামধন্য মেকলে ভুল বলেননি, বাস্তবে ঘটেছিলোও তাই। সরকার শিক্ষার বাহন ইংরেজি করলো এবং পাশ্চাত্যের শিক্ষাধারা চালু করতে চাইলো কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। সাধারণ মানুষের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে তাই অসংখ্য পাঠশালাকে ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। কিন্তু আঠারশো পঁয়ত্রিশ সাল পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষানীতি উদ্ভাবিত হয়নি। আঠারশো পঁয়ত্রিশ সালের পর সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তশ্রেণীর শিক্ষার প্রতি সরকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও নিম্নশ্রেণী সম্পূর্ণ উপেক্ষিত ছিলো। টমাস মেকলে তাঁর ঘোষণায় প্রাচ্যবিদ্যার সকল পুস্তক মুদ্রণ কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। দিল্লি, বেনারস ব্যতীত প্রাচ্যের অন্যান্য মাদ্রাসা ও মহাবিদ্যালয় সমূহে তালা ঝুলিয়ে দিতে বলেন এবং সেখানকার ছাত্রদের বৃত্তিসমূহ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, প্রাচ্য বিদ্যার গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য সরকারী অর্থ সাহায্য বন্ধ থাকবে এবং এর জন্য সংরক্ষিত অর্থ পুরোটাই ইংরেজী সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তারে জনগণের মধ্যে বন্টন করা হবে এবং সে শিক্ষা অবশ্যই হবে ইংরেজীর মাধ্যমে।
যখন অন্যরা ভারতে ইংরেজী চালু করার ব্যাপারে উদগ্রীব জেমস মিল তখন মাতৃভাষার প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। তাঁর মতে, ভারতের মতো জনবহুল দেশে বেশির ভাগ মানুষকে ইংরেজী শেখানো অসম্ভব। আর এই অসম্ভবকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করলে অনেক প্রয়োজনীয় কর্তব্যই অবহেলিত থাকবে। বরঞ্চ ইউয়োপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইয়ের অনুবাদ করে দেশীয় ভাষায় শিক্ষা দিলে অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি লোককে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করা সহজ হবে। সত্যিকার অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি বলেছিলেন জেমস মিল। উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখতে হবে মাতৃভাষায়, শাসকদের ভাষা ইংরেজীতে নয়। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, শাসকের ভাষায় শিক্ষা দিলে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক কি অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয় না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আয়ারল্যান্ডের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে আইরিশরা ইংরেজী শিখেও ইংরেজদের সঙ্গে আত্মীয়তা করেনি। তা ছাড়া ভারতের মতো দেশে ইংরেজীকে সর্বসাধারণের ভাষা করা কখনোই সম্ভব নয়। শাসকরা সেদিন জেমস মিলের কথার গুরুত্ব দেয়নি। বাংলার পাঠশালা কিংবা প্রাচ্যশিক্ষার বিরুদ্ধে মেকলে যে যুক্তি তুলে ধরেন তাহলো, পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষাদানের সুযোগ থাকতে প্রাচ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই; কারণ এগুলি কোনো উপকারেই আসছে না। তিনি ইংরেজী ভাষার সমর্থনে লিখলেন, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অমূল্য অফুরন্ত খনি। ইংরেজী ভাষা ইউরোপীয় ভাষা সমূহের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। দেশী ভাষা বা মাতৃভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশীয় ভাষাসমূহ অত্যন্ত দীন ও ঐশ্বর্য্যহীন, এ ভাষার শব্দ সম্পদ ভাবপ্রকাশে অনুপযুক্ত এবং পাশ্চাত্য ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থসমূহ দেশীয় ভাষাসমূহ অনুবাদ করা সম্ভব নয়। যে ভাষা এতো দরিদ্র সে ভাষা শিক্ষার বাহন হতে পারে না। লর্ড মেকলে মিথ্যা স্বপ্ন দেখার মতো ভেবেছিলেন ইংরেজী শিক্ষা লাভ করে ভারতীয়রা সবাই খ্রীস্টান হয়ে যাবে। পিতার কাছে লিখছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস পরবর্তী ত্রিশ বছরের মধ্যে এদেশে একজনও মূর্তিপূজক থাকবে না। ইংরেজী শিক্ষা পেয়ে বাঙালীরা স্বাভাবিকভাবেই খ্রীস্টধর্মভাবাপন্ন হয়ে উঠবে, পাদ্রীদের আর ধর্ম প্রচার করার আবশ্যক হবে না।
সনাতনী দেশীয় শিক্ষা সরকারের বিবেচনায় স্থান পায়নি, সাধারণের শিক্ষা নিয়ে তারা সামান্য চিন্তিত ছিল না। ইংরেজদের শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে মেকলের তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজের উঁচুশ্রেণীর হিন্দুর জন্য শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে সমাজের বিত্তবান লোকেরাই উপকৃত হন। যাঁরা শহরে বসবাস করেন তারাই নিজেদের সন্তানদের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ানোর সুযোগ পান। বাংলার যেকোনো গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের মিশ্র আবাস ছিল। গ্রামে স্বল্প সংখ্যক ছিল জমিদার, জোতদার, মহাজন, ধনী বণিক ও অন্যান্য বিত্তশালী ব্যক্তি। গ্রামের মোট জনসংখ্যার বিপুল অংশই নিয়োজিত ছিল কৃষিকাজে। গ্রামের জনগণের এক অংশ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিল। যেমন কেউ জমিদারের সহকারী বা প্রতিনিধি হিসেবে, কেউ অন্য কোনো ছোট ব্যবসায়, কেউ চালাতো মুদি-দোকান। নাপিত বা দরজির পেশায়ও কেউ কেউ নিয়োজিত ছিল। কিন্তু মানুষগুলোর শিক্ষার কথা সরকার বা উচ্চবর্গের লোকরা ভাবলেন না। সুবিধাপ্রাপ্তরা ব্যাপারটাকে যেভাবে বিচার করলেন তাহলো, সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা দরকার। কিন্তু তা দরকার শুধু কলকাতার আশেপাশের সুবিধাভোগীদের জন্য, বাকিরা নিরক্ষর থাকলেও তাদের কিছু যায় আসে না। রামমোহন রায় ছিলেন এঁদের পথিকৃত। রামমোহন রায় যতোই আলোকপ্রাপ্ত হন না কেন, তিনি গ্রামবাংলার বাকি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। চলবে