আমার ভ্রমণিয়া দিন
শেষ পর্ব
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : আগস্ট ১৬, ২০১৮
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি
সে আমার জীবনে এসেছিল দমকা হাওয়ার মতো। মিলিয়েও গিয়েছিল সহসাই। আসলে সে যে এসেছিল, তখন তা বুঝতে পারিনি, বুঝিনি আরো অনেক অনেকদিন পর্যন্ত, বুঝলাম— যখন আমার যৌবন দুপুরের আকাশ পেরিয়ে খানিকটা বিকেলের দিকে সবে হেলতে শুরু করেছে, তখনই বুকটা ব্যথায় মুচড়ে যেন জানান দিয়ে গেল, তার মতো করে আর কেউ আসেনি আমার জীবনে, তার মতো আর কেউ আসেনি আমার জীবনকে মহার্ঘ্য উৎসবে রাঙিয়ে দিতে!
তার নামধাম পরিচয় কিসসু বলতে পারব না। চেহারাটাও হারিয়ে গেছে স্মৃতির গোপন অলিগলি থেকে। শুধু মনে আছে, তার মাথাভর্তি ছিল ঝাঁকড়া চুল, কাঁধ পর্যন্ত। সে চুল শ্রাবণী মেঘলা আকাশকে নাড়িয়ে উড়ত, কাঁপিয়ে দিত আমার হৃদয়ের মর্মমূল! আর সে ছিল ভারী চপলা, উচ্ছ্বল ঢেউ যেন উপচে পড়া! অনেকটা রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ীর মতো। তবে অতটা বখাটেপনা ছিল না কিছুতেই। ছিল সপ্রতিভতা আর হরিণের চোখের মতো সজাগ উদ্ভাসন।
যে-ঈদের কথা বললাম, সেই ঈদ উৎসবের পর, যখন আনন্দের ভাঙা হাট— তখন বর্ষাকাল, মেঘলা আকাশের দিনে ওদের নৌকাটা এসে ভিড়েছিল নানাবাড়ির বাইরের ঘাটলায়। একদঙ্গল ছেলেমেয়ের সঙ্গে নৌকা থেকে নেমে এসেছিল সরবা মৃন্ময়ী। সঙ্গে বয়স্কা বলতে ছিল ওর মা এবং আরো একজন মহিলা। তখন বেশ একটা হৈ চৈ আর কল-কোলাহলে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল নিস্তব্ধতা। ওর মা যখন আমার নানি আর আমার মায়ের সঙ্গে মেতে ওঠেছিল গল্পে নানাদের বড় ঘরে, ও চলে এসেছিল কাচারি ঘরের মাঠে সবার সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে উঠতে।
তখন কখনো বৌমাছি খেলা হতো, কখনো বা তিলোসপ্লে। ছোট মামা, ছোট খালাম্মারা খেলতেন আশেপাশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে। ও ছিল আমার চেয়ে বয়সে তিন কী চার বছরের বড়, বুদ্ধি-জ্ঞানেও অনন্যা। সবার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে ওর একটুও সময় লাগল না। মামা-খালাদের সঙ্গে বোধ হয় আগে থেকেই চেনা-জানা ছিল। মুহূর্তেই আনন্দ খুশির জোয়ার উঠলো।
বেশ কিছুক্ষণ যখন খেলাধুলা চলছে, খেলতে খেলতেই হঠাৎ সে আমার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। আমি তখন একা একা গুমরোমুখো দাঁড়িয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে থাকব না? কেউতো আমাকে খেলায় নিত না। এই যেমন এখন ফেসবুকে কী এক বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের প্রায় কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকজন, কর্পোরেট ব্যক্তিবর্গ আমাকে এড়িয়ে চলেন— লাইক দেন না, তেমনি আমার ছোট মামা-খালারাও কী এক প্রাকৃতিক বৈরিতাতেই যেন আমাকে কখনোই খেলতে ডাকত না, উপেক্ষা-অবহেলা আর অপমানের কাটায় ক্ষতবিক্ষত করে রাখতো! কিন্তু মৃন্ময়ী যেন স্বর্গদূতী; তার মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য নেই, মিথ্যে অহমিকা নেই, আলগা আত্মগরিমা নেই; আছে শুধু বিশাল এক হৃদয় আর কুণ্ঠাহীন এগিয়ে আসবার অকপট সাহস; সে এগিয়ে এসে আমাকে হাত ধরে টানতে লাগলো খেলার জন্য।
সেদিন না খেলে কাটাতে পারলেও, এর পরদিন থেকে সেই মৃন্ময়ীর অনুরোধকে আর কিছুতেই অগ্রাহ্য করা গেল না। সবাই খেলছে, তার মধ্যে একটা ছেলে গুমরো মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে— এ দৃশ্য যেন ও কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। একদিন আমাকে কাচারি-ঘরের মাঠে না দেখে নানাবাড়ির অন্দরেও খুঁজতে এসেছিল। কী একটা বইয়ের ভেতর মাথা গুঁজে ডুবেছিলাম আমি। মৃন্ময়ী আমাকে এসে আদেশের সুরে বললো, খেলবে এসো! আমি সুড়সুড় করে ওকে অনুসরণ করেছি। এমন ভালোবাসার ডাককে আর যে কেউ উপেক্ষা করতে পারে, আমার পক্ষে অসম্ভব।
প্রতিদিন বিকেল হলেই নানাবাড়ি চলে আসত মৃন্ময়ী। খেলার জন্যই আসতো। এক কী দেড় সপ্তাহ সে এভাবেই এসেছিল। তারপর একদিন, সেটা শেষদিনের ঘটনাই হবে, সেদিন আমরা তিলোসপ্লে খেলছিলাম। আগেই বলেছি, আমাদের নানাবাড়িটা ছিল ট্রেন লাইনের মতো বিশাল লম্বা এক বাড়ি। বগির মতোই চার শরিকের আটটা ঘর। এর মধ্যে আবার চারটা ঘরের মাঝখানে একটা গলিগুপচির মতো ছিল। সেটা বাড়ির পেছন দিকে গোলাঘরের মতো আরো কয়েকটি খোপ খোপ রুমের অন্তর্জাল তৈরি করে বাড়িটাকে একটা রহস্যময় দূর্গের বাতাবরণ দিয়েছিল। দিনের বেলায়ও সে জায়গা কালি অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকত। সেদিন তিলোসপ্লে খেলার সময় আমি এসে সেই খুপরিরই একটিতে লুকিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মৃন্ময়ীও দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানেই ঢুকলো। আমাকে দেখে ফিসফিস করে ওঠলো, শব্দ করো না। শব্দ করো না! ও আসছে। ও মানে— যে আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, একটু পর যেন তারও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
ক্রমশ শব্দটা আমাদের কাছে এগিয়ে আসে, আরো কাছে, আরো একটু কাছে। ধরা পড়বার উত্তেজনা আমাদের দুজনের মধ্যেই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠে! সেই আবেগের ভাসানে মৃন্ময়ী আমাকে জাপটে ধরলো, আমিও ওকে জড়িয়ে রাখি। আমার মুখটা ওর বুকের কাছে লেগে থাকে। ওর তখন আম্র্রমুকুল ধরবার বয়স। ওর বুকের মঞ্জুরিতে আমার মুখ ক্রমাগত চোত হয় বোশেখ আনে। আমি ডুবে থাকি সেখানে স্থাণুর মতো। কেমন একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে! আমার চৈতন্য বিবশ হয়ে যায় সেই মোহনীয় স্নিগ্ধতায়। যেন এ সৌরভ এ-পৃথিবীর নয়, অন্য কোনো দূর গ্রহজগতের, অলৌকিক কোনো সৌরলোকের! আমার নিঃশ্বাস সঙ্গীতের বাঙ্মময়তা পায়।
সেদিন আমি ও মৃন্ময়ী দুজনই একসঙ্গে ধরা পড়েছিলাম। যে আমাদের খুঁজতে এসেছিল, তার কাছে। তারপর খেলা আর জমলো না। মৃন্ময়ীরা চলে গেল অলস কোন্ এক নৌকা দিয়ে। সেই যে গেল, গেলতো গেলই। সারাজীবনের জন্যই হারাল। আর কোনোদিনও ওর সঙ্গে দেখা হলো না। আমি আজো মাকে হঠাৎ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসি, আচ্ছা মা, ওরা কারা ছিল? মা আমার দিকে বোবা-চোখে তাকায়, কারা? ওই যে একবার নৌকা দিয়ে খেলতে এলো মেয়েটা, ববকাটা চুল, আহা! ওই যে বর্ষা ছিল, বর্ষা! ওর মা আপনার সঙ্গে খুব গল্প করছিল!
মার কি আর মনে পড়ে সহজে! মনে করবার অক্ষম একটা চেষ্টা করতে করতে গাল পেড়ে ওঠেন, ধুর ছ্যারা। একটা পাগল!