আশিকুজ্জামান টুলুর খুদে গল্প

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৮

ডিস্কো ড্যান্সার

বেশ বহু বছর আগে এক ছেলে এলো আমার কাছে। তখন আমি ব্যান্ডদল ‘চাইম’ এ  ছিলাম । ছেলেটা এসে বললো, টুলু ভাই, আমি ভালো গান গাইতে পারি, আমাকে আপনার ব্যান্ডে ভর্তি করে নেন।
মনে মনে ভাবলাম, ব্যান্ড কি ই-হক কোচিং সেন্টার যে ভর্তি করে নেব? আমি বললাম, গাও তো একটা গান।
ও গান ধরলো, আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার...
তাও আবার ভারনিয়ার স্কেলে অর্থাৎ স্কেলের কোনো আগামাথা নাই । মুখ এক জায়গায় গায় তো অন্তরা আরেক জায়গায়। পরে অবশ্য ওই ডিস্কো ড্যান্সারকে আর আমাদের ব্যান্ডে ভর্তি করতে পারিনি ওর ড্যান্স দেখে।

উপদেষ্টা

৯০ দশক। এক ব্যাণ্ডের ছবিতে দেখলাম, বিশাল দাড়িঅলা একজন বেশ বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক। কালো সার্ট, জিন্সের প্যান্ট পরা একদল ইয়াং ব্যান্ড মেম্বারদের ব্যান্ডের ছবিতে ওরকম দাড়িঅলা একজনকে দেখে আমার খুব জানতে ইচ্ছা করলো, উনি কে। স্বভাবতই সবার জানতে ইচ্ছা করবে যে, সব ইয়াং ছেলেদের মধ্যে ওরকম শ্বেত শুভ্র লম্বা দাড়িঅলা পাঞ্জাবি পরিহিত বয়োজ্যেষ্ঠ পীর বংশের চেহারার অধিকারী এই মুরুব্বি কে?

ওদের সাথে যেদিন আমার দেখা হলো, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের সাথে ওই ভদ্রলোক কে?
ওরা বলল, কার কথা বলছেন? আমাদের ম্যানেজার?
আমি বললাম, উনি তোমাদের ম্যানেজার? তো অতবড় দাড়িঅলা ম্যানেজার রাখার কারণ কি?
ওরা বলল, ও, এবার বুঝেছি, না না ভাই উনি ম্যানেজার না, উনি আমাদের উপদেষ্টা।
আমি বললাম, বলো কি! তোমাদের আবার উপদেষ্টাও আছে এবং তাকে তোমরা ব্যান্ডের ক্যাসেট কভারেও জায়গা দিয়েছ? আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো তোমাদের ড্রামার বা গিটারিস্টের আব্বা হবেন উনি।
ওরা বলল, না ভাই, উনি খুবই আলেম লোক এবং বুদ্ধিমান। ওনার উপদেশ মতোই আমরা চলি।
আমি বললাম, বাহ, তোমরা অনেক লাকি, তোমাদের একজন ম্যানেজার, একজন উপদেষ্টা, একজন রোডি, একজন পিওন, কতকিছু আছে, আর আমাদের সব কাজ আমাকেই করতে হয়। কাউকে দায়িত্ব দিলেই বলে, টুলুভাই, আজকে সিরিয়াস ক্লাস আছে, কালকে পরীক্ষা।
যাই হোক, পরের এলবামের ছবিতে যখন দেখলাম ওই উপদেষ্টা ভদ্রলোক আর নাই, তখন বুঝতে পারলাম ব্যান্ড আর ওনার উপদেশ মানছেনা, বেয়াদবি করে ওনারে বাদ দিয়া দিছে অথবা উপদেষ্টা ভদ্রলোক বিনা বেতনে বেশিদিন আর থাকতে পারে নাই।

মাইডিয়ার ফিরোজ সাঁই

মরহুম ফিরোজ সাঁই ছিলেন অসম্ভব প্রাণখোলা স্বভাবের একজন মানুষ। মুখে সদা হাসি লেগে থাকতো, সবাইকে প্রাণবন্ত রাখার কি এক জাদু যেন উনি জানতেন। ওনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই হতো আনন্দের প্রত্যেকটা মানুষের জন্য।

উনি প্রথম আমাকে সাউণ্ডটেকের কর্ণধার বাবুল সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ওনার একটা সোলো এ্যালবাম আমি করি সাউন্ডটেকে, যেটা আমার প্রথম এ্যালবাম ছিল সাউন্ডটেকের ব্যানারে। ফিরোজ ভাই শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। ওনার অফিসরুম সারাক্ষণ কোনো না কোনো শিল্পী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতো। শিল্পকলা একাডেমির কথা বলতে গেলে আরও কয়েকটা নাম সভাবতই চলে আসে, যারা প্রচণ্ড মজার মানুষ ছিলেন, যেমন মিনু ভাই, জিন্নাহ ভাই, সহিদ ভাই, জামান ভাই, শফি কামাল ভাই। মিনু ভাইয়ের কাছ থেকেই নিচের ঘটনাটা শোনা।

একবার এক লোক বিদেশ থেকে এলো ফিরোজ ভাইয়ের কাছে এক প্রোগ্রামের কন্ট্রাক্ট নিয়ে। লোকটা ফিরোজ ভাইয়ের রুমে বসে শুধু বড় বড় কথা বলে যেতে থাকলো, ‘আমি সাবিনা ইয়াসমিনকে দশবার নিছি লন্ডনে। আমি ফকির আলমগিররে পরিচিত করছি সবার সাথে। আমি কালচারাল সেক্রেটারির তালাতো ভাই, আমি বাংলাদেশের সঙ্গীতে বিরাট অবদান রাখছি, আমি একদিনে সবার ভিসা করায় দিতে পারি, আমার হাত ধরে অনেক শিল্পী আজ আলোর মুখ দেখছে... ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরই মধ্যে এক গিটারিস্ট এসে ফিরোজ ভাইয়ের রুমে ঢুকে ফিরোজ ভাইয়ের পাসের চেয়ারে বসেছে। তখনও ওই লোক আকাশ কুসুম চাপা মেরে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়, কাউকে কিচ্ছু বলতে দিচ্ছে না, ইভেন ফিরোজ ভাইকেও কিচ্ছু বলতে দিচ্ছে না। সবার বাধ্য হয়ে ওনার চাপাবাজি শুনতে হচ্ছে। ওনার বড় বড় কথা শুনতে শুনতে একসময় গিটারিস্ট ফিরোজ ভাইকে একটু নিচু গলায় কানের কাছে গিয়ে জানতে চাইলো, ফিরোজ ভাই, ওনার নাম কি?
ফিরোজ ভাই একটু বিরক্তি নিয়ে এবং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক চেহারা করে বেশ জোরেই বলে উঠলেন, ওনার নাম আমার চাইতে বেশি বোঝে। গিটারিস্ট কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটু হতবিহব্বল হয়ে পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠলো। ওই লোকের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই, তখনও বলে যাচ্ছে, আমি তো পিলু মমতাজকে প্রথম লিফট দিছি। আমি তো বাংলাদেশের প্রথম অরগানাইজার যে লন্ডনে প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান করছে। আমি তো... বক বক বক বক...