‘আলোয় অন্ধ শহর’ ও কিছু ভাবনা

দিবাকর মজুমদার

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০২০

অনুরোধে ঢেঁকি গিললেও গিলে ফেলতে পারি, কিন্তু অনুরোধে বই কেনার অভ্যাস আমার নেই। এটা কেমন এক নিষ্ঠুরতা আমার! শুভ্র ভাই যদি সাইন্স ফিকশান না লিখতেন বইটা বোধহয় আমি কিনতাম না। কিন্তু কিনে যে গভীরতর লাভ হলো, তা লিখে জানানোর একটা ইচ্ছা অনুভব করছি। ইচ্ছা যে একটা শারীরিক বিষয় তা টের পাই তখনি যখন না লিখে শরীরে শান্তি পাই না। এখন বইয়ের প্রসঙ্গে আসি। অনেক দিন ধরে ফেন্টাসি, থ্রিলার, হরর ধাঁচের কৈশরিক বই ছাড়া সিরিয়াস সাহিত্য পড়তে আমার মুড হয় না। প্রথমে কবিতা, এরপর সিরিয়াস উপন্যাস আস্তে আস্তে এইসব ভালো জিনিসের থেকে আমার রুচি উঠে যাচ্ছে। এর কোনো নিদান খুঁজি না। সেলিম মোরশেদের একটা গল্পে পড়েছিলাম, সুব্রত সেনগুপ্ত নামের একটা ছেলে কবিতা পড়া ছেড়ে দিয়েছে বা কবিতা পড়ে না বা পড়ে কিছু অনুভব হয় না, কারণ জীবনের যে দ্বান্দ্বিকতা সেটার সাথে তার সম্পর্ক কেটে গেছে। আর এজন্য তার জীবনের প্রতি কোনো টান নেই, সুইসাইড করে ফেলাই তার জন্য মানানসই। তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো বা বলা চলে আকাঙ্ক্ষা যে, এই দ্বান্দ্বিকতা কখনো একেবারে চলে যায় না। যায় আবার আসে। কখনো আসি আসি করেও আসে না। কখনো আচমকা এসে হাজির। তো উনার উপন্যাসটা শুরু করেছিলাম এক ধরনের উন্নাসিক মন নিয়ে, কারণ বাংলা ভাষায় থ্রিলড হওয়ার মতো সাইন্স ফিকশান কেউ কি লিখে ফেলবে এটা সহজ ঘটনা না। পরিচিতদের মধ্য থেকে কাউকে পুরোদস্তুর লেখক হিসাবে মেনে নিতে মন চায় না। সম্ভবত সূক্ষ্ম একধরনের ঈর্ষা কাজ করে। লেখক হয়ে উঠলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখে ফেলবেন, তা মানতে আরো কষ্ট হয়। তাই পড়তে শুরু করেই কিছুটা ঝাঁকুনি লাগলো। সহজ ভ্রমণ নয়। গদ্যের দেহ হেলা করবার মতো নয়। প্রতিটা ছত্রেই তথ্যের বরাদ্দ ন্যায্য যা ফুটে উঠাকে সম্ভব করে, সজীব রাখে। কোনো ফাতরামি নেই। একটা শব্দও অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাজির হয়নি। তরল নয়, বায়বীয় নয় আবার ঠিক কঠিনও নয়, প্লাজমা ধর্মী শরীর, নক্ষত্রের মতো। যেখানে জীবনের আগে জীবনের নির্মাণ হয়!

আর সেখানেই আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। যেই দ্বান্দ্বিকতাকে আমি হারিয়ে ফেলছি বলে মনে হয়েছিল, সেখানে আবার তার দেখা পেলাম। ফেন্টাসির পিনিক কেটে গেল। পুষ্টির আনন্দে সেই প্রশ্ন ও ভাবনাগুলিকে ছড়ানো দেখলাম যেগুলি আমার আন্তরিক। দেড়শ বছর পরের ঢাকার মাঝে আমি খুঁজে পেলাম, আমার ঢাকায় থাকতে না পারার কারণ। সেখানে যেসমস্ত বিভাগ আন্তঃসম্পর্কিত জটিল তাতে আমার কোনো এক্সেজ নেই। প্রবেশপত্র নেই। ওয়ালীউল্লার ‘নয়নচারা’য় যে ঢাকা নবাগতকে করুণা করে না, সেই একই নিষ্ঠুরতায় সে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয় তাদের, যাদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। প্রতিটা এজেন্সি যেন এক একটি সার্বভৌম ধারালো সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করছে অনাগত কোনো যুদ্ধের যোদ্ধা ও হাতিয়ার হিসাবে। এর বাইরে যে বিরাট ভূমি, মানুষ, তাদের কাজ ও ভাবনার তরঙ্গ, ব্যাপ্ত ‘লোক সংস্কৃতি’ এসব কেবল পালন করছে অনিচ্ছুক ফুয়েলের ভূমিকা। বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো যোগাযোগই সম্ভব নয় কেন্দ্রের সাথে প্রান্তের। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ এ ইনভেলিভ হয়ে যেতে থাকা সব চরিত্র ও তৎপরতার মতো আমি ও আমরা। নিজেদের অর্থ হারিয়ে ফেলেছি কেন্দ্রের প্রেক্ষিতে। যতদিন না কেউ আমাদের আবিষ্কার করছে একটা ব্র্যান্ড হিসাবে।

এইসব আসলে উপন্যাসের বিষয়বস্তু নয়, কিন্তু যে অন্ধ হয়ে যাওয়া আলো সেটা বিচ্ছুরিত করছে সেই আলোতে আমি নিজের অবস্থানকে দেখছিলাম। উপন্যাসটির বিষয় মূলত কী? প্রযুক্তি ও পুঁজির অভিজাত চুক্তি! যার দরুণ মানুষের স্বাধীনতা, এমনকি পুরো মানব সভ্যতাই হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল? মানুষ তার জৈবিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন, হয়ে কেবল মগজ। সাইন্স ফিকশানের জন্য এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এই আসন্ন যে আমাদের নিকটেই! ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের শিকার হওয়া মানুষের অনিবার্য নিয়তি, এর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যারা সর্বশেষ প্রাচীন, আমাদের সংরক্ষণ করার মতো কিছুই নেই। ট্র্যাভেলের শরীরে চেপে আমরা যারা রিমেক, তারা এই বৃহৎ দুর্বিসহ বিকশমান অচলায়তনের কাছে ভিডিও গেমের চরিত্র মাত্র। আমরা বাস্তব নই, অর্ধবাস্তব! বাণী বসু ভেবেছিলেন, ‘সাম্রাজ্য হলো সহজ বিকল্প।’ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও একমুখী করার। কিন্তু সেই বিজ্ঞানভিত্তিক সাম্রাজ্যের লক্ষ্যে আমরা কি মানুষকেই হারিয়ে ফেলব? আর এইসব যারা পরিচালনা করবেন, তাদের লক্ষ্যই বা কী? নাকি এশুধু মানব জাতির ধ্বংস হওয়ার নিজস্ব ধরণ মাত্র? জ্ঞানের কাছে আমাদের যে দাবি, তা কি বিজ্ঞান সত্যি পারবে দিতে। নাকি মানুষ কলাপ্স করবে? নাকি মানুষ বিদ্রোহ করবে? সেই বিদ্রোহ ব্র‍্যান্ডেড হয়ে গেলেও?

পুঁজির প্রতি বিজ্ঞানের আজন্ম নির্ভরশীলতার বিচ্ছেদ ঘটানোর কোনো উপায় কি আছে মানুষের ভাবনায়? প্রেম কি একটা শক্তি হয়ে উঠবে? লেখক এইসব প্রশ্ন ও ভাবনা সৃষ্টির কন্ডিশান সৃষ্টি করতে পেরেছেন প্রখর ভাবেই। অন্তত আমার ক্ষেত্রে পেরেছেন। কিন্তু আমার বা আমাদের অবস্থান থেকে কি করার আছে আমাদের? কোনো নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। যাদের হাতে আছে তাদের কাছে আমাদের কোনো এক্সেস নেই। তাদের কাছে আমরা অর্ধবাস্তব। তাদের সাজানো নাটকের অনিচ্ছুক নিরুপায় চরিত্র মাত্র। যারা এক্সেস সৃষ্টি করতে যায় তারা আর ফিরেও আসে না। নিজ নিজ টিকে থাকার প্রয়োজনে তারা হয়ে উঠে ভূমিকা, সঞ্চালক, রাখাল। হয়তো মানুষের জ্ঞান ও সম্ভাবনা নিয়ে এটাই সামগ্রিক ধারণা নয়। মানুষ ওসম্পূর্ণ সমীকরণের মতো অপেক্ষা করছে অন্য কোনো অচেনা রাশির। সেটা কী? সেটা কী লেখক তা জানেন না। আমরাও জানি না। আমি জানি না। সত্যিকার অর্থে মানুষের অভাব হলো জ্ঞানের। যা কেবল বিজ্ঞান নয়। আবার সেটা আধ্যাত্মিক জ্ঞানও নয়। বা হয়তো তাই! যেকারণে গ্লিরা নামের একটা অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন লেখক। যেখানে ঈশ্বরকে রিপ্লেস করেছে মগজ। সেই মগজ নিজেই নিজেকে বয়ান করছে ধর্মগ্রন্থের ভাষায়।

পরিশেষে কী হলো এটা এই উপন্যাসের প্রয়োজনীয় ব্যাপার নয়। যে পরিবেশ সে সৃষ্টি করেছে, তা সম্পর্কে লেখকের কোনো মূল্যায়ণ নেই। ইতিবাচক এমনকি নেতিবাচক কোনো ইশারাও নেই। আসিলে নেতি বলেই কিছু নেই। এমনটা ঘটছে ও ঘটবে, কেবল এটুকুই বলছেন। কিন্তু আমরা যদি এটাকে শুধু ফিকশান হিসাবে না দেখি তাহলে মানব সমাজ ও সভ্যতার আরো স্বল্প পরিচিত বা অচেনা সূত্রগুলি উন্মোচন করতেই হবে, যা একটা ভিন্ন আশাপ্রদ সম্ভাবনার দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে। অন্তত ভাবনায়। আমাদের দ্বান্দ্বিক মনোভঙ্গি যদি এই পরিণতিতে এসে থমকে দাঁড়ায় সেটা আত্মহত্যার মতোই করুণ ব্যাপার হবে।

সাইন্স ফিকশন ‘আলোয় অন্ধ শহর’। লেখক: সালাহ উদ্দিন শুভ্র। প্রকাশক: বৈভব। প্রচ্ছদমিল্পী: ধ্রুব এষ।

একুশে বইমেলা ২০১৮