আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’ মায়াবী সিনেমাটোগ্রাফি

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২৩

কবিতা এমন


আল মাহমুদ


কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি- রাবেয়া রাবেয়া-
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠোনে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর
কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।

 

কবিতাকে এমনভাবে দেখা বা সংজ্ঞায়িত করার কাজটি অনেক কবি-সাহিত্যিক করে থাকেন। কেউ কবিতা, কেউ ইশতেহার, কেউ বা গদ্য (জীবনানন্দের ‘কবিতার কথা’, হাল আমলের বারিন ঘোষালের ‘অতিচেতনের কথা’ স্মরণযোগ্য) লিখে কবিতাকে ডিফাইন করার চেষ্টা করেন। বরাবরই এসব সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কবি-সাহিত্যিকরা কিছু বিমূর্ত চিন্তা-ভাবনার আশ্রয় নেন। এতে কবিতার ভাষা-ভাবনাজনিত একটা আবছা পরিচয় বা দেহ হয়ত আমরা পেয়ে যাই। কিন্তু আল মাহমুদ ওপরের কবিতাটির মাধ্যমে কবিতার একটি মূর্ত ও ব্যবহারিক সংজ্ঞার প্রস্তাবনা করলেন। এই প্রথম আমরা দেখলাম, কবিতা কিভাবে কলাকৈবল্যবাদিদের হাতছাড়া হয়ে একদম আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সাথে মিশে নিজেকে ডিফাইন করছে। যেন কবিতা হাইডেগারের দর্শনস্নাত, ভূপ্রকৃতির প্রাণ-নির্ভর হয়ে, আপনা আপনি নিজের পরিচয় তুলে ধরছে।

 

এর থেকে আল মাহমুদ আমাদের জন্য দুটি উদাহরণ রেখে যান। এক. কবিতার দায় মানুষ, সমাজ, বিশেষ করে কৃষিজীবী সভ্যতার কাছে। দুই. কবিতায় নিজস্ব পারিবারিক আদর্শ-আপব্রিংগিং ব্যবহার করা দোষের কিছু নয় (আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, রাবেয়া রাবেয়া অথবা ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’।

 

আল মাহমুদের পোয়েটিক সাইকি, কাব্য-মানসিকতা ও তার কবিতার সামগ্রিক জ্যামিতিক অবস্থান হরিজন্টাল, ভার্টিকেল নয়। তার কবিতা ভূমিঘেঁষা, তাই তার কবিতায় থিমেটিকেলি, আকাশ, চাঁদ, ইউনিভার্স বা আমাদের বিশাল গ্যালাক্সি প্রায় অনুপস্তিত। তার কবিতায় আইরিশ কবি টেড হিউজ এবং সিমাস হীনির প্রত্নতাত্বিক- মাটি কোপানোর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই কারণে প্রায় সব সময়ই, তার কবিতার কাঁচামাল -আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অর্থাৎ ভূমিতে বিরাজমান প্রকৃতি, মা, মাটি ও মানুষ। কিন্তু তিনি জীবনানন্দের মতো প্যাসিভ দেখনেওয়ালা নন। তিনি শুধু দেখে আনন্দ পান না। তিনি কর্মি-পিতার মত হালচাষ- ভূমি ও মানবী উভয় জায়গাতেই তার কলম-লাঙ্গল চালু রাখতে চান। তাই সোনালী কাবিনে এক কৃষি-কর্মি-কবি আল মাহমুদকে আমরা ব্যাপকভাবে দেখতে পাই। এই আলোচ্য কবিতাটিও এর থেকে বাদ পড়েনি।

 

বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া, আমাদের লোকজ জীবনের এলিমেন্টস, আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি, পার হয়ে হাটুজল নদী, ভোরের আজান, উঠনে ছড়ানো জাল, অগ্রজের কাতর বর্ণনা ও সর্বশেষ ‘মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ এসব সম্মলিত ক্রিয়াবাচক আবহধ্বনি কবিতাটিকে দেয় প্রাণচাঞ্চল্য- গতি ও গভীরতা।

 

বহু বছর আগে আল মাহমুদের এই `কবিতা এমন` কবিতাটি পড়ে যে রকম অবাক, শিহরিত হয়েছিলাম, তার রেশ আজো কাটেনি। কবিতার এই তো বিস্ময়কর শক্তি! এই কবিতাটি আমাকে এমনভাবে আক্রান্ত করেছিল যে আমি যুগপৎ আনন্দ আর আত্ম-আবিষ্কারে অনেকগুলো প্রহর কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আনন্দ পেয়েছিলাম এই কারণে যে এই কবিতার ভাঁজে ভাঁজে লুকনো আছে এক কলুষমুক্ত, জীবন্ত সিনিক বিউটি। আর চিরদিনের কিন্তু কবির মমতায়- সদ্য জন্ম নেয়া রক্ত-ক্লাথ মেশানো ক্যারিশম্যাটিক আল মাহমুদীয় কাব্যভাষা। আর আত্ম-আবিষ্কার বললাম এই কারণে যে আমি যেন আমারই প্রতিবিম্ব দেখলাম- আবহমান বাংলার রূপ ভারাতুর ক্যানভাসে- সেই অপাপবিদ্ধ যাদুময় কৈশোর।

 

কবিতাটি শুরু হয়েছে সেভাবেই, আমাদের স্মৃতিকে গভীর মমতায় একটি মন্ত্রের মতো জাগিয়ে। সেই সময় কবি শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, সিকদার আমিনুল হক, আবুল হাসান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ ইত্যাদির কবিতা পড়তাম প্রায়ই। একজন নবীন কবিতা লিখিয়ে হিসাবে দেশের প্রধান সাময়িকী গুলোর দিকে চোখ রাখতাম ঈগল পাখির মতো। কিন্তু একদিন সকাল বেলায় ‘কবিতা এমন’ নামের কবিতাটি পড়তে গিয়ে চমকিত হয়ে যাই। আমার প্রাথমিক অনুভূতি ছিল বিস্ময়, আনন্দ আর আত্মসমর্পণের। শামসুর রাহমানের ট্যুরিস্ট চোখের চশমায় আধুনিক শহুরে, নাগরিক জীবনের একঘেয়ে জীবন-বয়ান হর হামেশাই পত্রিকা খুললেই দেখা পেতাম। এর বিপরীতে আল মাহমুদের কবিতায় আবিষ্কার করলাম এক নিবিড় শব্দ আর্কিওলজিস্টকে, যিনি স্বদেশের স্মৃতি, ইতিহাস আর উর্বর ভূমি খনন করে তুলে আনলেন গুচ্ছ গুচ্ছ হীরক খণ্ড।

 

আমি থরো থড়ো করে কেঁপে উঠলাম। দেখলাম আবহমান বাঙলা, তার রক্ত,মাংস নিয়ে আমার সামনে উন্মোচিত। বিশেষ করে একটি কৃষিজীবী, কৌম সমাজের শরীর ও আত্মার দ্যুতি এই কবিতায় লক্ষ করা গেল। কবিতটি মনে হলো এতই জীবন্ত ও তাজা যে তার থেকে আমারই জীবনের গন্ধ ভুর ভুর করে বেরিয়ে আসছে।

 

নিজেকে প্রশ্ন করলাম এই কবিতাটির কোন বিশেষ দিকটি আমার মনে ধরল? সাথে সাথে কোনো উত্তর পেলাম না। কারণ ভালো কবিতা না বোঝার আগেই ভালো লেগে যায়। তারপর ভেবে দেখলাম এই কবিতায় ‘সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি_ রাবেয়া রাবেয়া, হাঁটুজল নদী, কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন ভোরের আজান’ থেকে শুরু করে ‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর...এবং শেষের ম্যাজিকেল লাইন –‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ এইসব মোহময় ইমেজারি মর্মে এসে বিদ্ধ হলো। বিশেষ করে মনে হলো মক্তবের মেয়ের যে সরলতা, তার যে স্নিগ্ধতা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আমার ভালো লাগাটি ধরা পড়ে আছে। এ যেন কবিতারই আর এক জন্ম। এরকম সরল অথচ প্রাণময় কাব্য-আবহ উপস্থিতি এর খুব একটা চোখে পড়েনি। একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিউক্লিয়াস যে পরিবার- তার মন্তাজ যেন- মা, বাবা, ভাইবোন আর শেষে সকাল বেলার আল পথ ধরে হেঁটে আসা আয়েশা আক্তার।

 

আয়েশা আক্তার জীবনানন্দের বনলতা সেনের কিশোরী রূপ যেন, যে কিনা ভোরের আজানের সাথে হাজার বছর ধরে, হেঁটে হেঁটে মক্তবে যায়। এই কবিতায় এই একটি সিঙ্গেল এন্টটিটি, যে মহাকালিক মূর্ত ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- যে এর কোনো তুলনা পাই না। খুব আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করলাম কবির কবিতার দায় আর সামাজিক দায় এই দুইয়ের অপূর্ব মিলন ঘটলো এখানে। সাথে সাথে আমার মত এক নবীন কবির মনের গভীরে ভোরের আজান আর মক্তবের আয়েশা আক্তার একটি সৃষ্টিবীজ হয়ে নতুন আগমনকে আহবান করতে লাগলো।

 

কবিতাটি লক্ষ্যণীয়ভাবে কোনো জটিল পঠন-অভিজ্ঞতা নয়। এখানে আধুনিকতার ব্যাধি, ব্যক্তিগত শাপ ও সন্তাপ, আত্মস্বীকৃত বিচ্ছিন্নতা, আধ্যাত্মিক শুস্কতা, শূন্যতা বা আত্মহত্যার কোনো ইল্যুশন নাই। এই কবিতায় আল মাহমুদ কবিতা কী- এর পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আবহমান বাঙলার এক রকম স্পর্শহীন, সহজ সরল লোকজ সমাজ- তথা গ্রামেই ফিরে গেছেন। তাই এর ভাষা ও বিষয় কবির থোট প্রাসেসকে আগলে রেখেই, কোনো রকম পথ না হারিয়ে প্রসবিত হয়েছে। কবিতাটির আঙ্গিক আল মাহমুদের অন্যান্য দশটা পাঁচটা কবিতার মতো- নাতিদীর্ঘ, ছোট চারটি প্যারাগ্রাফে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। কিন্তু তাতেই তিনি তার কবিতাটিকে স্বয়ং সম্পূর্ণতা ও প্রশ্নহীন নির্মাণ-প্রষন্নতা দিতে সক্ষম হয়েছেন। টেকনিক হিসাবে আল মাহমুদ এখানে চারটি স্তবকে চারটি সিনামাটোগ্রাফি এঁকে দিয়েছেন খুব ধারাবাহিকভাবে। আমাদের প্রত্নময়, গ্রাম জীবনের ইমেজারি আর মেটাফর এক এক করে ব্যবহার করে কবিতার জার্নিটাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, একটি নির্ভার গতি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

 

এই যে ইমেজারি, স্মৃতির ট্রেন ধরে কবিতাটি আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে অনায়াসে জাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কবিতাটির আসল ইসেন্স হলো- এর লোকজ প্রাণ প্রাচুর্যময় অরগ্যানিক, সিম্পল কাব্যভাষা, যা কবিতাটিকে করেছে একটি টাইমলেস মাস্টারপিস। এর ভাষা ‘হাঁটুজল নদী কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন’ পার হয়ে ‘পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ’ এর ভাষা, তাই মেকি নয়, মৃত নয়। এই ভাষা হাজার বছরের বাঙ্গালিদের রক্তে থাকা লোকজ ভাষা- যার বিকাশ হয়েছে মানুষ আর তার যূথবদ্ধ, তার কৃষিজীবী কৌম সমাজের প্রতি প্রবল ভালোবাসা থেকেই।

 

কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে শিল্প সম্পর্কিত বিশ্বাস থেকে তার লেখার প্রতি একধরণের কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতা জন্মায়। কেউ arts for art’s sake, আবার কেউ arts for people’s sake এই আদর্শ থেকে শিল্প সাহিত্য চর্চা করেন। আল মাহমুদ শুরু থেকেই তার সমসাময়িক অনেক কবির arts for art’s sake এর ভয়াবহ কূপমন্ডুকতা, স্বার্থপরতা, বিবরপূর্ণ বিচ্ছিন্নতাকে পাশ কাটিয়ে মানুষের সাথেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাই তার এই কবিতা স্মৃতি আর ইতিহাসের হাত ধরে, একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর সিনেমাটোগ্রাফি হয়ে শিল্পের সেলুলয়েডে চিরদিনের জন্য জায়গা করতে সক্ষম হয়।