অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার

আর্টিসম্যান

রিফা সানজিদা

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৮, ২০১৭

চেরাগীতে কিংবা গোলপাহাড় মোড়ে যেসব ফুলের দোকান, আমি আজকাল ওগুলোর পাশ দিয়ে যেতে কী রকম ঠিক স্বস্তি পাই না। চকবাজারে গ্যালেও একই অবস্থা হয়। পাহাড় ঘেরা এ শহরে বছরে কয়েকদিনের জন্যে আসা হয়। পুরনো সব স্মৃতিরা এসে উৎপাত শুরু করে।
অথচ আগে কত ভালোবাসা ছিল এসব জায়গার প্রতি! এখনও আছে, তবে হাঁপিয়ে ওঠার মতো এতে একটা ব্যাপার থাকে। কেন জানি না, এখন এলেই অস্বস্তি হয়। পুরনো কোনও গলির ধার দিয়ে রিকশা যখন চলে, আমার মাথায় আঘাত করে ফুলের গন্ধ। পুরনো মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি, ধুপধুনোর রহস্যময় গন্ধ, কিংবা মানুষের হইহল্লা, পাড়ার মশলা মেশিনের ঝাল-ঝাল গন্ধ। নিজেকে আটকে পড়া এক প্রাচীন আত্মা মনে হয়।
মনে হয়, এক ছুটে পালিয়ে যাই শত বছর আগে। যখন নগরীতে এত কোলাহল ছিল না। ভিড় বড় অসহ্য ঠেকে আজকাল।
সেবার যখন চকবাজারে গেলাম, পুরনো পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে দ্যাখা হলো। বই কিনে বেরিয়েছি মাত্র বাতিঘর থেকে। ওদের সঙ্গে নতুন একজনকে দেখলাম, ঝাঁকড়া কোকড়ানো চুল। ইতস্তত এদিক ওদিক দেখছেন। ভাবলাম, কিছু হারিয়ে ফেলেছেন বোধয়। পরিচিত হলাম, তিনি চারুকলার ছাত্র। না, কিছু হারিয়ে ফেলেননি। মানুষের ভিড়ে তিনি নাকি নিজেকেই হারিয়ে ফ্যালেন।
সাথে সাথেই আমার ‘জলের গান’ এর হতভম্ভ আর্টিসম্যান গানটার কথা মনে পড়লো। এ যে বাস্তবেই আছে চরিত্রটা!
আমি বুঝলাম, তার বেশ অস্বস্তি হয় নতুন মানুষজনের মধ্যে। তার মধ্যে সঙ্গে থাকা বড়ভাইটি আবার বেশ রসিকতা করছেন। একটু পর সবাই গিয়ে বসলাম চা খেতে। বটগাছের মতো বিশাল এক ছাউনি দেয়া গাছের নিচেই চা-ঘরটা।
আর্টিসম্যান তখন একটু সহজ হলেন। আমাদের চা খাওয়া শেষ হলে বেরিয়ে যখন এলাম, সূর্যটা তখন প্রায় ডুবছে। গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আর্টিসম্যান তখনও ভাবছেন, কী করবেন। দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে আড্ডা দেবেন নাকি হনহন করে হেঁটে সোজা নিরুদ্দেশ হবেন। আমার তখন একবার মনে হলো, এই রে! বেশ তাকে জ্বালাচ্ছি আমরা। যেতেও পারছেন না, আবার থাকতেও বেশ অস্বস্তি পোহাচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, কাজ আছে কোথাও? নইলে থাকলে থাকুন না! সিগারেট খেতে পারেন, আমার অসুবিধে নেই।
সিগারেট ধরিয়ে এবার গাছটার দিকে তিনি তাকালেন। বললেন, জানেন, এই গাছটা অক্সিজেন দেয় না বরং নেয়।
আমি বললাম, না, গাছটা আমি তেমন একটা চিনি না।
তিনি বললেন, চিনে রাখবেন। এরা বেশ ক্ষতিকর।
আমি বললাম, তা হবে। তবে মানুষের চেয়ে কম ক্ষতিকর নিশ্চয়ই।
আর্টিসম্যান এবার সিগারেট শেষ করেই বললেন, আপনারা চকবাজার যাবেন বলছিলেন, যান তবে। আমি একটু পর আসছি। একথা বলে তিনি তিনটে গলির মুখে উধাও হয়ে গ্যালেন। কোন গলিতে গিয়ে ঢুকলেন, আমরা আর ঠাহর করতে পারলাম না ।
পাশের জন হেসে বললেন, ও এমনই। কোথাও নিয়ে গ্যালে ভারি বিপদ। মানুষের ভিড়ে তটস্থ হয়ে পড়ে।
আমি তখন ভাবলাম, এমন বিপদে আমিও থাকি। শুধু আর্টিসম্যানের মতো অস্থিরভাবে হারিয়ে যেতে পারি না একটা গলির মুখে।