চিত্রকর্ম: মকবুল ফিদা হুসেন
আশরাফ রোকনের পাঁচটি কবিতা
প্রকাশিত : আগস্ট ৩১, ২০২০
ফয়েল
নিতান্তই রূপোর ফয়েল যার তলায় জগতের সকল আগুন,
তবু একটুও পুড়বে না; ছিদ্রও হবে না, ঢালাই করে রেখে দেয়া
সুগোল বিম্বের দিকে তাকিয়ে ওড়া দুঃখের ধোঁয়ায়,
বাষ্পেই আজ মিশে গেলো চকচকে
সোনার অস্তিত্বে কালসিটে কোনো দাগের মতো,
রেখার মতোই চিরায়ত হয়ে মৃত্যুচিহ্নাদি রইলো জেগে,
আর হিয়ায় জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের গায়েই লিখে রাখা
বিগত জন্মের স্মৃতিতাড়িত বাতাস:
কিছুটা নিদ্রা ভেঙে সপ্রতিভ হয়ে উঠলো,
নিশিপেঁচার মতো চিৎকারে কোঁকানিতে ভার করে তুললো
পড়শির পারুল, চম্পার সৌরভ থেকে বিচ্ছিন্ন
আরও কতক রোদেলা সকাল দেখার প্রত্যাশাতে অনিবার
জেগে জেগে রুপোর ফয়েল, জগতের সব আগুন নিয়ে বুকে
গোপনে দুঃখ দুঃখ খেলে অগাধ,
গভীর অন্ধকারের সাথেই সারাক্ষণ,
যতক্ষণ পুড়বে না; ছিদ্রও হবে না বরাবর
একসুতো পরিমাণও হবে না নড়চড়
চলতে চলতে থেমে যাওয়ার আগে
কখনও মাঝপথে এসে যে-দিন ফুরিয়ে নিঃশ্বাস
শেষ হবে গোল সে বিম্বের প্রতিবিম্ব পর্যন্ত থাকবে না,
আগরকাঠের অসামান্য সুগন্ধটুকু ছাড়া কিছু আর!
হাওড়
জন্মে সিন্ধু ছিলাম, সমুদ্র ছিলাম,
পড়শি নদনদীর মেয়েরা বলতো
সাগর, আর দূরবর্তীরা সব সায়র;
বোধ করি জলদেবতার অভিশাপে
গভীরতা হারিয়ে একদা ধীরে ধীরে
মুছে গিয়ে বিশালত্ব হাওড় হলাম:
গ্রীষ্মের নিদাঘে পোড়া মন নিয়ে
শুকিয়ে মরা ঘাসমাঠের কান্না হই,
বর্ষার পাহাড়ি ঢলের অবাধ জলে
ভাসে অন্তরে পালতোলা পানসি নাও
শরতে ছায়া ফেলে জলের আয়নায়
আকাশ তার মুখ দেখে আমার বুকে:
হেমন্তেও ছুটি নেই কুয়াশার স্রোতে
চোখ মেলে শীতের আগমনের পথে
অতিথি পাখিদের পালকে ছেয়ে যায়
তখন সমস্ত দেহজুড়ে পলিময়
মাটিতে বালিহাঁসের পদচিহ্ন জুড়ে
জেগে ওঠা কাঁচা কাঁচা ধানগাছ যেন
কোনো সবুজ সমুদ্রেরই প্রতিরূপ;
শ্যামলিম প্রতিবেশ এক ছেয়ে থাকে
অফুরান অবসর আমার বসন্তে
পেকে ওঠা অবধি বোরো ধানক্ষেতের!
আনন্দধাম
এ.এম আহমেদ কায়সার সুজনেষু
পৃথিবী কোনো আনন্দধাম
আমরা সব আনন্দ শাস্ত্রী,
আনন্দ-নৃত্যগীতেই রোজ
নেচে গেয়ে উঠোন মাতাই
পরস্পরে গলাগলি করে
ক্রন্দনে মালামে একাকার
হাওড়ের ঢেউ স্ফীতাকার
উথলে উঠে মরমে নিত্য:
আমাদের নেই দুঃখ নেই
সাদা সহজ সরল মনে,
আঁধার ও ছায়া নেই কোনো
কেবল আলোকের ইশারা:
পৃথিবী কোনো আনন্দধাম
আমরা সব আনন্দ শাস্ত্রী!
পরিত্রাণ
ফুল ঝরে, কাঁটা ঝরে না কখনো
অমৃতের চারুপদে চিরকাল ফুলেরাই শ্রেষ্ঠত্ব পায়
কাঁটারাতো বেঁচে থেকেও মৃতের সমান
ফুল দিয়ে গাঁথা হয় মালা ফু্লেই হয় বরণ
ফুল নিয়ে ফুলগাথা ফুলের আঘাতেই মরণ
ফুল সে ফুলই থাকে বিশ্বাসের তরু জুড়ে
কাঁটাগুলোর সামান্যও হয় না পরিবর্তন
পারিজাত না হলেও গন্ধবহ অত
শ্বাশত বেদনার অনুষঙ্গ কিন্তু কাঁটা নয়,
ফুলের বুকে রেখে চলে যাব একদিন
এছাড়া জানি পরিত্রাণ পাবে না এই হৃদয়।
যদি আকাশ না থাকতো
যদি আকাশ না থাকতো আমাদের,
তাহলে আর থাকতো কি!
হয়তো-বা থাকতো একটা মাথা কেবল,
মাথার উপরে কোনো ভরসা থাকতো না,
রইতো না মেঘের আলিঙ্গন, বৃষ্টির দেমাগে
ভেসে যাওয়া জ্যৈষ্ঠের হাওড়ে হতো না
জ্যান্ত জিওলের মুখে কাঁচা দূর্বাঘাস দেখে শিউরে ওঠা!
জলের পিঠে চড়ে উজান বেয়ে উঠা ঘনিষ্ঠ তাকিয়ে
শামুকের স্ফীত, কালচে মাংসপিণ্ড দেখা হতো না কোনোদিন!
ঘনিয়ে আসতো আঁধার, সূর্যতারানক্ষত্ররাজির
নিজস্ব একটা সামান্য সিঁড়িঘরও থাকতো না উঠে দাঁড়ানোর!
বাতাসের ডানাগুলিও হতো না অত বিস্তৃত, সর্বমুখী;
বৃক্ষদের মাথাও আমাদের মাথার মতোই ন্যুব্জ চেতনারহিত থাকতো
হতো না পরিবর্তন আসতো না বসন্ত, বর্ষার
অনন্তের সৌন্দর্য হারাতো ঋতুগুলি;
আর খোলসবিহীন একফালি
সাদা গোল চিংড়ি মাছের মতো
মনে হতো পৃথিবীকে তখন!