আহমদ ছফার দুটি কবিতা
প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২১
সাহিত্যিক আহমদ ছফার আজ মৃত্যুদিন। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি মারা যান। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণাঞ্চলের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা দুটো কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
শুধু একটি শব্দের জন্য
তুমি যখন রজনীগন্ধার ডাঁটার মত নত হয়ে
ঘরের মধ্যে পা রাখলে সারাঘরে খেলে গেল একটা স্পন্দন
হঠাৎ যেন বদ্ধ হওয়া শিউরে উঠল।
তুমি যখন বাঁকাচোরা হাত দুটো আলতোভাবে
কোলের উপর শুইয়ে রাখলে
অপার বাঙময় সে দুটো অপরূপ হাত
বীণার মত বেজে উঠতে চাইল।
তুমি যখন শরীরের বসন টেনে টুনে ঠিক করায়
হঠাৎ খুব মনোযোগী হয়ে উঠলে, মনে হল
শরীর ঢাকতে গিয়ে তুমি শরীর থেকে পালাতে চাইছ।
অমনি তোমার ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ
বিদ্যুৎপ্রবাহ নির্গত হয়ে আমাকে তড়িতাহত করল।
তুমি যখন কার্পেটে বুড়ো আঙুল খুঁটে খুঁটে মেঝের
পানে তাকিয়ে খুউব নিচুস্বরে কথা বললে
মনে হয় ঘরে দেয়ালগুলো সন্তর্পণে কান পেতে আছে
যাতে তোমার প্রতিটি উচ্চারিত ধ্বনি দেয়ালের মর্মে বিধে থাকে।
যখন আমি তোমার কাছে গেলাম, মনে হল
একটা নির্জন ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি
জাগতিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে যার উৎসস্থল।
আর যে ঝর্ণা মৃদুস্বরে কেবল নিজের সঙ্গেই আলাপ করে।
আমি যখন তোমার ঘরের বাইরে পা রাখলাম
আমার রক্তে, আমার অনুভবে ফুটন্ত ঝর্ণার আবেগ;
একটা মৃদু মোহন প্রীতিবদ উত্তাপে আমার
ভেতরের পদার্থ সকল গলানো মোমের মত বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যত দূরেই যাচ্ছি পথের পাশের সব কিছুর মধ্যে
যে ঝর্ণার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি,
সে অদৃশ্য ঝর্ণার ঝংকার শুনতে পাচ্ছি।
আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।
তুমি আমাকে চরাচরে প্রবাহিত হওয়ার
আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী করেছ।
তুমি আমার হাতে তুলে দিলে বিশ্বলোকে
বিহার করার টাটকা নতুন ছাড়পত্র।
হে নারী তোমাকে কি নামে ডাকব।
কোন নামে ডাকলে তোমার হৃৎকমল সুখসমীরে
আন্দোলিত হয়। কোন নামে ডাকলে আমার
নাভিপদ্মের মূল থেকে শৈলের
সোনালী পোনার মত যে অনুভবরাশি
ওপরে ভেসে উঠেছে তার বিশ্বস্ত প্রকাশ ঘটাতে পারি!
বেতারে খবর ঝরে
বেতারে খবর ঝরে,
তাজা খুন; কাঁচা প্রাণ ঝরে
ভিয়েৎনামে; পথে পথে
নগরে বন্দরে, বনে বনান্তরে
রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে
তপ্ত রক্ত ঝরে।
জিঘাংসার জটা মুক্ত সাগ্নিক নিঃশ্বাসে মূর্ত
মমচেরা কামনার বেশুমার নিহত মুহূর্ত
অকস্মাৎ আগ্নেয় ঝলকে
দুর্মর চেতনারশ্মি দুর্জয় প্রত্যয়ে ফুসে
তুলি লক্ষ গোখরার ফণা
দুরন্ত মাভৈঃ সুরে সবল দরাজ কণ্ঠে উদাত্ত ঘোষণা
মার্কিনির বর্বরতা ক্ষমা করিব না।
জন্মে জন্মে যুগে ক্ষমা করিব না
কোটি কণ্ঠে নৃশংস ঘোষণা।
আত্মারে গচ্ছিত রেখে পাপের হারেমে
জোব্বা পরা লম্পটেরা;
নারীর সতীত্ব লুটে বীরত্বের দর্প করে যারা
যারা দুনিয়ার লোভে সত্যসন্ধ মানুষের বেচাকেনা করে,
যাদের পাশব শৈর্যে মানবতা মাথা কুটে মরে,
যাদের নাপাং বোমা ফুলের ফাগুনভরা
সবুজ পোয়াতি ক্ষেতে আগুন লাগায়,
যাদের জীবাণু অস্ত্রে শিশুরা মাছের মতো ধুকে ধুকে মরে,
যাদের রকেট ঘাটি ঘুমন্ত চোখের কোণে
বিভীষিকা আনে,
যাদের হিংসার শরে নিগারেরা নিত্য বিদ্ধ হয়,
যাদের বেনিয়াবুদ্ধি পৃথিবীর উর্বরতা ক্ষুণœ হয়,
যারা রাখে জারজের রক্ত মাংসে
কলুষিত কামনার বীজ;
– সেই ঘৃণ্য দানবের নগ্ন বর্বরতা
ভিয়েতনাম সইবে না, সইবে না দুনিয়ার সংগ্রামী সেনানী।
আফ্রো’শিয়ার গহীন গহনবন, ফেনিল সমুদ্রতীরে।
মরুভর বুক কুঁড়ে অযুত নিযুত কণ্ঠ
বাতাসের হৃদপিণ্ড চিরে চিরে কয়,
– আদিম বর্বর তেজ বলদীপ্ত অহিংস হৃদয়
হিংসায় হিংসায় আজ নব পরিচয়।
তাই ধমনীর শেষে লালে, লিখে যাবো
সংগ্রামের রক্তাক্ত আখর।