আরিফুল ইসলামের কলাম ‘তারাবিহ: আট নাকি বিশ রাকআত’

প্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২২

মুসলিম ইতিহাসের প্রায় ১৩০০ বছরে তারাবিহর নামাজের রাকআত সংখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। এই বিতর্ক শুরু হয় গতো শতাব্দীতে। তাহাজ্জুদের নামাজের যে ফযিলত, তারাবিহরও একই ফযিলত। তবে রামাদ্বান মাসে রাতের নামাজ তথা তারাবিহর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় যে রাতে নামাজ পড়ে, আল্লাহ তার আগের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। বোখারি ৩৭

এখন আসুন, আমরা জানবো কিভাবে তারাবিহর নামাজের প্রচলন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ রামাদ্বানে একদিন রাতে মসজিদে যান। একা একা তারাবিহ পড়েন। তিনি কাউকে নামাজ পড়তেও বলেননি। কিন্তু সাহাবিরা তাঁর দেখাদেখি নামাজ পড়ে। পরের রাতে দেখা গেল, সাহাবিদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তৃতীয় রাতে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। চতুর্থ রাতে মসজিদে তিল ধারণের জায়গা ছিল রইল না। কিন্তু সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে গেলেন না।

ফজরের নামাজ পড়ে তিনি উপস্থিত মুসল্লিদেরকে বললেন, শোনো, আমি জানতাম তোমরা সারারাত ধরে এখানে আছ, কিন্তু আমি আসিনি। আমি এই নামাজ তোমাদের ওপর ‘ফরজ’ হয়ে যাবার আশঙ্কা করছি (বিধায় বের হইনি)। আর তোমরা তা আদায় করতে অপারগ হয়ে পড়তে পারো। বোখারি ২০১২

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেন এবং তারাবিহর বিষয়টি অমীমাংসিত থাকে। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়েও বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে প্রথম বছরে তারাবিহ নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। উমরের রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দ্বিতীয় বছর রামাদ্বানে তিনি মসজিদে ঢুকে দেখেন মুসল্লিরা এলোমেলোভাবে নামাজ পড়ছে। কেউ একা একা নামাজ পড়ছে, কেউ ছোটো ছোটো জামায়াতে নামাজ পড়ছে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু চাইলেন, সবাই এভাবে এলোমেলো না হয়ে যদি একজন ইমামের পেছনে নামাজ পড়তো।

তখন উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিযুক্ত করেন তারাবিহর নামাজ পড়ানোর জন্য। সবাই এক জামায়াতে তারাবিহর নামাজ পড়া শুরু করে। দৃশ্যটি দেখে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, কতোই না সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা! বোখারি ২০১০

ইতিহাসের বইগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু পুরুষদের তারাবিহর নামাজের জন্য দুজন ইমাম নিযুক্ত করেন এবং নারীদের নামাজের জন্য আরেকজন ইমাম নিযুক্ত করেন। প্রথমদিকে তারাবিহর নামাজ আট রাকআত পড়া হতো, সাথে তিন রাকআত বিতর। সবমিলিয়ে এগারো রাকআত। কিন্তু, তার খিলাফতের শেষদিকে তিনি আট রাকআতকে বাড়িয়ে বিশ রাকআত করেন। তিন রাকআত বিতরসহ মোট তেইশ রাকআত। মুয়াত্তা ইমাম মালিক ২৪৪

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন বিশ রাকআতের প্রচলন করেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেন আন্দালুসের বিখ্যাত মালেকী মাজহাবের স্কলার আল-বাজী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি বলেন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এটা মানুষের জন্য সহজ করার জন্য করেন। কারণ, আট রাকআত নামাজ এত লম্বা হতো যে, মানুষের পায়ে ব্যথা হতো। দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ থাকতে হতো। এজন্য তিনি আট রাকআত থেকে বিশ রাকআত করেন।

মানুষজন তখন আরেকটা জিনিসের প্রচলন করে। প্রতি চার রাকআত পর তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার নামাজ শুরু করতো। এটার ভিত্তি কী? হাদিসে আছে, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাতের নামাজের বিবরণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বর্ণনা করেন, তিনি চার রাকআত পড়তেন, তারপর বিশ্রাম নিতেন। এরপর আবার চার রাকআত পড়তেন। তুমি জিজ্ঞেস করো না তাঁর নামাজ কতটা সুন্দর ছিল। বোখারি ২০১৩

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময় এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে তারাবিহর নামাজের মাঝখানে বিশ্রাম নেওয়া হতো, এটাকে আরবিতে বলে ‘তারউইহা’। এই তারউইহা থেকে তারাবিহ এসেছে। যার মানে হলো, অনেকগুলো ব্রেক-বিশ্রাম।

বিখ্যাত হানাফী ফকীহ ইমাম আল-সারাখসী তার বিখ্যাত বই ‘আল-মাবসুত’ এ বলেন, ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ তারাবিহ শব্দের উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে এই যুক্তির কথা বলেন। অর্থাৎ, বিশ্রাম নেওয়া।

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন বিশ রাকআতের প্রচলন করেন এটার কারণ জানা যায়নি। খিলাফতের রাজধানী মদিনায় তখন বিশ রাকআত তারাবিহ হয়, মক্কায়ও তখন বিশ রাকআত হয়। এমনকি বর্তমান সময়েও মক্কা-মদিনায় বিশ রাকআত তারাবিহ প্রচলিত।

কয়েক বছরের মধ্যে মক্কায় তখন আরেকটি কাজের প্রচলন দেখা দেয়। মক্কার লোকেরা চার রাকআতের মধ্যের ব্রেকে তারা তাওয়াফ করা শুরু করে। অনেকেই বলতে পারেন, এত কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে বলবো, তখন এত জনসমাগম ছিল না, হৈ-হুল্লোরও ছিল না। কম সময়ের মধ্যে তাওয়াফ করা যেত। আমি (ইয়াসির ক্বাদি) ছাত্রাবস্থায় নিজেও অনেক তাওয়াফ করেছি, যেগুলোতে সময় লেগেছে ১১ মিনিটের মতো কিংবা তারচেয়েও কম।

মক্কার লোকেরা পড়তো বিশ রাকআত তারাবিহ, পাশাপাশি করতে পারতো তাওয়াফ। এই খবরটি যখন মদিনার লোকেরা জানতে পারলো, তারা তখন চিন্তা করলো আমরা তো তাওয়াফ করতে পারবো না! তারা বিশ রাকআতের সাথে আরো ষোলো রাকআত তারাবিহ পড়া শুরু করলো। সবমিলিয়ে ছত্রিশ রাকআত তারাবিহ (তিন রাকআত বিতর মিলিয়ে ঊনচল্লিশ রাকআত)। এটা ছিল তাবেঈ, তাবে-তাবেঈদের যুগে।

ইমাম জাফরানি ইমাম আশ-শাফে’ঈ রাহিমাহুল্লাহকে তারাবীহর রাকআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ইমাম শাফে’ঈ বলেন, আমি মদীনার লোকদেরকে ঊনচল্লিশ (৩৬+৩) রাকআত পড়তে দেখেছি এবং মক্কার লোকদেরকে তেইশ (২০+৩) রাকআত। তুমি এই দুটো মতের যে কোনো একটা ফলো করতে পারো, কোনো অসুবিধা নেই।

দেখুন, ইমাম আশ-শাফে’ঈ বলছেন, মক্কার লোকেরা তেইশ রাকআত পড়ে, মদিনার লোকেরা ঊনচল্লিশ রাকআত, তুমি যে কোনো একটা অনুসরণ করলেই হবে। এই পজিশনটি ইসলামের ইতিহাসে ছিল সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ড পজিশন। অর্থাৎ, একটা পড়লেই হলো।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আযাদকৃত দাস না’ফে রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মনার মানুষকে আমি ৩৯ রাকআত তারাবিহর নামাজ পড়তে দেখেছি, যারমধ্যে তিন রাকআত বিতর নামাজ অন্তর্ভুক্ত।

অনেকেই অবাক হতে পারেন, এই ৩৯ রাকআত কোথা থেকে আসলো? এটা সাহাবি/তাবেঈদের সময় থেকেই চলে আসছে। মদিনার গভর্নর ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহকে তারাবিহর নামাজের রাকআত সংখ্যা কমানোর জন্য বললে ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ প্রতিউত্তরে বলেন, আমি মানুষজনকে এটার ওপর আমল করতে দেখেছি এবং এটি পূর্ববর্তীদের আমল।

ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ, যিনি জন্মগ্রহণ করেন ৯৩ হিজরিতে, তিনি বলছেন ‘পূর্ববর্তীদের আমল’; যিনি নিজেও ছিলেন একজন পূর্ববর্তী। তাহলে তার পূর্ববর্তী কারা? সাহাবি, তাবে’ঈ। পূর্ববর্তী আলেমরা আলোচনা করতেন তারাবিহর নামাজ কত রাকআত পড়া ‘উত্তম’ এটা নিয়ে। বেশিরভাগ বলতেন বিশের পক্ষে (২০+৩)। কারণ, এটার ওপর সাহাবিদের ইজমা ছিল। উমর ইবনুল খাত্তাবের আমল থেকে এটা প্রচলিত।

যে কোনো নফল নামাজের ক্ষেত্রে সংখ্যাগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা এমন না যে, ২০ রাকআতই পড়তে হবে, ৩৯ রাকআতই পড়তে হবে। নফল নামাজের ক্ষেত্রে যত বেশি পারবেন পড়বেন। কোনো কারণে পড়তে অপারগ হলে যতোটুকু পারেন পড়ুন। কিন্তু, আমরা এসব বাদ দিয়ে নফল নামাজের রাকআত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করি!

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! তারাবিহ আট না বিশ রাকআত এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। আমার জানামতে ইসলামের তেরশো বছরের ইতিহাসে এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিল না। এটা নিয়ে প্রথম ঝামেলা শুরু হয় গত শতাব্দীতে! এটা একটি আধুনিক বিতর্ক।

গত শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস, খুব দক্ষ আলেম রাহিমাহুল্লাহ প্রথমবারের মতো দাবি করলেন, বিশ রাকআত তারাবিহ হলো বিদআত! এর আগে আমার জানামতে কেউ এমন দাবি করেননি।

আমার শিক্ষক শায়খ ইবনে উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যে বলে আট রাকআতের বেশি তারাবিহ পড়া বিদআত, সে নিজেই আসলে বিদআত বলছে। কারণ, এর আগে কোনো আলেম এটাকে বিদআত বলেননি।

তারাবিহর নামাজ কোনো সংখ্যাগত বিষয় বা কোয়ান্টিটি না, এটা হলো কোয়ালিটি। এটা ফরজও না যে কমালে বাড়ালে ক্ষতি হবে। এটা নফল নামাজ। আপনি আপনার ইচ্ছেমতো আট রাকআত পড়ুন, বিশ রাকআত পড়ুন কিংবা ছত্রিশ রাকআত।

আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারাবছর রাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়তেন। তিনি রাতে পড়তেন আট রাকআত। কিন্তু, তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে যাননি, আট রাকআত পড়তেই হবে। এমনকি একবার একজন সাহাবি এসে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি রাতের নামাজ কিভাবে আদায় করবো?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দুই রাকআত দুই রাকআত করে আদায় করবে। আর যদি আশঙ্কা করো ফজরের সময় হয়ে যাচ্ছে, তখন বিতর পড়া শুরু করবে। বোখারি ৪৭২

এই মতটিই ছিল দীর্ঘ তেরশো বছর ধরে মুসলিম উম্মাহর মত। এই তেরশো বছরে কেউ কখনো বলেনি, বিশ রাকআত তারাবিহ পড়া বিদআত। সুতরাং, আপনাকে কেউ এসে যদি বলে, তুমি বিশ রাকআত পড়ছো কেন? তুমি কি জানো না বিশ রাকআত পড়া বিদআত? তাহলে আপনি জবাবে বলবেন, জাজাকাল্লাহু খাইরান। আপনি আট রাকআত পড়ুন, আমি বিশ রাকআত পড়ি।

অ্যান্ড অব স্টোরি। এটা নিয়ে ঝগড়া করার কোনো দরকার নেই।

কলামটি শায়খ ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকে অনূদিত