অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম
আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘লিভিং রুম’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১
কাজের জন্য লিনাকে রওনা দিতে হয় ভোর ৫টায়। তাই ওকে উঠতে হয় ঠিক ৪টা ২০ এ। মিনিট চল্লিশেক লাগে রেডি হতে। ছেলে আর মেয়েটাকে কাপড় চোপড় পরিয়ে দেয় তখনি। যদিও ওরা তখন গভীর ঘুমে থাকে, ছেলেটা পড়ে গ্রেড ওয়ানে আর মেয়েটা কিন্ডারগার্টেনে। কিচ্ছু করার নাই, কারণ ওর স্বামী লিটন ঘুম থেকে সাড়ে ৫টায় উঠে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় কাজের জন্য, সাথে করে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে দিয়ে যায় বেবি সিটারের বাসায়। পাকিস্তানি মহিলা বেবি সিটার। ওদেরকে ওখানে রেখে চলে যায় লিটন কাজে। এই হলো ওদের প্রবাস জীবন।
প্রতিদিনের মতো একদিন লিনা বাচ্চা দুটোকে রেডি করে দিয়ে ভোর ৫টায় বেরিয়ে যায় কাজে। লিটন উঠে পড়ে সাড়ে ৫টায় এবং ২০ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বাচ্চাদুটোকে কাঁচা ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে রওনা দিয়ে দেয় পাকিস্তানি বেবি সিটারের বাসার দিকে। ওরা ঘুমের মধ্যেই উঠে বসে বাবার গাড়িতে, তবে বেবি সিটারের বাসায় পৌঁছানো মাত্র ওদের চোখ থেকে ঘুম একেবারে উবে যায়, ওরা টান টান হয়ে ওঠে। ওদেরকে ওখানে রেখে লিটন চলে যায় কাজে।
ওদিকে লিনা অফিসে গিয়ে দেখে, সেদিন কাজ খুবই স্লো। ম্যানেজার ওকে চলে যেতে বলে। ২০ মিনিটও থাকতে পারেনি কাজে। ও আর কী করবে, বাসায় রওনা দিয়ে দেয়। সাধারণত প্রতিদিন বেবি সিটার সাড়ে ৮টায় অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে লিনার বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসে। যেহেতু সকাল ৭টা বাজে মাত্র, ও মনে মনে ভাবে, বাচ্চাদুটোকে বেবি সিটারের বাসা থেকে নিয়ে বাসায় চলে যাবে। আজ আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই, আজ ওরা বুকে বুকে থাকুক।
শীত আসে আসে করছে, সকাল ৭টায়ও চারদিকে কেমন অন্ধকার। লিনা বাস থেকে নেমে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে বেবি সিটারের বাসার দিকে। কিছু বাসার সামনে এখনও পড়ে আছে লাল হয়ে যাওয়া শুকনো পাতা। কিছু উড়ে উড়ে যাচ্ছে এদিক সেদিন শীতের বাতাসে। ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো ক্লান্তিহীনভাবে এখনও জ্বলে আছে। নেইবারহুডে কোনো লোকজন নেই, মাঝে মাঝে হুশ করে চলে যাচ্ছে অফিসে যাওয়া গাড়িগুলো, তাও তেমন ঘন ঘন নয়। লিনার মনটা শুধু পড়ে আছে ছোট্ট বাচ্চা দুটোর কাছে, কখন দেখবে ওদের। আজ ওর কেন যেন এলোমেলো ভাবনা আসতে থাকে মনে, ভাবতে থাকে, কি বা তেমন ইনকাম হয় এই চাকরিটা করে। এটা না করলে কি হয়? হয়তো আটশো টাকা কম আসবে, তাতে কি, স্বামী যা আনে ঘরে, তা দিয়ে চলে যাবে কোনরকমে। ভাবতে ভাবতে ও পা চালায় আরেকটু জোরে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বেবি সিটারের বাসাটা। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ডে চলে আসে লিনা।
এখনও জ্বলে আছে সামনের ল্যামপোস্টের আলোটা। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছে বাড়িটা এখনও গভীর ঘুমে। কোনো জনপ্রাণী এখনও জেগে ওঠেনি। ধীরে ধীরে ও এগিয়ে গিয়ে বাংলোটার এক চিলতে বারান্দায় ওঠে এবং দরজায় নক করতে উদ্যত হয়। দরজার হ্যান্ডেলে হাত দেয়া মাত্র দরজাটা ইঞ্চি খানেক খুলে যায়। ও বুঝে যায়, দরজাটা খোলা। ও খুব সমর্পণে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে যায়। প্রথমেই লিভিং রুম, পাশে কিচেন। লিভিং রুমটায় একটা বড় সোফা আর একটা লাভসিট, সামনে একটা কাঁচের সেন্টার টেবিল। বাসার সামনের বারান্দার সাথে একটা বড় কাঁচের জানালা, পরদাগুলো দুই সাইডে সুতো দিয়ে বাঁধা। একপাশের দেয়ালে একটা হাচ এবং হাচের ভিতরে কাঁচ ও ক্রিস্টলের গ্লাস, পেয়ালা, শো পিস। ঘরে কোনো টেলিভিশন নাই, বেবি সিটার গোড়া হওয়ায় এবং বেহেশত মিস না করার কারণে বাসায় টিভি কেনেনি। লিভিং রুমটা অন্ধকার, কোনো লাইট জ্বালানো নেই। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের কিয়দংশ হলদেটে দুর্বল আলো এসে লিভিং রুমটার মেঝেতে পড়েছে। ওই আলোয় রুমের ভিতর একটা আলোআঁধারির খেলা, ঠিক মতো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিনা সবকিছু পরখ করে দেখছে কারণ, ওর চোখ দুটো খুঁজে ফিরছে ওর প্রাণের স্পন্দনদুটোকে। প্রথম দেখায় ও কিছুই দেখতে পায় না। পরক্ষণেই দুইজোড়া জ্বলজ্বলে ধারালো তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি ওর দৃষ্টিকে তীরবিদ্ধ করে। হ্যাঁ, ওর সোনার টুকরা দুটো সোফায় খুব লক্ষ্মী হয়ে বসে আছে। সারা ঘর অন্ধকার, সামনে কোনো টিভি নাই, বাসার সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওরা দুটি প্রাণী শুধু জেগে লক্ষ্মী সোনার মতো সোফায় বসে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে আছে। হয়তো আরও ঘণ্টা খানেক ওদের বসে থাকতে হতো বেবি সিটার ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত। ওদের হয়তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এভাবে একা একা বসে থাকার। ওরা হয়তো বুঝে গিয়েছে, সবাই ঘুমাবে আর ওরা শুধু লিভিং রুমে একা একা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। কোনো শব্দ করা যাবে না যাতে বেবি সিটারের ঘুমে ডিস্টার্ব না হয়। লিনার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, কোনোদিনও সোনা দুইটা ওকে বলে নাই যে কিভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নীরবে জেগে বসে থাকতে হয়।
অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে, তবুও লিনার মন থেকে এখনও ওদের একা অন্ধকারে চুপচাপ লক্ষ্মী হয়ে বসে থাকার স্মৃতি মুছে যায় নাই। ছেলেমেয়ে দুটো বড় হয়ে গিয়েছে। ওরা খুব চুপচাপ থাকে, বোঝাই যায় না যে, বাসায় কোনো মানুষ আছে। লিনার নিজের কাছে নিজেকে দোষী মনে হয়, ও ভাবে হয়তো পাকিস্তানি বেবি সিটারের কাছে শেখা চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাসটা এখনও যায় নাই ওদের। লিনার এত ইচ্ছা করে ওরা কথা বলুক, ওরা চিৎকার করে ঘর ভরে রাখুক, দৌড়ে এসে ওর বুকে ঝাপিয়ে পড়ুক। কিন্তু ওরা চিৎকার করে না কিংবা দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে ওর বুকে পড়ে বলে না, মা, আমাদের ওই বাসার লিভিং রুমে অন্ধকারের মধ্যে একা একা ফেলে কেন যেতে? আমাদের ভালো লাগতো না।