অলঙ্করণ: দীপাঞ্জন সরকার
আমার ভ্রমণিয়া দিন
পর্ব ৩
হামিদ কায়সারপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০১৭
দাদাবাড়ি নানাবাড়ি পর্ব ৩
বর্ষায় সেই চিনির খালে লুরানি নামের রসিক চেহারার একজন মানুষ নামকাওয়াস্তে কাছা দিয়ে ভেশালে মাছ ধরতেন। নামকাওয়াস্তে বললাম এ কারণে, সেটা শুধু নামেই ছিল কাছা, আসলে ছিল নেংটির চেয়েও সংক্ষিপ্ত কিছু! লুঙিটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যতটুকু সূক্ষ্ম করা যায় ততটুকুই করে, কেবল নিতম্বের দু’পাশের অর্থাৎ সামনের আর পিছনের যে অংশটুকু না ঢেকে রাখলেই নয়, কোনোমতে সে আবরুটুকু রক্ষা করা হতো। নিতম্বের অন্য কোনও অংশের পর্দা রক্ষার দায়-দায়িত্ব বহন করতেন না। লুরানি মামা সারাক্ষণ সেই কাছা দিয়ে ভেশালে দাঁড়িয়ে থাকতেন, নৌকায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকতেন! তার মধ্যে আবার গায়েগতরে থাকত না সামান্য একটু সুতোও। হঠাৎ তাকালে মনে হতো, তিনি বুঝি পুরো উদোম হয়ে আছেন! চিনির খালের কাঠের সাঁকো দিয়ে পারাপারের সময় গ্রামে আসা নতুন বউ হয়ত লজ্জায় মাথায় ঘোমটা তুলতে বাধ্য হতো। কিন্তু আর সবার কাছেই বিষয়টা ছিল স্বাভাবিক, জলভাত এবং সহজাত। কেননা শীত হোক বসন্ত হোক গরম হোক হেমন্ত হোক, মাছ মারার সময় লুরানি মামাকে ওই অবস্থায় ছাড়া ভিন্ন রূপে দেখাটা কল্পনায়ও সম্ভব নয়। প্রকাশ্য দিবালোকে কীভাবে যে তিনি পারতেন এমন প্রকৃতির কাছা দিয়ে সারাক্ষণ মাছ মারতে, সেটা একটা রহস্যই বটে। এমন কাছা দেয়ার হেতুটা লুরানি মামা কাউকেই কখনো বলেননি। তবে শেষপর্যন্ত কারণটা চেপেও রাখতে পারেননি। অনেক বছর পর তার মৃত্যু হলে ছেলে সামাইদা রহস্যটা ফাঁস করে দিয়েছিল।
তখনও আমি ভ. ই. লেনিনকে দেখিনি। পরে যখন লেনিনকে আবিষ্কার করলাম, আমার শুধু লুরানি মামার মুখটাই ভেসে উঠত চোখের সামনে। সে রকমেরই টাক, সে রকমেরই থুতনির মাঝে সামান্য একটু দাঁড়ি। পার্থক্য হলো লেনিন সব সময় স্যুটেডবুটেড থাকতেন, আর লুরানি মামা থাকতেন পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম কাছায় প্রায় আদুল গায়। একবার কল্পনা করে দেখুন তো, লেনিনের গায়ে কোনো কাপড় নেই, শুধু একটা লুঙিকে যতটুকু পারা যায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একেবারে চিকন করে পরে আছেন... থাক! এতটা কষ্ট করার দরকার নেই।
ক্ষমা করবেন কমরেডগণ, লুরানি মামাকে লেনিনের সঙ্গে তুলনা করার জন্য। লেনিনের সঙ্গে লুরানি মামার অবশ্য আরেকটা জায়গায় পার্থক্য ছিল, লুরানি মামা খুব পান খেতেন, আর কতক্ষণ পরপর কোথা থেকে চুন নিয়ে সেটা আবার মাথাটা নিচু করে এক ঝলকের জন্য দেখে তারপর মুখে পুরতেন। যেমন কোনও কোনও রমণীর অভ্যাস আছে পথচলতি সময়ে বিশেষ করে রিক্সায়, হঠাৎ আবরু ঠিক আছে কীনা দেখার জন্য নিজের ক্লিভেজের দিকে মাথা নিচু করে তাকানোর, লুরানি মামার চুনের দিকে তাকানোটা ছিল অনেকটাই সে রকমেরই।
লুরানি মামারা ছিলেন তিন ভাই এক বোন। ছোট দুই ভাইয়ের নাম খেদানি, দৌড়ানি। না না, গ্রামের লোক এতটা শুদ্ধভাবে ডাকতো না তাদের। আমাদের নানাবাড়ির রেওয়াজই ছিল, আব্বাসকে আব্বাইসা ডাকার, সামাদকে সামাইদা। ওসমানকে ডাকা হতো ওসমাইনা, তেমনি জালালকে জালাইলা, আবুলকে আবুইল্যা, বিনতোষকে বিনতোইষা। হিন্দু, মুসলমান ছোট বড় কেউই নামের এই বিকৃতি থেকে মুক্তি পেত না। যারা বছরে এক দু’বার বেড়াতে যেত, তারাও রেহাই পেত না। অপুকে ডাকা হতো অইপা। আমাদের নানাবাড়িতে একজন গৃহকর্মী ছিল। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এবাড়িতে কাজ শুরু করেছিল, এবাড়ি থেকেই বিয়ে দেয়া হয়েছিল। সারাজীবন জেনে এসেছি ওর নাম সম্মেহারি, প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর পর জানা গেল, তার নাম শবমেহের। জানি না নানাবাড়ির সে গ্রামে নাম বিকৃতির সেই ট্র্যাডিশনটা এখনো সেভাবে বজায় আছে কীনা!
লুরানি মামাকে ডাকা হতো লুরাইনা বলে আর তার দুই ভাইকে ডাকা হতো যথাক্রমে খেদাইনা আর দৌড়াইনা। বোনের নামটার মধ্যে তেমন কোনো ক্রিয়াশীলতা না থাকলেও একেবারে যে ভদ্রস্থ ছিল, সেটা বলবারও জো নেই। আর যাই হোক বেগী নামটা বোধ হয় শ্রুতিমধুর নয়। আমি বেগীর সঙ্গে যোগ করেছিলাম ফুপু। তা বেগীফুপুর খুব একটা দুঃখ ছিল। দুঃখ মানে কী, সত্যিই বড় হতভাগী ছিলেন মানুষটা। তার সারা গায়ে ছিল আঁচিলের মতো বড় বড় কালো চাকা। মুখ-হাত-গলা এবং পায়েও দৃশ্যমান ছিল। সে কারণে ফুপুর বিয়ে হলো না। তিনি নানাবাড়ির পুকুরঘাটলায় আসতেন গোসল করতে। সকালের কাঁচা রোদ পাকা হয়ে যেত, সূর্য পূব আকাশ থেকে চলে আসতো মাঝ আকাশ বরাবর, তবু ফুপুর ছোবরা দিয়ে শরীর ঘষা শেষ হতো না। দুপুরবেলা যখন লোকজন আসা শুরু করতো গোসল সারতে, ফুপু চুপচাপ নিজেকে যতটুকু গোটানো যায়, গোটানোর চেষ্টা করতে করতে ঘাটলা থেকে উঠে যেতেন। না, এতো ঘষাঘষির পরও ফুপুর শরীরের কালো চাকাগুলো কোনোক্রমেই ওঠেনি। উলটো কালোচাকার আশপাশের জায়গাগুলো ঘষায় ঘষায় শ্বেত আকার ধারণ করেছিল।
নামের সব অদ্ভুত বাহার দেখতাম নানাবাড়ির গ্রামে। চিনির খালের ওপারের এক বাড়িতে দুই ভাইয়ের নাম ছিল টুয়া আর ভুইট্টা। ওরা দুজনই ছিল যেন প্রকৃতিরই অংশ। বর্ষায় দেখতাম সবসময় বিলে বিলেই পড়ে থাকত। হয় মাছ মারত না হয় নৌকার মাঝিগিরি করত, কাটা আমন ধান বোঝাই করা নৌকায়ও দেখেছি বহুবার। বাকি সিজনে ওদের কাটত ফসলের ক্ষেতে জমিজিরেতে। নিজেদের অত জমি ছিল না। নানাদের জমি বর্গা নিয়ে ফসল করত। এখনো চোখে ভাসে মুগুর দিয়ে দুজনের মাটির ঢ্যালা ভাঙার দৃশ্য! পাতিল থেকে বীজ হাতের মুঠোয় নিয়ে চষা ক্ষেতে ছিটানোর দৃশ্য। নিড়ানি নিয়ে ক্ষেতের আগাছা সাফ করার দৃশ্য। যা করতো দুই ভাই মিলেমিশে একসঙ্গেই করত। আহারে! দুজনই মারা গেছেন অকালে, পঞ্চাশ পেরুবার আগেই। একজন ক্ষেতে কাজ করতে করতে আরেকজন রাতে ঘুমের ঘোরে! আর বেঁচেই বা আছে কে? লুরানি মামা, খেদানি, দৌড়ানি কেউ নেই। এমনকি বেগী ফুপু তিনিও গেছেন, বিয়ের স্বাদ না নিয়েই মারা গেছেন হতভাগী!
নানার এক চাচাতো ভাই বাদশা মিয়া, যিনি আবার অনেক বছর বাস্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি তো ছেলেদের দিয়ে পুরো মোগল সাম্রাজ্যই অধিকার করে ফেলেছিলেন। ছেলেদের নাম ছিল বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আলমগীর। নাম কম পড়েছিল বলে মোগল সাম্রাজ্যের বাইরে থেকেও ধার করে এনে একজনের নাম রেখেছিলেন শেরশাহ! মেয়ে হলে নিশ্চয়ই সে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যেত নূরজাহান, মমতাজ কিংবা মেহেরুন্নিসাদের! না, তার কোনও মেয়ে ছিল না। এখনো মনে আছে, রেগে গেলেই বাদশা চেয়ারম্যান হাঁক দিয়ে উঠতেন, বন্দুক লে আও! ভাগ্যিস তার বন্দুক ছিল না। আমার আরেক চাচাতো নানা ছিলেন কাইয়ুম সাহেব। ইনিও চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কখনো বাদশা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জিততে পারেননি। জিততে না পারলে কী হবে, প্রতি বছর ইলেকশন পারপাস খরচ জোটাতে জমি বিক্রি করতে করতে প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছিলেন! সেই নানা তার এক মেয়ের করেছিলেন বিশাল সর্বনাশ। পপি খালাম্মাকে কখনো পপি ডাকতে পারতেন না। ডাকতে গিয়ে শুধু পঁপঁ করতেন। কীভাবে কীভাবে যেন ব্যাপারটা পুরো গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল। পপি খালাম্মা যখন বড় হলো, স্কুলে যাওয়া শুরু করল, ক্রমশ হলো যৌবনবতী, তাকে দেখলেই গ্রামের জওয়ান ছেলেগুলো শুরু করে দিল পঁপঁ পঁপঁ। অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত এতটাই দুঃসহনীয় হয়ে উঠেছিল যে, পপি খালাম্মাকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে আসতে হয়েছিল বংশালের নানাবাড়িতে। পরে ওখান থেকেই তিনি আন্ডার মেট্রিক হন।
আমি নানাবাড়ি গেলে সারাক্ষণ চিনির খালের সেই কাঠের সাঁকোতে বসে বসে লুরানি মামার ভেশালে মাছ মারা দেখতাম। সদ্য জালে ওঠা মাছগুলোর তড়পানি দেখে মনও নেচে উঠতো কী এক অজানা খুশিতে!
চলবে...