আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২৫
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মে ১০, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
কটা’রা ছিল খুব চঞ্চল। কটা মানে কাঠবিড়ালি। এই যদি দেখলেন তো কাঁঠাল গাছের মগডালে, কখন যে লাফিয়ে নিচে নেমে আপনার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে, আপনি যদি আই কনট্যাক্ট করতে গেলেন তো, ওটা আবার শিমুল গাছের গা বেয়ে বেয়ে উঠে গেছে সেই কোন চুড়োয়। রক্তচোষা বলে একটা ছিল, পাখি না, ওটা ওই কটা জাতীয়ই- কটা, রক্তচোষা, বেজি, হ্যাজা এরা বোধ হয় একই জাতীয় প্রাণী। একই গোত্রভুক্ত। রক্তচোষা দেখলেই আমরা প্রায়ই আঙুল নাভিতে দিয়ে বুড়ো আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চুষতে থাকতাম। চুষতে চুষতে রক্ত চুষে নেয়া ঠেকাতাম। সবাই যে বলাবলি করতো দূর থেকে ওটা রক্ত চুষে নেয়!
এখন আর রক্তচোষা দেখি না। হ্যাজাও চোখে পড়ে না বহুদিন। ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতাম। হ্যাজা, বেজি, খরগোশ। কোনও একটা উপজাতীয় সম্প্রদায়, বংশী বলা হতো মনে হয়, মৌচাকের দিক থেকে প্রায় প্রায়ই চলে আসতো খরগোশ শিকার করতে! ওরা নাকি খরগোশ খেতো। এতই খরগোশের পাগল ছিল যে, দেশবিদেশ চষে বেড়াত খরগোশের জন্য। আমি অবশ্য তত খরগোশ দেখিনি। এক দু’বার দেখেছি। তবে প্রায় প্রায়ই হ্যাজা দেখতাম আমাদের বাড়ি সংলগ্ন জঙ্গলে, গ্রামের কোথাও কোথাও। লেজের দিকে কাটা। প্রচুর কাটা। সেই কাটার জন্য কলাগাছের সঙ্গে ওদের কী একটা আড়ির ব্যাপারস্যাপার ছিল। কোনোদিন ক্কক্ব দেখিনি। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই আমাদের তখনকার মাটির জুম্মাঘরের সামনের মিম্বরের দিক থেকে ক্কক্কর তুমুল ডাক ভেসে আসতো। কী যে গলা ফুলিয়ে ডাকত প্রাণীটা। আমার তো একসময় ধারণা ছিল ক্কক্ক, বুঝি সন্ধ্যারই অংশ। সন্ধ্যা হলেই অমন ডেকে ডেকে আসে! কিন্তু দাদাবাড়ি থেকে বিযুক্ত হলেই তখন বুঝতাম; আদতে আমি যা ভাবছি তা না, ক্কক্কটার যত মস্তানি শুধু আমাদের ওই জুম্মাঘরেরই মিম্বরে। ক্কক্ক, আমি কখনো দেখিনি। শুধু তার ডাক আমি শুনেছি। ক্কক্কর মতো ঝিঁঝিপোকাও দেখা হয়নি কোনোদিন। তবে তার ডাক প্রায় প্রতিদিনই শুনেছি। এত ঘন এবং নিয়মিত যে, আজকাল মনে হয়, ওরা বুঝি পৃথিবীর চলার পথের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিশিয়ানের দায়িত্ব পালন করতো। ঝাঁ ঝাঁ ঝিঁ ঝিঁ। ঝাঁ ঝাঁ ঝিঁ ঝিঁ! একটানা বাজতেই থাকত।
আতংকের নাম ছিল খাটাস। কেউ কেউ ওটাকে বনবাঘও বলতো। ভীষণ শক্তিশালী। বিড়ালের চেয়ে অনেক বড় আর বাঘের চেয়ে ঢের ছোট। রাতবিরেতে শিয়ালের মতো মুরগি নিতে আসতো এ-বাড়ি সে-বাড়ি। শিয়ালকে কেউ ভয় পেত না। কিন্তু খাটাস ভয় পাওয়ার মতোই ছিল বটে। মুখের কাছের গুলফি দিয়ে বাঘের ডব আনতো! আমার নানার বাড়িতে এইসব গাছপালা, যা এখানে উল্লেখ করলাম, কোনোকিছুই ছিল না, এসব প্রাণীও চোখে পড়ত না। তবে মসজিদের আশপাশে প্রচুর টিয়াপাখি দেখা যেত। বক, হাঁস, ডাহুক, মাছরাঙা- এসব খুব চোখে পড়ত। দুটি জায়গা ছিল আশ্চর্য রকমের দু’রকম। নিচু ভূমি, জলমগ্নতা, কোমল মাটি সব মিলিয়ে আমার নানাবাড়ি যদি ছিল নারী, দাদাবাড়িটা ছিল পুরুষ। কঠিন লালমাটি, ঘন ঘরবাড়ির আবেষ্টনী, প্রকৃতির রুক্ষ্মতা- সব মিলিয়ে বলিষ্ঠ একজন পুরুষ।
বলছিলাম ধানের কথা। তা রেখে কিসের কামলাগিরিতে মেতে উঠলাম, তারপর এখন এইসব পাখিপ্রকৃতি! আসলেই ছোটবেলার কথার যেন কোনো শেষ নেই। কথার পিঠে কথা আসে। কোনটা রেখে যে কোনটা বলবো! ধানের কথাই তো এখনো পুরোপুরি বলা হলো না! মলম দেয়ার পরও কি ধান নিয়ে কর্মযজ্ঞ থামতো! সেই যে বাড়িতে ধান আসা মাত্রই সোঁদা ঘ্রাণে ভরে উঠতো বাতাস, তার রেশ সহজে ফুরাতেই চাইত না। একদিকে যেমন চলত খড় পালা দেয়া শোকানোর আয়োজন, অন্যদিকে বাজতো খলার মধ্যে ধান শোকানোর গান। ধান মেলে দাও দুয়ারে, মুরগি খেদাও, তারপর ঝাড়াঝাড়ি, হারপাট, কুলা! কত কি! ধান সিদ্ধর ব্যাপারটাতো আরো জমকালো! আলাদা একজন মানুষই রাখা হতো ধান সিদ্ধ করতে! আহা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুতে ধান সিদ্ধ দেয়ার কী অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা রয়েছে।
এই যে ধান নিয়ে এত ঘটনার ঘনঘটা, এত কা-কীর্তি- দিনের পর দিন সেই ঘ্রাণে ডুবে থাকা; তারপরও সেই ধানের ঘ্রাণ বাউন্স খেয়ে গেল পাটজাগ দেয়া গন্ধের কাছে। যেমন সরিষার ঘ্রাণ চরম মার খেল আটাকালের ঘ্রাণের কাছে। সরিষার ঘ্রাণও তো কম নেয়া হয়নি শৈশবে। আমাদের দাদাবাড়ির বাগে নিয়মিত সরিষার চাষ হতো। মাঠে ফুল দেখে দেখে বিমুগ্ধ তো হতামই, যখন সরিষার গাছ কেটে বাড়িতে এনে মেলে দেয়া হতো, তখন যেন আমাদের দাদাবাড়িটা রাতারাতি হয়ে যেত অন্য রকম আবেদনময়। সরিষার তরতাজা ঘ্রাণ কেমন যেন আনমনা করে দিত। লাল লাল ছোট ছোট সরিষার দানাগুলো হাতে নিয়ে ঝুরঝুর করে মাটিতে ফেলতাম আর ওঠাতাম। ওঠাতাম আর ফেলতাম। কী কোমল কত মসৃণ! শিশুর গালের মতো তুলতুলে। শীতে নানাবাড়ি যাওয়ার পথে কিংবা পরে যখন মাঠে মাঠে ঘোরা হতো, তখনও পেতাম সরিষা ফুলের আবিলগন্ধি সোহাগস্পর্শ।
সরিষার ঘ্রাণের কথা বলতে গিয়ে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। শীতের দিনে আমি গোসল সারার পর, মনে আছে মেলে দেয়া সরিষার ঘ্রাণ নিতে নিতে, সারা শরীরে তেল ঢলতাম। কখনো সরিষার তেল, কখনো আবার নারিকেলের তেল। নারিকেলের তেল জমে থাকত বয়ামে। রোদের তেজে গালিয়ে নিতে হতো। তেল না মাখলে শরীর কেমন চড়চড়া হয়ে থাকত! এই যে ধান কিংবা সরিষা বা গোলাপ এসবের সঙ্গে তুমুলভাবে কাটিয়েও আমি কিনা নেশাসক্ত হয়েছি পাট জাগ দেয়া আর আটাকলের ঘ্রাণে, এর পিছনের কারণটা কি? সঠিক বিশ্লেষণ আমি করতে পারব না, তবে আটাকলের ঘ্রাণ আমাকে স্ট্রাইক করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার তেমন ভালোভাবে মনে নেই। তখন আমার বয়স মাত্র তিন বছর। আমার জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৪ নভেম্বর সোমবারের এক সকালবেলা। লালবাগের বিষ্ণুচরণ স্ট্রিটে!
তো, তিন বছর বয়সের স্মৃতি আর কতটুকু মনে থাকে? আমরা ঢাকা থেকে জিনজিরা দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম নানাবাড়ি। আতংকতাড়ানিয়া ছিল সে-যাত্রা। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে নৌকা থেকে নেমে টানে ওঠতেই আটাকলের আটা ভাঙানোর ঘ্রাণটা নাকে এসে ধক করে লেগেছিল। সেদিন আমি কতটুকু আতংকগ্রস্ত ছিলাম আজ আর সেভাবে মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে, ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে যে ক’টা দিন ঢাকার কলাবাগানে মায়ের জ্যাঠাদের বাসায় ছিলাম, সময়গুলো কাটছিল ভয়ানক ভয় আর বিভীষিকার ভেতর।
কবে কখন কীভাবে কোথা থেকে পৌঁছেছিলাম কলাবাগান সেসব আজ আর কিচ্ছু মনে নেই, দাদার বাড়ি কাশিমপুর থেকে তো বটেই, কিন্তু কী পরিস্থিতিতে কীভাবে সেখান থেকে কলাবাগান গেলামÑ সেসব স্মৃতি পুরোই ব্ল্যাক আউট। শুধু মনে আছে কলাবাগানে নানার সে-বাসায় রাত কাটানোর দুঃসহনীয় স্মৃতিগুলো। বেশ কটা রাত থাকতে হয়েছিল সেখানে। মানুষ সম্ভবত ভয়ের স্মৃতি সহজে ভুলতে পারে না, মৃত্যু এমন এক ভয়ানক ব্যাপার যাকে ঘিরে কোনও স্মৃতিই হয়তো ভোলা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এটাই বুঝি প্রকৃতি, সুখস্মৃতির চেয়ে দুঃসময়ের স্মৃতিই আমাদের মনে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে। আমরা সবচেয়ে যে বেশি দেয় তাকে মনে রাখতে চাই না, সবচেয়ে যে বেশি কষ্ট দেয় তাকে ভুলি না।
কী যে আতংকের কালোছায়া নিয়ে নেমে আসতো তখনকার সেই একাত্তরের এক একটা সন্ধ্যা। মনে হতো যেন রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে হামলে পড়বে রাক্ষসখোক্কসের দল। সম্ভবত ২৫ মার্চের কালরাতই একাত্তরের প্রতিটি রাতকে দিয়েছিল চরম এই বিভীষিকাময় প্রেক্ষাপট।
চলবে