আসিফ ইকবাল আরিফ
আসিফ ইকবাল আরিফের গল্প ‘ফুলের রাত, দ্বিধার সকাল’
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৪, ২০২০
সে রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। একেবারে অঝোর ধারায় বৃষ্টি না ঝরলেও মোটামুটি ভালোই বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। আমি এককাপ কফি বানিয়ে সেরাতে না বসেছিলাম ডাইনিং টেবিলে, না বসেছিলাম সোফাতে। আমি আমার পড়ার কক্ষে একেবারেই জানালার খুব কাছাকাছি এসে বসেছিলাম। আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম; আমার বাসার পাশে টিনের চালের গ্যারেজে, পাশের পিচঢালা রাস্তাতে, ঘরের কোণের নারিকেল গাছের চিরল চিরল পাতাতে - শুধু বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার জানালার কাচে বৃষ্টিফোঁটা লেগে লেগে থাকছিলো। আমি মুগ্ধ নয়নে সেই লেগে থাকা বৃষ্টিফোঁটা দেখছিলাম আর বৃষ্টির শব্দের নাচনে নিজেকে মাতিয়ে রাখছিলাম। আমি মাঝে মাঝে রাস্তার কোল জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক খুটিগুলোতে মিটমিটিয়ে জ্বলা আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সেরাতে যেহেতু ঝড়ের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না, তাই সারা শহর জুড়ে বিদ্যুৎ ছিলো। দূরের রাস্তাগুলো থেকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন মোটর গাড়ির `ভ্যাঁ ভ্যুঁ প্যা পু` কানে আসছিলো।
আমি কংক্রিটের দেওয়ালে বালিশ চেপে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কফিতে ঠোঁট ভেজাচ্ছিলাম। আমি যখন একটা সিগারেট জ্বালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় আমার ফোনে `ট্যুং` করে শব্দ হলো। `অসাধারণ হয়েছে স্যার` - আস্থা আমাকে বার্তা পাঠিয়েছিলো। আস্থা’কে আমি খুব বেশিদিন ধরে চিনতাম না বা জানতাম না। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ও আমাকে মাঝে মাঝে ওর লেখা কবিতা পাঠাতো, আমিও পাঠাতাম। তবে এই তো বছর খানেক আগে আমাদের মধ্যে একটু চেনা জানা ছিলো। আমি তখন ব্যাংকে চাকরি করতাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বন্ধুর নিজ বিভাগ, অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলো আস্থা। আমিও অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম। তাই আমার বন্ধু আমাকে একটু সুযোগ করে দিয়েছিলো আস্থা’দের ব্যাচে একটি ক্লাশ নেওয়ার। আমি আস্থা’দের ক্লাশ নিয়েছিলাম। অফিসিয়াল ছুটির দিনগুলোর কোনোটা একদিন আমি ওদের ক্লাশ নিয়েছিলাম। আস্থা মনে হয় তখন অনার্স দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো।
আমি নিজেও পরে সেই মুইভুঁইমারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে। আস্থাদের একটি কোর্স পড়ানোর কিছুদিন পরেই আমার চাকরি হয়েছিলো। সুতরাং আমার আর আস্থার চলাফেরা এক জায়গাতেই ছিলো; সে শিক্ষার্থী ছিল, আর আমি শিক্ষক ছিলাম। যাক গে সে সব কথা। আমি আস্থা’কে সেই বৃষ্টিরাতে আমার একটি প্রকাশিত কবিতার লিংক পাঠিয়েছিলাম। তাই সে উত্তর দিয়েছিলো অসাধারণ হয়েছিলো সেই কবিতাটি। আমি একটি পছন্দ বা ‘লাইক’ চিহ্ন দিলাম। এরপর আস্থা বললো, `স্যার কেমন আছেন? তিয়ানা, সিলভিয়া আর ম্যাডাম কেমন আছে?` ফেসবুকের কল্যাণে আস্থা হয়তো আমি এবং আমার পরিবার - সবার সম্পর্কেই কমবেশি জানতো । আমি উত্তর দিলাম, `ভালো আছে। ওরা গ্রামে বেড়াতে গেছে।` এরপর আস্থা বললো, `আপনি?` আমি বললাম, `ক্যাম্পাসে, মানে মুইভুঁইমারী ক্যাম্পাসে।` আমার ক্যাম্পাসে থাকার কথাশুনে আস্থা হয়তো তার কথোপকথনে একটু চমক আনতে চেষ্টা করছিলো। আস্থা লিখলো, `ওহ! ওখানে? যেখানে শিক্ষকগণ থাকেন?` আমি ভারী মুখ করে উত্তর দিলাম, `হুম।`
আস্থা: খেয়েছেন স্যার?
আমি: না।
আস্থা: এখনো না?
আমি: না।
আস্থা: কখন খাবেন? রান্না কে করেন?
আমি: পরে খাবো। কাজের খালা আসে প্রতিদিন।
এইভাবে আমাদের বৃষ্টিভেজা রাতের আলাপন শুরু হয়েছিলো। এক পর্যায়ে আমি কিছু জানতে না চাইলেও আস্থা বলেছিলো, `আমিও মুইভুঁইমারীতে চলে আসবো। লকডাউনে গ্রামে থাকতে আর ভালো লাগছে না।` আস্থার এমন বার্তা পেয়ে আমি আস্থা’কে একটু ঝালাই করার চেষ্টা করলাম। `তুমি যেনো কোন বিভাগের? কোন বর্ষের?` - আমি এই প্রশ্ন করতেই আস্থা উত্তর দিলো, `অর্থনীতি, চতুর্থ বর্ষ।` আমি আস্থা’র উত্তর পেয়ে বললাম, `তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?` আস্থা উত্তর দিলো, `গাজীপুর।` আস্থা আবার আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, `স্যার, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?` আমি বললাম, `আমি অনেক দূরমুল্লুকের। রংপুর বাড়ি আমার।` আস্থা আমার উত্তর পেয়ে বললো, `হুম। অনেক দূর।` আমিও বললাম, `হুম।` আমি তখন আরেকটা সিগারেট ধরালাম আর আনমনা হয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। এমন সময় আবার আস্থা’র কাছ থেকে বার্তা আসলো। `কি করছেন স্যার? আপনার ফেসবুক ওয়ালে আপনার কেটে যাওয়া পায়ের ছবি দেখলাম - অনেকটা কেটে গেছে, না স্যার?` – আস্থা’র এমন প্রশ্নে আমি নিজেকে অনেকটা সুখী মনে করতে শুরু করলাম। আমাকে কেউ খোঁজ করছে, যত্ন করছে - এটা ভাবতেই আমার ভেতরে অন্যরকম এক ভালো লাগতে শুরু করেছিলো। আমি কোনো রকম দ্বিধা না করেই আমি উত্তর দিলাম, `পা কম কেটেছে। তবে হাতটা কেটেছে অনেক।` আমার নিকট থেকে এমন বার্তা পেয়ে আস্থা বললো, `হায়! হায়! খুব খারাপ খবর।` আমি আনমনেই বললাম, `হুম।`
আপনার গানটা বেশ ভালো ছিল– আস্থার এমন বার্তার প্রেক্ষিতে আমি বললাম, `কোন গানটা?` আস্থা বললো, `প্রেমে পড়া বারণ.....।` আমি বললাম, `হুম।` আমি ফেসবুক লাইভে একটা গান গেয়েছিলাম। আস্থা হয়তো সেই গান শুনেছিলো। আমি আস্থা’কে বলেছিলাম, `আজকের গানে আর তোমাকে পাঠানো কবিতার মাঝে বেশ ছাপ আছে?` আমি আস্থা’কে ম্যাসেজ পাঠায়, `আজকের কবিতাটি পড়ার পরে কি কবির প্রতি কোনো খারাপ ধারণা এসেছে?` আমার এমন প্রশ্ন পেয়ে আস্থা একটি হাসির স্টিকার পাঠিয়েছিলো আর আস্থা বলেছিলো, `না। কবি তো তার কল্পনায় লিখেছেন।` আমি আস্থার উত্তরে খুশি হলাম। আমি গতকাল একটি অতীত প্রেমের কবিতা লিখেছিলাম। যেটাকে হয়তো অনেকেই পরকীয়া প্রেমের কবিতা বলে ঘৃণার স্বর ছড়াতে পারে - তাই একটু দ্বিধাতে ছিলাম। এমনিতে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকজনই কবিদের চরিত্র নিয়ে গবেষণা করে বা আন্দাজে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, `কবিদের চরিত্রে একটু দোষ থাকে বা অনেকেই কবিদের লুইচ্চাও বলে থাকে।`
আস্থার উত্তর পেয়ে আমি একটু ফুরফুরে হলাম। আমি আবার আস্থা`কে লিখলাম, `যাক, তাহলে তোমার ভাবীর হাত থেকে মনে হয় বেঁচে গেলাম।` আমার এই কথা আস্থা জানার পরে আমাকে একটি হাসির স্টিকার পাঠিয়েছিলো। `ভাবীকে ভয় পান নাকি?` - আস্থা জানতে চেয়েছিলো। সাথে সাথে সে আবার আমাকে দাঁত বের করা স্টিকার পাঠিয়েছিলো। `ভয় পান না কে?` - আমি উত্তর দিলাম। আস্থা বললো, `সব ভাইয়া-ই ভাবীকে ভয় পায়।` আমি বললাম, `হুম। তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমাকে ভয় পায় না?` `আমার বয়ফ্রেন্ড নেই (সাথে দু:খের স্টিকার), থাকলে হয়তো পাইতো (সাথে আবার দু:খের স্টিকার) - আস্থার ঝটপট উত্তর। আস্থার এমন উত্তরে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার বিস্মিত হওয়ার কারনও ছিলো বেশ। অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া মেয়ে - তাও আবার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাও আবার অর্থনীতির মত একটা বিষয়ে; যে বিষয় হিমালয় পর্বত থেকে সুদূর আফ্রিকার হনুলুলু পর্যন্ত সকলের কাছে সমাদ্রিত - এমন বিষয়ে পড়েও আস্থা কোনো প্রেমে পড়েনি বা কেনো কোনো ছেলে ওর প্রেমে পড়ে লেপ্টে থাকতে চায় নি - এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আমি আস্থা`কে বলি, `তাহলে কি হাজবেন্ড আছে?` আস্থা উত্তর দেয়, `আমি অবিবাহিত।` আস্থা অবিবাহিত - এটা জানার পর আমি একটু ভয় যেমন পেয়েছিলাম, তেমনি সাহসও পাচ্ছিলাম তার সাথে কথার খেলা চালিয়ে যেতে। আমি বলি, `বলো কি? তুমি কিছু মনে না করলে একটা ফটো দিবে তোমার?` আস্থা বলে, `আমার ফটো?` আমি বলি, `হুম।` আস্থা আমাকে ওর সব থেকে সুন্দর ফটোটি পাঠিয়েছিলো। আস্থা’র ফটোটি পেয়ে আমি বলি, `তুমি যা বলছো, সব মিথ্যে বলছো। তুমি তো অনেক সুন্দরী!` আস্থা বলে, `সুন্দরী হলেই কি বয়ফ্রেন্ড বা হাজবেন্ড থাকে?` আমি বলি, `তা আমি জানি না। লোকে বলে আর কি!` `হুম।‘ আসলে হয়ে ওঠেনি` - আস্থা উত্তর দিয়েছিলো। আমি কিছুক্ষণ থমকে গিয়ে বললাম, `হুম। বুঝলাম।` আস্থাও আমার মত বললো, `হুম।` আস্থা আর আমার হুম হুম শ্বাস-প্রশ্বাস চালাচালি বেশ ভালোই লাগছিলো। আস্থার এমন দীর্ঘ প্রশ্বাসের উত্তর পেয়ে আমি আবার প্রশ্ন করলাম, `বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলে না?` আস্থা উত্তর দিলো, `নাহ! আগে প্রতিষ্ঠিত হই। বাবা-মা তা-ই চান। আর তাছাড়া বিশুদ্ধ প্রেম এখনো বেঁচে আছে বলে আপনার মনে হয়?` আস্থার সাথে আমার কথোপকথন ওখানেই শেষ হতে পারতো তবে `বিশুদ্ধ প্রেম আছে কি নেই` - এটা নিয়ে কথা না চালালে পাপ হতে পারতো বলে নিজের কাছে মনে হলো। আস্থা আমার কাছে এমনভাবে জানতে চেয়েছিলো মনে হয় প্রেম বিষয়ে তিন অক্ষরের ঘুচুমুচু পিএইচডি ডিগ্রিটা আমার দখলে ছিলো। যাই হোক, এরপর শুরু হলো আমাদের কথার ঝড়।
আমি: প্রেম কি বিশুদ্ধ হয়? এটা জৈবিক প্রয়োজন।
আস্থা: মানসিক টানের কথা বলছি।
আমি: বাবা কি করেন?
আস্থা: ব্যবসা।
আমি: প্রেম যত্নের বিষয়। যত্ন না থাকলে কিছুই টিকে থাকে না। ভেঙে পড়ে।
আস্থা: হুম।
আমি: জীবনে কতগুলো প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছো?
আস্থা: আমি হিসেব করিনি।
আমি: তুমি প্রেমের জন্যে প্রস্তুত ছিলে?
আস্থা: হুম। কিন্তু আমি যেমনটি চাই, তেমনটি পাই নি।
আমি: চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে কি সব সময় মিল থাকে?
আস্থা আমাকে তার লেখা একটা কবিতা পাঠিয়েছিলো। কবিতার নাম ছিলো প্রেমিক তোমার অপেক্ষায়। আস্থা বললো, `আমি এমনটি চাই।` আস্থা’র কবিতা পড়ে আমি উত্তর দিলাম, `বুঝেছি। তুমি ধর্মের মত হতে চেয়েছো; যেখানে কোনো দূষণ নেই, খালি শুদ্ধতা আর শুদ্ধতা। তুমি তোমার নিজের ইচ্ছা অন্যের মাধ্যমে পূরণ করে নিতে চাও।` আমার বার্তা পেয়ে আস্থা একটু সময় নিলো। এরপর আস্থা বললো, `কবিতার মাধ্যমে আমি আমার ভুলগুলোও তার কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি। মন্দ অর্থেই ভুল বলেছি।` আস্থা’র কথাতে আমি আটকে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে আটকে থাকলে চলছিলো না। আমি ফের বললাম, `ভালো। তবে তুমি কবিতাতে একটি বারও বলো নি যে তোমার ভেতর-বাহিরের মন্দটা জেনেও কেউ তোমার আবদার পূরণ করবে, কি করবে না। তুমি নিজেকে নির্বাক প্রতিবিম্ব হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছো। যেটা ধর্ম করে; কেউ করতে বাধ্য হয়ে যায়, সমাজ বাধ্য করে ফেলে।`
অনেক্ষণ আস্থার নিকট থেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না। আমার জানালায় তখনো বৃষ্টি হচ্ছিলো। আকাশে কোনো চাঁদ ছিলো না। আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিলো। আমি বেলকনীতে গেলাম। সেরাতে টবে লাগানো অলকানন্দাতে নতুন ফুল ফুটেছিলো। আমার দক্ষিন বেলকনীর মাধবীলতাও হেলে দুলে দোল খাচ্ছিলো। কামিনী ফুলের গন্ধে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আস্থা’র থেকে উত্তর পাওয়ার জন্য আমার ভেতরটা ছটফট করছিলো। আমি আরেকটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে একটান দিতে না দিতেই আস্থা আমাকে ম্যাসেজ দিলো। `আমি আমার ভুল আর অপরাগতাও তুলে ধরতে চেয়েছি` - আস্থা লিখেছিলো। আস্থার ম্যাসেজ পেয়ে আমার খুব সুখ সুখ লাগছিলো। আমার ভেতরটা বেলকনীতে ঝুলে থাকা মাধবীলতার মত দুলে দুলে যেতে চাচ্ছিলো। `কিন্তু তোমাকে যে ভালোবাসবে, সে যে ঘৃণা বা অভিমান করতে পারবে - সেটা বলো নি তো! শুধু তুমিই চেয়েছো` - আস্থার উত্তরে আমি পাঠালাম। আমি আরও বললাম, `বাদ দিই তোমার কবিতার কথা। এতে শিল্পবোধ আছে, আছে তোমার কল্পনা।` আমার কথা শুনে আস্থার কোমল হৃদয় যেনো ভেঙে না পড়ে এই জন্যে আবার আস্থা`কে বার্তা পাঠালাম। আমি লিখলাম, `আমি এতোগুলো কথা বলেছি শুধুই তোমার কথার প্রেক্ষিতে। কবিতার জন্যে নয়।` আমার বার্তা পেয়ে আস্থা বললো, `হুম। বুঝতে পেরেছি। আসলে পুরো কবিতা জুড়ে আমি আমার চাওয়ার কথা-ই বলেছি।` আস্থার বার্তার পরে আমাদের কথোপকথনকে আমি অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেললাম।
আমি বলি, `আমাকে দেখেছো (যদিও আমি জানতাম, সে আমাকে দেখেছে)?` আস্থা বলেছিলো, `হুম। দেখেছি।` আমি বলি, `কোথায়?` আস্থা বলেছিলো, `ক্লাশে, ক্যাম্পাসে, ঘুরতে ঘুরতে, চলতে চলতে।` আমি বললাম, `আমি ভালো না মন্দ?` আস্থা বলেছিলো, `ভালো মন্দ দেখে বিচার করা যায় না। তারপরেও আপনি শিক্ষক, সে হিসেবে আপনি অবশ্যই ভালো।` আস্থার নিকট থেকে প্রশংসা পেয়ে আমার বুকের বামপাশ আঁতকে উঠলো। আমি প্রায়ই ঘেমে ঘেমে যাচ্ছিলাম। `তুমি সারাদিনে কি কি করো?` - এই প্রশ্নতে আস্থা উত্তর দিলো, `কিছুই করছি না ইদানিং। অলসদিন পার করছি। লিখিও না, পড়িও না।` আস্থার এমন কথার প্রেক্ষিতে আমি বললাম, `আমি তো তোমার টাইমলাইনে তোমার ভালো ভালো কবিতা দেখি।` আমার বার্তা পেয়ে আস্থা বললো, `একটু আধটু লিখি। বেশি লিখি না। কিছু গল্প লিখবো। থিমগুলো মাথায় আছে। অলসতার জন্য লেখা হচ্ছে না।` আস্থা’র চটপট উত্তর পেয়েই আমি বুঝতে পারছিলাম যে সে আরও কথা বলতে চাচ্ছিলো। আর আমিও খুব করে চাচ্ছিলাম কথা চালিয়ে যেতে।
আমি আবার সিগারেট ধরালাম। বৃষ্টি একটু একটু করে থামছিলো, তবে বেশ গরম ছিলো। মাঝরাত শুরু হয়েছিলো, তবুও আমাদের কথা শেষ হচ্ছিলো না। এমন সময় আমি আস্থা`কে বার্তা পাঠালাম, `আচ্ছা। আমাদের এই কথোপকথন যদি একটা গল্পে রূপ নেয়।` আস্থা বলেছিলো, `যেমন?` আমি বললাম, `আমাদের এই কথোপকথন নিয়ে একটা গল্প লিখবো।` আস্থা বললো, `ভালো। আপনার গল্পের চরিত্র হতে পারলে খুব ভালো লাগবে। অগ্রিম ধন্যবাদ।` `কিন্তু আমি তো তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না` - আমি এটা বলতেই আস্থা বলেছিলো, `বলুন, কি জানতে চান?` আমি বললাম, `এইভাবে বললে সেটা হবে কাটখোট্টা গবেষণা, গল্প নয়।` আস্থা বললো, `প্রেম সম্পর্কে বলতে গেলে আমি খুব মানসিক টানে বিশ্বাস করি।` আমি বললাম, `আমি কিন্তু এটা জানতে চাই নি।` এরপর শুরু হলো আমাদের কথার ঝড়।
আস্থা: আমার জ্যোৎস্না রাত খুব ভালো লাগে। সবকিছুর চাইতে বেশি।
আমি: পেটে খাবার না থাকলেও? পরিবারের কেউ অসুস্থ থাকলেও? পুরো দেশে অশান্তির আগুন লাগলেও?
আস্থা: হ্যাঁ। উত্তরটা অযৌক্তিক হয়তো। আমি আবার বলি, `দেশে আগুন লাগলেও? যেমন লেগেছিলো সাতচল্লিশে, ঊনসত্তরে, একাত্তরে, নব্বইয়ে, দুইহাজার সাত সালে।` আস্থা বললো, `হ্যাঁ। চাঁদে তো আর আগুন লাগবে না। পুরো দেশে আগুন লাগলেও আমি চাঁদের মধ্যে ফাগুন খুঁজে নিবো।` `তুমি খুব সম্ভবত প্রেমে আছো, পড়তে যাচ্ছো বা প্রেমের সংকেত তোমার খুব সন্নিকটে` – আস্থা’র কথাতে আমি উত্তর দিলাম। `না সেরম সম্ভাবনা নেই। আমার মনের মত কাউকে আমি পাই না` – আস্থা’র এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বললাম, `প্রেম হয়তো মন দেখে হয় না, মন দেখে টিকে থাকে।` আমি আস্থা`কে আবার বললাম, `আমি কিভাবে বুঝলাম যে তুমি প্রেমে পড়তে যাচ্ছো - তা আমি হয়তো এখন বলবো না, পরে বলবো। কিছু মনে না করলে কি তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?` আমার এমন কথায় আস্থা রস ঢেলে বললো, `বলেন, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।`
আমি: তোমার ভাবী তো গ্রামে। তিয়ানা আর সিলভিয়াও গেছে। আরও কিছুদিন হয়তো ওরা থাকবে। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা কথা চালিয়ে যেতে পারি।
আস্থা: আচ্ছা। আপত্তি থাকবে কেন? আপনার গল্পের প্রয়োজনে কথা বলা যেতে-ই পারে। আর হয়তো কথা বলতে বলতে অনেক কিছু শেখা যেতে পারে। গুনীজনের সাথে কথা বললে চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। আপনার গল্পের প্রয়োজনে কথা বলা যেতে পারে।
আমি: আর গল্পের অপ্রয়োজনে?
আস্থা: আরও হয়তো কথা বলতে বলতে অনেক কিছু শেখা যাবে।
আমি: আমি কি তোমার থেকে কিছু শিখবো না?
আস্থা: আমি সাধারণ মেয়ে। আমার থেকে কি বা শেখার আছে!
আমি: মেয়ে কেনো বললে? আগে মানুষ বলতে?
আস্থা: মানুষ লিখতে চেয়েছিলাম। মেয়ে লেখার পরেও আমি এটা ভাবছি। আপনি বলে দিলেন।
আমি: যদি নিজেকে মেয়ে বলে ভাবো, তাহলে তোমার থেকে আমার শেখাটা হবে অল্প, আর যদি মানুষ ভাবো - বেশ কিছুটা শিখতে পারবো। তোমার চৈত্রের নদী আছে, সেখানে উত্থান পতন আসে। তুমি জেগে ওঠো, ডুবে যাও। প্রতিঘাতেই তুমি কিছু না কিছু শেখো। তোমার লোকালয়ে ঘুঘু ডাকে। আমি ঘুঘুর ডাক শুনি নি অনেকদিন। তোমার কথার ঘুঘুর ডাকে আমার মায়া জাগতে শুরু করেছে।
আস্থা: তবে জানেন আমায়, শিখেন আমায়। আমার লোকালয়ের ঘুঘু আর শালিকের ডাক কান পেতে শুনে নেন। যদি সে ডাক শুনে কোনো মন্ত্রের কবলে পড়েন, সে দায়ভার আমার না।
আমি: আমি জানি না। মন্ত্রে কি মানুষ বাঁধা পড়ে? না। মানুষ বাঁধা পড়ে প্রয়োজনে, সব প্রয়োজনে।
আস্থা: সবই কি প্রয়োজনে?
আমি আস্থার কথার উত্তর দিতে পারলাম না। আমি আবার সিগারেট ধরালাম। এইবার আলাপ অন্যদিকে ঘুরাতে লাগলাম।
আমি: আচ্ছা। আমরা যেভাবে কথোপকথন শুরু করেছিলাম, তা কি আগের পর্যায়ে আছে? ইতোমধ্যে আমাদের কথোপকথন একটা পর্যায়ে এসে পড়েছে। কি নাম দেওয়া যায় বলো তো?
আস্থা: চেনাজানা। ভেতরটা চিনছি। শিক্ষক ইমতিয়াজ থেকে ব্যক্তি ইমতিয়াজ`কে চিনছি।
আমি: আসলেই কি চিনলাম/জানলাম অথবা চিনছি/জানছি? আমরা কি কথার গভীরে হারাচ্ছি না? শব্দের অনেক তলে কি যাচ্ছি না?
আস্থা: যাচ্ছি। আপনিও শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন, আমিও। সুতরাং শব্দরা এখানে ডানা মেলবেই।
আমি: যদি আমি বলি যে আমি এখন সিগারেট টানছি - তোমার কেমন লাগবে?
আস্থা: বিশেষ কিছু লাগবে না। সিগারেট তো এমনিতেই টানেন আপনি।
আমি: জানতে?
আস্থা: এই যে বললেন সিগারেট টানছেন। তা থেকে আন্দাজ করলাম।
আমি: তুমি কি একটু সচেতন হতে শুরু করেছো?
আস্থা: আমি অবচেতনে ছিলাম?
এইভাবে আমাদের কথা চালাচালি হচ্ছিলো। আমাদের কথা শেষ হচ্ছিলো না। নতুন কথা আর পুরাতন ম্যাসেজ ঘেটে ঘেটে আবার তুলে নিয়ে আসছিলাম। এইভাবে কথার পর কথার রাশিতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। ফুলের রাত কাটাচ্ছিলাম আমরা।
আমি আস্থার একটা পুরাতন ম্যাসেজে উত্তর দিলাম, `কথার রাশিতে প্রেম থাকে, শব্দের গহীনে থাকে মায়া।` আস্থা উত্তর দিলো, `যে কবিতা ফাগুন ঝরাতে পারে অগ্নি জর্জরিত পৃথিবীতে, যারা শব্দের গহীনে খোঁজে মনের দর্পণ - তার প্রেম মায়ায় ভয় পায়।` আস্থার কথার কোনো উত্তর আমার প্রস্তুত ছিলো না। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সে যা বলতে চেয়েছিলো – সেই কথা। আমি বরাবরের মত অন্যদিকে কথা ঘুরিয়ে ফেললাম।
আমি: তোমার ডাক নাম কি?
আস্থা: আস্থা।
আমি: তুমি অবচেতনেই বললে। কারন এখন আমাদের যে পর্যায়ে কথোপকথন চলছে - এখানে না তুমি শিক্ষার্থী, না আমি শিক্ষক। তুমি আস্থা আর আমি ইমতিয়াজ। তাই নয় কি? তুমি আমাকে স্যার সম্বোধন করো নি। এখন তোমার মনে ইমতিয়াজ নামের কোনো শিক্ষক নেই। ইমতিয়াজ নামের একটি ছেলে/পুরুষ বা বেটা-ছেলে - যা কিছুই বলো না কেন, সে আছে। আর সেই মানুষটি তোমার সাথে খুব মন খুলে কথা বলছে। তাই নয় কি?
আস্থা: তাই?
আমি: তোমার কি মনে হয়?
আস্থা: যেমনটা আপনার মনে হয়। আপনার কথাতে তেমনটাই মনে হচ্ছে।
আমি: আমি কিন্তু সেখানেই আছি, যেখানে তোমার ইর্ষা ভাবী ছিলো/ফিরে এসে আবার থাকবে। তোমার ভাবীর সাথে কাটানো মিলনের গন্ধ মনে হয় এখনো লেগে আছে। আছে আমার চার বছর বয়সী তিয়ানা আর দুই বছর বয়সী সিলভিয়া`র ছুটে চলার অসংখ্য শব্দধ্বনি। তারপরেও এখন মনে হচ্ছে আস্থা নামের মেয়েটি এখন আমার খুব কাছের। এই বৃষ্টিভেজা রাতে তার খুব কাছে বসে আমি গল্প করছি। উজাড় করছি তার ভেতরের কথা, আর নিংড়িয়ে দিচ্ছি আমার ভেতরের সবটা।
আস্থা: বৃষ্টি হচ্ছে এখনো?
আমি: হুম। আমার জানালার খুব পাশে বৃষ্টি হচ্ছে।
আস্থা: বৃষ্টিভেজা রাত খুব সুন্দর! না? আমার ভীষণ ভাল্লাগে।
আমি: এতোদিনে মনে হয়নি খুব বেশি। তবে হয়তো আজ একটু বেশি ভালো লাগছে। তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?
আস্থা: পাচ্ছে না।
আমি: গতরাতে পেয়েছিলো?
আস্থা: গতরাতে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়েছিলাম। জার্নি করেছিলাম তো।
আমি: আজ কেনো ঘুম পাচ্ছে না?
আস্থা: জানি না তো। আমার ঘুম আপনার জানালার কাচে বৃষ্টিফোঁটার সাথে লেপ্টে যাচ্ছে।
আমি: বিশেষ কোনো কারন?
আস্থা: সেরম কিছুই না।
আমি আস্থা`কে একটু অন্যভাবে ঝালিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। ওর ভেতরে বিশেষ কিছু ভর করেছিলো কিনা – তা জানতে চাচ্ছিলাম। পরে আমি আবার আমাদের কথোপকথন অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করলাম।
আমি: আচ্ছা তাসরিন মৌলি কি তোমাদের ব্যাচের?
আস্থা: হ্যাঁ।
আমি: মেয়েটি অনেক সুন্দরী! খুব দরদ দিয়ে গান গায়তে পারে।
আস্থা: কথা হয় ওর সাথে? গান শুনিয়েছে কি?
আমি: না।
আস্থা: ওকে বললে ও আপনাকে গান শুনাবে। গান শুনুন। মন ভালো হয়ে যাবে। বৃষ্টির সাথে গানের সুর মিশে সিক্ত হবে আপনার মন।
আমি: কেনো শোনাবে? আমি কি ওর বিশেষ কেউ হই যে এই রাতে ও আমাকে গান শোনাবে?
আস্থা: আপনি বললে ও এমনিতেই গান শুনাবে। ও ফেসবুকে একটিভ আছে। ওকে বললেই শুনাবে।
আমি: একটিভ থাকলেই শুনাবে! আমি তো ওর বিশেষ কেউ নই।
আস্থা: থাক বাদ দিই এসব কথা। বিশেষ কেউ হতে বিশেষ কিছু সময়ই যতেষ্ট নয় কি? এই যে কিছুক্ষণের ইমতিয়াজ স্যার থেকে ব্যক্তি ইমতিয়াজ হলেন।
আমি: আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম। তাসরিন মৌলি তোমাদের ব্যাচের কিনা? কিন্তু তুমি অনেকগুলো ফিরতি প্রশ্ন করলে। তার মানে কি এই নয় যে তুমি আমাদের আলাপের মাঝে তাসরিন`কে চাচ্ছো না?
আস্থা: আমি জানি না কিছু।
আমি: জানতে মনে হচ্ছে না?
আস্থা: সেটাও জানি না।
আমি: তাহলে কি তোমার মাথায় বিশেষ কিছু ভর করছে?
আস্থা: সেটাও জানি না। এই মুহুর্তে মাথা কিছু বলছে না আমায়।
আমি আস্থা’র মনের অবস্থা বুঝতে চাচ্ছিলাম। অন্য আরেকটা মেয়ের কথা বললে সে ইর্ষাবোধ করে কিনা – তা জানতে চাচ্ছিলাম। তাসরিন`কে আমাদের আলাপের মধ্যে নিয়ে আসতেই আস্থা নীরব অনুরাগ দেখাতে থাকে। ‘আপনি ওর গান শুনুন। যান…..’ – এই বলে আস্থা খোঁচা দিতে থাকে। আমি বললাম, ‘আমি তো আগে ওর সাথে কথা বলিনি।‘ আস্থা বললো, ‘এখন বলুন।‘ আমি বললাম, ‘সেটা কি সম্ভব?’ আমি তো ওর কাছে ব্যক্তি ইমতিয়াজ নই, শিক্ষক ইমতিয়াজ।‘ আস্থা আমাকে বাঁকামুখের স্টিকার পাঠালো। আমি বললাম, ‘আমি বাঁকামুখের মানে বুঝিনা। মানে বুঝিয়ে দাও।‘ আস্থা এই প্রসঙ্গে আলাপ করতে আর আগ্রহ পাচ্ছিলো না। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে লাগলো। আমি আবার একটি সিগারেট ধরালাম। এরপর আবার আমাদের কথোপকথন শুরু হলো।
আস্থা: বৃষ্টি থেমেছে?
আমি: না।
আস্থা: ঘুমাবেন কখন?
আমি: জানি না। তোমার ঘুম পাচ্ছে?
আস্থা: না।
আমি: তুমি কি জানো যে আমি আমার কেটে যাওয়া আঙুল দিয়েই ফোন বাটন স্পর্শ করছি? একটু একটু ব্যথা করছে। তবুও আমার ভালো লাগছে।
আস্থা: একটা ছবি দিবেন ক্ষতের?
আমি: পাঠিয়েছি। সময় লাগবে। তুমি কি একা ঘুমাও?
আস্থা: আচ্ছা। হুম।
এরপর বেশ কয়েক মিনিট আমি আস্থা`র থেকে উত্তর পেলাম না। আমি ছটফট করতে থাকি। চুল ছিঁড়লাম, দাড়ি চুলকাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো যে আমি হয়তো অনেক অনেক বছর ধরে একটি বার্তার জন্যে ফোনের সামনে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমি আস্থা’কে বার্তা দিলাম।
আমি: তুমি কি আছো?
আস্থা: খুঁজে দেখেন।
আমি: পাচ্ছি তো। গান শুনবে?
আস্থা`কে গান শোনানোর প্রস্তাব দিতেই কেমন জানি কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে আমার বুকের ভেতর। আমি আস্থা`র নিকট আবার জানতে চেয়েছিলাম, ‘তুমি কি একা ঘুমাও?’ আস্থা বললো, ‘হুম।‘
আমি: ভিডিও কলের পরিবেশ আছে?
আস্থা: না।
আমি: তাহলে অডিওতে যাবো?
আস্থা: আসেন। যদিও নেটে সমস্যা।
আমি: আমি তো আছিই। তুমি একটু প্রবেশ করো। তোমার নামের ডানপাশে একটু আঙুল ছোঁয়াও।
আস্থা আমাকে অডিও কল দিলো। আমি রিসিভ করলাম। আমি ওর কণ্ঠ শুনলাম। খুব মিষ্টি একটা কণ্ঠ নিয়ে সে ‘হ্যালো’ বলেছিলো। আস্থা`র সাথে এটাই ছিলো আমার প্রথম কথা। এর আগে আমরা ম্যাসেজ চালাচালি করে মনের কথা বলাবলি করেছিলাম। আমি যখন আস্থা`কে শুনছিলাম, তখন মনে হচ্ছিলো যে আস্থা আমার খুব কাছে ছিলো, আমিও আস্থা`র খুব কাছে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো সেরাতে আমরা ফুলের মত একে অপররের কথাতে জড়িয়ে ছিলাম।
আমি গান গাইতে শুরু করলাম, যদিও আমার কণ্ঠ খুব ভালো ছিলো না। আমি মোটামুটি গাইতে পারি, কোনো রকম সুর আনতে পারি। ‘আমি তোমাকেই বলে দেবো……..’ – আমি এই গানটি পুরোই গেয়েছিলাম। আমি যখন আস্থা`কে গান শুনাচ্ছিলাম, তখন আমি আস্থা`র নি:শ্বাস শুনতে পাচ্ছিলাম। গান শেষ হলেই আমরা আবার ম্যাসেঞ্জারে আলাপন শুরু করেছিলাম।
তখন রাত বেজেছিলো বারোটা চুয়ান্নোর মিনিটের মত। আর আমরা আলাপন শুরু করেছিলাম মনে হয় রাত সাড়ে এগারোটাতে। রাত যত বাড়ছিলো, আমাদের দু`জনের চোখ থেকে ঘুম ততোই পালাচ্ছিলো। আমাদের চোখে ঘুম ছিলো না, আমাদের ঘুম আসছিলো না। আমরা রাতের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, বৃষ্টিতে আর কথার ফুলে ডুবেছিলাম। এরপর আবার আমাদের কথোপকথন শুরু হয়েছিলো।
আস্থা: অসাধারণ আমি কি বলবো – ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এতোটা বেশি ভালো লাগছে আমার।
আমি: আমি দু:খিত যে তোমার কম্পন কণ্ঠ স্বর শুনে ফেলেছি, তোমার নি:শ্বাসের শব্দ শুনে ফেলেছি।
আস্থা: ভুল কিছু হয়নি তো। আপনার গানের সুরের তালে তালে আমার হৃদস্পন্দনের নৃত্য অনুভব করেছেন। আমি ধন্যবাদ দিবো না, ধন্য হবো।
আমি: সামান্য একটা গানকে তুমি এভাবে দেখছো কেনো? আমি বাসায় গান গাইলে তো তোমার ভাবী মাঝে মাঝে কুকুর শেয়াল বলে বাসা থেকে বের করে দেয়।
আস্থা: মিথ্যা বলছেন। ভুল কাজ করেছেন। এই সুর তাচ্ছিল্য করার মত নয়।
আমি: একজনের সব সুর কি আরেক জন নিয়ে শেষ করতে পারে?
আস্থা: তা হয়তো পারবে না। সুর সবার জন্য। আপনি আমার ম্যাসেঞ্জারে ‘এড ডে’ তে দেখেন। আমি দিয়ে দিয়েছি। আমি কান্নার রঙ, আমি জোছোনার ছায়া।
আমি: এটা চিরস্থায়ী নয়।
আস্থা: কোনো কিছুই কি চিরস্থায়ী?
আমি: হুম। না। তুমি কি আজকের রাতটিকে দীর্ঘায়িত করতে পারবে?
আস্থা: দীর্ঘ হচ্ছে তো।
আমি: আর একটা গান শুনবে?
আস্থা: হুম। শুনবো।
আমি: তাহলে আগের মত হোক।
আস্থা: এবার একটু অন্যরকম হোক।
আমি আস্থার ম্যাসেঞ্জারে আবার অডিও কল দিলাম। আস্থা এক দুই সেকেন্ড রিং বাজতেই রিসিভ করলো। ‘একদিন স্বপ্নের দিন, বেদনার বর্ণবিহীন…’ – আমি এই গানটি গাইতে থাকলাম। আস্থা শুনতে লাগলো। গান শেষ হলো।
আস্থা: মুখে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছি না।
আমি: আমি আবারও তোমার নি:শ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়েছি।
আস্থা: আমার নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছিলো, গান যতক্ষণ কানে বাজছিলো।
আমি: কেনো? এর আগে গান শোনো নি?
আস্থা: শুনেছি। এই মধ্যরাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে কানের এতো কাছে কখনো গান শুনিনি। নতুন একটা ইচ্ছে সংযুক্ত হলো ইচ্ছে ঝুলিতে।
আমি: গান না প্রেম?
আস্থা: আমি বলবো না।
আমি: বলতে দ্বিধা কেনো? আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। হয়তো তুমিও।
আস্থা: আমি খুব লোভী!
আমি: অন্যের কোনো কিছু ছিনিয়ে নিতে চাও?
আস্থা: না। সেটা অন্যায়। আমার এই মুহূর্তে লোভ হচ্ছে, আমি যদি সারাজীবন মধ্যরাতে কানের কাছে এমন একটা সুর ধরে রাখতে পারতাম।
আমি: অন্যের কোনো কিছু ছিনিয়ে নিতে চাও?
আস্থা: না। সেটা অন্যায়।
আমি: তুমি যদি চাও আর যদি কেউ দিতে চায় – এখানে তো আপত্তি থাকার কথা না। সমাজের কথা ভাবছো?
আস্থা: জানি না। আমি কি আরও গান শুনতে পারি?
আমি: সব শুনে কি তাহলে আমাকে রাতের ঘুমে মুছে ফেলবে?
আস্থা: না।
আমি: সারাজীবন মনে রাখার মতই বা কি আছে?
আস্থা: এই সুর কে না চাইবে? বাজুক।
আমি আবার গান গাইতে শুরু করলাম। গান শেষ হলে আমি লাইন কেটে দিলাম। আবার আলাপ ছোড়াছুঁড়ি করতে লাগলাম।
আস্থা: এতো অসহ্য সুখ আপনার সুরে! আমি কোনোদিন এতোটা মন্ত্র মুগ্ধ হইনি। কোনো শিল্পীর গানেও না।
আমি: তাতে কি! তোমার হৃদয়ে তো লাগছে না?
আস্থা: কে বলেছে লাগেনি?
আমি: এখন কি আমরা আর ছাত্র শিক্ষক আছি?
আস্থা: আপনি শিল্পী।
আমি: আর তুমি?
আস্থা: আমি আপনার সুরের প্রেমী।
আমি: তাহলে তুমি আমার সুরের প্রেয়সী?
আস্থা: হ্যাঁ।
আমি: এইরাত কতদিন বেঁচে থাকবে তোমার মনে?
আস্থা: আমার মনে যে দাগ কেটেছে- তা কোনোদিন মুছবে না। কিন্তু ভাবী তিয়ানা আর সিলভিয়া আসলে তো আপনার সুর আমি আর শুনতে পারবো না!
আমি: যদি বাজে।
আস্থা: তাহলে অন্যায় হবে। এই সুরের দখলদার তো আছেই।
আমি: অন্যায় হবে কেনো? সে তো আমার সুরের যত্ন করে না। আমি হয়তো এই সুর তোমার মত কারোর জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।
আস্থা: আমি এই সুর নিত্য পূজা করতাম।
আমি: সেটা তুমি এখনো করতে পারো। চার দেওয়ালে সুরের পূজা চলে না। গতরের খেলা চলে, ঘাম ঝরে, ঘেমে যায়, হিমআগুন খসে যাওয়ার পরে থালাবাসনের ঝনঝনানি শুরু হয়ে যায়। এইভাবে নিত্যদিন সুর মরে যেতে থাকে।
আস্থা: আমি না হয় দূর থেকেই সেই সুরের পূজা করবো।
আমি: কাছে এসে ছুঁয়ে দেখবে না?
আস্থা: আমি দূর থেকে আবগাহন করেছি সুরলহরীতে।
আমি: যদি সে তোমাকে চায়; অমিত যেমন চেয়েছিলো লাবণ্য`কে। তোমার ভাবী না হয় কেতকী`র মতো ঘটের জল হয়েই থাকুক। তুমি দিঘীর জল হয়ে থেকো; আমি আমার ইচ্ছেমত তোমার লাভার জলরাশিতে ডুবে থাকবো, তোমার কানের লতির বিদ্যুতে পুড়ে যাবো, তোমার গ্রীবায় ঔষ্ঠ্যে আর বক্ষে কাচের জানালার বৃষ্টিফোঁটার মত লেগে থাকবো।
আস্থা: সব সময় প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয় না।
আমি: যেটা তোমার নিজের হাতে – সেটা ভাগ্য বিধাতার হাতে ছাড়ছো কেনো?
আস্থা: অস্পৃশ্য কিছু প্রাপ্তি হয়তো থাকে, যা অবর্ণনীয়, অঢেল আনন্দদায়ক। অথচ আগুনে ভরা। পুড়ে যাবার ভয়!
আমি: আর তোমার ভেতরে যে আগুন, তাতে তুমি পুড়বে না?
আস্থা: উত্তর নেই। আমি তোমার কান্নার রঙ, জোছোনার ছায়া। গানটি আমি কোনোদিন মনোযোগ দিয়ে শুনি নি। আজ এতো বেশি ভালো লেগেছে।
আমি: আমি যে পেতে চাই – স্পর্শে, আঙুলে ছুঁয়ে দেখতে চাই।
আস্থা: আপনি এতো প্রেম আর সুর নিয়ে যেকারোর কাছে গেলে, কোনো পাষাণীও ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
আমি: তুমি তো ফিরিয়ে দিতে পারছো?
আস্থা: দেই নি তো। আপনি শিক্ষক না হয়ে সুরের ভূবনে গেলেও পারতেন।
আমি: আর যদি প্রেম করতাম?
আস্থা: আপনি শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হতেন। প্রথম গানটি আবার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি: আজ রাতই কি সব শেষ?
আস্থা: না।
আমি: রেকর্ড করো নি?
আস্থা: না। আমি এইভাবে রেকর্ড করতে পারি না
আমি: পারলে করতে?
আস্থা: নাহ!
আমি: কেনো?
আস্থা: ইচ্ছে হলে আপনাকে বলবো শোনাতে।
রাত প্রায় ভোর হয়ে আসছিলো তবুও আমাদের ফুলের রাত শেষ হচ্ছিলো না, আমাদের কথা শেষ হচ্ছিলো না। সারারাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো লোকালয়ের বাঁশবাগানের শালিকগুলো কিচিরমিচির গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। রাতভর সুবাস ছড়ানো কামিনী আর গন্ধরাজ ফুলগুলো ডগা থেকে লেতিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, মসজিদের মুয়াজ্জিন রাতের ঘুম শেষে ফযরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, শহর নগর আর লোকালয়ের ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষগুলো হাঁটার প্রস্তুত হচ্ছিলো, কৃষক তার পালের গোরু গুলোকে গোয়ালঘর থেকে অদূরে গাছতলাতে বাঁধতে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলো, বনের ঘুঘু পাখিও আড়মোড়া ছাড়ছিলো, শহরের বড় বড় রাস্তায় দূরপাল্লা থেকে ছেড়ে আসা বাস-ট্রাকের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো, গ্রাম বাংলার হাঁস মুরগী কুকুর বিড়াল ছাগল ভেড়া বনবনানী সবুজ তরুরাজি সবকিছু জেগে উঠছিলো - তবুও আমাদের ঘুমোতে যাবার কথা মনে হচ্ছিলো না। আস্থা`র কথাতে আমি ডুবে যাচ্ছিলাম আমি। আর আমার সুরে ডুবছিলো আস্থা। আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিলো না, ফোনের ব্যালেন্স শেষ হচ্ছিলো না।
আস্থা: গান শুনান আমাকে। গান শুনান।
আমি: সব সুর কি আজকেই শেষ করতে হবে নাকি?
আমি আস্থা`কে আবার ফোন করলাম। আস্থা আমার গান শুনছিলো। আস্থা যখন আমার গান শুনছিলো, তখন আস্থা`কে আমার পোষা বেড়ালের মতো মনে হচ্ছিলো। আমি খালি আস্থা`র নি:শ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আস্থা আমার থেকে ততোটা আদর নিচ্ছিলো, যতোটা দরদ আমি আমার সুরে দিচ্ছিলাম। আস্থা’কে আমার এতোটাই সংবেদনশীল মনে হচ্ছিলো, যতোটা নরম হয়ে গানের কথাগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছলো। আস্থা`কে আমার খুব আপন মনে হচ্ছিলো। হয়তো আমাকেও আস্থা`র।
ভোর পাঁচটা যখন বাজলো, তখন আমাদের কথোপকথন শেষ হলো। আমাদের ফুলের রাত শেষ হলো। আমরা একে অপরকে `শুভ সকাল` বলে বিদায় নিলাম। এরপর আমি শাওয়ারের নিচেই গেলাম। পানি ছেড়ে আয়নায় নিজেকে নতুনভাবে দেখতে লাগলাম; আমার চোখ, মুখ, আঙুল আর আমার নাভীমন্ডল - সব, সবকিছু। আমার মাথার লম্বা চুলগুলো হালকা টানতে থাকলাম। সাওয়ারের ঠান্ডা পানি যখন আমার সারা শরীরে পড়ছিলো, মনে হচ্ছিলো আস্থা আমার উপর খসে খসে পড়ছিলো; ওর কাজল চোখের জল, ওর নাক কানের লতি ভেজাচুল থুতনি আর চিবুক - সবকিছু থেকে জ্যোৎস্না গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো। আমি পুরো আধঘন্টা ধরে শাওয়ারের নিচেই ছিলাম। আমি ঠান্ডা হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম, তবুও আমার ভেতরের হিম আগুন শীতল হচ্ছিলো না। আস্থা`র ও হয়তো এমন হচ্ছিলো।
আমি গোসল শেষ করলাম। আমি গা মুছে বিছানায় যেতে না যেতেই আস্থা`র ফোন। আস্থা আমার ভেজা চুলের ছবি দেখতে চেয়েছিলো। আমি ছবি পাঠালাম। আমিও আস্থা`র নিকট থেকে ভেজাচুলের ছবি পেলাম। এরপর আমি ঘুমিয়ে গেলাম। হয়তো আস্থাও।
পর সকাল দশটাতে আমার ঘুম ভেঙেছিলো। আমি হাত মুখ ধুয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে ফোন নিয়ে বসলাম। ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। ভাবলাম আস্থা`কে ফোন করবো। আস্থা আমাকে তার দু`টো ফোন নম্বরই দিয়েছিলো। আমি আস্থা`কে ফোন দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু দিলাম না। ভাবলাম ফোনটা আস্থা`র নিকট থেকেই আসুক।
আস্থা আমাকে ফোন দিলো। আমি একটু পুলোকিত হলাম। `রাতের কথা মনে রেখেছেন?` - আস্থা জানতে চেয়েছিলো। আমি উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। `মনে না রাখলে কি ফোন ধরতাম` - আস্থা`কে উত্তর দিলাম। আস্থা বললো, `গতরাতের ক্ষত মনে হয় শুকিয়ে গেছে। রাতের কথার সাথে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছেন মনে হয়` - আস্থা`র এমন কথাতে আমি ভাবতে থাকি, `আস্থা কি আমাকে অনুমান করতে শুরু করছে নাকি?` আমি আমার স্ত্রী ইর্ষা`র কথা ভাবছিলাম, ভাবছিলাম আমাদের কন্যাদ্বয় তিয়ানা আর সিলভিয়া`র কথাও। আমি ঘেমে ঘেমে যাচ্ছিলাম। বেশি কথা না বলেই ফোন রেখেদিলাম।
এরপর প্রায় পনেরো রাত আমার আর আস্থা`র কথোপকথন হয়েছিলো। আমি খুব দ্বিধায় ছিলাম এই ভেবে যে `ইর্ষা জানলে কি হবে` - এই ভেবে। আমি আর আস্থা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। বেরিয়ে আসার উপায়ও ছিলো না। আস্থা তার পিরিয়ডের কথা পর্যন্ত আমাকে বলেছিলো। ইর্ষার প্রতি আমার মায়া লাগতে শুরু করছিলো। হয়তো সে কোনো অপরাধী না - তারপরেও আমি তাকে লুকিয়ে আস্থা`র প্রেমে পড়েছিলাম। `ইর্ষা আসলে কি হবে? ও জানলে কি ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে? সমাজ জানলে কি হবে? কাটমোল্লারা জানলে কি হবে?` - এইসব ভাবতে ভাবতে আমি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলাম।
এরপর কোনো একদিন আমি আর আস্থা একসাথে রাত কাটিয়ে ছিলাম। সেটা ছিলো ফুলের রাত, তুষার খসে খসে পড়ার রাত। বনের ভেতরের এক রেস্ট হাউজে গিয়ে উঠেছিলাম দু`জন। একসাথে রাত কাটিয়ে যা হওয়ার - তাই হয়েছিলো। আস্থা আমাকে জাগিয়ে তুলছিলো, আমি ওকে ভেঙে চলছিলাম। সেরাতে বেশ ক`য়েক বার আমরা পুলোকিত হয়েছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একে অপরকে জড়িয়ে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন বনের পাখি গাছপালা তরুলতা দুর্ভাঘাস আর ভোরের সূর্য - সবকিছুই মনে হচ্ছিলো আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করছিলো আর `লুইচ্চা বা পরনারী আসক্ত বলে গালি দিচ্ছিলো`। মনে হচ্ছিলো তিয়ানা বলছিলো, `বাবা খারাপ মানুষ`, সিলভিয়া বলছিলো, `বাবা খালাপ (খারাপ) লোক`, ইর্ষা বলছিলো, `তুমি লম্পট, লুইচ্চা।` শুধু আস্থা ছাড়া এই পৃথিবীর সবার কাছেই মনে হচ্ছিলো আমি খারাপ মানুষ।
আমার স্ত্রী ইর্ষা গ্রাম থেকে ফিরে এসেছিলো। সে আমাকে খুব ভালোবাসতে শুরু করছিলো, যেমনটি বাসতো আগে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো আস্থা`র কাছে।
আমি একদিন ভাবতে থাকি, `আমি ইর্ষার সাথে চার দেওয়ালের আগুনে জ্বলবো না নাকি আস্থা`র প্রশান্তিতে দেশান্তরী হবো?` চার দেওয়াল আর পুরাতন প্রথার সুখ আঁকড়িয়ে কেনোইবা পড়ে থাকবো? আস্থা`কে আমার মন টানে। আমি আস্থা`র সাথে থাকতে চাই।
আস্থা ছিলো অনেকটা স্বাধীনচেতা নারী। আমি ওর ভেতরে প্রত্যয় দেখেছিলাম। আর ইর্ষা? সে আপাদমস্তক নির্ভরশীল নারী; সে আমার উপর নির্ভরশীল, তার পিতৃকূলের কাছে নির্ভরশীল, সমাজের প্রথার নিকট নির্ভরশীল। আমি মাঝে মাঝে দ্বিধানিত্ব হয়ে যায় - ইর্ষা`র ভেতরে সত্তাতে কেনো আমি এতো বেশি, কেনো তার পিতৃকূল এতো বেশি, কেনো সমাজের রীতি আর প্রথা এতো বেশি? আমি ইর্ষা`র সাথে কাটানো অর্ধযুগের সংসার জীবনে ইর্ষা’র নিজের অস্ত্বিত্ত পাই নি। যাইহোক, আমার এসব ভাবনার একমাসের মধ্যে আমার একটা স্কলারশিপ অফার আসলো। আমি শিক্ষাছুটি নিয়ে নিলাম। আমি নেদারল্যান্ডে চলে আসলাম তিন অক্ষরে হনুলুলু এই পিএইডি ডিগ্রি করতে। ইর্ষা`কে আমি নিয়ে আসি নি। আস্থা`কেও না। আর আস্থা`কে আমার সাথে নিয়ে আসার আইনগত বৈধতাও ছিলো না, যা ছিলো ইর্ষা`র প্রতি। আস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলো। আমি তার ইচ্ছাতে হস্তক্ষেপ করি নি। ইর্ষার সাথে মাঝে মাঝেই কথা বলি। আমার বড় মেয়ে তিয়ানা`র সাথে কথা বলি। কথা বলি সিলভিয়া`র সাথেও। আস্থা`র সাথেও আমার কথা হয়। আমার আর আস্থা`র শেষ পরিণতি কি হবে - তা জানি না। ইর্ষা কি সব মেনে নিবে? নাকি ইর্ষাও হারিয়ে যাবে? একদিন হয়তো কঠিন সত্যের সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে। আস্থা`র সাথে আমার শাশ্বত প্রেমের সম্পর্ক নয়; প্রয়োজনে একে অপরের কাছে এসেছিলাম। আর ইর্ষা`র সাথে? সেটা ছিলো কাগজে আর চার দেওয়ালে বাঁধা প্রাণহীন সম্পর্ক। হয়তো একদিন সবকিছুই ভেঙে পড়বে, ভেঙে যাবে – শাশ্বত হয়ে কোনো কিছুই টিকে থাকবে না। এমনকি আস্থা আর আমার প্রেমও সেরাতের মত ফুল ঝরিয়ে টিকে থাকবে না। টিকে থাকবে না ইর্ষা`কে ‘কবুল কবুল কবুল` বলে ইহকালে একসাথে থাকার শপথ। যাক সেসব কথা। এখন আমার মনে হয় তিনাক্ষরের এই হনুলুলু পিএইচডি`কে আঁকড়ে ধরা উচিত।
গল্পকার: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ