আল-আকসা ফ্লাড ও হামাস-পিএলএফপি অ্যালায়েন্স

তুহিন খান

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২৩

ফিলিস্তিন-ইজরাইলের সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় অনলাইনে ফিলিস্তিনি লেখক ও পিএফএলপি কর্মী গাসসান কানাফানির কিছু ছবি, ভিডিও ও বাণী নতুন কইরা ভাইরাল হয়। ভাইরাল হওয়া ছবিগুলার ব্যাপারে বাঙলাদেশের কোন কোন বামপন্থীর অভিযোগ ছিল এই যে: কানাফানি যে একজন বামপন্থী, তা এইসব ছবিতে লুকায়ে ফেলা হইতেছে। কানাফানি যে একজন মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট, এসব ছবিতে কানাফানিরে তার সেই রাজনৈতিক পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে উপস্থাপন করা হইছে।

এ ব্যাপারে আরো কিছুদিন আগে আপত্তি তুলছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেঘমল্লার বসু। আমি উনার আপত্তির জবাবে বলছিলাম যে, ছাত্র ইউনিয়ন যদি শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভির ‘ফুক্কা কুল্লে নিজামিন’রে কনটেক্সট থেকে আলগা কইরা নিজেদের শ্লোগান বানাইতে পারে, তাইলে প্যালেস্টাইন নিয়া কানাফানির পলিটিকাল বাণী শেয়ার করার জন্য তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রচার এত গুরুত্বপূর্ণ হইতে হবে কেন? কানাফানি কেবল পলিটিশিয়ান না, একজন রাইটারও বটে। আর রাইটারের রাজনৈতিক পরিচয় বা সত্তার বাইরেও, একটা ভিন্নতর সত্তা থাকে, যেখানে এমন অনেকেই তারে দিয়া প্রভাবিত হন, যারা তার রাজনীতি মানেন না।  

যদি প্রত্যেক লেখক বা কবিরে তার রাজনীতি দিয়া আইডেন্টিফাই করা লাগত, করতে বাধ্য হইত মানুশ, তাইলে কবি/লেখকের যে স্বাধীন, সার্বভৌম ও গ্রেটার দ্যান পলিটিকাল সত্তা, তার যে আর্টিস্টিক সত্তা, যে সত্তা লেখকের রাজনৈতিক পরিচয় ছাপাইয়া তারে গণমানুশের মনে জায়গা আইনা দেয়, যে সত্তা তারে ‘সার্বজনীন’ কইরা তোলে, সেই সত্তার বিকাশ ঘটত না। পলিটিকাল পরিচয়ের নীচেই ওই সত্তা চাপা পইড়া থাকত। তখন বাম লেখকদের পড়ত না বুর্জোয়ারা, বুর্জোয়াদের পড়ত না বামরা। কিন্তু আর্টের জগত ভিন্ন। উদাহরণ দিতে গেলে এই লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। আপাতত কেবল আল মাহমুদ আর নির্মলেন্দু গুণের নাম লেইখা রাখলাম।

২.
কিন্তু যে বামপন্থী বন্ধুরা পিএফএলপি নিয়া অনেক ফ্যান্টাশিতে থাকেন, কানাফানির এই বামপন্থী সংগঠনের সর্ব সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়া তাদের অবগতি কতটুকু, আমি জানি না। হামাস, যারে সাধারণত এদেশের বামপন্থীরা ‘টেররিস্ট’ মনে করেন, তাদের সাথে পিএফএলপির সম্পর্ক নিয়াও উনাদের ধারণা কদ্দুর, জানি না আমি।

অসলো অ্যাকর্ডের পর ১৯৯৩ সালে দামেশকে অসলো অ্যাকর্ডরে প্রত্যাখ্যান কইরা ৮ টা সংগঠনের একটা জোট হইছিল, AFP (Alliance of Palestinian Forces) নামে। এই জোটে PFLP বা DFLP’র মত হার্ডলাইনার বাম দলগুলার সাথে হামাস ও প্যালিস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ গ্রুপও ছিল। জোটটা পরে আর কার্যকর থাকে নাই, কিন্তু হামাস আর পিএফএলপি যে পরবর্তীতে ফিলিস্তিনের পলিটিক্সে নানা কারণেই অ্যালায়েন্স করতে বাধ্য হবে, তা ওইসময়ই পরিষ্কার হইছিল।

সর্ব সম্প্রতি গত বছরের মার্চে, ওয়েস্ট ব্যাংকের লোকাল কাউন্সিল ইলেকশনরে কেন্দ্র করে অ্যালায়েন্সও বানাইছে এই দুই দল। এই ইলেকশনের সেকেন্ড রাউন্ডে ওয়েস্ট ব্যাংকে পিএফএলপি ও হামাস যৌথভাবে ক্যান্ডিডেট খাড়া করছে। পিএফএলপি লিডার মাহের হারবের ভাষ্যমতে, গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি পিএলও’র সেন্ট্রাল কাউন্সিলের বৈঠক ও পরবর্তী আলাপের ভিত্তিতে এই অ্যালায়েন্সের ডিসিশন নেন তারা। হামাস ও পিএফএলপি— দুই দলই ওই বৈঠক বয়কট করে। এর আগে, ২০২১ সালের আগস্টে ইঞ্জিনিয়ার্স সিন্ডিকেট ইলেকশনেও হামাস ও পিএফএলপি অ্যালায়েন্স করে এবং জয়ী হয়।

৩.
হামাস-পিএফএলপি’র এই অ্যালায়েন্স আনএক্সপেক্টেড না। প্রথমত, দুই দলই অসলো অ্যাকর্ডের ব্যাপারে একইরকম মনোভাব রাখে। পিএলও বা পিএ ইজরাইল ও ওয়েস্টের সাথে যে ধরনের স্যাটেলমেন্টে যাইতে চায়, এরা তা চায় না। দ্বিতীয়ত, পিএলও ও পিএ-তে ফাতাহর প্রভাব, একচেটিয়া দখল ও একনায়কসুলভ সিদ্ধান্ত পিএফএলপির মত বাম দলগুলারে কোনঠাসা করে ফেলছে। অনেকটা যেমন আওয়ামী ন্যারেটিভের সাথে থাকার কারণে অন্য বাম দলগুলা প্রায় নাই হয়ে গেছে। পিএফএলপি হামাসের সাথে অ্যালায়েন্স কইরা, পিএলওরে রিফর্ম করার মাধ্যমে, এটা থেকে বের হইতে চাইতেছে। তৃতীয়ত, পশ্চিম তীরে ফাতাহর জনপ্রিয়তা বেশি। সেখানের পরিস্থিতি গাজার মত না। ইজরাইলি সেনারা প্রায়ই সেখানে হামাস আর পিএফএলপি লিডারদের অ্যাটাক করে, ফাতাহ তেমন কিছু বলে না। এই পলিটিকাল সিচুয়েশনও আছে এই অ্যালায়েন্সের নেপথ্যে। চতুর্থত, ওয়েস্ট ব্যাংকের ইলেকশনে হামাস আর পিএফএলপি একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে। তারা জনপ্রিয় লোকেদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট হিশাবে খাড়া করছে, দলীয় ব্যানার না দিয়া। এর ফলে ফাতাহরে হারাইতে যেমন সুবিধা হইছে নান ইলেকশনে, তেমনি অ্যালায়েন্স করতেও সুবিধা হইছে। বেসিক্যালি, এই অ্যালায়েন্স ফাতাহর রাজনীতি ও পলিসির বিরুদ্ধে জাতীয় অসন্তোষের এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ বলা যায়।

৪.
আল-কাসসাম ব্রিগেডের লঞ্চ করা ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ সাপোর্ট করছে পিএফএলপি’র মিলিটারি উইং আবু আলি মোস্তফা ব্রিগেড। যার নামে এই ব্রিগেডের নাম, সেই আবু আলি মোস্তফা ছিলেন পিএফএলপির জেনারেল সেক্রেটারি; ২০০১ সালে ইজরাইলের রকেট ফায়ারে খুন হন উনি। মোস্তফা ছিলেন ইজরাইলের টোটাল ডেস্ট্রাকশনের পক্ষে। ২০০০ সালে, মৃত্যুর আগেও আল-জাজিরারে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে উনি বলছিলেন যে: ‘ইজরাইলের সাথে কোন ডিল বা সন্ধি চলবে না।’

যাহোক, আবু আলি মোস্তফা ব্রিগেড তাদের স্টেটমেন্টে বলছে যে: ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামের এই যুদ্ধ ফিলিস্তিনের মানুশ ও সবগুলা প্রতিরোধী শক্তির সম্মিলিত যুদ্ধ।’ এবং তারা এই যুদ্ধরে স্বাগত জানাইছে; এরে ‘শত্রুর পরাজয়ের শুরু’ হিশাবে চিহ্নিত করছে। এই স্টেটমেন্ট এমনি এমনি আসে নাই।

সাম্প্রতিক অ্যালায়েন্সের কথা তো কইলামই। চলমান আল-আকসা ফ্লাডের মাত্র কিছুদিন আগে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর, লেবাননে বৈঠকে বসছিল হামাস পলিটব্যুরোর প্রধান সালেহ আল-আরুরি, পিএফএলপির ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল জামিল মেজহের ও ইসলামিক জিহাদের সেক্রেটারি জেনারেল জিয়াদ নাখালেহ। বৈঠকের পর এক জয়েন্ট স্টেটমেন্টে তারা ‘ইজরাইলি দখলদারিত্বের মুখে সার্বিক প্রতিরোধ, বিশেষত সশস্ত্র প্রতিরোধরে আরো শক্তিশালী করার গুরুত্ব সম্পর্কে আলাপ করেন, এবং সকল ইস্যুতে, এই ৩ সংগঠনের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগ আরো শক্ত করার ব্যাপারে একমত হন।’

হারেৎজসহ ইজরাইলের একাধিক পত্রিকা এই মিটিং কভার করে। এই তিন গ্রুপ মিলা নতুন কোন সন্ত্রাসী হামলার প্ল্যান করতেছে কিনা, এ ব্যাপারে আর্টিকেল ছাপা হয়। এই মিটিংয়ের পরপরই ওয়েস্ট ব্যাংকে স্যাটেলারদের বসতিতে গুলি ছোঁড়ে ফিলিস্তিনিরা, দুইজন ফিলিস্তিনি মারাও যায় পুলিশের পালটা গুলিতে। রামাল্লার বিরযেইত ইউনিভার্সিটি থেকে ৮ ছাত্ররে ‘সন্ত্রাসবাদী’ অভিযোগে গ্রেফতার করে ইজরাইলি সিক্যুরিটি। এসব তথ্যের আলোকে দুইটা সিদ্ধান্তে আসা যায়।

প্রথমত, শুরু থেকেই এই ‘আল-আকসা ফ্লাড’র প্ল্যানিংয়ের সাথে আছে পিএফএলপি। অন্তত কিছুমাত্রায় হইলেও তারা ইনভলবড।

দ্বিতীয়ত, মিশরের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল বলছেন যে, ইজরাইলরে তারা রিপিটেড ওয়ার্নিং দিছেন ‘বড় কোন ক্ষতি’র ব্যাপারে। আবার ১৬ সেপ্টেম্বর তিনটা সশস্ত্র গ্রুপের বৈঠক এবং এরপরে ইজরাইলের পত্র-পত্রিকায় যেসব লেখালেখি হইছে, ইজরাইলের তরফে যেসব তৎপরতা দেখা গেছে, তাতে ইজরাইল কোন একটা হামলার ব্যাপারে একেবারেই বেখবর ছিল, এটা মনে করা ভুলই হবে আমার মতে।

এক হইতে পারে, হামলা বা অ্যাটাক কেমন হবে, কোথায় হবে, গতি-প্রকৃতি কী হবে— এসব ইজরাইল বোঝেই নাই। অথবা, পশ্চিম তীরে হামাস ও পিএফএলপির নানা অ্যাক্টিভিটিজে তারা ভাবছে যে, হয়ত পশ্চিম তীরে স্যাটেলারদের উপর কোন হামলা হবে। কিংবা, তারা হয়ত এইটারে গুরুত্ব দেয় নাই; ভাবছে অ্যাজ য়ুজুয়াল কিছু হবে। অথবা অন্য কিছুও হইতে পারে, আম নট শিউর।

মিশরিয় সূত্রের কথা যদি সত্য নাও হয়, তবু ইজরাইলের মিডিয়ায়ও আসন্ন কোন বড় অ্যাটাকের ব্যাপারে আলাপ হইছে, স্পেশালি লেবাননে ওই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর। ফলে এটুকু শিওর যে, ইজরাইলে কোন একটা সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে আলাপ চলতেছিল।

৫.
পিএফএলপি সাম্প্রতিক সময়ে ফাতাহ ও পিএলওর ছায়া থেকে বের হইতে চাইতেছে। গাজায় তাদের সামরিক উইংয়ের মহড়া হয় নিয়মিত; পশ্চিম তীরেও তারা হামাসের সাথে জোট করছে। আর সম্প্রতি লেবাননের ওই বৈঠকে তো তারা ডিরেক্ট হামাস ও ইসলামি জিহাদের সাথে ‘সব ধরনের যোগাযোগ’ শক্ত করার কথা বলছে।

আমার মনে হয়, অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড হামাস কেবল বাইরের শক্তির আশ্বাস বা আস্কারায় করে নাই। বরং ফিলিস্তিনের ভেতরে যে পুরাতন, পরস্পরবিরোধী আর্মড গ্রুপগুলা, বিশেষত বামপন্থী গ্রুপগুলা, তাদের একটা সিগনিফিক্যান্ট অংশের সাপোর্ট ও কো-অর্ডিনেশনেই এই হামলা অপারেট করতেছে হামাস।

একদিকে পিএলও প্রায় নিষ্ক্রিয়, ফাতাহর জনপ্রিয়তা তলানীতে, মাহমুদ আব্বাসেরও বয়স হইছে৷ ফিলিস্তিনের পলিটিক্সে নতুন মুখ ও নয়া শক্তির আবির্ভাব আসন্ন। এই সুযোগে পিএফএলপির মত বামপন্থী দলগুলাও নিজেদের পলিসি রিভাইজ করতেছে, তারা সিরিয়াসলি ডেস্পারেট হইতেছে আগের মত অ্যাক্টিভ হওয়ার জন্য। আর এটা করতে গেলে হামাসের মত গ্রুপগুলার সাথে অ্যালায়েন্সেই আপাতত তাদের সবচে বড় লাভ।

ফলে, এবারের এই হামলা ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ পলিটিকাল সিনেও বেশ বড়সড় বদল আসার বার্তা বইলাই আমার মনে হয়।

লেখক: কবি