আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘সুখির কিংবদন্তি’

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০

ডাক্তার সাত্তার ধীরে ধীরে হাঁটছেন মাগুরার রাস্তা ধরে। বয়স হয়েছে, একটা চুলও আর কাঁচা নাই। কম করে হলেও৭৮টা বসন্ত পার করেছেন উনি। ক’দিন ওনার খুব ইচ্ছা করছিল একটু মফস্বলে যেতে। তাই একবার ঘুরে যাওয়া আর কী! শহরে পাকা দালনের মিছিলে ভালো লাগার মন পাখিটা কবে কোথায় যেন উড়ে গেছে। মফস্বল আর আগের সেই মফস্বল নাই, কেমন একটা শহুরে বাতাস লেগেছে। এসেছে আমূল পরিবর্তন, পরিবর্ধন। রাস্তা সব পাকা করে ফেলেছে, কিছু দূর পরপর লাইটপোস্টের খাম্বা। সন্ধে হলেই ল্যাম্পপোস্টে জ্বলে ওঠে সন্ধ্যাবাতি, ঘরে ঘরে বেজে ওঠে টেলিভিশন। ওনার ভালো লাগে না আজকের এই আধুনিকতা, এই নগরায়ন। ওনার মনে পড়ে যায় সেই সত্তর দশকের মাগুরার কথা। উনি দোহার পাড়া রোডে খুঁজে বেড়াতে থাকেন ওনার সেই ছোট্ট ডিসপেনসারি, যেখানে রোগী দেখতেন। ওনার ডিসপেনসারি থেকে হাসপাতাল বেশি দূরে ছিল না। সন্ধার পর বসতেন ওনার ডিসপেনসারিতে আর দিনে ডিউটি থাকতো হাসপাতালে। এভাবেই কেটে যেত সপ্তাহের সাতদিন। কোনও ছুটি ছিল না, শুধু রোগী আর রোগী। রোগী দেখাই ছিল ওনার জীবন। জীবনে বহু রোগী উনি দেখেছেন, বহু রকমের। কোনও আফসোস নাই এই জীবনে নিয়ে। আজ ওনার ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, দুজনই ডাক্তার। তবে এদেশে নয়, বিদেশে। ওনার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে তাও বছর আস্টেক হয়ে গেছে। মোটামুটি সারাদিনই মনে পড়ে স্ত্রীর কথা। ওনারা একই বয়সী ছিলেন, মেডিকেলে পড়ার সময়ই পরিচয়। এরপর প্রণয় এবং বিয়ে।

ডাক্তার সাত্তার হাঁটতে থাকেন আর ভাবতে থাকেন সেই ফেলে আসা সময়টার কথা। ওনার মনে পড়ে যায়, ওনাকে সবাই সাত্তার ডাক্তার বলে সম্বোধন করতো। কতশত স্মৃতি এসে ভিড় করে মনের জানালায়। হঠাৎ একটা স্মৃতি ওনার মনকে নাড়িয়ে দেয়, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে স্মৃতিটা। হ্যাঁ, ওই ঘটনাটা ভোলার মতো নয়। ডাক্তার সাহেব একটু আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ঘটনাটা মনে করে, মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।

নাকোল গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা গরিব আকমল মিয়ার ছনের ঘরের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে থাকে। অনেক রাত হয়ে গেছে, চারদিক সুনশান, কেউ জেগে নেই। শুধু আকমল মিয়া আর তার বউ সমীরণ জেগে আছে। অনেক অভাব, একবেলার ব্যবস্থা কোনোরকমে হয়, পরের বেলার কোনো গ্যারান্টি নাই। খানিকটা চিড়াগুড় আর বেশি করে পানি, ব্যাস চলে যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। পরেরদিন আবার সংগ্রাম। ১৫ দিন আকমল মিয়া কাজে যায় নাই, বাসায় সময় কাটিয়েছে। দুদিন ধরে চাল দিয়ে পানি পড়ছিল, চালে উঠে সেখানে খানিকটা সারিয়েছে। গত মাসে ঘরের পিছনের দিকে পাটখড়ির দেয়ালে গরু এসে গুতো দিয়ে ছিদ্র করে দিয়েছিল, সেটা সারতেও শ’খানেক টাকা খরচ হয়েছিল। সেই টাকার জোগাড়যন্ত্র করতে কী না বেগ পেতে হয়েছিল আকমলকে! এই বাজারে কেউ কাউকে টাকা ধার দেয় না, তারমধ্যে আকমলের মতো কপর্দকহীনকে কেইবা কর্জ দেবে? বরং ভিক্ষা হলে দিতে পারে।

এতকিছুর পরেও আকমল আর সমীরণের খুশিরর শেষ নাই। বহু বছর পর ওদের ভাঙা চালের ফুটো দিয়ে একচিলতে চাঁদের আলো ঘরের ভিতর এসে পড়েছে। ওদের সংসারে যমজ কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে। বিয়ের বহু বছর পর ওদের কোল রাঙাতে সুখি-দুখির আগমন। সেই খুশিতে আকমল আবার শ’খানেক টাকা ধার করেছে হানিফ ব্যাপারির কাছে। তাই কিছুদিন একবেলা শুকনা মরিচ পোড়া আর আরেকবেলা পেটভরে পান্তার জোগাড়যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। আকমল আর সমীরণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নবজাতকদ্বয়ের দিকে। কী একটা সুখ ওদের সারা মনকে ভরিয়ে রাখে। ওরা আদর করে নাম রাখে সুখি আর দুখি। একটু ফর্সা যে তার নাম রাখে সুখি, আর খানিকটা কালো যে তার নাম দুখি। সুখি আর দুখিকে নিয়ে ওদের সংসার সুখে-দুখে চলে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সুখি আর দুখি। বছর তিনেক পরে সমীরণ আর আকমল খেয়াল করে, দুখি কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সুখি একটা কথাও বলে না, চুপচাপ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দেখতে দেখতে আরও বছরখানেক চলে যায় তবুও সুখি কথা বলে না। ওরা পাশের পাড়ার শরিফুলের পরিচিত এক ওঝাকে ডাকায়। ওঝা এসে ঝাড়ফুঁক করে বলে দেয়, সুখির শরীরে বাতাস লেগেছে। ওর কথা বলতে আরও দেরি হবে যদি এই বাতাসকে সরানো না যায়। বাতাস সরাতে হলে প্রতি মাসে একবার করে ওই ওঝাকে আনতে হবে। পানপড়া ও মন্ত্রের মাধ্যমে বাতাস সরাতে হবে এবং এরকম ৯ মাস করতে হবে। প্রতিবার ওঝাকে আনতে তেইশ টাকা তেরো আনা, সাথে তিন কেজি চাল আর তিন কেজি ডাল লাগবে। আকমল সমীরণের এত টাকা নাই যা দিয়ে ওরা ৯ মাস ধরে ওঝাকে আনবে। আকমল আশা ছেড়ে দেয়, থাকলে থাকুক ওর সুখি বোবা। মনকে সান্ত্বনা দেয় এই ভেবে যে, কত মানুষের বাচ্চারাইতো বোবা হয়!

এভাবে আরও বছর দুয়েক চলে যায়। সমীরণ ও আকমল আরেকটা শারীরিক পরিবর্তন খেয়াল করে সুখির মধ্যে, সুখি তরতর করে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। দুজনের বয়স এক হলেও লম্বা হওয়ার মাত্রাটা এক নয়। অর্থাৎ বয়স মাত্র ছয় অথচ এর মধ্যেই সুখি দুখির চাইতে ছয় ইঞ্চি বেশি লম্বা। আকমল আর সমীরণ খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করতে থাকে, সুখির লম্বা হওয়ার মাত্রাটা বেশ অস্বাভাবিক। প্রতি মাস যায় আর সুখি একটু একটু করে লম্বা হয়। ওর এই লম্বা হওয়াটা একেবারে চোখে পড়ার মতো। এ যেন মড়ার উপর খাড়ার ঘা। এমনিতে কথা বলতে পারে না, তার ওপর এভাবে লম্বা হতে থাকলে কী করে কী হবে? দিন দিন শরীরটা ওর লিকলিকে বাঁশের মতো হয়ে যাচ্ছে আর সাথে লম্বা হওয়াতো আছেই। গরিব আকমল সমীরণের সংসারে এক মুহূর্ত সুখ নাই, শুধু আছে বুকভরা দুঃখ। দিন যায় রাত যায়, কত নির্ঘুম বসন্ত কেটে যেতে থাকে আকমল সমীরণের জীবনে।

দিন থেমে থাকে না। এর মধ্যে কেটে যায় আরও বছর চারেক। সুখি আর দুখি এখন দশ বছরের বালিকা। সুখির বেড়ে ওঠাটা বরাবরই অস্বাভাবিক অর্থাৎ দশ বছর বয়সেই সুখি প্রায় সাড়ে ছয় ফিটের মতো লম্বা হয়েছে। গায়ের রঙ সুন্দর, চেহারা সুন্দর কিন্তু লিকলিকে শরীরে অসম্ভব লম্বা। আকমল বা সমীরণের চৌদ্দ গুষ্টিতে এরকম লম্বা কেউ ছিল না। দুখি মাত্র সাড়ে চার বা পাঁচ ফিট, অথচ সুখি সাড়ে ছয় ফিট। কে জানে সামনের বছর কত লম্বা হবে। আকমল সমীরণের দুশ্চিন্তার মাত্রা অনেক বেড়েছে। যত বড় হচ্ছে সুখি তত দুশ্চিন্তায় পড়ে যাচ্ছে আকমল আর সমীরণ। পাড়ার লোকেরা একথা-সেকথা বলে। ওরা বলে, সুখি নাকি অপয়া। ও যতদিন ওদের সংসারে থাকবে ততদিন আকমলের কোনো উন্নতি হবে না। আর সারা পাড়াতেও অভিশাপ নেমে আসবে। এসব কথা শুনে মা-বাপের মনটা একেবারে ছোট হয়ে থাকে। ওরা বসে শুধু ভাবে কি করবে। বহুবার ওঝা দেখিয়েছে, ওষুধ খাইয়েছে। একজন নামকরা পির সাহেবের কাছেও নিয়ে গিয়েছিল মাস ছয়েক আগে। ওনার পড়াপানি এনেও খাইয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। লিকলিকে শরীরে সুখির লম্বা হওয়া থামছেই না। ওর কথা বলতে না পারাটা এখন আকমল আর সমীরণের কাছে মোটেই ধর্তব্যের বিষয় নয় বরং লম্বা হওয়াটাই মূল সমস্যা।

সুখির মনটাও খুব ছোট হয়ে থাকে। সবাই ওর দিকে কীভাবে যেন তাকায়! পাড়ার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করে, ধাক্কা দেয়, গালি দেয়, আরও কত কী! পাড়া প্রতিবেশী ওকে দেখলেই কেমন করে তাকায়, জিজ্ঞাসা করে, কিরে তুই অত লম্বা হতিছিস কেন, তোরে কি জিনে ধরছে?

ও শুনতে পায় না কে কী বলছে, তবে আচ করতে পারে যে, ওকে নিয়ে ওরা বাজে কথা বলছে। ওর ভীষণ কান্না পায়, মাকে এসে ইশারায় বলে। মা কি করবে, চুপ করে থাকে আর গোপনে চোখের পানি মোছে শাড়ির আচল দিয়ে। ওকে ইশারায় বলে, তুই আর ওদিক যাইসনে, ওগের বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই তোর। সুখি ছোট্ট মানুষ, ওর কি আর মন মানে, ও আবার খেলতে চলে যায় আর অপমানিত হয়ে ফিরে আসে।

দেখতে দেখতে আরও ছয় মাস কেটে যায়। সুকি আরও ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হয়ে ওঠে। আকমল মিয়া আর সমীরণের চিন্তায় ঘুম আসে না। এমনি অভাবের সংসার তার মধ্যে এরকম একটা অস্বাভাবিক কাণ্ড! যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের সংসারে এরকম একটা অস্বাভাবিকতা থাকলে কিভাবে জীবন পার হয়? পাড়া প্রতিবেশীদের কথায় আর কান দেয়া যাচ্ছে না। এই মেয়ে বিদায় করবে কিভাবে ওরা? সারা জীবনতো এই অপয়া মেয়ে টেনে যেতে হবে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না আকমল আর সমীরণ। পাড়ার সেলিম বক্স আকমলকে বুদ্ধি দেয় হাসপাতালে নিয়ে যেতে, ওরা হয়তো কোনো একটা ওষুধ বিশুধ দিয়ে লম্বা হওয়া ঠেকাতে পারবে। আকমল মিয়া বাসায় ফিরে সমীরণের সাথে শলাপরামর্শ করে সুখিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। সমীরণ রাজি হয় না, ভীষণ কান্নাকাটি করে। দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়, মুখ কালাকালি করে সমীরণ দুদিন পানিও মুখে দেয় না। সমীরণ কিছুতেই রাজি না সুখিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে আর ওদিকে আকমল নাছোড়বান্দা। সে নিয়ে যাবেই সুখিকে। এই বাকবিতণ্ডার মধ্যে কেটে যায় ১৫ দিন। একসময় সমীরণ মত দেয় বাধ্য হয়ে। সমীরণ সুখিকে আদর করে আকার ইঙ্গিতে বোঝায় হাসপাতালে গেলে ডাক্তার ওষুধ দিয়ে দেবে, তখন ও আর লম্বা হবে না। সুখি ভীষণ খুশি হয়। ওর খুব ভালো লাগে। ওকে আর কেউ বাজে কথা বলতে পারবে না। ও সবার সাথে খেলতে পারবে, কেউ আর খেলা থেকে বাদ দিতে পারবে না। সুখি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে ।

আজ সোমবার। সমীরণ সুখিকে গোসল করিয়ে মাথায় ভালো করে তেল দিয়ে দুইটা বেনি করে দেয়। ওর পছন্দের লাল রঙের জামাটা পরিয়ে দেয়, চোখে কাজল দিয়ে দেয়। সুখির জামা লম্বায় অনেক বড় আর তাছাড়া জামা পরাতে গেলে সুখিকে মাটিতে বসতে হয়, তারপর মা পরিয়ে দেয়। কারণ দাঁড়িয়ে থাকলে সমীরণ নাগাল পায় না। মা সুখির পছন্দের খিচুড়ি রান্না করে, সাথে শুকনা মরিচ পিঁয়াজ সরিষার তেলের ভর্তা। আরও বানানো হয় শুকনা মরিচ দিয়ে আলু ভর্তা। এত কিছু পেয়ে সুখি খুব খুশি হয়ে খেতে থাকে। প্রাণভরে দুখিও খায়। সমীরণ এক দৃষ্টিতে সুখির দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। কতদিন মেয়েটা পেট আর প্রাণভরে খায় না। সবার অলখে সমীরণের চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ে, ও সেটা লুকিয়ে আরেকটু ভাত তুলে দেয় সুখির প্লেটে। পেটভরে ভাত খেয়ে নেয় সুখি, বাবা ওকে বুঝিয়েছে হাসপাতালে অনেক্ষণ থাকতে হতে পারে। তাই পেটভরে খেয়ে নিতে হবে।

আকমল একটা ফতুয়া পরে কাঁধে গামছাটা নিয়ে নেয়। হাসপাতালে যাচ্ছে বাবা আর সুখি। সমীরণ আর দুখি থাকছে বাড়িতে। সুখি খুশিতে ফেটে পড়ছে। সে দুখির কাছে আসে। সুখি ওর হাতটা ধরে আদর করে বুঝিয়ে দেয়, আমটা খাইসনে। আমি আলি পরে দুইজনে মিলে খাবানে। দুখি চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলে। উঠোনে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ছয়ফিট লম্বা সুখি। আকমল কাঁধে গামছা নিয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। খালি পায়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে বাড়ির পাশের চিকন কাঁচা রাস্তার দিকে। পিছে পিছে সুখি যায়। সমীরণ এসে সুখিকে জড়িয়ে ধরে চুমা দেয় গালে। সুখি চাঁদের মতো সুন্দর করে হাসে। এরই মধ্যে আকমল বেশ সামনে চলে যায় এবং পিছনে ফিরে সুখিকে ইশারায় ডাকে। সুখি দ্রুত হাঁটতে থাকে বাবার পিছে পিছে। সমীরণ দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির উঠোনে। সামনের রাস্তা ধরে আকমল আর সুখি ধীরে ধীরে দূরে ছোট হয়ে যায় এবং এক সময় দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। আকমলের বাসার আঙিনায় প্রতিদিনের মতো দখিনা সমীরণ বইতে থাকে, উঠোনে বসে দুখি একা একা খেলতে থাকে, আর ওদিকে সমীরণ উনুনে ভাত চড়িয়ে চুলায় চোংগা দিয়ে ফুঁ দিতে থাকে। জীবন প্রতিদিনের মতো চলতে থাকে একই ঢিমা তেতালা গতিতে।

সুখি অবাক নয়ন মেলে বাইরের পৃথিবী দেখতে থাকে। আজ অবধি কোনোদিনও সুখি বাড়ি আর পাড়ার বাইরে কোথাও যায়নি। এই প্রথম ও বাসার সামনের রাস্তা ধরে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। অনেক অজানা অদেখা জিনিস ও চোখভরে দেখতে থাকে। ও মা’র কাছে শুনেছিল ওরা আজ বাসে উঠবে। বাস ও জীবনেও দেখেনি। গরু ও ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা পর্যন্ত দেখেছে। কিন্তু বাস আজ ও প্রথম দেখবে। খুব খুশি লাগছে ওর। মা বুঝিয়েছে, বাস একটা বিরাট গরুর গাড়ির মতো। কিন্তু দেখতে গরুর গাড়ির মতো নয় এবং ওই গাড়ি একটা ইঞ্জিন দিয়ে চলে। সুখি ওর নিজের কল্পনায় গাড়ির একটা প্রতিকৃতি আন্দাজ করে নেয় এবং অপেক্ষা করতে থাকে ওর মনের প্রতিকৃতির সাথে সত্যিকারের বাসের কতটুকু মিল, তা দেখার জন্য।

ওরা এসে বড় রাস্তার একটা জায়গায় দাঁড়ায়। ওদের সাথে আরও অনেক মানুষ একই জায়গায় দাঁড়ায়। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সুখি দেখতে পায় একটা বিরাট গাড়ি এসে ওদের কাছাকাছি দাঁড়ায়। সব লোকজন হুড়মুড় করে ওই বড় গাড়ির গেট দিয়ে ভিতরে উঠে যায়। লোকগুলির সাথে ওর বাবাও রওনা দেয়, সাথে ও। ওরাও উঠে পড়ে বড় গাড়িটায়। গাড়িটা বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর একসময় বিকট গর্জন করে চলতে শুরু করে। এই গাড়িকেই বাস বলে। কী অদ্ভুত লাগে দেখতে চারদিক। ও বাসকে যে ভাবে ভেবেছিল, সত্যিকারের বাস মোটেই সেরকম নয় বরং আরও অনেক সুন্দর। বাসের জানালা দিয়ে সুখি তাকিয়ে তাকিয়ে দূরের গ্রাম দেখতে থাকে। ওর দুখির কথা মনে হয়। যদি দুখিও থাকতো ওদের সাথে তাহলে খুব মজা হতো। বাসে বসা অনান্য যাত্রী সুখির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ওর বাবাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে এত লম্বা মেয়ে দেখে। আকমল দুয়েকটা উত্তর দিয়ে একসময় বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকে। এর মধ্যে দুয়েকজন ওকেও বিভিন্ন প্রশ্ন করে, ও কিছুই বুঝতে পারে না, বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। একঘেয়ে আওয়াজে বাস ছুটে চলে গন্তব্যে। সুখি মনের সুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে অনেক দূরে মাঠে চাষরত কৃষকের দিকে।

আজ হাসপাতালের আউটডোরে বেশি ভিড় নাই। সাত্তার ডাক্তার এসে বসে তার আউটডোর ওয়ার্ডের চেম্বারে। বাইরে টিকেট কাটা রোগীরা দাঁড়িয়ে আছে লাইনে ডাক্তার দেখানোর জন্য। একে একে রোগী আসছে, সাত্তার ডাক্তার দেখে ওষুধ লিখে দিচ্ছে কিংবা ভর্তির দরকার হলে ওয়ার্ডে রেফার করে দিচ্ছে। এবার এলো এক গরিব কৃষক তার মেয়েকে নিয়ে। অসম্ভব লম্বা একটা মেয়ে। ডাক্তার রোগীর নাম জিজ্ঞাসা করে। কৃষক বলে, রহিমা। ডাক্তার কৃষকের নাম জিজ্ঞাসা করে, কৃষক উত্তর দেয়, আবুল ব্যাপারি।

নাম লিখে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে কি তাদের সমস্যা। কৃষক উত্তর দেয়, মেয়েটা আমার ছোটকাল থেকে বোবা আর তখন থেকে এ পর্যন্ত ও শুধু লম্বা হয়ে চলতেছে। থামে না লম্বা হওয়া। আপনি যদি কোনো ওষুধ দিয়ে ওর এই লম্বা হওয়াটা থামাতি পারতেন, আমরা বাঁইচে জাতাম।

সাত্তার ডাক্তার প্রথম থেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল এত লম্বা দেখে কিন্তু প্রকাশ করে নাই। ডাক্তার মেয়েটার পালস দেখে, চোখ দেখে, হা করিয়ে জিব দেখে এবং কতটুকু লম্বা সেটা দেখার জন্য হাইট মেশিনে দাঁড় করায়। মেয়েটা ছয় ফিট ১১ ইঞ্চি লম্বা। ডাক্তার সাত্তার হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে এই রোগী দেখানোর জন্য একদিন ওয়ার্ডে থাকতে বলে কৃষককে মেয়েসহ। কৃষক রাজি হয়ে যায়। ডাক্তার ওয়ার্ডে রেফার করে দেয়।

হাসপাতালের চার নম্বর ওয়ার্ডে সুখি ভর্তি হয়। ওই ঘরে আরও বেশ কয়েকজন রোগী আছে। এই ওয়ার্ডটা বাচ্চাদের, যার কারণে কিছু রোগীর সাথে বাবা অথবা মা আছে। আকমল ওর নাম এবং সুখির নাম গোপন করে বলেছে এবং গ্রামের নামও করেছে গোপন। ওর মনে যে কী আছে, বোঝা যাচ্ছে না। সুখির বেডটার পাশেই বারান্দায় যাওয়ার দরজা আর আরেক পাশে বিরাট জানালা। বারান্দার পর ছোট্ট একটা লনের মতো এবং তার পরেই রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার ওপারেই বিরাট একটা বটগাছ। গাছটার নিচে ছায়ায় বসে থাকা কিছু মানুষ, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ বা অলস সময় কাটাচ্ছে। ওখানে একটা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িয়ালও বিশ্রাম নিচ্ছে। সুখি তাকিয়ে দেখতে থাকে। রাস্তাটা খুব অলস, খুব কম গাড়ি ঘোড়া দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে সুখির খারাপ লাগে না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ওর বাবা বিছানার পায়ের দিকে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। ওয়ার্ড বয় এসে রাতের খাবার দিয়ে যায় একটা চারকোনা লোহার ট্রেতে। সুখি বাবাকে ডেকে তোলে। লোহার ওই রকমের বাসন দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সুখি। এরকম বাসন ও আগে দেখেনি। সেই বাসনের মধ্যে কতগুলি কুঠুরি আর তাতে কত রকমের খাবার। ওরকম রঙ-বেরঙের খাবার দেখে সুখির খুব ভালো লাগে। বাবাকে খেতে সাধে ও। বাবা ইশারায় বলে, আমি খাবান্নানে, তুই খাইয়ে নে।

সুখির বাবা আকমল বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়, একটু পরে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান দেয়। বিড়ির কমজোর লাল আগুনের আলোতে আকমলের অভাবক্লিস্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তামাটে চেহারার একাংশ দেখা যায়। আকমল গভীর ভাবনার জ্বালে হারিয়ে যায়। সুখি পেটভরে খায় আর দুখির কথা ভাবতে থাকে। মা’র কথাও মনে আসে। খাওয়া সেরে ও বিছানার এক সাইডে শুয়ে পড়ে বাবার জন্য জায়গা রেখে। ওয়ার্ডে জ্বলা লাইটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুখি। একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে ও। আরও ঘণ্টাখানেক পরে ওয়ার্ড বয় এসে লাইটটা অফ করে দিয়ে যায়। অন্ধকার নেমে আসে চার নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকমল একমনে বিড়ি টানতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওই ছোট্ট একচিলতে বিড়ির আলো আলোকিত করে ফেলে আকমলের মুখমণ্ডল।

ওয়ার্ড বয়ের ধাক্কাতে ঘুম ভাঙে সুখির। জীবনেও ও এত আরামের বিছানায় ঘুমায় নাই। তাই আজ বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছিল। চোখ খুলে দেখে, সাদা গাউন পরা একদল লোক এবং ওই দলের মধ্যে কালকের ডাক্তারটাও আছে। ওরা দেখতে এসেছে সুখিকে। ডাক্তার সাত্তার সুখিকে উঠে দাঁড়াতে বলে। ও বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ায়। সবাই মাথা উচু করে সুখিকে খুব আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে। ডাক্তার সাত্তার হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টকে দেখানোর জন্যেই রেখে দিয়েছিল সুখিদের। হেড অফ দ্য ডিপারমেন্ট ডাক্তার হাসিবুল রশিদ সুখিকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন বেশ সময় নিয়ে। দেখার পর সাত্তার ডাক্তারকে জানিয়ে দেন, এই গ্রোথ রোধের ব্যাপারে মেডিকেল সাইন্সে কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা নাই। এ ধরনের গ্রোথ যাদের হয় তাদের একটু বয়সে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। সেটার হয়তো চিকিৎসা হতে পারে কিন্তু লম্বা হওয়া আটকানোর কোনো ওষুধ নাই যা ডাক্তার সাত্তারও জানতেন। তবুও তিনি একটা এক্সেপ্সনাল কেস হেডকে দেখানোর জন্যে রেখে দিয়েছিলেন। হেড সুখিকে রিলিজ করে দিতে বলেন কিছু ভিটামিন দিয়ে। ডাক্তার সাত্তার সুখির বাবাকে খোঁজেন। ওয়ার্ডবয় বাইরে যায় দেখতে যে, ও কি বিড়ি খেতে গেল কিনা। কিছুক্ষণ পর বয় ফিরে এসে জানায় যে, ওই লোককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তার সাত্তার একটু আশ্চর্য হয়ে যান। হেড ডাক্তার হাসিবুল রশিদ চলে যান। সাত্তার ডাক্তার চলে যান তার চেম্বারে এবং ওয়ার্ডবয় ও নার্সকে বলে যান যে, যখনই মেয়েটার বাবা ফিরলে ওনার কাছে নিয়ে যেতে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালে আবুল ব্যাপারি নামের রহিমার বাবা ওরফে আকমল আর ফিরে আসে না। বিকেল গড়িয়ে যখন রাত হয়ে যায় তখন বাসা থেকে হাসপাতাল এসে সাত্তার ডাক্তার খবর নেন রহিমা ওরফে সুখির বাবা ফিরেছে কিনা। নার্সরা বলে দেয় সে ফেরেনি। মহাচিন্তায় পড়ে যায় সাত্তার ডাক্তার। কারণ এই রোগীকে সে-ই রেখে দিয়েছিল হেডকে দেখানোর জন্য। এখন পুরো দায়িত্বটাই তার ঘাড়ে এসে পড়ে যাচ্ছে। সুখি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। কয়েকজনকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করে ওর বাবার কথা। ওর ইশারা ওরা বুঝতে পারে না। সুখির চোখে পানি চলে আসে। কেঁদে দেয় ও। কেউ ওর কান্না খেয়াল করে না। ও মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে ওর বেডে বসে বসে।

রাতটা পার করে সকাল সকাল ডাক্তার সাত্তার চলে যায় হাসপাতাল। খুঁজে বের করে রেজিস্ট্রার যেখানে ওই মেয়ের বাপের নাম, গ্রামের নাম, থানা, সবকিছু লেখা আছে। ঠিকানা অনুযায়ী নড়াইলের এক গ্রামে জরুরি ভিত্তিতে পিওনকে পাঠায় ডাক্তার ওর বাপকে নিয়ে আসতে। সন্ধ্যা নাগাদ পিওন ফিরে এসে জানায় যে, ওই নামে ওই গ্রামে কেউ থাকে না। ডাক্তার সাত্তার বুঝে যায় যে, ভুল নাম ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রি করেছে মেয়েটার বাবা। বিশাল এক চিন্তায় পড়ে যায় সে। হেডকে জানায়। হেড থানায় ডায়েরি লেখার জন্য বলে।, ডায়েরি লেখানো হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় মেয়েটাকে আপাতত রাখার বিষয়ে। ডাক্তার হাসিবুল রশিদের সাথে সাত্তার সাহেব আলোচনা করে কোথায় মেয়েটাকে রাখা যায় সে ব্যাপারে। কিন্তু কোনো কূল কিনারা করতে পারে না।

সাত্তার ডাক্তার বলেন, স্যার ওকে আমাদের যেকোনো একটা ওয়ার্ডে রোগী করে রেখে দেই যতদিন না ওর বাবাকে পাওয়া যায়।
হাসিবুল রশিদ বলেন, তা কি করে হয়? ওতো রোগী না, সুস্থ মানুষকে তো আপনি হাসপাতালে রেখে দিতে পারেন না। আর তাছাড়া আমাদের বেডও তো পর্যাপ্ত নাই যে, আপনি ব্যবহার করবেন ওর জন্য। এটা সম্ভব না। অন্য কোনো একটা ব্যাবস্থা করেন, হাসপাতালে সম্ভব না।

সাত্তার ডাক্তার চিন্তায় পড়ে যায়। ফোন করে যশোরের ডিসিকে পুরো বিষয়টা জানায়। ডিসি সাহেব ডাক্তার সাত্তারকে ওনার অফিসে যেতে বলেন বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ডাক্তার সাত্তার পরের দিন চলে যায় যশোর, ডিসির সাথে দেখা করতে।

সবকিছু শুনে ডিসি সাহেব বলেন, লোকালি কারও বাসায় রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কোনো এতিমখানায়ও ট্রাই করতে পারেন। আর ওই লোককে আরেকটু ভালোভাবে খোঁজার ব্যবস্থা করেন।

সাত্তার ডাক্তার বলেন, লোকালি কার বাসায় রাখার রিকোয়েস্ট করবো বুঝতে পারছি না। আর তাছাড়া মেয়েটা তো যেহেতু স্পেশাল কেস, লম্বায় প্রায় সাত ফিট এবং বোবা, কেউ হয়তো রাখতে চাইবে না।
ডিসি বলেন, দাঁড়ান আমি ওখানকার চেয়ারম্যানকে বলে দিচ্ছি। আপনি ওর সাথে বসে একটা ব্যবস্থা করেন আর সে পর্যন্ত আপনাদের হাসপাতালেই রেখে দেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এই বলে চলে আসে ডাক্তার সাত্তার।

পরের দিন দুলাল চেয়ারম্যানের সাথে দেখা হয় ডাক্তার সাত্তারের, তাকেও পুরা বিষয়টা খুলে বলে এবং একটা জায়গা চায় মেয়েটাকে রাখার জন্য। চেয়ারম্যান দুইদিন সময় চায় জায়গা খুঁজে বের করার জন্য। এদিকে মেয়েটার বাপকে খোঁজার জন্য নড়াইল এবং আশপাশের আরও কয়েকটা গ্রামে লোক পাঠানো হয়। খোঁজ চলতে থাকে সব জায়গায়। মেয়েটা কিছু বলতে পারে না বিধায় আরও সমস্যা হয়েছে। ও শুধু ইশারায় যা বলে তা বুঝে ওর বাপকে খুঁজে বের করা একেবারে অসম্ভব। সারাক্ষণ মেয়েটা কান্নাকাটি করে বাবা-মা’র জন্য। দিনে দিনে মেয়েটা দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাত্তার ডাক্তারের খুব মায়া হয়। ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আর নীরব অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। এর মধ্যে উনি গিয়ে মেয়েটাকে কয়েকবার সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। মায়াবী চোখ দুইটা বৃষ্টি থামায় নাই। সাত্তার ডাক্তারের ভীষণ রাগ হয় ওর বাপ-মা’র উপর। মানুষ কিভাবে এত নির্মম হয়, এত দয়ামায়াহীন হয়! কিভাবে নিজের সন্তানকে এভাবে রেখে পালিয়ে যায়!

দুইদিন পরে চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালো ডাক্তার সাত্তারকে। ডাক্তার গেলো দেখা করতে। চেয়ারম্যান অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো জায়গা পায়নি মেয়েটাকে রাখার জন্য। কতদিন রাখতে হবে তারতো কোনো ঠিক নাই। আর ওদিকে ওর বাপকে কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে গ্রামের নাম দিয়েছিল সেটাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটা গ্রাম খোঁজা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। শেষে চেয়ারম্যান মাস দুয়েক রাখতে রাজি হলো। মেয়েটা থাকবে চেয়ারম্যানের বাড়িতে। বিরাট বাড়ির একেবারে কোনার একটা পড়ে থাকা ঘরে ওর থাকার ব্যাবস্থা হলো। ওই ঘরটার পাশের ঘরেই শস্যভাণ্ডার। ঘরটায় একটা সিঙ্গেল চৌকি আর কয়েকটা কোলা ছাড়া আর কিছুই নাই। একটা ছোট্ট জানালা আছে, জানালার পাশেই একটা নিমগাছ। এটা আসলে বাসার পিছন দিকটা। ওই ঘরের পরেই জংলা একটা আঙিনা এবং ৫০০ গজ পরেই প্রধান সড়ক। ওটা কামারখালীর দিকে চলে গেছে। জানালায় দাঁড়ালেই ওই রাস্তাটা দেখা যায়। মাঝে মাঝেই বাস যায়। দুয়েকটা গরুগাড়িও যায়। ছোট্ট সুখির নতুন জীবন শুরু হয় কোনার ঘরটায়। মৃদুমন্দ বাতাসে মাঝে মাঝে দোলে নিম গাছের ডালগুলি আর সুখির মনে পড়ে যায় দুখিকে, মাকে আর বাবাকে। কখন যেন চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা কষ্টের অশ্রু।

সুখি কিছু বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ও শুধু ওর বাবাকে খুঁজে ফিরছে। একটা প্রশ্ন বারবার মনে আসছে, বাবা কোথায় গেল? তাহলে কি দুখি বা মায়ের কোনো বিপদ হয়েছে? মনে মনে এসব সাত-সতের প্রশ্ন করে আর চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা ঝরতে থাকে। ও কিছুতেই ভাবতে পারে না যে, ওর বাবা ওকে রেখে চলে গেছে। মাঝে মাঝে পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ওকে দেখতে আসে ওর কোনার ঘরে, কেউ কেউ হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনী কাটে, কেউবা কাছে এসে একটা খোঁচা দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে ওর। সবাই কেমন করে সারাক্ষণ ওকে দেখে, কী সব প্রশ্ন করে, না পায় শুনতে, না পারে বুঝতে।

মাগুরার সবচাইতে বড় মেলা শুরু হয়েছে জেলা স্কুলের মাঠে। কত ধরনের খেলা এসেছে, এসেছে সার্কাস পার্টি, যাত্রা পার্টি, আরও কত কি। ছোট ছোট মিষ্টির দোকানে দানাদার, গুড়ের প্যারা সন্দেশ, নলেন গুড়ের সন্দেশ, মুরালি, ছানার জিলাপি, কটকটি, রসগোল্লা, চমচম বিক্রি হচ্ছে। মেলায় প্রচুর খেলনার দোকান। মাঠের একেবারে শেষ কোনায় মোসলেমের খেলনার দোকান কিন্তু কোনায় পড়ে যাওয়ায় বিক্রি কম হচ্ছে। মোসলেম বহু কষ্টে ধার বাকি করে মেলায় দোকান দিয়েছে। এখন যদি এই দোকান না চলে তাহলে জমি বেচে টাকা শোধ করতে হবে। বড় চিন্তায় পড়ে গিয়েছে মোসলেম। ওর চাচাতো ভাই নোয়া এসে একটা বুদ্ধি দেয়। সেই বুদ্ধি অনুযায়ী মোসলেম পরের দিন মেলা শুরু হওয়ার আগে সকাল সকাল দুলাল চেয়ারম্যানের বাসায় চলে যায়। ওখানে ঘণ্টাখানেক কাচারি ঘরে বসে অপেক্ষা করে। এক সময় দুলাল চেয়ারম্যান আসে এবং জিজ্ঞাসা করে, কিরে, কি মনে কইরে আলি?

মোসলেম বলে, চেয়ারম্যান সাহেব, আমি এইবারগের মেলায় দুকান দিতে যাইয়ে অনেক টাকা ধার কইরে ফেলিসি হুমেন ব্যাপারির কাছে। দোকান একখান পাইছি কিন্তু টাকা দিতি দেরি হইছিল তাই মাঠের একেবারে শেষের দোকান খেন আমারে দেছে।

চেয়ারম্যান বলে, শেষের দোকান? সেইটা কোনদিকে? ওই যে ওগের বাসার পিছনে।
মোসলেম বলে, কিডা।
চেয়ারম্যান বলে, আরে রহিম জোলাগের বাসার পিছনে?
মোসলেম বলে, ঠিক ধরিছেন। আমিন কুলুর বাসার গা ঘেইষে পড়িছে দোকানখেন। একটা মানুষও যায় সারাদিনে। মেলা থুইয়ে অতদূরে যাবি কিডা? একেবারে মাইর খায়ে গিলাম এইবার।
চেয়ারম্যান বলে, তো আমি কি করবানে?
মোসলেম বলে, না মনে, নোয়া আইসে কোইলো যে, কী এক লাম্বা এতিম মাইয়ে নাকি আপনাগের বাসায় রাখিছেন। সে নাকি দেখার মতো লাম্বা, লোকজন নাকি তারে দেখতি আইসতেছে লাইন ধইরে?
চেয়ারম্যান বলে, হ্যাঁ রাখিসি, তো?
মোসলেম বলে, না কতিসিলাম যে, প্রতিদিন যদি আমার দোকানে ওরে একটু বসাতি পারতাম, তালি পরে লোকজনের অভাব হতো না, অনেক কাস্টোমার পাতাম। ওরে দেখতি আইসে কিছু বেচাবিক্রি হতো।
চেয়ারম্যান বলে, আমারে কি নতুন চাকরি  দিতি চাস? তোর দোকানে ওই মাইয়ে নিয়ে যাব আর নিয়ে আসবো?
মোসলেম বলে, না চেয়ারম্যান সাহেব, আপনি যাবেন কেন, আমি নিয়ে যাব আবার আমি দিয়ে যাবানে।
চেয়ারম্যান বলে, ও যাইয়ে কি করবি তোর দোকানে?
মোসলেম বলে, কিছু না। শুধু বইসে থাকবি দোকানের সামনের একখেন টুলে। লোকজন আইসে ওরে দেখবি। ব্যাস আর কিছু করতি হবে না নে ওর। ওতেই আমার বেচাবিক্রি বাইড়ে যাবি।
কি কইস, ওরে দেখতি লোকজন আসবি?
কন কি চেয়ারম্যান সাহেব, ওরে দেখতি ভিড় লাইগে যাবি। অত লাম্বা মাইয়ে মানুষ আমার বাপের জম্মে দেহিনি, লোকজন দেখলি পরেতো এক্কেবারে লাইন লাইগে যাবি। আর তাছাড়া মেলায় যাইয়ে বইসে থাকলি ওরও ভালো লাইগবেনে।
তুই কাইল আয়, আমি আগে সাত্তার ডাক্তাররে জিজ্ঞাসা কইরে নি।
আচ্ছা, বলে মোসলেম চলে যায়।

মোসলেমের দোকানে আজ আবাল বৃদ্ধ বণিতার ভিড়। যে দোকানে তিনদিনে সব মিলিয়ে ৪০-০৫০ জন মানুষও আসে নাই, সেই দোকানে আজ কত মানুষের আনাগোনা! মেলায় চাওড় হয়ে গিয়েছে যে, পৃথিবীর সবচাইতে লম্বা মেয়ে মোসলেমের দোকানে বসে আছে। সবাই এদিক সেদিক একটু ঘুরে চলে যাচ্ছে মাঠের কোনায় মোসলেমের দোকানে। মোসলেমের আজ বেচাবিক্রির অবস্থা খুবই ভালো। মোসলেমের কপাল থেকে চিন্তার রেখা মিলিয়ে আনন্দের ঘাম চিকচিক করছে। কর্জ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। এবার ও দান মারবে এভাবে যদি প্রতিদিন মানুষ আসতে থাকে।

দোকানের একটা টুলে বসে আছে সুখি। একজন করে আসছে আর ওকে দাঁড়াতে বলছে। ও দাঁড়াচ্ছে, ওরা একটু দেখেশুনে চলে যাচ্ছে। আবার পরের জন আসছে। সুখির ভালোই লাগছে এত লোকজন দেখে, সাথে আশপাশের দোকানপাট দেখা যাচ্ছে, চরকি চলছে, রংবেরঙের লাইট জ্বলছে। এত কিছু দেখে ওর চরকিতে চড়তে ইচ্ছা করে। কিন্তু দোকানে এত মানুষের ভিড়ে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। দূর থেকে দেখেই আশা পূরণ করতে থাকে ও। বারবার দুখির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, মা-বাবার কথা। ওরা সবাই যদি একটু এখানে আসতে পারতো, কী যে মজা হতো!

দেখতে দেখতে ১৫ দিন কেটে গেছে। মোসলেমের দোকানে ভিড় আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন জেলা থেকে বহু মানুষ এসে দেখে যেতে থাকে পৃথিবীর সবচাইতে লম্বা মেয়েটাকে। এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। সুখির মনটা দিনে দিনে খুব খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন এত মানুষের ভিড় ওর আর সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে গা ঘিনঘিন করে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। প্রতিদিন এই মোসলেম সকালে গিয়ে নিয়ে আসে সুখিকে আর ফেরত দিয়ে আসে রাতে। সারাদিন যায় হাড়ভাযা খাটুনি। অতটুকু একটা ছোট্ট মেয়ের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না এভাবে সারাদিন শত শত মানুষের সামনে সার্কাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ওর শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। দুর্বল লাগে, তবুও মাফ নাই। বাড়িতে থাকলে মা’কে বলতে পারতো, এখানে কাকে বলবে, ওরতো এখানে কেউ নাই। ওরা নাকি ওর বাবাকে এখনও খুঁজে পায় নাই। আর কিছুই ভালো লাগে না সুখির। সারাদিন এখানে সার্কাস দেখিয়ে বাসায় ফেরার পর ওর আর হাত পা চলে না, পাগলের মতো ঘুম আসে। একেবারে অচেতন হয়ে পড়ে। তার মধ্যে মোসলেমের দোকানে ঠিকমতো খাবার দেয় না। এবেলা দিলো তো ও বেলার খবর নাই। ও ছোট মানুষ, ইশারায় খাওয়া চাওয়া এখনও শিখে নাই। যার কারণে অভুক্ত থেকে যেতে হয়। তাতে মোসলেমের কিছুই যায় আসে না। ওর ব্যাবসা হলেই চলে।

দুইদিন আগে মোসলেমের নিজেরই না খেয়ে মরার জোগাড় হয়েছিল দোকান না চলার কারণে। আর আজ ব্যবসা হওয়ার মূল কারণকেই প্রচণ্ড অবহেলা ওর। আসলে মানুষ বিপদে পড়লেই খুব ভালো হয়ে যায় এবং বিপদ শেষ হলেই আবার চামার হয়ে যায়। সুখির মনটা একেবারে ভেঙে যায় যখন একেকজন মানুষ এসে ওকে দাঁড়াতে বলে এবং দাঁড়ানোর পর শরীরে স্পর্শ করে পরখ করে দেখে, মানুষ কিনা। কেউ কেউ এসে আজেবাজে ইশারা করে। কেউবা জোরে চিমটি দেয়। সুখির মনে এসব আচরণ একটা ট্রমার মতো কাজ করে। ও স্বাভাবিক হতে পারে না। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে, কিন্তু কেউ দেখে না। আজ মা থাকলে ওর এই অবস্থা হতো না। মাঝে মাঝে সুখি দুর্বল শরীরের জন্য ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। মোসলেম ওকে চিৎকার করে ইশারায় দাঁড়াতে বলে। ও অনেক কষ্ট করে কাঁদতে কাঁদতে দাঁড়ায়। মোসলেমের এমন একটা ভাব যে, সুখিও ওর দোকানের কর্মচারী। তাই যখন যা ইচ্ছা তাই বলে। সুখি কিছুই বুঝতে পারে না। নীরব হয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর যাদু করা পুতুলের মতো মোসলেমের কথা শুনতে থাকে। টুলে বসে মাঝে মাঝে খুব ঘুম আসে সুখির। একটু চোখ বুজলেই মোসলেম চিৎকার করে উঠিয়ে দেয় আর বলে, কিরে, তুই কি ঘুমুতি আসিছিশ? চোখ খুইলে রাখ।

কষ্ট করে চোখ খুলে রাখে সুখি আর কাঁদতে থাকে নীরবে। এত ভিড়ের মধ্যে প্রতিদিন বাবাকে খোঁজে। যদি একফাঁকে বাবা চলে আসে? তাহলে আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবে না। বাড়ি চলে যাবে। বাড়ি গিয়ে দুখির সাথে আমগাছ তলায় গিয়ে বসে থাকবে আর বসন্তের বাতাসে বেণী দুলাবে। মা, দুখি ওকে কত আদর করে, কত ভালবাসে। ওর হঠাৎ মনে হয়, সুখি নামের মেয়েরাই বোধহয় সবচাইতে দুখি হয়। এসব ভাবতে ভাবতে আবার চোখটা বুজে আসে আর সাথে সাথে মোসলেমের গগন বিদারী চিৎকারে ওর দিবাস্বপ্নে ছেদ পড়ে।  সুখির শরীর খারাপ লাগে কিন্তু মোসলেম এসব কিছুই খেয়াল করে না। ওর শুধু সদাই বিক্রি হলেই চলে, কে বাঁচলো আর কে মরলো, তা দিয়ে ওর কি হবে।

ভোর হয়ে গেছে। দুলাল চেয়ারম্যানের বাড়ির পিছনের প্রধান সড়কে দুইটা একটা যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। সুখির ঘরের পাশের নিম গাছটায় পাখিদের কলকাকলি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। টিনের চালে টুকটাক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওই পিছন দিকটায় গরুর গোয়াল, ওখানে রাখাল এসে বাছুরের মুখে মা গরুর দুধ ছুঁইয়ে দুধ দোয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে মুরগীর খোয়াড় থেকে মুরগীও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারা বাড়ি চরে বেড়াচ্ছে ওরা। ভোরবেলার ঝিরঝির শান্ত ঠাণ্ডা বাতাস সুখির ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে ঘরটা শীতল করে দিচ্ছে। আজ আর ওর উঠতে ইচ্ছা করছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোসলেম চলে এলো সুখিকে নিতে। আজ রোববার। মেলায় অনেক ভিড় হবে। নতুন পালা বসবে আজ। তাই যশোর ও খুলনা থেকেও অনেক মানুষ আসবে। সেকারণেই আজ একটু তাড়াতাড়ি সুখিকে নিতে চলে এসেছে ও। চেয়ারম্যান বাড়ির গরু চরায় রাখাল রহিমুদ্দি, ওর বউ জরিনা এ বাসায়ই থাকে এবং রান্নাবান্নার কাজ করে। তাকে মোসলেম বলে সুখিকে ডেকে দিতে। মোসলেম কাচারি ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে সুখির জন্য। জরিনা যায় সুখির ঘরে ওকে ডাকতে। ভেড়ানো দরজা খুলে জরিনা ঢুকে ভিতরে, সুখি মনের শুখে আরামে একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জরিনা ওকে ডাকে, সুখি কোনো সাড়া দেয় না। জরিনা আবার ডাকে। নাহ, সুখির কোনো সাড়া শব্দ নাই। একেবারে অচেতন মনে হচ্ছে। জরিনা বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও ওর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে দৌড়ে যায় চেয়ারম্যানের ঘরে। চেয়ারম্যানের বউ দৌড়ে আসে সুখির ঘরে। সুখী তখনও মনের সুখে ঘুমাচ্ছে। ও আজ আর মেলায় যাবে না, মেলায় যেতে ওর ভালো লাগে না। ২০ দিন যাবত মেলায় বহু মানুষের অপমান ওকে ক্লান্ত করে দিয়েছে, ও আর পারছে না। তাই ও আজ আর মেলায় যাবে না। কেউ ওর ঘুম ভাঙাতে পারবে না আজ, ওর বাবাও যদি ফিরে আসে তবুও ও উঠবে না, শুধু ঘুমাবে।

না, আর কোনোদিন সুখি ঘুম থেমে ওঠেনি। ও সেদিন শেষ ঘুমটা দিয়েছিল। এরপরে কাউকে আর কোনো বোঝা বইতে হয় নাই। তখনকার মাগুরাবাসীদের কথন অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচাইতে লম্বা মেয়ে সুখি সবাইকে সুখি করে, শান্তি দিয়ে, সবার অলখে নিম গাছের পাশের ছোট্ট জানালাঅলা ছোট্ট ঘরে অনাদিকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে।