আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

আইনস্টাইন ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু

‘আমি ধূমকেতুর মতো, যা আসে একবারই আর ফিরে আসে না’

প্রাচ্য তাহের

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২০

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বয়স তখন ৩০ বছর। যোগ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একদিন তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছিলেন, মাক্স প্লাঙ্কের বিকিরণ তত্ত্ব। বলা দরকার, ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় মাক্স প্লাঙ্ক নোবেল পান। তো, সত্যেন বসু পড়াতে গিয়ে দেখলেন যে, কোথায় যেন একটা লুকোচুরি রয়েছে, হিসেবটা ঠিকঠাক মিলছে না।

ব্যাপারটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। এ বিষয়ে শুরু করলেন পড়াশোনা আর গবেষণা। তার পরিশ্রম শেষমেষ সাফল্যের মুখ দেখল। তিনি আবিষ্কার করলেন, বোসন কণা। ভাবতে অবাক হতে হয়, ৮৮ বছর আগে ঢাকায় আবিষ্কৃত সেই তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় পদার্থবিজ্ঞানীরা সন্ধান পেলেন ঈশ্বর কণার।

২০১৩ সালের ৪ জুলাই জেনেভার জাঁকালো অনুষ্ঠানে সার্নের গবেষকেরা ঈশ্বর কণার অস্তিত্বের জানান দিলেন। বোসন কণা, নাম বদলে যা হিগস-বোসন; সেই যে গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা, তার দেখা মিলেছে! সত্যেন বসুর গবেষণা ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ নামে বিশ্বজয় করেছিল। সার্নে আবিষ্কৃত কণাটি সেই গণনার নীতিই মেনে চলে। এ কারণেই হিগস কণাটি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামের ‘বসু’ অংশটি ধারণ করেই বসু কণা বা বোসন বলে পদার্থবিজ্ঞানে পরিচিত।

আমরা জানি যে, বস্তুর ‘ভর’ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কণার ভর না থাকলে তা আলোর বেগে একাকী ছুটবে। ঘর বাঁধবে না কারও সঙ্গেই। অথচ বিশ্ব গড়েই উঠেছে কণার সমষ্টিতে, রূপ পেয়েছে পাহাড়, সমুদ্র, গাছ আমাদের শ্যামল পৃথিবী। ভর না থাকলে তো এর কোনো কিছুই থাকত না। আর এই বোসনসদৃশ ঈশ্বর কণাই যে অন্য কণাদের ভর জোগায়। সেই হিসাবে মানুষের মূলেও এই ভর। সংগত কারণেই ভর-রহস্য, যা কিনা বিশ্বের জন্মরহস্যে আলো ফেলতে পারে, সেই ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী একটি ঘটনা।

এবার একটু পেছনে চোখ ফেরানো যাক। ১৯২১ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন সত্যেন বোস। নতুন জায়গায় এসে খানিক অস্বস্তিতে ভুগতেন তিনি। কলকাতায় সতীর্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে চিঠিতে তিনি লিখলেন, “কাজকর্ম এখনো শুরু হয়নি। যদিও এখানে অবহেলায় অগোছালো স্তূপাকার ঢের কাজ জমা হয়ে আছে। আমাদের এখানে বইপত্তর, জার্নাল একেবারেই নেই। অবশ্য কেনার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সায় দিয়েছে। আলাদা একটি বিজ্ঞান পাঠাগারের বিষয় নিয়েও কথা হয়েছে, আলোচনা চলছে।”

জ্ঞানতৃষ্ণা শুধু নয়, জ্ঞানবিস্তার ও মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাই যে বিজ্ঞানের আলো সারা দেশে ছড়িয়ে দেবে; একথা সত্যেন বসুর চেয়ে স্পষ্ট করে আর কেউ হয়তো এ বাংলায় ভাবেনি। তিনি বলেছিলেন, “যারা বলেন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তারা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না।” অথচ ইংরেজি শিক্ষার চল তাদের পরিবারে তিন পুরুষের। জন্ম ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। পূর্বপুরুষের আদি বাস নদীয়া জেলায় হলেও কলকাতার গোয়াবাগানে বেড়ে ওঠেন তিনি।

১৯০৯ সালে হিন্দু কলেজ থেকে পঞ্চম স্থান পেয়ে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১১ সালে আইএসসি, ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্সসহ বিএসসি, ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে এমএসসি। তিন পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। মেঘনাদ সাহা ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ছিলেন তার সহপাঠী। জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন তার শিক্ষক। ফলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মানসগঠন তৈরিই হয়েছিল বিজ্ঞানমনস্ক পরিবেশে।

এর আগে জেনেছি, ১৯১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক। এদিকে কয়েক বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের নিভৃতে কাসে ছাত্রদের জন্য প্লাঙ্কের বিকিরণ তত্ত্বের হিসাব মেলাতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বারবার ভাবনায় পড়ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল, এ হিসাবে কোথায় যেন খানিকটা লুকোচুরি রয়েছে, মিলছে না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো করে একটি পরিসংখ্যান বের করলেন ছাত্রদের পড়ানোর প্রয়োজনেই। এভাবেই অকস্মাৎ ‘বোসন’ খুঁজে পান বসু।

১৯৭০ সালে জগদীশ মেহরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বসু বলেন, “আমার নিজস্ব পন্থাতেই আমি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতাম। কোনো শিক্ষকের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে নয়, বরং আমি নিজেই এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে তা জানতে চেয়েছিলাম।”

তার সেই জানতে চাওয়া আর নিজস্ব পন্থার ফলাফল নিয়ে চার পৃষ্ঠার গবেষণাপত্র লিখলেন বসু। নাম, ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য লাইট-কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস’। পাঠালেন লন্ডনে, ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনের দপ্তরে। যারা এর আগেও তার গবেষণাপত্র ছেপেছিল। কিন্তু এবার না ছেপে পাঠাল ফেরত। মনোক্ষুণ্ণ বসু তা পাঠালেন বার্লিনে, খোদ আইনস্টাইনের কাছে। সে গ্রীষ্মে আইনস্টাইনের নোবেলপ্রাপ্তির তিন বছর হয়েছে। বার্লিনে, তার বাড়ির চিঠির বাক্স উপচে পড়ে গবেষণার অনুরোধ থেকে শুরু করে বিচিত্র ধরনের সব চিঠিপত্র, আবেদন-নিবেদন ভরা অসংখ্য কাগজে। সেগুলো থেকে বাছতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণাপত্রটির সঙ্গে পাঠানো চিঠিতে আইনস্টাইনের নজর আটকে গেল।

সে চিঠিতে আইনস্টাইনকে ‘শ্রদ্ধেয় গুরু’ সম্বোধন করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “পর্যবেক্ষণ আর মতামতের জন্য আপনার কাছেই এ প্রবন্ধ পাঠালাম। পড়ার পর আপনি কী মনে করেন তা জানার জন্য তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি। লেখাটি জার্মানে অনুবাদ করার মতো যথেষ্ট ভাষাজ্ঞান আমার নেই। যদি মনে করেন এটি ছাপার যোগ্য, তবে এটি সাইট ফুইর ফিজিকে প্রকাশের ব্যবস্থা করলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। যদিও আপনার কাছে আমি অপরিচিত, তবু এ অনুরোধের জন্য আমার মনে কোনো দ্বিধা কাজ করছে না। কারণ, আমরা সবাই আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছি।”

এ চিঠিটি সত্যেন্দ্রনাথ বসু শেষ করেছিলেন এই বলে যে, এর আগেও কলকাতা থেকে আইনস্টাইনের অনুমতি নিয়ে তিনি তার লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন।  যাই হোক, এ ঘটনার মাসখানেকের মধ্যে আইনস্টাইনের হাতে সত্যেন্দ্রনাথের সে লেখাটি জার্মান অনুবাদে কাঙ্ক্ষিত ফুইর ফিজিতে প্রকাশিত হয়। বসুর এ গবেষণাপত্রকেই কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিকসের প্রারম্ভ বা সূচনা বলে ধরা হয়।

এরপর বলা চলে, ইউরোপের দরজা খুলে গিয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সামনে। পেয়েছিলেন উচ্চতর গবেষণা ও শিক্ষালাভের জন্য দুই বছরের ছুটি। তাকে লেখা আইনস্টাইনের একটি পোস্টকার্ড দেখিয়ে বিনে পয়সায় জার্মান ভিসাও পেয়েছিলেন বসু। আইনস্টাইনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাক্ষাৎ হয় ১৯২৫ সালের শেষদিকে, বার্লিনে। এর মাঝে প্যারিসে মোরিস দ্য ব্রোগলির সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। মেরি কুরির সঙ্গেও তার গবেষণাগারে তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কিছুদিন কাজ করেছেন বসু।

আইনস্টাইনের সঙ্গে কাজ করার তীব্র আগ্রহ থাকলেও শেষপর্যন্ত নিরাশই হতে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথকে। হয়তো এরই প্রভাবে দেশে ফেরার পর বাকি জীবনে খ্যাতি, সম্মান, ভারতের জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম প্রাপ্তি থেকে শুরু করে ভারত আর বাংলাদেশে তার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে অধিষ্ঠান করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ বিজ্ঞানী ‘বোসন’ কণার জনক হয়েছিলেন, আইনস্টাইনের কাছ থেকে শেষের দিকে একধরনের নির্লিপ্ত উপক্ষার পরবর্তী সময়ে তিনি আর সেভাবে জ্বলে ওঠেননি।

আইনস্টাইন তখন গূঢ়-জটিল গবেষণায় মগ্ন। তরুণ এই একলব্যের প্রতি তিনি আর নজর দেয়ার ফুরসত পাননি। এদিকে ‘দ্রোণাচার্য’ আইনস্টাইনের ভগ্নমনোরথ ‘একলব্য’ সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৬ সালে ঢাকা ফেরার পর দীর্ঘদিন আর কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশে আগ্রহী হননি। সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদার্থবিজ্ঞানের উঠোন ডিঙিয়ে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দর্শনে, নৃতত্ত্বে, সাহিত্যে, সংগীতে। দেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত হয়ে একসময় অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। বসু যেন স্বীকার করেই নিয়েছিলেন, ‘আমি আর বিজ্ঞানের সঙ্গে ছিলাম না, আমি ছিলাম অনেকটা ধূমকেতুর মতো; যা আসে কেবল একবারই, আর কখনোই ফিরে আসে না।’