আশ্রয়

পর্ব ৩

সুলতানা পারভীন

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০১৯

 
বাইরে কি হচ্ছে সেটা দেখতে যাব কিনা ভাবছি। এমন সময় দরজার বাইরে মহুয়ার গলা শুনলাম।
-বাবা, তাড়াতাড়ি এসো। 
 
কি হচ্ছে দেখতে রুমের বাইরে বের হলাম। সত্যিই ভিষণ অবাক হলাম। বিশটা বছর পর আজ আবার মায়ের মুখটা দেখতে পেলাম। মা বলে জড়িয়ে ধরলাম। যতই রাগ করে ঘর ছেড়ে আসি না কেন চোখের জলেরা বাঁধা মানল না। আমি আর মা-দুজনেই কেঁদে সাগর না হলেও ছোটখাটো একটা পুকুর বানিয়ে ফেলতে পারতাম।তবে সেটা আর হয়ে উঠল না।
 
ছোট বোনও আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল।নন্দিতা-আমার থেকে কম করেও হলেও দশ বছরের ছোট।আমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম তখন ও বড় জোর ১৩-১৪ বছরের কিশোরী।তাই এতোদিন পরে নন্দিতাকে চিনতেই দু মিনিট লাগল।এর শাস্তিস্বরূপ ও অবশ্য আমাকে শুকনো হাতজোড়া দিয়ে ধুমধাম দু-তিন ঘা লাগিয়ে দিল না। ওর শুকনো হাতগুলোতে পুরু পুরু একটা ভাব এসেছে।চেহারাতেও একটা গিন্নি গিন্নি ভাব এসেছে।
 
আমি মা আর নন্দিতাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছি-তার চেয়ে কম করে হলেও হাজার গুণ বেশি অবাক হয়েছি দুটো বাচ্চার নন্দিতার পিছন থেকে উকিঁ মারা দেখে। নন্দিতা ঠেলেঠুলে বাচ্চা দুটিকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ দুজনের। ১০-১১ বছরের বড় একটা ছেলে-৮-৯ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। মেয়েটা আমার হাতে ঝাড়া দিতে লাগল।
 
-তুমি আমাদের মামা হও?
 
আমি দুই ভাগিনা ভাগনিকে নিয়ে মেতে আছি এমন সময় মোহনাকেও নিয়ে এল মহুয়া। বাচ্চা দুটিও মামি মামি করতে করতে মোহনার দিকে ছুটল। বাঁধন এতোক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে! এতোক্ষণে বসার ঘরে আসতেই মা বাঁধনে জড়িয়ে ধরে আাবার বিলাপ করলেন অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ গায়ে মাথায় হাত বুলালেন।কিছুক্ষণ পাশে বসিয়ে রাখলেন-পাশ থেকে বেচারাকে কোথাও নড়তেই দিলেন না।
 
বারবার একটা কথাই আওড়ালেন:- তুই কতো বড় হয়ে গেছিস ভাই!
 
এতোক্ষণে মহুয়ার দিকে আমার নজর গেল। মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে মা আর বাঁধনকে দেখছিল। আমার দিকে চোখ পড়তে মিষ্টি করে একটু হাসল। তবুও আমি তো বাবা-সেই হাসির পিছনে মহুয়ার চোখের ছলছলানি আমার ঠিকই চোখে পড়ল।
 
মেয়েকে তাই কাছে ডাকলাম।
 
-মহুমা। ভাই-বোনের সাথে কথা হয়েছে?
-হ্যাঁ বাবা। তুমি তো নামও জানো না। ফুপ্পির সাথে তো কথা হয়েছে। রবিন আর মিমের সাথেও কথা হয়েছে। তাই না বাচ্চা পার্টি?
 
এবারে রবিন আর মিম মোহনাকে ছেড়ে মহুয়াকে নিয়ে পড়ল।
 
-মহু আপ্পি? 
 
কতো সহজে মহুয়াটা বাচ্চাগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। মা বোধ হয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন।তাই বাঁধনকে নিয়ে যেন আরো বেশি করেই আহ্লাদ করতে লাগলেন।।
 
আমি গিয়ে মোহনার পাশে বসলাম। এই বয়সে একটা দিনের জন্য এতোটা ধকল যথেষ্ট। আর ধকল শরীর নিতে পারবে না। মোহনার তাকাতে খেয়াল করলাম মোহনা মহুয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
 
-মহুকে এভাবে কি দেখছ?
-আমাদের মেয়েটা কতো বড় হয়ে গেছে-তাই না আকাশ?
-তা বড় তো হবেই।
-অনেক বড় হয়ে গেছে।
-ওই? এতো তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি না আমি। মহু পড়ালেখা শেষ করবে। তারপর না হয়।
-আকাশ আমি সে কথা বলছি না। মেয়েটাকে দেখো-আমাদের বাড়িতে সবাই যখন মহুয়ার বদলে বাঁধনকে আদর করত-মহুয়া কতো কাঁদত। মা যখন বলত-আমরা মহুয়াকে কুড়িয়ে পেয়েছি আমার না হয় তোমার কোলে মুখ লুকিয়ে সারারাত ফোঁপাতো। 
অথচ আজ দেখো মেয়েটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে। একেবারে চুপচাপ।
 
আমি মোহনাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। সেটা আর বলা হল না মায়ের একটা কথায়।
 
-আমি তোদের নিতে এসেছি। তোরা আজই আমার সাথে যাবি।
-মা। তা হয় না। মহুয়ার ভার্সিটি এখান থেকেই যেতে হবে। আর বাঁধনও সামনে ভর্তি হবে ভার্সিটিতে।
-মহুয়া হোস্টেলে থেকে পড়বে। এ আর এমন কি!
-তা হয় না মা।
-তার মানে। বিশ বছর আগে যার জন্য ঘর ছেড়েছিস--আজ বিশ বছর পরেও তুই তার জন্যই ঘরে ফিরবি না?
-মা? কি সব বলো না তুমি!
-থাক যাস না। নন্দিতার তো একটা ছেলে একটা মেয়ে।
-মা ,মহুয়া আর বাঁধন ও তো।
-ভেবেছিলাম ছেলের ঘরের নাতিনের বিয়েতে শখ করে আনন্দ করব। তা আর হল কই?
-মা,মহুয়া তো তোমার নাতনি ই?
 
মা কেমন যেন রেগে নাক সিটকালেন।
 
-নাতনি! কে কার নাতনি?
 
 
চলবে