আলবেয়ার কামুর নোটবুক থেকে
অনুবাদ: এমদাদ রহমানপ্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২৩
নভেম্বর ১১, যেন একটি ইঁদুর আটকা পড়েছে ফাঁদে
এই মাসের সকালগুলোয় দেখা যায়, চারপাশের সবকিছু ঢেকে গেছে সাদা তুষারে, আকাশ উজ্জল হয়ে সেখানে, যেখানে এক অনিন্দ্য-ঐতিহ্যময় গ্রাম্য মেলার চত্বরকে ফুলপাতা আর লম্বা করে কাটা কাগজের সরু টুকরো দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, তার ঠিক পিছনে, দীপ্তিময় আলোয় উদ্ভাসিত হয়। দশটার সময়, সূর্য যখন তাপ ছড়াতে শুরু করে, তখন, ঠিক তখনই প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্যাবলি যেন একটু একটু করে নিজেকে পরিপূর্ণ করতে শুরু করে এক আচ্ছন্ন করে দেয়া স্ফটিক-স্বচ্ছ কোমল সঙ্গীতের মূর্ছনায়, কেননা তখন বইতে শুরু করে হাওয়া আর তাতেই যেন গলতে শুরু করে তুষার: অতি সন্তর্পণে তুষারের স্তূপ ভাঙতে শুরু করে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে গাছগুলি, জমাট হিম এমনভাবে ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে নামতে শুরু করে নিচে, যেন তাদের এই অবিরাম নেমে আসবার তালের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে শুভ্র কীটপতঙ্গদের একের ওপর অন্যের টপাটপ পড়তে থাকার প্রায় শুনতে না পাওয়া শব্দ, এখনও ঝরে পড়েনি এমন পাতারা অন্তহীন অবিরাম ঝরছে জমে থাকা বরফের ভর সামলাতে না পেরে; এবং, মরা মাকড়শার পলকা শরীরের মতো মাটিতে পড়ছে তারা এমনভাবে যেন কোনোমতে কেবল স্পর্শটুকুই করতে পারছে! চারপাশের পাহাড় আর উপত্যকাগুলি ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়ে দৃষ্টিসীমা থেকে ক্রমশ আবছা হয়ে গেছে। আপনি যদি এই আবছা হয়ে যাওয়া দৃশ্যের দিকে নির্দিষ্ট কিছু সময় ধরে তাকিয়ে থাকেন, উপলব্ধি করতে পারবেন— তাদের নিজস্ব রঙ যেন হারিয়ে গেছে। পুরো ভূভাগ যেন হঠাৎ করেই বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই ভূমি পৃথিবীর বুকের বহু পুরনো একটি দেশ যা মাঝে মাঝে একটিমাত্র ভোরের প্রথম আলোর ভিতর দিয়ে আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে... পাহাড়ময় এই ভূমিখণ্ডের সর্বত্র বৃক্ষরাজি আর ফার্ন, শুধুমাত্র দুইটি নদীর সংযোগের মাঝখানে; যেন তারা একটি জাহাজের সূচালো অগ্রভাগ। যখনই, সূর্যের প্রথম রশ্মিগুলি এই অঞ্চলটাকে তুষারহিমের কবল থেকে মুক্ত করে দিতে থাকে, তখন মনে হয় এই পাহাড়জঙ্গল যেন পৃথিবীর মাঝখানের একমাত্র জীবিত কিছু, শুভ্রতা বিস্তার করছে, আর এমনটা করতেই থাকবে অনাদিকাল ধরে। এখানে, অন্তত দুটি জলপ্রবাহের সম্মিলিত তরঙ্গস্বর অন্তহীন নীরবতার সঙ্গে যেন যুদ্ধ করছে। নীরবতা তাদের ঘিরে রেখেছে চারপাশ থেকে। কিন্তু একটু একটু করে জলের এই তীব্র স্রোত, এই তরঙ্গরোল নিজেকে এই পুরো অঞ্চলটাতেই মিশিয়ে দিয়েছে। অসীম নীরবতার মাঝখানে নিজেকে ধীরে ধীরে বিস্তার করা ছাড়া যেন তার আর কোনো উপায় ছিল না। তাই তার প্রয়োজন তিনটি ছাইরঙা কাক, জীবনের চিহ্ন হয়ে যারা আচমকা আকাশের বুকে উড়তে থাকবে।
কাফকার সমস্ত সৃষ্টি, সমস্ত শিল্পকর্ম ঘুমিয়ে থাকে তাকে পুনর্বার পড়বার জন্য আমাদের নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়ার ভিতর। যেভাবে তার বই শেষ হয়, কিংবা তারা আসলেই যেভাবে শেষ হতে চায় না, দাবি করে পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যার, যা কখনোই যথাযথভাবে বলা যাবে না কোনোভাবেই এবং যা আমাদেরকে বাধ্য করে একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটিকে পুনরায় পাঠ করতে, যাতে গল্পের ভিত্তিতি আমরা খুঁজে বের করতে সফল হই। মাঝে মাঝে তার বইকে দুই বা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যাখ্যা করা যেতেও পারে; এবং এই ব্যাখ্যা দেবার জন্য বইগুলোকে দুই থেকে তিনবার পড়তেও হতে পারে। কিন্তু মারাত্মকরকমের ভুল হয়ে যেতে পারে কাফকার লেখাগুলোকে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। একটি প্রতীক সব সময়ই থাকে এক সাধারণ স্তরে বা পর্যায়ে; এবং, একজন শিল্পী প্রতীকটিকে মোটামুটি উপযোগী কিংবা হতে পারে অদ্ভুতভাবেই রূপান্তরিত করে ফেলতে পারেন। শব্দকে অনুবাদের জন্য শব্দ কখনোই অস্তিমান বা বিদ্যমান থাকে না। কেবলমাত্র শব্দের সাধারণ চলন থেকেই এর অর্থকে খুঁজে বের করা যায়। যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায়, শব্দ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা নিয়ে আরেক শব্দের কাছে, আমরা তখন শব্দ থেকে শব্দকে খুঁজে বের করে নেবার সুযোগটা পেতে থাকব, আর এই ব্যাপারটাই সমস্ত সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য এক মহৎ সম্মান।
কারুর প্রবল উৎসাহ, ঘৃণা কিংবা ক্রোধের তীব্র অনুভূতির সঙ্গে বেঁচে থাকবার মানেই হলো, সেই একজন আসলে বাস করছে প্রচণ্ড দুর্দশার মধ্যে, যা বোঝায় এই দুই বিপরীতধর্মী অবস্থানের ভারসাম্য, একটি সংশোধনক্ষম অবস্থা, একীভূত করা আর তার মধ্যেই জীবনটাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করা। যখনই একজন ব্যক্তি কিছু শিখে ফেলে— বই পড়ে নয়— তার দুর্ভোগের সঙ্গে তার নিজের অস্তিত্বের অন্তরঙ্গতাটুকু অবশিষ্ট থাকে, যেখানে সে হয়ে পড়ে চরম নিঃসঙ্গ; তার আকাঙ্ক্ষাগুলোকে অতিক্রম করবার জন্য সে দৌড়ে পালিয়ে যায় আর তখন তৈরি হয় এক বিভ্রম, যেখানে অন্যান্য ব্যক্তি নিজেদেরকে ব্যক্ত করে অন্যের কাছে আর তার ক্ষেত্রে আরও কিছু শিখে নেবার বিষয় বাকি থেকে যায়। এই উদ্ভট নিরর্থক কিম্ভূতকিমাকার বিশ্বকে কেবল নান্দনিকভাবেই সমর্থন করা যায়।
প্লেগ। দ্বিতীয়বার লেখার পর
মূলত, প্রথম তিনটি পর্বই লিখিত হয়েছিল ডাইরিতে— নোটবুকে— নোট আকারে, লেখার ভাবনা এসেছিল ধর্মোপদেশ থেকে, বিভিন্ন আলোচনা গ্রন্থ থেকে, এবং বইটি লেখার লক্ষ্যগুলো, যা নিজের ভিতর থেকে কেউ যেন ঠিক করে দিচ্ছিল, দাবি করছিল গভীর মনোযোগ, এবং; বইটিকে বোঝবার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে ছিল। শেষের পর্বটি বিভিন্ন ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লিখিত হয়েছিল, যার মাধ্যমে একটি সাধারণ উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছিল এবং খুব নিঃসঙ্গভাবেই তারা প্রকাশিত হচ্ছিল। প্রত্যেকটি পর্ব চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিবিড় হবার যোগসূত্র তৈরি করছিল আর পাঠককে তৈরি করছিল এমনভাবে, যেখানে ক্রমশ ঘটনাবলি সংগঠিত হচ্ছে এমন এক একীভবন বা সংমিশ্রণ দিয়ে, যাতে অনেকগুলো ডাইরিকে একটি ডাইরি করে যৌক্তিক শৃঙ্খল তৈরি করা যায়; আর, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয় চতুর্থ পর্বের দৃশ্যাবলির মাধ্যমে।
শত্রুতা আর উষ্ণতা বা আন্তরিকতার অবস্থান একই সঙ্গে, একই সময়ে। সিনেমায় সবকিছুই যেন মিটমাট হয়ে যায়, একাত্মবোধ তৈরি হয় অদ্ভুতভাবে, মানুষ যেখানে নিজেকে অন্য আরেকজনের সঙ্গে নিজেদের সহজেই মিশে যায়, পরস্পরকে যা জেনেই। প্লেগের মাধ্যমে আমি বলতে চেয়েছি সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিটাকে, আমরা সবাই যার শিকার, যেখানে আমরা সবাই শাস্তি ভোগ করছি আর এখানে বিরাজ করছে ভয়- প্রদর্শন, হুমকি, গুম, হত্যা… আর এসব থেকেই তৈরি হচ্ছে চরম এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি; আর, আমরা যেখানে বাস করতে চাইছি, সেখানে আমাদের জন্য যেন অনিবার্য হয়ে আছে, নির্বাসন। একইসঙ্গে একই সময়ে আমি আমাদের অস্তিত্বের সাধারণ ধারণাটিকে বোঝাবার জন্য ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছি। কারণ, আকাশ নীল, নদীকূলের বৃক্ষগুলি তুষার-চাদরে ঢাকা; বৃক্ষেরা তাদের শুভ্র ডালপাতা নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে হিমে জমে যাওয়া জলের ওপর, যেন জলকে স্পর্শ করলেই তার জীবন। তাদের দেখে মনে হচ্ছে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া বাদামের গাছ। এই দেশ আমাকে এমন এক চক্ষু উপহার দিয়েছে, যাতে বসন্ত আর শীতের ব্যবধান বোঝবার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক অপরিবর্তনীয় বিভ্রান্তি!