আশিকুজ্জামান টুলুর গল্প ‘ছন্দু’
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৮, ২০২০
সত্তর দশক। বামনা উপজেলার ছনবুনিয়া গ্রামের ছন্দুকে চেনে না এরকম লোক কম আছে ওই তল্লাটে। দুর্ধর্ষ সাহসী সন্ত্রাসী এই ছন্দু। ওর এলাকাসহ আশপাশের দুই-চারটা গ্রামের অধিবাসীরা ওকে খুব ভয় পায়। পুলিশের খাতায় নাম আছে ওর। তবে প্রশাসনে পরিচিত মানুষ থাকায় জেলে যেতে হয় না বড় অপরাধ করেও। ওর সাথে কোনো ব্যাপারে ঝামেলা পাকানোর মতো মানুষ নাই বললেই চলে। তবে দিন সাতেক আগে পাশের গ্রামের কমবয়েসি ছেলে মোতালেব একটা জমি সংক্রান্ত বিষয়ে ওর সাথে বচসায় লিপ্ত হয় এবং বিষয়টা গ্রামের হাটে ঘটে। জনসমক্ষে যখন ছন্দু মোতালেবকে মারতে উদ্যত হয়, মোতালেবও ওকে মারতে এগিয়ে আসে এবং হাতাহাতি হয় দুজনার। পাঁচ গ্রামের কেউ ওর সাথে বিশ বছরে হাতাহাতি তো দূরে থাক, চোখ তুলে কথা বলারও সাহস পায়নি। ফলে সবার সামনে সেদিনের ছোকড়া মোতালেবের এহেনো বেয়াদবি ছন্দুকে ভীষণভাবে অপমানিত করল। ছন্দু রাগে পাগল হয়ে যায় হাটভর্তি মানুষের সামনে নিজের সম্মান খুইয়ে। ছন্দু সবার সামনে শাসায় মোতালেবকে, তোরে আমি খুন করমু মোতালেব, মনে রাখিস।
সবার সামনে বীরদর্পে চলে আসলেও মোতালেব ভিতরে ভিতরে খুব ভয় পেয়ে যায়। কারণ ও জানে, ছন্দু খুব ভয়ংকর মানুষ। দশ গ্রামের সবাই ছন্দুকে ভয় পায়। তবে ওর একটা শক্তি আছে, ওর গ্রামসহ পাশের গ্রামের বেশ কিছু কম বয়সের ছেলেদের নিয়ে ওদের একটা বড়সড় দল আছে, যেটা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধরনের কন্ট্র্যাক্ট মারামারিতে লাঠি বাহিনী হিসাবে ওরা অংশ নিচ্ছে এবং আয় রোজগারও করছে। এই কারণে বয়স্ক ছন্দুকে ওর বেশি ভয় লাগেনি। তবুও মোতালেব ছন্দুর গ্রামে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এভাবে কেটে যায় প্রায় বছর দুয়েক। একসময় এই রেষারেষির কথা মোতালেব ভুলে যায় এবং ছন্দুও মনে রাখে না। যেহেতু কেউ কারও সাত-পাঁচে নেই। এ কারণে রেষারেষি মনে রাখারও আর কোনো কারণ থাকে না।
মোতালেবের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। ওর পরিবার ওর জন্যে মেয়ে দেখছে। পাশের গ্রামের মোকসেদ ঘটক ওর বাবা-মাকে জানায় একটা খুব সুন্দরী মেয়ের খবর। ওই মেয়েটা ছন্দুর ছোট মেয়ে শেফালি। মোতালেবের বাবা-মা মেয়েটার ব্যাপারে উৎসাহ দেখালেও মোতালেব সেরকম কোনো আগ্রহ দেখায় না। তবে ছন্দুর মেয়েকে গতবারের মেলায় দেখে খুব ভালো লেগেছিল ওর। মনে পড়ে যায় বছর দুয়েক আগে ভরা হাটে ছন্দুকে অপমান করার কথা। ওর বাবা-মা ছন্দুকে প্রস্তাব পাঠায় ছেলের বিয়ের জন্য। প্রস্তাব পেয়ে ছন্দু রাজি হয়ে যায়। আসলে বয়স এমন একটা ব্যাপার, যার কাছে হার মানতে হয় সবাইকে। ছন্দু সেই আগের মতো নাই। বয়স বেড়েছে, মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে, এলাকায় প্রভাব কমেছে নতুন তরুণ বাহিনী আসার কারণে। আর তাছাড়া মেয়েটার একটা ভালো বিয়ে দেয়ার জন্যেও ছন্দু একটু চিন্তিতও ছিল। তাই মোতালেবের বাবার প্রস্তাবটা আর ফেলতে পারেনি। ওদের বিয়ে হয়ে যায় ধুমধাম করে। ছন্দু সবার সামনে বুকে জড়িয়ে ধরে মোতালেবকে, মোতালেবও জড়িয়ে ধরে। দুজনের ভুল বোঝাবুঝির শেষ হয়। সেদিন থেকে মোতালেব হয়ে যায় ছন্দুর জামাই।
বিয়ের পর ছয় মাস কেটে যায়। কিন্তু মোতালেব বউ নিয়ে ছন্দুর বাসায় আসে না। ওদিকে ছন্দুর মেয়ে সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। ছন্দু পাগল হয়ে যায় মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু শেফালি আসতে পারে না বাপের বাড়ি। ছন্দু বুঝে যায় যে, মোতালেব আসতে দিচ্ছে না শেফালিকে। ছন্দু ওদের সুখের দিকে তাকিয়ে এ নিয়ে আর কোনো কিছু বলে না। চুপচাপ হয়ে যায়। মোতালেবের বাসায় ঘটনাটা উল্টো ঘটে। অর্থাৎ ওর কোনো অসুবিধা নাই শেফালিকে বাপের বাড়ি যেতে দিতে এবং শেফালির সাথে ও নিজেও শ্বশুর বাড়ি যেতে প্রস্তুত। কিন্তু শেফালি নিজেই যেতে দেয় না জামাইকে বাপের বাড়ি। জামাই জানতে চায়, কেন দিচ্ছ না যেতে? শেফালি শুধু বলে, আমার ভয় লাগে। যদি আব্বা আপনারে অপমান করে অথবা কিছু বলে।
মোতালেব ওকে বোঝায়, অপমান মোটেই করবে না না। আর করলেও সে সহ্য করে নেবে। মেয়ের জামাইকে আর কতই বা অপমান করবে! আর এত আগের কথা ওনার মনে থাকার কথা না। বিয়ের আগে মোতালেব শশুরের কাছে মাফও চেয়ে নিয়েছে। সুতরাং অপমান করার প্রশ্নই আসে না। এতকিছু বলার পরেও শেফালি যেতে রাজি হয় না বাপের বাড়ি।
দেখতে দেখতে সাত বছর কেটে যায়। শেফালির ঘরে দুই বাচ্চা হয়। একটা ছয় বছর, আরেকটা সাড়ে চার বছর। আজ অবধি ও স্বামীসহ বাপের বাড়ি যায়নি। ওদিকে ছন্দু মিয়ার বয়স হয়ে গেছে। আগের মতো ঘোরাঘুরি আর করে না। বেশির ভাগ সময় বাসায় বসেই কাটে। শেফালি খবর পায়, বাপের শরীরটা বেশি ভালো না। ওর মন আনচান করে ওঠে। ওর যেতে ইচ্ছা করে বাপকে দেখতে। ও আর পারে না না দেখে থাকতে বাবাকে। যদি বাবা মরে যায় তাহলে আর কোনোদিন দেখা হবে না। মোতালেবকে বলামাত্র সে রাজি হয়ে যায়। পরের দিন ওরা রওনা দেয়।
ছন্দুর বেশ বয়স হয়ে গেছে। ওদেরকে দেখে খুশিতে পাগল হয়ে যায় ছন্দু। এই প্রথম ও ওর নাতিদের দেখছে। বিছানায় শুয়ে থাকা ছন্দু উঠে বসে, ওদের দেখে ওর অসুস্থতা অর্ধেকটা ভালো হয়ে যায়। নাতি দুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, আদর করে মেয়েকে আর মেয়ের জামাই মোতালেবকে। চোখের জলে ভেসে যায় ছন্দু, কতবছর পর ওর ঘরে চাঁদের আলোর বন্যা বইছে। ওদের প্রথমবারের মতো আসা উপলক্ষে খাসি জবাই দেয়া হয়। বিরাট রান্নার ব্যবস্থা করা হয়। বাচ্চাদুটো সারা আঙিনায় খেলে বেড়ায়। শেফালি নিজের বাড়িতে এতগুলো বছর পরে আসতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মোতালেবের খুব ভালো লাগে। শ্বশুর বাড়ির সবাই ওকে ভীষণ আদর করে। ওরা সাবাই মিলে ছন্দুর ঘরে বসেই খাওয়া দাওয়া করে। ছন্দু অসম্ভব খুশি হয় এত অসুস্থতার মধ্যেও। ওরা কয়েকটা দিন থাকার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। তাই ওদের জন্য আলাদা একটা ঘর বরাদ্দ করা হয়। ওরা রাতে খেয়েদেয়ে গল্পগুজব করে ওদের ঘরে চলে যায় অসুস্থ ছন্দুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে। নয়-দশ বছরের অযথা ভুল বোঝাবুঝির সমাপ্তি হয় সেদিন।
শেফালির মনে শান্তি নেমে আসে। স্বামীকে নিয়ে প্রথমবারের মতো বাবার বাড়িতে এসে ওর বুকটা ভরে গেছে। আজ মা বেঁচে থাকলে কী আদরটাই না করতো ওর স্বামীকে আর বাচ্চা দুটোকে। সাতসতের ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে শেফালি। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে শেফালির কপালে পড়ে। টানা টানা চোখের শেফালিকে দেখা যায় প্রশান্তির ঘুম দিতে। গভীর রাতে হঠাৎ বিকট এক চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় শেফালির। ও ধড়ফড় উঠে বসে। ঘুমের ঘোর কোনোরকমে কাটিয়ে পাশে ঘুরেই দেখতে পায়, মোতালেব কেমন যেন গোঙাচ্ছে। ও সাথে সাথে মোতালেবের গায়ে হাত দিয়ে বলে, কি হইছে? কি হইছে আপনার? কি হইছে কন...
মোতালেবের শুধু গোঙাতেই থাকে। শেফালি বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে। ওর হাত ভিজে গেছে, ও ভয় পেয়ে যায়। সাথে সাথে ও উঠে বসে হেরিকেনের আঁচ বাড়িয়ে দেয়। আলো ভরে যায় ঘরটায়, মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে ওঠে শেফালি আব্বা বলে। ও দেখতে পায়, ছন্দু ঠিক মোতালেবের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। হাতে বিরাট একটা রামদা। ওদিকে মোতালেবের ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে বিছানাতেই পড়ে আছে এবং সারা বিছানাসহ মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তখনও মাথাবিহীন ধড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। শেফালি চিৎকার করে বলে ওঠে, আব্বা আপনি এইটা কি করলেন, ওরে মাইরা ফেললেন, আমি এই জন্যেই আসতে দেই নাই সাত বছর...
ছন্দু বলে ওঠে, আমি ওরে কইছিলাম খুন করমু, ও মনে রাখে নাই, ভুইলা গেছিল, আমি ভুলি নাই।
রাত আরও গভীর হয়। প্রায় ভোরের দিকে পুলিশ আসে বামনা উপজেলার ছনবুনিয়া গ্রামের ছন্দুর বাড়িতে। তারপরে কি হয়েছিল সেটা কেউ আর জানে না।