আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘মুক্তিযুদ্ধ’
পর্ব ১
প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০১৯
১৯৭১ সাল। আমরা থাকি পুরান ঢাকার ১৩৬/২ হাজী ওসমান গনি রোডে। জায়গাটাকে আলু বাজারও বলা হতো। গুলিস্থান থেকে খুবই কাছে ছিল আমাদের বাসাটা। মাত্র চারানা রিকশা ভাড়া। মাঝে মাঝে রিক্সাওয়ালারা ছয়আনাও নিতো। আমাদের বাসাটা ছিল একতলা, পাশাপাশি তিনটা রুম। রুমগুলির সামনে ছোট্ট একটা বারান্দা। বারান্দার সামনে একপাশে ছোট্ট একটা উঠোন এবং তার পাশেই রান্নাঘরটা। ওই ছোট্ট উঠোনের পাশের দেয়াল ঘেঁষে একটা বাঁশের মই। ওই মই বেয়েই ছাদে যেতে হতো। ছাদটা আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা ছিল। দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমার ছাদে কাটতো। ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে খুব ভালো লাগতো। ইচ্ছা করতো পাখিদের সাথে উড়ে যেতে। আমরা চার ভাইবোন ছিলাম। আমি সবার ছোট। আমাকে ওরা চোখে চোখে ঠিকমতো রাখতে পারতো না। তাই একধরনের ইচ্ছামতো চলার হ্যাবিট ছোটবেলা থেকে। স্বাধীনতা ছিল চরম এক পাওয়া আমার জীবনে। যেখানে ইচ্ছা চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছোটকাল থেকেই। বাধা পেলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত।
আমাদের পিছনের বাসাতে জহুর সাহেব থাকতেন। ওনারা বিহারী ছিলেন। উনি ভীষণ বদমেজাজি। সবার সাথেই খারাপ ব্যবহার করেন। আম্মার কাছে শুনেছি, উনি মদ খান। ছোটকালে মদ যারা খায় তাদের খুব খারাপ মানুষ হিসাবে জানতাম। তাই জহুর সাহেবও একজন খারাপ মানুষ। এছাড়াও পিছনের দোতলা বাসায় থাকতো শামা নামের একটা মেয়ে, ওর ভাই ও মা বাবা। মেয়েটা অনেক বড় ছিল আমার চাইতে। আমার বড় ভাইয়ের বয়সী হবে। ওরাও বিহারী ছিল। আমাদের ওই ছোট্ট গলিটার মধ্যে ছয়টা বাড়ি ছিল এবং তারমধ্যে চার ঘর বাঙালি ও দুই ঘর বিহারী। সবাই খুব মিলেমিশে থাকতাম। আমাদের পাশে রুমা সীমাদের বাসা। তার পিছনে কোহিনুরদের বাসা। কোহিনুরদের দোতলায় থাকতো লিয়াকতরা। লিয়াকতদের টেইলোরিং শপ ছিল। ওরা কোলকাতার মেটিয়াব্রুজের লোক বলে শুনেছিলাম।
খুবই সহজ সরল জীবন ছিল। আমার বোন ঘোড়াগাড়িতে করে স্কুল যেত। আমি আমার আম্মার সাথে প্রায়ই সিনেমা দেখতে যেতাম গুলিস্থান বা স্টারে। সিনেমাকে তখন সবাই বই বলতো। আবার উল্লেখ করা হতো কত রিলের বই। কমপক্ষে ১৬ রিলের বই হলে সবাই খুশি হতো। সিনেমা হলে ঢুকে বাদাম খাওয়া একটা সাধারণ বিষয় ছিল। মাঝে মাঝে আলুর চিপস খেতাম। ছোটবেলায় বেশি দুঃখের বই ভালো লাগতো না। আম্মা দেখতো কিন্তু আমার খুব বোর লাগতো।
একবারের কথা মনে পড়ে, স্বাধীনতা সংগ্রামের পরের ঘটনা, তখন আমি বেশ বড় হয়ে গিয়েছি, ক্লাস ফাইভে পড়ি। মধুমিতায় বিস্তর ছবি দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। সব সময় ইংরেজি সিনেমাগুলি দেখতাম। তখন ইংরেজি ছবি দেখার খুব নেশা ছিল। একদিন একটা ইংরেজি সিনেমা দেখবো মধুমিতায়। রেয়ার স্টলের টিকেট কিনেছি সাড়ে চার টাকা দিয়ে। হলে ঢুকলাম। হল একটু ফাঁকা ফাঁকা। কাটিং দেখানো শুরু হলো। কাটিং মানে মূল ছবি শুরু হওয়ার আগে অন্যান্য ছবির অংশবিশেষ দেখানো হতো, এবং সেটাকেই কাটিং বলতো সবাই। একসময় সিনেমা শুরু হলো, দীপ জ্বেলে যাই। আমি দেখছি অনেক ধৈর্য নিয়ে আর মনে মনে ভাবছি বোধহয় কাটিং দেখাচ্ছে। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল তবু কাটিং শেষ হয় না। এর মধ্যে আমি কখন যেন গল্পের মধ্যে ঢুকে গিয়েছি, বুঝতে পারি নাই। খুব মনোযোগ সহকারে ছবি দেখতে থাকলাম। ছবি এক সময় শেষ হলো। খেয়াল করে দেখলাম যে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি। তখনও চোখে পানি। খুব লজ্জা লাগলো। লাইন ধরে যখন হল থেকে বের হচ্ছি। পরের শোতে হলে ঢোকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলির দৃষ্টি থেকে মুখটাকে লুকাতে শুরু করে দিলাম, কারণ কানতে কানতে চোখ ফুলে ঢোল এবং ওই মুখ আমি ওদেরকে দেখাতে চাচ্ছি না। ফুটপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুধু নায়িকাকে মনে হতে থাকলো। নায়িকা সত্যিকারের পাগল হয়ে যায়, ওটা দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। এরপর থেকে আগে কনফার্ম হোতাম ছবি ইংরেজি না বাংলা কারণ পয়সা খরচ করে আমি কাঁদতে রাজি না। এমনি বাসায় ভাইদের অত্যাচারে কাঁদতে হতো, তার ওপর আবার সিনেমা দেখে কান্না? না তা হয় না।
২৫ মার্চ, ১৯৭১। দুপুর থেকেই আব্বা ও আম্মা, দুজনই একটু অন্য মনস্ক। কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করতে থাকি। ওনারা কী যেন বলাবলি করছেন গোপনে। আমি ঠিকমতো বুঝতে পারছি না। আমার বোঝার মাত্রা একটু কম ছিল ছোট বয়সের কারণে। সন্ধে হওয়ার সাথে সাথে মনে হলো, আমাদের বাসার দক্ষিণ দিকের আকাশটা লাল হয়ে গিয়েছে। ওদিকটায় বাবুবাজার ও নয়াবাজার। ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আমার বড় ভাইরা সবাই ছাদে উঠে গেল, সাথে আমিও। ছাদে উঠে দেখি, সব ছাদেই কিছু কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। বাবুবাজারের ওইদিকটার আকাশ একেবারে লাল। অনেক মানুষই ছাদে উঠেছে। তবে সবাই কেমন যেন একেবারে নিশ্চুপ। আমি বুঝতে পারলাম না, কী হচ্ছে। তবে ভয়ংকর কিছু একটা হচ্ছে তা আম্মা আব্বা ও ভাইদের চেহারা দেখেই বুঝলাম। আমারও ভয় লাগতে থাকলো, তবে ভয়টা একেবারে অজানা। বুঝতেই পারছি না ভয়টা কিসের। আব্বা নিচে যেতে ডাকলেন সবাইকে। আমরা নিচে চলে গেলাম। আব্বা আম্মা ভাইদেরসহ আমরা একটা ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সব লাইট অফ করে দেয়া হলো। এবার ভীষণ ভয় লাগলো। সবার কথায় বুঝতে পারলাম, আমরা আর পাকিস্থান চাই না, ওরা আমাদের অনেক অত্যাচার করেছে। শহরের অবস্থা আরও খারাপ হবে। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। রেডিওতে বললো আগামীকাল কারফিউ। কোথাও যাওয়া যাবে না। হয়তো পরশুদিন কারফিউ ছাড়তে পারে। আব্বা বললেন, আমরা প্রথমে হাতিরপুলে শামসুল ভাইদের বাসায় যাব, তারপর ওখান থেকে সুযোগ বুঝে আমাদের গ্রামে রওনা হয়ে যাব। এক রুমের মধ্যে সবাই ঘাপটি মেরে চোরের মতো বসে থাকলাম। কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। এর মধ্যে কখন যেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকালে ঘুম ভাঙলো। সবার কাছে শুনলাম, জহুর সাহেব আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। আগেই বলেছিলাম জহুর সাহেবরা বিহারী। আমাদের সবার খুব ভয় হতে লাগলো। হঠাৎ উনি কেন আমাদের ডেকে পাঠালেন! উনি কী তাহলে আমাদের ধরিয়ে দেবেন? আমরা ওনাদের বাসায় বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি, আমাদের গলির সবাই ওনাদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। শামারাও এসেছে। জহুর সাহেব বললেন, আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। আমার একটা বন্দুক আছে। শামাদেরও একটা বন্দুক আছে। গলির মেইন দরজাটা বন্ধ থাকবে। কেউ খুলবে না। গলির ভিতরে যত ইট পাটকেল আছে সব জড়ো করে ছাদে নিয়ে যান সবাই। সবার বাসায় গরম পানি করার ব্যবস্থা করেন। মেয়েরা বঠি, দাও সব হাতের কাছে রাখেন। কেউ যদি আমাদের দরজার কাছে আসে তাহলে আমরা ছাদ থেকে গুলি করবো। আপনারাও ছাদ থেকে ইট পাটকেল মারবেন। যতগুলি পারবো লাশ ফেলে দিবো। তারপর যদি গলির দরজা ভেঙে ফেলে তাহলে সবাই ইট মারবেন, গরম পানি মারবেন আর আমরা আবারও গুলি করবো। আমার কাছে চার প্যাকেট গুলি আছে, কোনো চিন্তা করবেন না। জান দিয়ে দিবো তবুও কাউকে এই গলিতে ঢুকতে দিবো না। শামার বড় ভাই জিক্কু, ও আমাদের সাহস দিলো, কোনো চিন্তা করতে বারণ করলো। আমরা যারা বাঙালি, তারা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছি।
চলবে