আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ১৭
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
জহির রায়হানের সবগুলো উপন্যাস ছিল আব্বার সংগ্রহে। হাজার বছর ধরে, বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন। সেট ধরে কিনেছিলেন বইগুলো। সন্ধানী প্রকাশনীর। প্রতিটি উপন্যাসই পড়ে ভাবনার জগতে দোলা লেগেছে। বরফ গলা নদী উপন্যাসের সেইসব মৃত্যু, দেয়াল চাপা পড়ে মাহমুদের পুরো পরিবারেরই, মধ্যবিত্ত জীবনের পুরো দৈন্যের চিত্রই যেন। মধ্যবিত্তকে ধরবার কী নিদারুণ প্রচেষ্টা। একুশের ওপর আরেক ফাল্গুনের মতো আরেকটি সার্থক উপন্যাস কি বাংলা সাহিত্যে রয়েছে? হাজার বছর ধরে-তে গ্রামকে কী নিটোলভাবে পাওয়া যায়। কেন যেন মনে হয়, ঔপন্যাসিক হিসেবে জহির রায়হানের মূল্যায়ন আমাদের সমালোচকরা সঠিকভাবে করতে পারেনি। সমালোচনা সাহিত্যের একটি বিশুদ্ধ ধারা এবং অবলোকনের সৎ প্রচেষ্টা তৈরি হলে আমাদের সাহিত্যের উৎকর্ষতার দিকটি স্পষ্টভাবে দেখা যেত, ঋদ্ধ একটি পাঠকসমাজও গড়ে উঠতো।
ট্রাঙ্কে আরও ছিল ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই। অপুর বিজয়া বলে একটা উপন্যাস ছিল, কার লেখা? ভুলে গেছি। জামসেদ ফয়েজীর অরণ্যরাগ, বনফুলের উপন্যাস হাটেবাজারে, তারাশংকরের গণদেবতা, আরও কী কী ছিল, আমার লাইব্রেরি ঘাটলে হয়তো তালিকাটা সঠিকভাবে দেয়া যাবে। তার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। আমি একের পর এক বইয়ে বুঁদ হয়ে রইলাম। মা আর আমাকে পড়তে বাঁধা দেন না। ততদিনে যেন জেনে গিয়েছেন, বই থেকে আমাকে সরানোটা হবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
লক্ষ্যণীয় যে, আমার আব্বার ট্রাঙ্কে হিন্দু, মুসলিম, বিদেশি লেখক সবার বই-ই অকপটে জায়গা পেয়েছে। সেখানে বই-ই ছিল মুখ্য। কে লিখেছে, সেটা বড় ব্যাপার না। কিন্তু আমার নানাবাড়িতে মুসলিম লেখকের বাইরে অন্য কোনো লেখকের বই আমি দেখিনি। অন্তত আমার চোখে পড়েনি, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। কিন্তু চিন্তাচেতনায় আমার নানাবাড়ির মানুষগুলো ছিল আমাদের দাদাবাড়ির মানুষগুলোর চেয়েও আধুনিক, উন্নত এবং মননশীল। এ নিয়ে যেন একটা দাম্ভিকতাও ছিল। শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞানে গরিমায় এগিয়ে থাকার অহঙ্কার। এই যে নব্য শিক্ষাবিদদের দাম্ভিকতা, এটাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের সম্পর্কে একটা যোজন যোজন পথের দূরত্ব তৈরি করেছে। আমাদের সমাজটা ভালোভাবে বিকশিত হয়নি। আবার ফিরে এসেছে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা, গোড়ামি, অজ্ঞতা আর মিথ্যের গরিমা কালিমালিপ্ত অহংবোধ। এখন মানুষ খুব পড়েটড়ে যতটুকু না হয় জ্ঞানী, তারচেয়ে বেশি হয় জ্ঞানপাপী। বিনয়ী না হয়ে হয় দুর্যোধন।
যা হোক, আব্বার সংগ্রহে বেশ কিছু ইসলাশি বইও ছিল। নামাজ শিক্ষা, ইমাম গাজ্জালির বই, শেখ সাদীর গোলেস্তান, বাংলা কোরআন, বিজ্ঞানের আলোকে কোরআন। এসব ছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও নিয়মিত আসতো বইপত্র, ম্যাগাজিন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী, উদয়ন, স্পুটনিক। বছরে একবার আসতো নতুন বছরের ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারের ছবিগুলো যেন অন্য কোনো পৃথিবীর। আমার বা আমাদের চেনাজানা জগতের বাইরের। বরফঢাকা গাছ, নির্জন কোনো গ্রাম, অচেনা সাজে নৃত্যরতা নারী, দূরের পাইনঘেষা পাহাড়।
আমাদের নানাবাড়িতে আবার বইপত্রের এতটা ঘনঘটা ছিল না। সোভিয়েতের ম্যাগাজিন সে-বাড়িতেও আসত, হ্যাঁ, আমি দেখেছি। তবে বোধ হয় মাত্র একটি। উদয়ন। বইপত্র বিশেষ একটা আসতো না। ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা পৃথিবীটাই প্রায় জয় করে নিয়েছিল তাদের এসব পত্রপত্রিকা ও বই বিভিন্ন দেশের নিজ নিজ ভাষায় ছড়িয়ে দিয়ে। কত বিপুল খরচ আর কর্মযজ্ঞের ব্যাপার! ভাবা যায়!
এই নানাবাড়িতেই আমি প্রথম খুঁজে পেয়েছিলাম রশীদ করীমকে। এক ঢল ঢল বর্ষার দিনে, বিষণ্ন ভারাতুর যখন মন, আলোহীন নৈঃশব্দ্যে ডুবে থাকতে থাকতে খুঁজছি কোনো একটা অবলম্বন। বই ব্যতিরেকে আর কী, গ্রন্থকীট বলে কথা, তখন আউট বই ছাড়া কিসসু বুঝি না; সেই কৈশোর থেকে যৌবন উদ্ভাসিতকালে মামা-খালাম্মাদের বই রাখার বেতের র্যাকটায় টর্চ লাইটের আলোয় হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে যাই রশীদ করীমের উত্তম পুরুষ।
সত্য লুকাব না। বইটি হাতে এলেও ক্ষান্ত হয় না আমার অন্বেষণ। শরৎচন্দ্র, নীহাররঞ্জন, ফাল্গুণী, আকবর হোসেন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, এদের কাউকে না পেয়ে অগত্যা আমি দক্ষিণের জানালাটা খুলে বিছানাতে উত্তম পুরুষ নিয়েই বসে যাই। তখনতো আর বিদ্যুৎবাতি ছিল না। দিনের বেলায় হারিকেন জ্বালানোরও রেওয়াজ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বই পড়বার ওই জানালাটাই শুধু সম্বল। কিন্তু চোখ আমার কেড়ে নিয়ে যায় অদূরের জলপাই পুকুর, পুকুর ছাপিয়ে ঈদগাঁও মাঠ, মাঠ ছাড়িয়ে জলমগ্ন প্রান্তর, প্রান্তর ছাড়িয়ে ধলেশ্বরী মাখানো ঝাপসা গ্রাম আর বৃষ্টির রুপালি শামিয়ানা। রশীদ করীমের নামটিই যে আগে শোনা হয়নি কখনো। তারপর বৃষ্টির পাখনাতে ভাসতে ভাসতে এক দু’ লাইন ধরে এগোনোর চেষ্টা।
তারপর ‘লোকটি আমি দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও এমন আর মন্দ কি!’ আস্তে আস্তে যেন যেন নিজের প্রাণের সুরের সঙ্গে বাঁধতে লাগল উত্তম পুরুষ। এইভাবে এগোতে এগোতে তৃতীয় অধ্যায়ে গিয়ে রীতিমতো চমকে ওঠলাম, আরে! এ যে দেখছি শ্রীকান্তর মতো স্বাদ এনে দেবে মনে হচ্ছে! তারপর যে শুরু হলো পাঠ, বাইরের বৃষ্টি কখন কমলো কখন বাড়লো, কখন দুপুর গেল বিকেল নামল আমার আর কোনো দিশজ্ঞান থাকে না। ছোট খালাম্মা এসে বলে, ভাত খাবি না? মা এসেও ভাত খাওয়ার তাড়া দেয়। আমার কি আর খাওয়ার দিকে খেয়াল থাকে! ততক্ষণে কলকাতার অলিতে গলিতে, মাঠে, বাড়ির কোণে ঘটনাস্রোতের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছি। খালাম্মা আমাকে টানতে টানতে জোর করে নিয়ে ভাত খাওয়ায়। কোনোমতো খাওয়া সেরে আবারো আমার জানালার কাছে উত্তম পুরুষ নিয়ে বসা। এক সময় বাইরের আলোও নিভে আসে কখন। ঘরে কে একজন হারিকেন জ্বালিয়ে দেয়। এবার টিমটিমে আলোয় আমার সমস্ত চৈতন্য ডোবে থাকে রশীদ করীমে! এর মধ্যেই রাতের খাবার, হারিকেনের সলতে কমানো, বাধ্য হয়েই বিছানায় গমন। এরপর, গভীর এক প্রতীক্ষা নিয়েই রাত পেরোয়। আসে নতুন সকাল। জানালা খুলতেই আবারো বৃষ্টি। মুখহাত না ধুয়ে আবারো উত্তম পুরুষ, বিকেলের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় পাঠ। কিন্তু সেই প্রথম পাঠের মুগ্ধতা আজো এতটুকুও কমেনি। আজো শেষ হয়নি ট্রেনের হাতল ধরে প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা।
আমার সেই অবুঝ বয়সে উত্তম পুরুষ পড়ে মেয়েদেরকে আমার খুব নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। পুরুষের চেয়েও নিষ্ঠুর। কোমল সুন্দর চেহারার অন্তরালে এত বিষ কী করে লুকিয়ে রাখতে পারে! পরবর্তীকালে যখন কৈশোর উত্তীর্ণ হলো, যৌবন এলো, এখন এই যৌবন পারাবার বেলাতেও আমি রশীদ করীমের উত্তম পুরুষের মাধ্যমে মেয়েদের চরিত্রকে ধরবার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়ে যাই। তিনি কী করে এমন তীব্র সত্যকে নিখুঁতভাবে উন্মোচন করতে পারলেন! আমাদের সমাজে যে সেলিনাদের সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে আজকের এ সময়ে। সে কারণেই উত্তম পুরুষের গুরুত্ব এখনো সমান তাৎপর্যময়।
কোনো কোনো বৃষ্টির দিন ছিল ঈদসংখ্যায় ভাসানো। আব্বা নানাবাড়ি যাওয়ার সময় দু’হাত ভরে নানারকম খাবারের সম্ভার নিয়ে যেতেন। কখনো প্যাটিস, কখনো পেস্ট্রি, কখনো হালিম, মিষ্টি, কখনো বা কমলা-আপেল-আঙুর আনারস! আমার কিন্তু এসব খাবারদাবারের প্রতি লক্ষ্য থাকত না। আমি হন্যে হয়ে খুঁজতাম আব্বার হাতে কোনও বই আছে কিনা কিংবা কোনও পত্রিকা বা ঈদসংখ্যা। কখনোই আমাকে নিরাশ হতে হয়নি। আমার নানাবাড়িতে আব্বার হাতে আমি যেসব বই আবিষ্কার করেছি সেসবের মধ্যে মনে আছে সাদাত হাসান মান্টোর গল্প, গাঞ্জে ফেরেশতা, ভাগ্যহত বাদশাহ সালাউদ্দিন (এ নামটা বোধ হয় ভুল লিখলাম, আফগানিস্তানের এক বাদশাহকে নিয়ে লেখা বই ছিল সেটা, বাদশাহ আমানউল্লাহ?)
পত্রিকার মধ্যে থাকত রোববার বা সন্ধানী, সিনে ম্যাগাজিন পূর্বাণী কিংবা চিত্রালী। নিউজ প্রিন্টের সেসব কাগজেই কী যে রঙিন পাখনা মেলে দিত আনন্দের প্রজাপতি। বুঁদ হয়ে থাকতাম। সিনেমার জগতকে মনে হতো কবিতা-শিল্পকলা-সাহিত্যের সমমাপের। নায়ক-নায়িকাদের ঘিরে গ্ল্যামারাস ব্যাপার তো অবশ্যই ছিল, কিন্তু তা ছিল রোমাঞ্চকর আবেগসঞ্জাত, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মিশেলে সুগন্ধিময়।
চলবে...