আরিফুল ইসলামের কলাম ‘নিজ পরিবারে স্বৈরশাসক’
প্রকাশিত : আগস্ট ১২, ২০২১
পরিবারের প্রধান যিনি, তিনি হতে পারেন পরিবারের একমাত্র বা সবচেয়ে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের বাকিদের ভরণপোষণ তিনি করেন। পরিবারের সবার ভরণপোষণ করাটা তাদের প্রতি তার ‘করুণা’ না; বরং সেটা দায়িত্ব। অনেক পরিবার-প্রধান নিজেকে মনে করেন করুণাকারী; সবাইকে তিনি খাওয়াচ্ছেন, তিনি পরাচ্ছেন। ফলে তিনি মনে করেন, তিনি যা চাইবেন তাই হবে, তার কোনো সিদ্ধান্তের সাথে কেউ দ্বিমত করতে পারবে না।
একটা দৃশ্যের সাথে অনেকেই হয়তো পরিচিত, আবার অনেকেই হয়তো শুধু শুনেছেন (তার সৌভাগ্য, তার পরিবারে এমনটা হয়নি)। সেটা হলো, মা যখন বাবাকে বলেন ‘আমি বাপের বাড়ি যাব, আমার মা/বাবা অসুস্থ’ তখন বাবা প্রতিক্রিয়া দেখান। কিংবা, স্বাভাবিক সময়েও যদি মা নানাবাড়িতে যেতে চান, বাবা তখন খুব সহজে অনুমতি না দিয়ে একটু কর্তৃত্ব খাটান। অনুমতি যখন দেন, তখনো মনে হয় যে তিনি করুণা করছেন। অফিসের বস বেতনসহ তার কর্মীকে এক সপ্তাহের ছুটি দিলে যেমন মনে করেন কর্মীকে করুণা করছে, তেমন।
আবার, পরিবারের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার সময় পরিবার-প্রধান অনেক ক্ষেত্রে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেন, পরিবর্তীতে পরিবারকে জানিয়ে দেন। যেমন: সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানো, বাসা পরিবর্তন করা, মেয়েকে বিয়ে দেয়া, গাড়ি কেনা, জমি বিক্রি করা ইত্যাদি। এসব সিদ্ধান্তগুলো নেবার সময় তিনি একবারও মনে করেন না যে, পরিবারের মতামত নেয়াও দরকার। সবাই কী বলে সেটা শুনাও দরকার। তিনি মনে করেন, আমি যেহেতু সবাইকে খাওয়াই, পরাই, সেহেতু সিদ্ধান্ত নেবো আমি, তারা শুধু শুনবে।
হ্যাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন পড়ে, প্রত্যেকটা বিষয়ে জানাতে গেলে দেখা যায় এক ধরনের লেজুড়বৃত্তির সম্ভাবনা থাকে। তারমানে এই না যে, কোনো কিছুতে অন্যকে যুক্ত করা হবে না, প্রত্যেকটা বিষয়ে শুধু নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন।
যেসব বিষয়ের সাথে অন্যের স্বার্থ জড়িত, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তার মতামত নিতে হয়। আপনি যদি সন্তানের স্কুল পরিবর্তন করতে চান, তাহলে তাকে আগে বুঝান যে কেনো স্কুল পরিবর্তন করছেন, নতুন স্কুলে কী সুবিধা থাকছে। সে যে স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলে তার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে। হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে জানালে সে হয়তো আকাশ থেকে পড়বে। ভয়ে কিছু বলবে না। কিন্তু, নতুন পরিবেশে ইচ্ছের বাইরে গিয়ে কি তার পড়ায় মন বসবে?
একটি বাসা পরিবর্তন করার সাথে সাথে পরিবারের সবার স্বার্থ জড়িত। নতুন বাসায় যেতে হলে মানসিক প্রস্তুতি দরকার, সেই বাসা কেমন হবে সেটাও তাদের জানা দরকার, সেখানে তারা মানাতে পারবে কিনা সেটাও বুঝা দরকার। আপনি হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজে নিজে নতুন বাসা দেখে এসে সবাইকে বলতে পারেন না, আমাদের এই বাসা ছেড়ে দিয়েছি, আগামী সপ্তাহে নতুন বাসায় যাব। সবকিছু গুছিয়ে নাও।
নিজের পরিবারের মানুষের কাছে স্বৈরশাসক হওয়াটা সুন্দর দেখায় না। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন করেন, অথচ ঘরের মধ্যে নিজেই একজন স্বৈরাচার! তাহলে তো আপনার কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। আপনি আদর্শিক স্বৈরাচার-বিরোধী নন। আপনি যদি আদর্শিক স্বৈরাচার-বিরোধী হোন, তাহলে নিজে অন্তত স্বৈরাচার হবেন না।
মানুষের মতামত নেয়া ছাড়া পৃথিবীতে কোনো মানুষ যদি বসবাস করার অধিকার রাখতেন, তাহলে তিনি হতেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তিনি আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাঁকে ওহী প্রেরণ করেন, তিনি সর্বোত্তম মানুষ; তাঁর আবার মানুষের সাথে পরামর্শ করার কোনো দরকার ছিলো?
অথচ আল্লাহ পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষকে, সর্বোত্তম নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কাজে-কর্মে তাদের (সাহাবিদের) সাথে পরামর্শ করো। সূরা আল ইমরান ১৫৯
বদর যুদ্ধ শুরুর আগের ঘটনা দেখুন, যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দীদের কী করা হবে সেই ঘটনা দেখুন, উহুদ যুদ্ধের ঘটনা দেখুন, খন্দক যুদ্ধের ঘটনা দেখুন; প্রতিটি বড়-বড় ক্ষেত্রে দেখবেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করছেন।
আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেয়ে কাউকে এত বেশি পরামর্শ করতে দেখিনি। মুসনাদে আহমাদ ১৭৯২৮
মানুষের সাথে যার পরামর্শ করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, তিনি যদি মানুষের সাথে এতো পরামর্শ করেন, তাহলে আমার-আপনার কীরকম পরামর্শ করা দরকার? অনেকেই স্ত্রীর পরামর্শ নেয়াকে অপমানজনক মনে করেন। তারা মনে করেন, আমার স্ত্রী আমাকে পরামর্শ দিলে আমি বেঁচে থেকে কী করবো? আমাকে স্ত্রীর পরামর্শ শুনতে হবে? এতই খারাপ দিন আসলো?
সমাজের কেউ যদি শুনে যে, অমুক স্ত্রীর পরামর্শে এই কাজটি করেছে, তাহলে তো তার ইজ্জত যায়-যায় অবস্থা! সবাই তাকে নিয়ে মজা করে। অথচ আমাদের চেয়ে উত্তম যিনি, তিনিও স্ত্রীর পরামর্শ নিয়েছেন, স্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে কোনো কোনো কাজ করেছেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল সাহাবিদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। সবাই আশা করে এসেছিলেন কা’বা ঘরে তাওয়াফ করবেন। কিন্তু, সন্ধি করে সেবারের যাত্রা স্থগিত করা হয়। পরেরবার যাবেন। সাহাবিরা সেটা মেনে নিতে পারছেন না। সবচেয়ে কঠোর আপত্তি জানান উমর ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে কুরবানি করার ও মাথা মুণ্ডনের নির্দেশ দেন। তিনি তিনবার নির্দেশ দেন, কিন্তু সাহাবিরা কেউ উঠলেন না। তারা খুব হতাশ ছিলেন। সেই সফরে উম্মু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফরসঙ্গী ছিলেন। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের আচরণের কথা তাঁকে বললেন। উম্মু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে পরামর্শ দেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যদি তাই চান তাহলে আপনি বাইরে গিয়ে তাঁদের সাথে কোনো কথা না বলে উট কুরবানি করুন ও ক্ষুরাকার ডেকে মাথা মুণ্ডন করুন। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীর কথামতো তাই করলেন। তাঁকে দেখে সাহাবিরা এবার উঠে দাঁড়ালেন এবং তারাও তাঁর অনুসরণ করলেন। সহীহ বুখারী: ২৭৩১
উম্মু সালামা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ধরনের নেতৃত্বের পরামর্শ দেন, সেটা হলো Leading by example বা উদাহরণের মাধ্যমে নেতৃত্বদান। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যার ওপর আল্লাহর ওহী নাযিল হয়, তিনি পর্যন্ত স্ত্রীর পরামর্শ আমলে নেন। স্ত্রীর পরামর্শ নিতে কোনো ধরণের সঙ্কোচবোধ করেননি।
সুন্নাহর কনসেপ্ট আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকটি রিচুয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। স্ত্রী যদি কোনো উত্তম পরামর্শ দেন, সেটার অনুসরণ করাটাও যে নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লিগ্যাসির অনুসরণ, সেটা যেনো আমরা আমলে নিতে চাই না। আমরা ভয় পাই, সমাজ কী বলবে? সবাই যদি শুনে স্ত্রীর কথায় এই কাজ করেছি, তাহলে ইজ্জত থাকবে?
আল্লাহ পুরুষকে নিজেদের পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক In Charge বানিয়েছেন। পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক হওয়া মানে এই না যে, স্বৈরশাসক হওয়া। আপনি সক্ষম থাকাবস্থায় যদি স্বৈরশাসক হোন, তাহলে আপনি যখন অক্ষম হবেন, তখন কিভাবে আশা করেন যে, সেই সময়ে আপনার পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলে আপনার সাথে স্বৈরাচারী আচরণ করবে না?
আপনার হাতে কর্তৃত্ব থাকাবস্থায় আপনার আচরণ হতে হবে সর্বোত্তম আচরণ। দুর্বল, অক্ষমদের খারাপ আচরণ অন্যদেরকে এতোটা প্রভাবিত করে না যতোটা প্রভাবিত করে ক্ষমতাবান দায়িত্বশীলের অনুত্তম আচরণ।