চিত্রকর্ম: হাশেম খান
আমার লাঞ্চের দাওয়াত ছিল
সাইফুল বাতেন টিটোপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
ধর্ষণ মামলার আসামির দিকে থানার ওসি যেভাবে তাকায়, আজকাল কারো সাথে বিমার বিষয়ে কথা বলতে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টও সেভাবে তাকায়। আমার আর ক্লায়েন্ট মেলে না। সৃজনশীল লেখাপড়ার যুগে আমার টিউশনি নেই বছরতিনেক। তারপর থেকে ধার-দেনা-বিমা এসব করে এক পেট আধা পেট করে দিন পার করছি কোনোমতে।
এমতাবস্থায় ফেসবুকে যোগাযোগ হলো ক্লাস এইটের পর স্কুল ত্যাগ করা মোতালেব ওরফে মোতার সাথে। স্কুলে তাকে আমরা মোতা নামেই চিনতাম। এখন তার ফেসবুক নাম চৌধুরী মোতালেব হোসেন। মুরাদ টাকলা ভাষায় তার অফিসে বেড়াতে যেতে বলল বেশ কয়েকবার। জানালো এখন সে মালয়শিয়া, সৌদি, দুবাই, কুয়েত, ব্রুনাই এসব দেশের সাথে ব্যবসা করে। কীসের ব্যবসা করে আমিও জানতে চাইনি, মোতালেবও বলেনি। তবে খুব ভালো আছে জানালো। বিয়েথা করেছে, এক ছেলে আছে। গাড়িতে বসে সবার তোলা ছবিও ইনবক্স করলো। বারবার বলল অফিসে যেতে। লাঞ্চের দাওয়াত।
আমার অবস্থা এমনই খারাপ যে, কোনোদিন যাকে ছাত্র হিসেবে গণ্যই করতাম না সেই মোতালেবের বিদেশের সাথে ব্যবসা করা অফিসে চাকরি চাইবো ভাবলাম। মনে মনে এও ভাবলাম, চাকরি না হোক, অন্তত মোতালেব আমার লাখ টাকা প্রিমিয়ারের ক্লায়েন্ট হতে পারে। ভাবছি ওর পরিবারের সবাইকে পটিয়ে বিমা করিয়ে ফেলবো। আর কিছু না হোক এই দুর্দিনে একটা ভালো লাঞ্চ অন্তত হবে!
একদিন নিজে থেকে নক করে জানালাম তার অফিসে যেতে চাই। বলল ওমুক দিন ওমুক সময় আয়। গুলশানে অফিস। গিয়ে বুঝলাম বন্ধু আমার আদম ব্যবসায়ী। বিশাল অফিস। রিসিপশনিস্ট আমাকে পাঁচমিনিটের কথা বলে যখন তিনঘণ্টা বসিয়ে রাখলো, ভালো একটা লাঞ্চের আশায় তখনও আমি মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। এগারোটা থেকে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি। সবচেয়ে খাটো আর মোটা কাঁটাটা এখন চার আর পাঁচের মাঝবরাবর বিরাজ করছে। হঠাৎ দেখলাম, বন্ধুর রুম থেকে অনেকগুলো মানুষ বের হয়ে গেল। আর তার মিনিটবিশেক পর আমার ডাক পড়ল।
তার রুমে গিয়ে তো আমি অবাক! এদেশের প্রেসিডেন্টের অফিসও এমন হয় কিনা আমার জানা নেই। রুমের সাইজ সিনেমায় বড়লোকদের যে সাইজের ড্রইংরুম থাকে তার চেয়েও বড়। সোফাসেট, ফ্রিজ, বিশাল সাইজের এলইডি স্মার্ট টিভি আরও নাম না জানা বিলাসি বাহারি উপকরণ দিয়ে রুম সাজানো। এমনকী রুমের এক কোনায় একটা বেশ বড় সাইজের বুকশেল্ফও রয়েছে! বাইরে যে কতটা গরম তা ওর ঘরে ঢুকে টের পেলাম। আরও টের পেলাম আমি কী পরিমাণ ক্ষুধার্ত। সারাঘর ম ম করছে কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধে। মোতালেব আমাকে দাওয়াত দিয়ে আমাকে ছাড়াই এই গরমের মধ্যে কোর্ট, টাই পরে একটা বিশাল সাইজের প্লেটে করে কাচ্চি বিরিয়ানি খাচ্ছে। আমি ওর টেবিলের একটু দূরে সোফায় বসলাম দেখে মোতালেব হা হা করে বলে উঠলো ‘আরে আমার সামনে বস।’ ওর বিশাল টেবিলে বিশাল খাবারের আয়োজন! কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়াও আলাদা প্লেটে রয়েছে একটা খাসির লেগ রোস্ট, যা প্লেটের দুইপাশ দিয়ে বের হয়ে আছে। একটা বাটিতে কয়েকটা টিক্কা, সিদ্ধ করা ডিম, এক কাপ দৈ, এক বোতল ঠাণ্ডা কোকাকোলা। আমার মনটা খুশিতে ভরে গেল। অবশ্যই আমার জন্যও কাচ্চি আনানো হয়েছে। ও হয়তো বা হাঁত দিয়ে বেল টিপে ওর পিয়নকে এখুনি বলবে ‘ওকে ওর কাচ্চিটা দিয়ে দাও।’
আমি বসার পর ও মুখে খাবার রেখেই বলল ‘স্যরি দোস্ত, সেই সময় থেকে মিটিং মিটিং মিটিং, খাবারও সময় পাইনি।’ খাবার গিলে কোকের বোতলে চুমুক দিলো। এই কাচ্চি সম্ভবত স্পেশাল কোনো দোকানের কাচ্চি। যেমন গন্ধ তেমন দেখতে। চালগুলো অনেক বড় বড় আর বেশ সরু। সারা প্লেটে মাংস আর রাইস যেন পাল্লা দিয়ে বাড়াবাড়ি। প্লেটের সাইজও সাধারণ প্লেটের দ্বিগুণ! সাধারণ দোকানের কাচ্চি এমন হয় না। মোতালেব বড্ড শব্দ করে খায়। ওর খাবারে শব্দ আমার ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার আর তর সইছে না। ও কখন ওর পিয়নকে বলবে আমাকে অমন ভরা উপচে পড়া একপ্লেট সুগন্ধভরা কাচ্চি বিরিয়ানি দিতে?
মোতালেব খাচ্ছে আর আমার খোঁজখবর নিচ্ছে। এখন কোথায় আছি, কী করছি, বউয়ের সাথে কেন ডিভোর্স হয়েছে এইসব। আমি খুব অনিচ্ছা নিয়ে উত্তর দিচ্ছি আর মনে মনে বলছি, আরে হারামজাদা, এসব খবর তো তুই ফেসবুকে ইনবক্সে শতবার নিয়েছিস। ক্ষুধার্ত একটা মানুষকে সামনে বসিয়ে খাবার খেতে খেতে এসব কেন জানতে চাইছিস?
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওর প্লেটের কাচ্চি কমে আসছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমার ক্ষুধা। বুঝতে পারছি না ও আমাকে এখনও কাচ্চি বিরিয়ানি দিতে বলছে না কেন? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, ও যে প্লেটে খাচ্ছে সেখানেই হয়তো অর্ধেকটা আমার। ও খেয়ে পরে আমাকে দেবে! কিন্তু মোতালেব খেয়েই চলেছে। বাটিতে রাখা শেষ টিক্কাটিও তুলে নিলো প্লেটে। ওর প্লেটের কাচ্চি অর্ধেক থেকেও কমতে শুরু করলো। এবার আমি বুঝলাম বিষয়টা অন্য। ও আসলে পিয়নকে পাঠিয়েছে আমার জন্য কাচ্চি আনতে। বেচারা হয়তো কাজের চাপে আমার কথা ভুলে গিয়েছিল। নিজের কাজের চাপ আর ক্ষুধার চাপ সামলাতে না পেরে হয়তো আমাকে রেখেই খেতে হচ্ছে বেচারাকে। কে বলতে পারে ব্যবসায়ী মানুষ, বন্ধুর জন্য হয়তো এই খাবার সময়টুকুই বরাদ্দ করতে পেরেছে।
মোতালেব প্রথমদিকে যেমন হাপুস-হুপুস করে খাচ্ছিল এখন ততটা হাপুস-হুপুস করে না খেলেও বেশ আগ্রহ করেই খাচ্ছে। পাশের প্লেট থেকে খাশির লেগরোস্টটা তুলে নিলো। একহাতে সেই প্লেটটা ওর কাচ্চির প্লেটের উপর রেখে আঙুল দিয়ে ঘষে নিয়ে নিলো প্লেট কামড়ে থাকা শেষ তেলটুকুও। বোঝাই যাচ্ছে বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে বেচারা। আমার জন্যেও নিশ্চয়ই এইসবই আনতে বলেছে...! বুঝতে পারছি না, পিয়নটা এতো দেরি করছে কেন?
এর মধ্যে মোতালেব বাঁ হাত দিয়ে বেল চাপল। খুশিতে আমার মন শিশুর মতো নেচে উঠলো। সাথে সাথে রুমে একজন ঢুকলো। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম সেও পিয়ন গোছেরই কেউ হবে। আমার মনটা উশখুস করছে পিয়নকে মোতালেব কী আদেশ দেয় তা শোনার জন্য। হতে পারে আমার খাবার দিতে কেন দেরি হচ্ছে সেটা জানতে চাইবে। যে ঢুকলো মনে হলো সে পিয়ন গোছের হলেও একটু বড়গোছের। কিন্তু মোতালেব তাকে আমার খাবারের কথা কিছু না বলে বলল ‘মাহবুব ব্যাঙ্ক থেকে ফেরে নাই এখনও?’
না স্যার।
ফিরলে আমার কাছে চেকগুলা নিয়া আসতে বইলেন, আমি সাইন কইরা দিমু।
আমি লোকটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছি। হয়তো সে এখনও আমার খাবার কেন দিতে পারেনি সেই বিষয়ে কৈফিয়ত দেবে। অথবা মোতালেব কৈফিয়ৎ চাইবে। কিন্তু কিছুই হলো না। লোকটা চলে গেলো।
মোতালেব আমার সাথে টুকটাক কথা বলেই চলেছে। তার প্লেটের খাবার শেষের দিকে। এখন হাড় চিবোচ্ছে। হাড়ের ভিতরের ম্যারা বের করে খাচ্ছে। আমার মুখের মধ্যে জমা হওয়া লালা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ওর সামনেই গিলতে হচ্ছে। ভাবলাম একবার হেসে জিগ্যেস করি, কীরে? আমার খাবার কই? কিন্তু খুব সংকোচ হলো। দাওয়াত যখন সে দিয়েছে নিশ্চয়ই খাবারের ব্যবস্থাও করেছে। মোতালেব খাবার শেষ করে বেসিনে গিয়ে বেশ সময় নিয়ে হাত ধুয়ে এসে বসলো। বোতলের তলানির কোটটুকু গিয়ে নিয়ে একটা ঢেকুর তুলে অনেকটা গাঁয়ের সুদব্যবসায়ী মোড়লের মতো কিছুটা আনমনে বলল, অ্যাঁ, তাইলে কীভাবে চলতেছে?
আমি এবার লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বললাম, ওইতো যেভাবে বললাম, একেবারে না খেয়ে মরার অবস্থা আর কী... এই মনে কর গত রাইতে একগ্লাস পানি খাইয়া শুইছি, সকালেও এক গ্লাস পানি খাইয়া বাইর হইয়া পড়ছি। এখন পর্যন্ত পেটে কিছু পড়ে নাই। পকেটে নাই ফুটা পাই। সেই পল্টন থিকা তোর অফিস পর্যন্ত হাঁইটা আছিস। বন্ধু, এই জীবন আর ভালো লাগে না। কিছুই করতে পারলাম না, সেই কতদিন ধরে বেকার... এখন এক তোলা বিষ কিনে খাওয়ার মতো পয়সা আমার কাছে নাই।
এত ভাবিস কেন? আমি আছি না?
হঠাৎ করে কেন জানি না আমার চোখে পানি চলে এলো। মোতালেব টেবিলের নিচে হাত দিয়ে আবার বেল বাজালো। সেই সাথে হাত দিয়ে একটা দইয়ের কাপ বের করলো। এর মধ্যে সেই পিয়ন গোছের লোকটা আবার এলো। তাকে টেবিল পরিষ্কার করার নির্দেশনা দিয়ে বলল, ‘যেটা রেডি করতে বলছিলাম রেডি হইছে?’
‘জি স্যার’।
সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে পিয়ন প্লেট-গ্লাস ইত্যাদি নিয়ে বিদেয় হলো। আমার মনটা আবার আশায় চনমন করে উঠলো। আমার খাবার তাহলে এতক্ষণে রেডি হয়েছে! শিশুরা যেমন কাপের শেষ আইসক্রিমটুকু চেটেপুটে খায়, মোতালেবও তেমন খেয়ে পায়ের কাছে রাখা প্রাইভেট ডাস্টবিনে তার দইয়ের খালি কাপটা ফেলল। এরপর রুমের বাইরে বের হয়ে গেলো। মিনিটদশেক পরে এসে চেয়ারে বসলো। তার অল্প সময় পরেই পিয়নটা আবার এসে ঢুকলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম পিয়নের হাতে এবারও কোনো খাবারের ট্রে নাই! বরং খয়েরি রঙের একটা খাম! খামটা সে মনিবের হাতে দিলো।
পিয়ন বিদায় নিলে বন্ধু মোতালেব একটা আস্ত সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বলল, স্যরি দোস্ত, আমাকে আবার মিটিং-এ ঢুকতে হবে। ইতালির একটা পার্টি আইসা ম্যালা সময় ধইরা বইসা আছে। আবার আসিস।’ বলে আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এ কেমন লাঞ্চের দাওয়াত? আমার হাত ছাড়িয়ে পিয়নের প্রস্তুত করে দেয়া সাদা খামটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখ। আবার আসিস।’ বলে মোতালেব বসে পড়ল এবং রিভলবিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে ডেস্কটপে মন দিলো। আমার বের হয়ে আসা ছাড়া উপায় রইলো না।
বাধ্য হয়ে খামটা নিয়ে আমি বের হয়ে এলাম। একটু মোটা একটা খাম। আদম ব্যবসা করে সদ্য কাঁচাটাকার মালিক হওয়া বন্ধু মোটা অঙ্কের কিছু একটা দিয়েছে। এও এক ধরনের ভিক্ষা। আবার বলেছে, আবার আসিস। মানে দরকার হলে এমন ভিক্ষা আবার নিতে আসিস। ভীষণ অপমানবোধ হলো। লাঞ্চের দাওয়াত দিয়ে আমাকে অভুক্ত রেখে অমন করে খেয়ে ও কী বোঝাতে চাইলো? কান্নায় আমার চোখ ফেটে যাচ্ছিলো। মানুষের অভাব নিয়ে মানুষ এমন মজাও করতে পারে? তবে মনে মনে এই ভেবে আনন্দ লাগছিলো যে কদিন তো ভালোমন্দ খেতে পারবো! ফেরার সময় আমার আর তর সইছিলো না। মানিব্যাগে দুটি পাঁচটাকার কয়েন আছে এই ভরশায় গুলশান থেকে ছয় নম্বর বাসে কোনোমতে নিজেকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম। কিছুসময় পর একটা সিটও পেয়ে গেলাম। বসে বসে ভাবছি এখানেই খুলি। পরে ভাবলাম ‘নাহ্, যদি জানালা দিয়ে টান দিয়ে ছিনতাইকারী নিয়ে যায়! দুদিন ভালোমন্দ খাবো তারও উপায় থাকবে না।
এখান থেকে সোজা বাসায়। গোসল সেরে তারপর রহমানের দোকানে কালাভুনা আর নান খাবো। কতদিন খাই না! রাস্তায় ভয়ঙ্কর জ্যাম। অফিসভাঙা জ্যাম। আমি প্যাকেটটা খুলে দেখার জন্য ক্রমশ ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম। কত দিয়েছে মোতালেব? যে মোটা খাম তাতে ৫০০ টাকার নোট হলেও কম করে দশহাজার তো হবেই। আর একহাজারের নোট হলে হাজারবিশেকের কম না।
পকেটে হাত দিয়ে আমি খামটার উত্তাপ বোঝার চেষ্টা করছি। আচ্ছা একটু লুকিয়ে এখানে খুলবো নাকি? নাহ্ থাক। প্রত্যেক বাসে ছিনতাইকারী চক্র থাকে। এখন দেখে নিলো, বাস থেকে নামার পর একটু নিরিবিলি দেখে নিলো সব কেড়ে। কী দরকার? আর একটু নাহয় অপেক্ষা করলামই। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেলো। গলির মোড় থেকে ঢোকার সময় দোকানদার আক্তার আজ আবার তাচ্ছিল্যের সাথে ডাক দিলো। আমিও তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম, ‘আইতাছি আইতাছি’। সে আমার কাছে তের‘শ টাকা পায়। গোসলটা সেরে প্যাকেট থেকে তিনটা পাঁচশ টাকার নোট মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলব, ‘আক্তার, এক প্যাকেট বেনসন দিও, আর আগের টাকাগুলো রাখো।’ কম অপমান করেনি। যখন তখন কথা শুনিয়েছে।
বাসায় ঢুকে মোবাইলের লাইট দিয়ে সুইচবোর্ড খুঁজে লাইটটা জ্বালালাম। কারেন্টের লাইন দেয়ার পর দুই-চারটা চড়থাপ্পর দিয়ে সেই ইন্টারমিডিয়েট আমলের টেবিলফ্যানটা চালিয়ে চেয়ারে বসে জামাটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে পকেটে হাত দিয়ে খামটা বের করলাম। উত্তজনায় আমার হাত কাঁপছে। তর সইছে না মোটেই। টান দিয়ে ছিঁড়লাম খামটা। ভেতর থেকে আরেকটা আলগা কাগজে মোড়া প্যাকেট বেরিয়ে এলো। প্যাকেটের গায়ে লেখা, র্যাটম, বাজারের একনম্বর ইদুঁর মারা বিষ!’ আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এমন রসিকতাও মানুষের সাথে মানুষ করে? আমি ভাবলাম হয়তো ওই র্যাটমের প্যাকেটের মধ্যে আসলে কিছু আছে। বড় আশা নিয়ে খুলে দেখি, না, সেখানে সত্যিই ইঁদুর মারার বিষ রয়েছে।
যে আলগা কাগজটা দিয়ে র্যাটমের প্যাকেটটা জড়ানো ছিল বড় আশা নিয়ে ঝাপসা চোখে সেটি মেলে ধরলাম চোখের সামনে। সেখানে সম্বোধনহীন একটা টাইপ করা চিঠি।
‘মনে আছে সেদিনের কথা? আমি চল্লিশটি ডাহুক নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলাম? তুই বিশাল পরিবেশদরদী হয়ে সবগুলো ডাহুক ছেড়ে দিয়েছিলি? তখন আমার কেমন লেগেছিল? আজ আঠারো বছর পর তার একটু প্রতিশোধ নিলাম। তুই ভিক্ষুক ভিক্ষুকই রয়ে গেলি। আর আমি কেমন আছি তার একটু নমুনা তোকে দেখালাম। তুই আমার খাবারের সময় যখন ফকিরের মতো তাকিয়ে ছিলি তখন আমার কী যে ভালো লাগছিল তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। আশাহত হোস না। খামের ভিতরে একটা বিশহাজার টাকার চেক আছে। এমন একটা চেক প্রতিমাসের এক তারিখে তোকে দেব। শর্ত হলো, এক তারিখ সকাল নয়টা থেকে আমার অফিসের রিসিপশনে তোকে আসতে হবে। তারপর আজ যা যা করেছি ঠিক তাই তাই করবো। তারপর সন্ধ্যায় এমন একটা চেক দেব। ভয় নেই; বিষ দেব না। আজ তুই যখন বললি ‘বিষ কেনারও পয়সা নেই’ তখই রসিকতার চূড়ান্ত হিসেবে এই চিঠির সাথে র্যাটম দেয়ার প্ল্যান মাথায় আসলো। খাবার শেষে চিঠিটা এডিট করে তারপর দিলাম। শর্তে রাজি থাকলে সামনের মাসের এক তারিখ ঠিক নয়টায় আমার অফিসে চলে আসিস।’
আমি খামটা ভালো করে দেখলাম। সত্যি তার মধ্যে একটা কিছু আছে। খুব সাবধানে সামান্য আঁঠা দিয়ে কৌশলে লাগানো। একটু টান দিতেই বের হয়ে আসলো। দেখি সত্যি সত্যি আমার নামে একটা বিশহাজার টাকার চেক! আমি চেকটা বের করে এক কোনা দিয়ে ধরলাম। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। পকেট থেকে লাইটার বের করে এক কোনা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম। হাতে তাপ লাগার আগপর্যন্ত ধরে থাকলাম।