আমারে চিনি না আমি
মাহমুদুল হাসানপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০
পেশায় সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে উত্তরের রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা ও দক্ষিণ-পশ্চিমের কুষ্টিয়ায়। মাহবুব মোর্শেদের প্রথম উপন্যাস ‘ফেস বাই ফেস’ প্রকাশিত হয় ২০১০ এ। অতিপরিচিত চারপাশের চেনা অচেনা গল্পগুলোকে সহজ গদ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা তাকে পাঠক নন্দিত করে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস `তোমারে চিনি না আমি’। এপর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাতটি।
খুব বেশি ভালো লেগে যাওয়া কোনো নারীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে যেমন বয়ঃসন্ধিকালের জিভ জড়িয়ে যায় বা প্রগলভতা পেয়ে বসে আচমকা কিংবা অসংলগ্ন হয়ে পড়ে শব্দচয়ন, তেমনি অনেক বইয়ের ভিড়ে হঠাৎ খুব ভালো লেগে যাওয়া একটি বই নিয়ে লিখতে বসে স্পষ্ট বুঝতে পারছি, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বলছিলাম মাহবুব মোর্শেদের একটি উপন্যাসের কথা যার নাম ‘তোমারে চিনি না আমি’।
রিয়েলিটি ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। কথাটা সত্য এবং বহুল প্রচলিত। তবে যদি এমন হয়, কোনো ফিকশন কারো জীবনের রিয়েলিটির সাথে কাকতালীয়ভাবে অনেকটাই মিলে যাচ্ছে, তাকে কি বলা যায়? কি হতে পারে তার ব্যাখ্যা? যার জীবনের গল্পের সাথে উক্ত ফিকশনের গল্প অনেকটা মিলছে, সেই পাঠকের মনে যে তোলপাড় তৈরি হচ্ছে, তার দায় যতটা কাকতালের, ঠিক ততটাই লেখকের মুন্সিয়ানার, বললে ভুল হবে বলে মনে হয় না। উত্তম পুরুষে বর্ণনার এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রানা যেন কাগজের মলাটে বন্দি হয়ে যাওয়া অনেকটা আমি।
বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারাটা যেকোনো পাঠকের জন্যই হয়তো আনন্দের। কিন্তু এই বইয়ের অনেক চরিত্র একেবারে ঠিক ঠিক নামসহ আমার সত্যিকারের জীবনের অনেক চরিত্রের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায় যা আমাকে বিহ্বল করে ফেলেছিল। অভিভূত হয়ে আমি ভাবছিলাম, কি করা যায়। তাই লেখক হবার দুঃসাহস দেখিয়ে ‘বুক রিভিউ’ লেখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে সোজা বাংলায় একটা পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার ইচ্ছে নিয়ে বসে পড়লাম।
দুশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের গল্প দুই পাতায় বুঝিয়ে দেবার মত ক্ষমতা এই অক্ষমের নেই। তবে এই উপন্যাসের দুর্দান্ত সব চরিত্রগুলোর প্রাণশক্তি এতটা বেশি যে, তারা কাগজের মলাট থেকে বেরিয়ে এসে চোখের সামনে কথা বলতে শুরু করে। চলতে থাকে লাইভ শো। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রানার বর্তমান জীবন থেকে গল্প শুরু হয়ে পেছনের দিকে যেতে থাকে খুব সাবলীলভাবে। বর্তমানের রানাকে দেখা যায় পরিবারের সাথে প্রায় সম্পর্কহীন অবস্থায়। চরম উদাসীনতা নাকি আত্মকেন্দ্রিকতা নাকি কনফিউজড যেকোনো আধুনিক নাগরিক মানুষের অবোধ্য আচরণ, ঠিক কি কারণে পরিবারের সাথে এই দূরত্ব, তা বুঝতে বুঝতে পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে দেখতে পাই রানা বলে চলেছে তার পেছনের জীবনের গল্প।
সেই বয়ঃসন্ধি কালের প্রেম, খালাতো বোন নূরুন্নাহারের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ, শারীরিক আবিষ্কার, বন্ধু কামরুজ্জামানের মাধ্যমে যৌনরসাত্মক চটি বইয়ের সাথে পরিচয়, হস্তমৈথুন… রানা বলে চলে অকপট, সোজাসাপ্টা। কলেজ জীবন শেষে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। কবি হতে চাওয়া রানার জীবনে আশ্চর্য সব আকর্ষণ নিয়ে হাজির হতে থাকে অদ্ভুত সব নারী। কিন্তু নানা কারণে হারিয়ে যায় তারা। মিলা হয়ে যায় দীপকের প্রেমিকা আর ধনী পরিবারের সন্তান মিথিলা চলে যায় নিউইয়র্ক। কাম্য সব সঙ্গ হারানোর শূন্যতায় ঘুরপাক খেতে খেতে রানা ডুব দেয় কবিতায়। নিজের ভেতর এক দুর্বার কবিকে আবিষ্কার করতে থাকে সে। দুহাতে লিখতে থাকে। লেখা ছাপা হতে থাকে পত্রিকায়। ঠিক এমন সময় রানার জীবনে আসে সরদার নামের অসামান্য রহস্যময় বর্ণময় এক চরিত্র।
মনের ভেতর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগুন নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই সরদার তাকে জীবন কাব্যের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার মধ্য দিয়ে। চলে আসে গাঁজার ধোঁয়া, আসে সমাজতন্ত্রের মন্ত্র, আসে বিপ্লবের হাতছানি, আসে সংগ্রামের মিছিল আর আসে মাতাল কবিতা। সরদারের সাথে রানা দেখতে থাকে এক নতুন দুনিয়া। সেখানে আবার আসে প্রেম। রোজ নামে অনন্য সুন্দরী সিনিয়রের জন্য পাগল হয়ে ওঠে রানা। সরদারের বুদ্ধিতে পেয়েও যায় তাকে। আসে পপি নামের এক আগুনে তরুণী যে কিনা সর্দারের প্রেমিকা। গল্প এগিয়ে চলে। রানা আর রোজের প্রেম তুঙ্গে ওঠে। এরই মাঝে আবার পপির সাথে জড়িয়ে যায় রানা। প্রেমে আর কামে অসাধারণ আপাত অবোধ্য একটা সময় কাটাতে থাকে। সময় গড়িয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেয় রোজ, তারপর পপি। আবার একা হয়ে পড়া রানার জীবনে এবার আসে লুৎফুন নাহার, যে কিনা তার প্রথম প্রেমিকা নূরুন্নাহারের ছোট বোন। সাময়িক মানসিক টানাপোড়েন কাটিয়ে শুরু হয় প্রেম। আর একইসাথে চলতে থাকে রানার কবিতা যাপন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে রানা একটি এনজিওতে চাকরিরত অবস্থায় বিয়ে করে নাজনীনকে। শুরু হয় সংসার নামে জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবলেশহীন রানা ভাবতে থাকে সে আসলে কেমন, সে কি চেয়েছিল, কি করছে এখন আর এসবের কোনো অর্থ হয় কিনা। ধর্ম নিয়ে নির্লিপ্ত আর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে উদাসীন রানা নিজের ভেতর আরো গুটিয়ে যেতে থাকে। উপন্যাস শেষ হয় একটি খবরে, যেখানে দেখানো হয় পুলিশের ক্রসফায়ারে সরদারের মৃত্যু আর পপির গ্রেফতার। সরদার আসলে বিপ্লবী ছিল নাকি পুলিশের ভাষায় একজন ডাকাত ছিল এসব ভাবনা ছাপিয়ে রানা চোখ ভরে জল আসে। রানা কাঁদতে থাকে। কাঁদতে থাকি আমিও। এই কান্না কতটা সরদারের জন্য, কতটা রানার জন্য আর কতটা আমার নিজের জন্য, তা ঠিক বলতে পারব না।
সক্রেটিস বলেছিলেন, Know Thyself নিজেকে জানো। আসলে পুরোটা জীবন আমাদের চলে যায় নিজেকে জানার চেষ্টায়। অধিকাংশই হয়তো এই বিষয়ে সচেতন থাকেন না বলে বুঝতেই পারেন না যে, নিজেকে জানাটা কতটা জরুরি এবং একই সাথে নিজেকে চেনাটা কতটা দুষ্কর। ‘তোমারে চিনি না আমি’ উপন্যাসটির নামকরণ কতটা চমৎকারভাবে সফল হয়েছে তা উপন্যাস পাঠ শেষে চিন্তাশীল পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন। প্রেম, কাম, কাব্য, সংগ্রাম, জীবন আর জীবনের অর্থবহ অর্থহীনতার প্যারাডক্স এই উপন্যাসের উপজীব্য। মাহবুব মোর্শেদ নিজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও তার এই উপন্যাসের পটভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবার কারণে খুব নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, লেখক কতটা সুস্পষ্ট ও নিপুণভাবে এই ক্যাম্পাসের আবহাওয়া তার উপন্যাসে ধরতে পেরেছেন। চরিত্র বিনির্মাণে কিংবা দৃশ্যের বর্ণনায় তার স্বতস্ফূর্ততা আর অকপটতা এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। আর মনোদৈহিক বিষয়গুলো নিয়ে তার সূক্ষ্ম নির্মোহ বিশ্লেষন পাঠকের চিন্তার খোরাক হিসেবে বাড়তি পাওনা।
তথাকথিত সাহিত্যিক মান বিচারে এই উপন্যাস কোন স্তরের বা ইতিহাসের কোথায় এর জায়গা হবে, এ ধরনের বৃহৎ অশালীন চিন্তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরে না বলেই সরল ভাষায় বলতে চাই, বহুদিন পর কোনো উপন্যাস পড়ে সত্যিই তৃপ্তি পেয়েছি। মাহবুব মোর্শেদকে ধন্যবাদ এই খরার কালে এমন একটি উপন্যাস উপহার দেবার জন্য।
লেখক পরিচিতি: বেসরকারি চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন। জন্ম ও বেড়ে ওঠা রংপুরে। ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশাগত কাজের বাইরে সময় কাটে পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে, আড্ডা দিয়ে, বই পড়ে আর প্রচুর ফিল্ম দেখে। ছোটগল্প, কবিতা আর পরীক্ষামূলক গান তার লেখালেখির আগ্রহের বিষয়।