আসুন, নিউজিল্যান্ড থেকে কিছু শিখি

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৯

নিউজিল্যান্ডের সরকার ও জনগণ কর্তৃক গৃহীত সন্ত্রাসী হামলা পরবর্তী নানা কর্মসূচি দেখে আমরা আনন্দে আপ্লুত। ফেসবুকের দেয়াল ভেসে যাচ্ছে প্রশংসার বন্যায়। নিউজিল্যান্ড যা করছে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ এবং তা বিশ্বমানবতার কাছে নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করছে। জাতি হিসেবে তারা অতি ভদ্র ও শান্তিপূর্ণ, সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। মানবাধিকার এমনকি নারীর অধিকার প্রশ্নে তারা সব সময়ই সোচ্চার। ভুলে গেলে চলবে না, তারাই পৃথিবীর প্রথম জাতি হিসেবে নারীদের ভোটাধিকার দিয়েছিল। সে দিক দিয়ে মানবাধিকার রক্ষায় দৃষ্টান্ত তৈরি করার বিষয়টি তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। উদারতা আর মানবতা চর্চা তাদের রক্তে, চেতনায় ও ব্যবহারিক জীবনে এমনভাবে মিলে গেছে, বিষয়গুলো তাদের মধ্যে সহজাত। তাই, নিউজিল্যান্ডের জনগণ যা যা করছে সেটা মনের টানেই করছে, এটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ।

তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র এধরনের পরিস্থিতিতে যা যা করে থাকে, তার পেছনে মানবতার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। একেক দেশ একেক ভাবে এধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে থাকে, তবে তার পিছে ক্ষমতাসীন দলের নিজস্ব রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয় থাকে। নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে সেটা কি ধরণের হতে পারে, তার একটা ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি, যা একান্ত আমার চিন্তা।

নিউজিল্যান্ডের বর্তমান সরকার একটি জোট সরকার। ক্ষমতায় আছে তিনটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট। গত নির্বাচনে প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা ন্যাশনাল পার্টি সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়। কোনো রাজনৈতিক দলই এককভাবে ক্ষমতায় যাবার মতো যথেষ্ট আসন জিততে ব্যর্থ হয় বিধায় ছোট্ট দল নিউজিল্যান্ড ফার্স্ট পার্টির সমর্থনে জাসিন্দা আর্ডানের লেবার পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। নতুন জোট সরকারকে সমর্থন দেয় গ্রিন পার্টিও। ক্ষমতায় যেতে ন্যাশনাল পার্টির প্রয়োজন ছিল আরো ছয়টি আসন আর জেসিন্দার দলের দরকার ছিল আরো ১৫ আসন। অপরদিকে ফার্স্ট পার্টি মোট আসন পায় নয়টি, গ্রিন পার্টি আটটি, দুইদল মিলে পায় ১৭ আসন। তাদের সমর্থনে লেবার পার্টি সহজেই সরকার গঠন করতে পারলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে এখনও সে দেশে একক দল হিসেবে শীর্ষে রয়েছে ন্যাশনাল পার্টি, যা জেসিন্দার দলের জন্য চিন্তার একটি বড় কারণ।

জাতি হিসেবে তারা অত্যন্ত ন্যায়বান এবং নিয়মতান্ত্রিক হওয়ায় পরবর্তী নির্বাচনে জয় পেতে জনগণের সমর্থনই তাদের একমাত্র পাথেয়। আর এটা সবারই জানা যে, পুরা ইউরোপে বা অন্যান্য মহাদেশেও মুসলিম ভোটারদের একটা শক্ত অবস্থান রয়েছে এবং নির্বাচনে তারা সরাসরি বড় ধরণের একটা ভূমিকা পালন করে থাকে। নিউজিল্যান্ডে মুসলিম ভোটার কম হলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে অন্যরা সরকারের ওপরে আস্থা হারাতে পারে, যা থেকে দ্রুত মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো জরুরি।

জুম্মার নামাজের সময় দুটি মসজিদে যে হামলা ঘটে গেছে, তার দায় নিউজিল্যান্ডের বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট এড়িয়ে যেতে পারে না। দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, হামলার স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেরিতে পৌঁছানো এবং আগাম ই-মেইল পেয়েও হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হবার জন্য বর্তমান সরকারের সক্ষমতার বিষয়ে খুব সহজেই প্রশ্ন তোলা যায়। আমাদের উপমহাদেশে অনেক কিছুর চর্চা চালু না হওয়ায়, তাদের সরকারের লজ্জায় পড়ার বিষয়টা আমরা সেভাবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু তারা সভ্যজাতি বলেই বিষয়টা তারা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। অতিদ্রুত এই পদক্ষেপগুলো নিয়ে তারা যেমন একদিকে নিজেদের সহজাত বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, তেমন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ নানা চাপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে। আজ তারা সারা বিশ্বে যে উদাহরণ তৈরি করেছে, তা তাদের মানবিক এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দারুণ এক সংমিশ্রণের ফল। এভাবেই জেসিন্দার দল মানুষের মনে স্থান করে থাকবে বহুকাল। তাদের দেখে অনেক কিছু শিখার আছে, পেশীশক্তির চেয়ে মানুষের মানবিক গুণাবলির স্থান যে অনেক উপরে সেটা তারা আবার প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

এখন আমাদের দেশে যারা নিউজিল্যান্ডের সংসদে কোরআন তেলাওয়াত করা হয়েছে বলে আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ বলে ফেসবুকের ওয়াল ভাসিয়ে দিয়েছেন, আপনারা ধর্মীয় আধিপত্যের পূজারী। আপনারা নিউজিল্যান্ডের থেকে কিছুই শিখতে পারলেন না। আপনারা খুশি, তারা তাদের সংসদে কোরআন পড়েছে বলে আর জেসিন্দা মাথায় হিজাব পরে নিহতদের স্বজনদের সাথে দেখা করেছে বলে। তাতে আসলে খুশি হবার কি উপাদান আছে? আপনি খুশি এটা ভেবে যে, যাক নিউজিল্যান্ডে এবার ইসলামের ঝাণ্ডা উড়েছে। কিন্তু আপনি সে দেশের মানুষের উদারনীতিবাদের জায়গাটা বুঝতে ব্যর্থ। তারা বার্তা দিল মানবতার, যেখানে ধর্মটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, আর আপনি খুশিতে ডগমগ আপনার ধর্মের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে।

আরেক দল বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে এরকম হামলা হলে আর আমাদের সরকার নিউজিল্যান্ডের মতো ব্যবস্থা নিলে কি কি হতে পারত, তার একটা তুলনামূলক তালিকা ফেসবুকে শেয়ার করে বেড়াচ্ছেন। সেটা শেয়ার করার আগে নিজের মনকে প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশে যখনই সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হয়েছে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল সচেতন মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। হ্যাঁ, কিছু উগ্রপন্থী মানুষ রয়েছে যারা সবসময়ই অন্যদের ক্ষতি কামনা করে বা সুযোগ পেলেই হামলা করে। একবার নিজের মনকে প্রশ্ন করুন, তারাই কি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে? আপনার কাছে তারাই যদি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে থাকে তাহলে আমার বলার কিছু নাই, আমি দুঃখিত। আর সেটা না হলে আপনি নিজেও জানেন, সেই উগ্রপন্থীরাই আমাদের দেশের আসল সংখ্যালঘু। ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ ভুলে আসুন আমরা সবাই নিজের দেশের মানুষদের ভালোবাসি, নিউজিল্যান্ডের মানুষদের দেখে কিছু শিখি।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী