আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২৪
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মে ০৩, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
আরেকটা তরকারির কথা বলা হয়নি। মাসকলুইয়ের ডাইলের মতোই বড় প্রিয় ছিল সে-খাবারটা। কথু। কাঁচা কাঠালের তরকারি। না না, সব রকমের রান্না নয়। আমার বিবি যেভাবে রাঁধতেন, সে পদটা। একদম নিরামিশ। মাছ-মাংস কিছুই থাকত না। শুধু ঝাল করে ঝোল সমৃদ্ধ থাকত। আর জিরার একটু প্রাধান্য থাকত আর কী! এক ধরনের সুবাস বেরিয়ে আসত! আর স্বাদের রোশনাইয়ের কথাটা তো আগেই বলেছি। সে-পদটা রান্না করতে মা কিছুটা হলেও রপ্ত করতে পেরেছিলেন। তবে একটা কথা কী, কাঁঠালের ওপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। কাঁঠালটা যেমন একটু বাত্তি হলে যেমন চলবে না, তেমনি একটু কড়া বা কচি থাকলেও স্বাদটা মাঠে মারা গেল! কচি থেকে কেবল বাত্তি হচ্ছে, তবে বাত্তি হয়ে যায়নি পুরোটা, এমন মুহূর্তের কাঁচা কাঁঠালের তরকারিটাই যেন দাদি বা মায়ের হাতে জমে যেত বেশি। আর সেদিনের যে স্বাদটা হতো তার কাছে পোলাও মাংস কিছুই না! গরুর মাংসই বলুন আর খাশির মাংসই বলুন, সবই ওই কথুর তরকারির কাছে দেমাগ হারাতে বাধ্য!
বিবি মানে আমার দাদির মতো মেঝচাচাও আমাকে ভালোবাসতেন খুব, অন্তত আমার ছোটবেলায়। তিনি ছিলেন চাষা, যাকে বলে জাতচাষা। সারা জীবনই প্রায় কৃষিকর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। হাজার কামলা থাকুক, হালচাষ থেকে হালি ফেলানো, কোনও কাজই নিজের হাতে না করলে যেন স্বস্তি পেতেন না। কোনও কাজ না থাকলে হাতে নিড়ানি দিয়ে অহৈতকী শস্যক্ষেতের মাটির সঙ্গে মেতে উঠতেন খুঁনসুটিতে। সেই চাচাকে আমি দেখেছি ধানের বিছুন নিজ হাতে কীভাবে বের করতো। আমার হাফপ্যান্ট পরা বয়সে সে ছিল এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা! হয়তো একদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই অবাক হয়ে দেখতাম, চাচা দুয়ারের মধ্যে এক পাল্লা সমান ধান কলাপাতায় ভালোভাবে মুড়ে তা চতুর্দিক থেকে ইট দিয়ে চেপে রাখছেন। সে এমন কঠিন চেপে রাখা, এক ছটাক বাতাস ঢোকারও জো থাকত না! তারপর দশদিন কী পনেরো দিন পর নাকি আরো একটু সময় লাগিয়ে সেই ইটগুলো সরিয়ে ফেলতেন। তারপর কলাপাতা সরাতেই ভাপ ওঠা সেই ধানের পুঞ্জের প্রতিটি ধানের মধ্যে দেখতাম শিকড় গজিয়ে গেছে। আজ মনে নেই ইটে চাপা দেয়ার আগে চাচা পানি বা গোবরপানি বা অন্যকিছু মেশাতেন কীনা। কিন্তু যখন বিছুন উন্মোচন করতেন, শিকড় গজানো ধানগুলোকে ভেজা ভেজা লাগতো।
বিছুন তৈরির পাশাপাশি এরই মধ্যে চাচা বাগের কোনও একটা ক্ষেত বা আরো দু’একটি ক্ষেতকে তৈরি করে ফেলতেন হালি ফেলানোর জন্য। সেই হালি ফেলানোটা ছিল আমাদের কাছে আরো একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। চাচা প্রথমে লাঙলের ফলায় ফলায় সেই ক্ষেতের মাটিকে মাখনের মতো নরম করে তুলতেন। তারপর কখনো বৃষ্টির পানি আটকিয়ে, সব সময়তো আর বৃষ্টি হয় না, বেশির ভাগ সময়ই ডিপটিউবয়েলের পানি জড়ো করে সেই ক্ষেতকে পুরোপুরিই কর্দমাক্ত করতেন। ঘন সেই কাদার স্তরকে সমান মসৃণ করার জন্য দুই গরুর কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে পেছনে লাঙল নয় চঙ্গ বা মই ফিট করে দিতেন। আমরা সেই মইয়ে চড়ার জন্যই থাকতাম অপেক্ষাকাতর। কাদার মধ্যে মই দেয়ার দিন ছুটে যেতাম বাগে। মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কাদার রাজ্যে বেশ একটা অদ্ভুত ড্রাইভিং হয়ে যেত। গরু দুটো কাদার মধ্যে চাচার নির্দেশনা মতো হাঁটছে তো হাঁটছেই। আবার পাক খেয়ে একই দিকে ফিরে আসছে। আমরা মইয়ে চড়ায় হয়তো গরু দুটোর একটু কষ্ট হতো। তখন কী আর অত কিছু বুঝি? বোঝার বয়সটিই যে হয়নি তখনো। শুধু মনে আছে, গরুর কষ্টের কথা ভেবেই কীনা, মেঝো চাচা সবাইকে একসঙ্গে মইয়ের মধ্যে উঠতে দিতে চাইতেন না। বলতেন, একজন একজন ওঠো।
সেই মই-গাড়িতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ হঠাৎই ইচ্ছে করেই চিতপাৎ পড়ে যেতাম দইয়ের মতো নরম কাদামাটিতে। অমনি দেখো, পুরো শরীরই কাদায় কাদায় একাকার হয়ে যেত। হৈ চৈ অট্টহাসিতে আমরা আবারো চলন্ত মইয়ে গিয়ে দাঁড়াতাম। আবার একটু পর আবারো কাদায় ডুব। এইভাবে বারবার চলতেই থাকত আমাদের কাদায় কাদায় একাকার হওয়ার সেই মাটিয়াল খেলা! চাচা মোটেও বিরক্ত হতেন না। কাদামাটির যে-অংশটা আমাদের অত্যাচারে মসৃণতা হারাল, সেখানে আবার তিনি মই ঘোরাতেন। এভাবে পুরো ক্ষেতের কাদা যখন সম্পূর্ণ সমান এবং মসৃণ হতো, তখন ডিশে ভরে আনা সেই শিকড়যুক্ত ধানের বিছুন হাত দিয়ে চাচা পুরো ক্ষেতের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলতেন। আমাদেরকেও দু’এক ছিটা বিছুন ছিটানোর সুযোগ তিনি দিয়েছেন অবশ্য। তারপর যখন হালি ফেলে ফিরে আসতাম বাড়ি, চোখ দুটো ছাড়া আমাদের শরীরের আর কিছুই দেখা যেত না। কাদা শুকিয়ে সাদা হয়ে যেত, শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকত একদম। শরীর চড়চড় করতো। পুরো একটা লাইফবয় সাবানই লেগে যেত সেই কাদা থেকে মুক্তি পেতে! কিন্তু সত্যিই কি কাদা থেকে মুক্তি আমার মিলেছে? আজো যে মাঝে মধ্যে মাটির সেই সোঁদা গন্ধটা পাই!
সত্যিই চাচা আমাকে খুব ভালো চোখে দেখতেন। মুরব্বি হয়েও আমার প্রতি কেমন একটা সমীহের ভাব ছিল তার। আমি কতবার বাগে আমার চাচার জন্য মাথায় করে নাস্তা নিয়ে গিয়েছি, কখনো সকালের নাস্তা, পান্তাভাত, নুন, কাঁচা মরিচ, শুকনা মরিচ-পিঁয়াজ সমেত। কখনো দুপুরের ভাত। চাচা-আমার গায়ে কাদা নিয়েই কোনোমতো জগের পানিতে হাতটা ধুয়ে বসে যেতেন খেতে মাটির মধ্যে লেটকা দিয়ে। আমি তার সেই সোয়াদ করে খাওয়া দেখতাম। ভাতগুলা পানির সঙ্গে মিশমার হয়ে যেত, শুকনা মরিচের লালকালো রঙ হারিয়ে যেত ধীরে ধীরে সাদায়, পিঁয়াজের টুকরাটা মেতে উঠতো লুকোচুরি খেলায়। এই হাতের ডান তালুর নিচে তো আবার দেখো পানির নিচে ভাতের ভেতর মুখ গুঁজ করে রেখেছে! আর সেসব দৃশ্য আমি নিষ্পলক চোখে দেখছি তো দেখেই চলেছি! চাচা আতকা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞোস করে বসতেন, কিরে খাবি?
আমি জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলতাম, না চাচা খামু না। ব্যস্ত হয়ে যেতাম পাখিদের গান শোনায়। চারদিকটা গাছপালায় ঢাকা থাকত। সেই গাছপালার মধ্যে কত রকমের পাখি যে বসে থাকত, ওড়াওড়ি করতো, ঘুমাতো। সত্যিই কি ঘুমাতো? ঘুমাতে আমি কোনোকালেই কোনও পাখিকে দেখি নাই। পাখি ঘুমালে পৃথিবী জেগে থাকবে ক্যামন করে? সবসময় শুধু ওদের গান শুনেছি! ক্লান্তিহীন সে গান। বউ কথা কও তো জ্বালিয়েই মারত। ক্রমশ ওদের কণ্ঠ কেবল উচ্চকিত হতে থাকত! যেন পুরো ভুবনই ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে! বউ কথা কও ডাকলে যেন সারা গ্রামই ভরে যেত মধুর রসে। বিশেষ করে যখন বৃষ্টির পর রোদ উঠত, ভেজা মাটির সোদা গন্ধ ছড়াত, তখন যে কী ভালো লাগতো আমার! একেবারে স্বগগো হয়ে যেত জীবন! আর ঘুঘুর ডাক যেন কোনোকালে থামতেই চাইত না। কী যে গলা ফুলিয়ে ফুলিয়ে ডাকতো পাখিটা! ও কি কোনো নালিশ জানাত নাকি প্রকৃতির কোনও রহস্যের কথা বলতে চাইত আমাকে? আমি যে কিছুই বুঝতাম না ওর ভাষা, হুমর দিব কী! ওর ডাক শুধু আনমনা শুনেই যেতাম!
জীবনে এমন কত ভাষাই যে বুঝতে পারলাম না! না বুঝতে পেরে কত কিছুই যে হারালাম! আমার হারানো আর কিছুতেই শেষ হয় না। তারপর টিয়া ছিল, ময়না ছিল, কাঠঠোকরা, শালিক, টুনটুনি, ঝুঁটি বাঁধা বুলবুলি। কাউয়া আমার জরুন গ্রামে কস্মিনকালেও দেখিনি। ওটা ছিল ঢাকা শহরের স্পেশাল। আমাদের গ্রামগঞ্জ বোধ হয় কাউয়ার ভালো লাগত না তেমন। শালিক ছিল বেশুমার, চড়ুইও। এত যে পাখি ছিল, থাকবেই তো। না থেকে পারে? কী যে গাছপালা ছিল তখন। বাতরে বাতরে গাছ। বড় বড় কাঁঠাল গাছ, আমগাছ, শিমুল গাছ, গাম্বুরি গাছ। ঝিটকা, তাল, খেঁজুর। গাছে গাছে চারপাশ ঢাকা থাকতো। আজ আর সেই গাছ নাই, সেই সব গাছে পাখিও নাই। আছে শুধু মিলকারখানার ক্যাওয়াজ আর মানুষ, আর আছে মানুষের শিক্ষার দম্ভ আর টাকার মিথ্যে ঝনঝনানি! নব্যধনীদের গরিমা আর ফেনসিডিল ইয়াবার আস্পর্ধা!
চলবে