আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ২৩
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
এভাবে দু’পক্ষের মধ্যে কথা বনলে শুরু হতো কাজে লেগে পড়া। আর কাজের কাজটাই যা করত প্রথম কামলারা তা হলো, খড়ের পালা থেকে টেনে টেনে খড় বের করে তা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি করে নিত বেশ গাট্টাগোট্টা এক বিড়া। হুক্কায় আগুন ধরানোর জন্য। তারপর সেই হুক্কায় তামুক ভরে বিড়া নিয়ে চলে যেত ক্ষেতে। বাড়ির একজন মানুষ চিনিয়ে দিয়ে আসত ক্ষেতটা। দুপুরে বিশাল একটা ডিশে আর বাটিতে বাটিতে ভাত তরকারি রেঁধে পাঠিয়ে দেয়া হতো অথবা কখনো কামলারা বাড়িতে এসেও খেয়ে যেত। আর রাতে তো বাড়িতে খেতেই হতো। তাদের থাকার ব্যবস্থাই করা হতো দক্ষিণের বাংলাঘরে।
কামলাদের খাওয়া ছিল দেখবার মতো। বাংলাঘরের বারান্দায় খেঁজুরের পাটি বিছিয়ে দু’পা মুড়ে গোলাকার বৃত্তাকার হয়ে খেতে বসতো তারা। তারপর প্লেটভর্তি ভাত নিয়ে প্রথম দফায় যে কোনও একটা ভর্তা নিয়ে মেরে দিত এক দু’প্লেট। দ্বিতীয় দফায় যে কোনও একটা তরকারি নিয়ে আরো এক দু’ প্লেট দিয়ে জমিয়ে দিত সে খাওয়া। শেষ দফায় মাসকলাইয়ের ডাল নিয়ে ফিনিশিংকামলাদের খাওয়া ছিল দেখবার মতো। বাংলাঘরের বারান্দায় খেঁজুরের পাটি বিছিয়ে দু’পা মুড়ে গোলাকার বৃত্তাকার হয়ে খেতে বসতো তারা। তারপর প্লেটভর্তি ভাত নিয়ে প্রথম দফায় যে কোনও একটা ভর্তা নিয়ে মেরে দিত এক দু’প্লেট। দ্বিতীয় দফায় যে কোনও একটা তরকারি নিয়ে আরো এক দু’ প্লেট দিয়ে জমিয়ে দিত সে খাওয়া।টা যেন তাদের আর ফুরাতেই চাইতো না। যে পর্যন্ত না পেটটা ভরে পুরো টিংটিঙা না হতো, সে পর্যন্ত চলতোই অব্যাহত গ্রাস। ভাতগুলো চেটকিয়ে আঙুলের উপর পর্যন্ত ভরিয়ে খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। খাওয়ার যেন কোনও শেষ ছিল না। বিশাল সেই ডিশ নিয়ে আবার ছোটো ভাত আনতে। আবার নিয়ে আসো তরকারি। বারবারই ছুটে আসতে হতো খাবার আনতে। আমার বিবিরও যেন জানা ছিল কামলাদের এসব কাজকারবার। তিনি রান্নাঘরে বসেই থাকতেন তৈরি হয়ে, কখন আবার ডিশে বেড়ে দেবেন ভাত। দাদিকে আমরা বলতাম বিবি। যতদিন সুস্থ ছিলেন আমার বিবিজান, সেই কোন সাতসকালে ফজর ওয়াক্তের সময় ওঠতেন ঘুম থেকে, তারপর থেকেই শুরু হতো তার গৃহস্থালি কাজকর্ম। কাজের লোকের ধার ধারতেন না কখনো। নিজের হাতেই রান্নাবান্না করতেন। তিন ছেলের বউকে দিয়েও রাঁধাতেন। তারপর ঘরবাড়িও পরিষ্কার করতেন নিজে, গোবর ফেলতেন, গোবরজলে ঘরবাড়ি খলা ধুতেন লেপতেন, গাভীর দুধ ধোয়াতেন, সব কাজ শেষ হলে হাইনজাবেলার পর সারতেন গোসল। আমাদের বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে সীমানা-দেয়ালের ভেতরেই ছিল টিউবয়েল। পাকা বাঁধানো সেই টিউবয়েল থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে ভেসে আসা জলের শব্দগুলো যেন অসহ্য নীরবতার গায় ঢিল ছুঁড়ে মারতো!
আমার বিবি কামলাদের জন্য আলাদাভাবে রান্নার ব্যবস্থা করতেন। বিশাল একটা ডিশে হয়তো শিম ভর্তা করে রাখতেন অথবা বেগুন বা আলুর ভর্তা, শুকনা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে। বাদাম ভর্তাও করতেন। সেকি ঝাল হতো ভর্তা, ঝালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বেড়ে যেত স্বাদ, সেই স্বাদের কথা মনে পড়লে এখনো আমার জিভ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। তরকারিটা রান্না হতো অধিকাংশ সময়ই নিরামিষের। কখনো হয়তো মূলা কখনো শিম কখনো বা দারা বা অন্য কিছুর। মাছ কখনো থাকত কখনো থাকত না। তবে এক দু’দিন কদাচিৎ মাছের বিরণ হতো। দারা বা মূলা বা বেগুনের তরকারির মধ্যে দৃশ্যমান হয় কী হয় না গোছের চিংড়ি বা ট্যাংরা। সেই এক টুকরো ট্যাংরাকেই হয়তো মনে হতো সাত রাজার ধন কুড়িয়ে পাওয়া এক মানিক। শেষের দিকে বোধ হয় একদিন মুরগিও খাওয়ানো হতো। যাই-ই খাওয়ানো হোক, ভর্তার মতো তরকারিতেও ঝালটা থাকত মারাত্মক। খাও আর জিভ দিয়ে শো শো করো আর চোখ দিয়ে পানি ঝরাও। তারপর মধুরেণু সমাপয়েৎ হিসেবে থাকত মাসকলাইয়ের ডাইল। আমি সব সময়ই মাসকলাইয়ের ডাইল বলি, ডাল বলতে পারি না। ডালতো হয় মসুর আর মটর আর মুগ। মাসকলাই আবার কী করে ডাল হয়, সেতো ডাইল। কী যে পিচ্ছিল আর সুস্বাদু হতো! আমার বিবির মতো ও ডাইল কেউ আর রাঁধতে পারল না। আমার দুই জ্যাঠি, আমার মা, আমার বউ কেউই পারল না। আমি আখুখার মতো গ্রামের এ-বাড়ির চাচি ও বাড়ির দাদিদের কাছেও পরে মাসকলাইয়ের ডাইল দিয়ে ভাত খাওয়ার আব্দার জানাতাম। অনেকে খাইয়েছেও। মুখে মুখে বলেছি বটে, খুব মজা হইছে, মনে মনে আফসোসে মরেছি, বিবির হাতের সেই সোয়াদ কোথায়? মানুষ যে কেন মরে যায়? কেন যে একদিন হারাইয়া যায় মানুষ!
কী সুন্দর কাঁসার থালায় ভাত খাইতাম আমরা, এক্কেবারে চাইট্টাপুইট্টা খাইতাম। শুধু কি ওই মাসকলাইয়ের ডাইল, ঘরে যখন ভাত খাইতে বসতাম, আমি মার কাছে হঠাৎ কইরা ওই কামলাদের ভর্তাই চাইয়া বসতাম, কামলাদের তরকারি। মায় কি আর দিবার চায়? ধমক দিয়া কইতো, ছ্যারাটা এক্কেবারে কামলাগো মতো হইছে! পরে তো আমি বুঝছি, মার কথাটা কতটা সত্যি! আমার মধ্যে একেবারে কামলারই নচ্ছম। সেই আচার-রীতিনীতি নিয়াও যে কীভাবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রায় সাত বছর পড়লাম বড় বড় ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষের সাথে, কীভাবে যে আমি সোবার্স গর্জিয়াস আর সভ্যভব্যদের আখড়া বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ২২ বছর চাকরি করলাম, সেইটাই একটা আজব ব্যাপার!
মায় আমারে কামলা কইব নাতো কী কইবো! কী সুন্দর কইরা হয়তো চিতল মাছ ভাজছে তাও আবার তেলতেলা পেটির, নাইলে হয়তো ফল্লি মাছের কুপ্তা বানাইছে বা শিলং মাছ রানছে, বা আইড় অথবা বোয়ালের দোঁপিয়াজা- সেইসব ভদ্রস্থ খাবার রাইখা কী কইরা দেয় আমারে কামলাদের রান্না? অ্যাই ছ্যাড়া চুপ! লাগাইতেন ধমক।
আমিও ছাড়তাম না। ক্যামনে ছাড়ুম! কামলাগো খাওয়া খাওনের জন্য যে আমার লোল ঝরতো! জিদ ধইরা বইসা থাকতাম। তাইলে আমি খামু না। অবশেষে মা পরাস্ত হইতেন। আমাদের এজমালি রান্নাঘরে গিয়া আমার জন্য সেই ভর্তা-ডাইল-তরকারি আইনা দিতেন। পাতে বেশ ভালোমতোই দিতেন ঢাইলা। তারপর আমিও সেই কামলাদের মতো দু’পা মুইড়া ঠাইসসা বইসা পড়তাম খাইতে। ভাতের সঙ্গে ইচ্ছামতো চ্যাটকাইতাম ভর্তা, তারপর রসাইয়া রসাইয়া খাইতাম আর শো শো করতাম। চোখের জল আর নাকের জল একসঙ্গে মিইল্লা মিইশ্যা কোথায় যে শান্তিতে বসবাস করতে থাকতো টেরই পাইতাম না। তারপর ভর্তার পালা শেষ হইলে পর তরকারির একটা অধিবেশন হইতো বটে, তবে সেটা যেন মাসকলাইয়ের ডাইল দিয়া ভাত খাওয়ার একটা পূর্ব বিরতি বা একটু বুঝি দম নেয়ার পর্ব। মাসকলাইয়ের ডাইলটা যেন গাছের সিঙুরের মতো লাল আম। যেনবা হাতের বড়ুইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাল টকটকে পাকাটা। যেন শেষ হয়ে গেলে বুঝি আমার সব শেষ হয়ে যাবে। ওটা খাব সবার পরে রসিয়ে রসিয়ে, যেন স্বাদটা থেকে যায় অনেকক্ষণ, সারাজীবন, সেভাবেই সবার পরে ওটা দিয়ে ফিনিশিং দিতাম। কাঁসার বাসনটা পুরা আমার ভইরা যাইতো গা। উপচাইয়া উপচাইয়া পইড়া যাইত গা ডাইল চাইরদিকে। একবার চুমুক দিয়া, একবার হাতের তালুতে আরেকবার ভাত সহযোগে যেমন খুশি ইচ্ছামতো চলতো খাওয়া। খাইতে খাইতে পেটটা আমার কামলাদের মতোই পুরা টিঙটঙা হইয়া যাইত। মায় আমারে আরেকবার ধমক দিয়া উঠতো, অই ছ্যাড়া, উঠ এইবার!
আমগো মায় ছিল টাউনের মাইয়া। আমগো নানাজান সেই পাকিস্তান আমলেই দশ না বারো বছর থাইকা আইছে লন্ডন, সেইখানে সাহেব-মেমের সঙ্গে ওঠাবসা করছে। আর হের পোলায়নি পাইল কামলার ছুরত! আমার হেডমাস্টার বাবা আমারে কত ধমকাইল কত ভদ্রস্থ বানানোর চেষ্টা করলো- আমার কী আর শুদ্ধতা অর্জন হয় কোনোভাবেই! আমার ভ্রষ্টতা কিছুতেই ঘোচে না! মাইনষে জানি ক্যামনে টাইট ঠাসাঠোসা প্যান্টকোট পইরাও ঠিকঠাক মতো কাঁটাচামচ ধইরা, ছুরি দিয়া ফ্রাইড মুরগি কাটে মাপমতো। চামচ দিয়া আস্তে স্যুপটা মুখের ভেতর আলগোছে ছেড়ে দেয়! আর আমি দেখো, সেই মুরগিতেই ছুরি ধরলে মরা মুরগি কী আচানক জিন্দা হইয়া ওঠে, লাফায়, দৌড়ায়, পারলে কক ককও করে। একবার চাইনিজ খাইতে গিয়া মাগো কী কাণ্ড!
চলবে